চুপকথারা_বিষন্ন পর্ব-২২

0
3007

#চুপকথারা_বিষন্ন
#জেরিন_আক্তার_নিপা
|পর্ব ২২|

গতরাতে ওটা কি নীড়ের স্বপ্ন ছিল! নাকি কথা সত্যিই ওর সাথে ওরকম আচরণ করেছে? কথা ওকে তুই করে বলেছে! নীড়ের বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু ওই ঘটনাকে স্বপ্ন ভেবেও তো ভুলে যাওয়া যাচ্ছে না। কারণ ওটা স্বপ্ন ছিল না। কথা বাস্তবেই ওই কথাগুলো বলেছে। কপালের দু’পাশের শিরা চেপে ধরে রেখেছে নীড়। ঠিক কী যেন বলেছিল কথা মনে করার চেষ্টা করছে।

“হঠাৎ ওকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছে! তুই মানুষটা মোটেও সুবিধার না। তোর থেকে ভালোমানুষি আশা করা যায়না। ওকে নিয়ে ভাবিস না তুই। ওর জন্য আমিই যথেষ্ট। পারলে তুই ওর থেকে দূরে থাকিস। সর্তক করে দিচ্ছি বলা যায়। নইলে পরের বার তোর পরিণতির জন্য তুই-ই দায়ী থাকবি। কথা বড্ড বোকা। যার কারণ তোর মত অমানুষকে ভালোবেসেছে। তোর জন্য এটাই ভালো হবে ওকে ছেড়ে দে তুই।”

নীড়ের মাথা ছিড়ে যাচ্ছে। ওই ঘটনার পর রাতে আর এক ফোঁটা ঘুম হয়নি। কথা এরকম ভাবে কথাগুলো বলেছে যেন তার হয়ে অন্য কেউ বলছে। সে নিজে বলেনি। নিজের জবান থেকে বললেও মানুষটা সে না।

-হঠাৎ ওকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছে! কথার জন্যই তো চিন্তা হচ্ছিল আমার। এতে তো বোঝা যায় যে তখন এটা বলেছে সে কথা না, অন্য কেউ। তাই তো কথাকে বোঝাতে ‘ও’ ব্যবহার করেছে।’

এসব ভেবে ভেবে নীড়ের নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। কথার মুখ দিয়ে অন্য কেউ কীভাবে ওসব বলবে?

-ওকে নিয়ে ভাবিস না। ওর জন্য আমিই যথেষ্ট। কথা নিজেই বলছে ওর জন্য ও-ই যথেষ্ট! কিন্তু তখন মনে হচ্ছিল ওর ভেতর থেকে দ্বিতীয় কেউ কথা বলছে। এটাও কি সম্ভব?’

গতরাতে যখন এটা ঘটে নীড় পুরোপুরি বাকরুদ্ধ হয়ে গেছিল। হতবুদ্ধি হয়ে কথাকেই দেখেছে সে। কয়েকবার প্রশ্নও করেছে।

-তুমি এসব কী বলছ কথা?’

কোন উত্তর দেয়নি কথা। অদ্ভুত কায়দায় হেসেছে শুধু। কথাকে ওভাবে দেখে নীড় ঘাবড়ে গেছিল। কারণ এতগুলো দিন ধরে যে মেয়েটাকে দেখে এসেছে সে, তার চোখের সামনে দাঁড়ানো এই মেয়েটার সাথে সেই মেয়েটার যেন কোন মিল নেই। সম্পূর্ণ আলাদা দু’জন মানুষ মনে হচ্ছিল।

-ওহ গড! আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি? নাকি সত্যি সত্যিই পাগল হয়ে গেছি। হ্যাঁ আমিই পাগল হয়ে গেছি। নইলে একটা মানুষকে আমার কাছে দুইরকম লাগবে কেন?’

ঘরজুড়ে পায়চারি করে বেড়াচ্ছে নীড়। কথার সমস্যা কী তাকে জানতেই হবে। অলৌকিক শক্তিতে নীড়ের তেমন বিশ্বাস নেই। কথার কি মানসিক কোন রোগ আছে?

-না,না। এটা কীভাবে সম্ভব? কথাকে দেখে কেউ বলবে ও মানসিক ভাবে সুস্থ না! ওকে দেখে কোন ভাবেই তো মনে হয় না ওর মাঝে কোন সমস্যা আছে।’

কাল রাতে কথার বলা শেষের লাইনগুলো যেন কী ছিল।
“কথা বড্ড বোকা। যার কারণ তোর মত অমানুষকে ভালোবেসেছে। তোর জন্য এটাই ভালো হবে ওকে ছেড়ে দে তুই।”

-হ্যাঁ কথা সহজসরল বোকা একটা মেয়ে। কথা কি আমাকে ভালোবাসে? আমাকে কেন ভালোবাসবে ও! তখন যে-ই কথাগুলো বলুক সে চায় না কথা আমার সাথে থাকুক। ওকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য হুমকি দিয়েছে বলা যায়।’

নীড় ল্যাপটপ খুলে বসলো। দ্রুত হাতে টাইপিং করছে সে। কোন কিছু সার্চ করছে নীড়। কথা কি সত্যিই মানসিক ভাবে অসুস্থ! তখনই কথা ঘরে আসে।

-সাতসকালে আপনি ল্যাপটপ খুলে বসেছেন কেন?’

নীড় কথার কণ্ঠ পেয়ে চোখ তুলে ওকে দেখল। কথাকে এখন ঠিক মনে হলেও চেহারায় ক্লান্তির ছাপ ওর। নীড় কি কথাকে কাল রাতের কথা জিজ্ঞেস করবে? করাটা কি উচিত হবে?
ঘোরের মধ্যে কথা কোনো মামার কথা বলছিল। ওকে সরাসরি কিছু জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে না। মেয়েটার ভয় পাওয়া দেখেই বোঝা যাচ্ছিল অতীতে ওর সাথে যা কিছুই ঘটে থাকুক সেই স্মৃতিটা ওর জন্য কতটা যন্ত্রণাদায়ক।

-কী হলো? আপনি আমাকে ওরকম ফ্যালফ্যাল করে দেখছেন কেন? ভূত দেখেছেন নাকি?’

-কিছু না। তুমি আজ বাড়িতেই আছো?’

-হ্যাঁ।’

-কেন, কলেজ যাবে না?’

-না।’

-ওহ আচ্ছা। তোমার তো দুইটা ভাই, তাই না?’

-হু, কেন বলুন তো।’

-না। এমনিতেই জিজ্ঞেস করলাম। ছোট জন, পলাশ তো আমাদের বাড়িত এসে থেকেছিল। বড়জনকে মনে হয় দেখিনি।’

-শিমুল একবারও আসেনি। বিয়ের দিন দেখেননি ওকে!’

-বিয়ের দিন দেখলেও কি এতকিছু মনে থাকে কে কী হয়। শিমুল আসে না কেন?’

কথা নীড়ের পাশে এসে বসল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

-বোনকে এখন বিয়ে দিতে চায়নি ও। কিন্তু বেচারা নিজেই ছোট মানুষ। কোনোভাবেই বিয়েটা আটকাতে পারেনি। তাই হয়তো রাগ করে আসে না।’

-বোনকে বিয়ে দিতে রাজি ছিল না কেন? আমাকে কি ওর পছন্দ ছিল না?’

-পছন্দ! হাহ্, আমিই তো আপনাকে বিয়ের দিন প্রথম দেখেছি। ও আপনাকে আগে কোত্থেকে দেখবে যে পছন্দ করবে!’

নীড় অবাক না হয়ে পারল না। বিয়ের আগে কথা কখনও ওকে দেখেনি! না দেখেই বিয়েতে রাজি হয়েছে?

-তুমি আমাকে না দেখেই বিয়েতে রাজি হয়েছে!’

-হুম।’

-কেন?’

-রাজি না হয়েও তো কোন উপায় ছিল না। আমার মতামতে কারো কিছু আসে যায় না।’

-তোমার নাহয় বাবা নেই। কিন্তু মা তো আছে। উনি নিজের মেয়ের সাথে কীভাবে এত বড় অন্যায় করলেন?’

কথার মুখটা মলিন হয়ে গেল। চোখে পানি টলমল করছে। মাথা নুইয়ে নীড়ের থেকে চোখের পানি আড়াল করছে ও। কান্না গিলে ধরা গলায় বলল,

-উনি তো আমার আসল মা না। আমি যখন খুব ছোট তখন আমার মা মারা গেছে। আমার মা কেমন দেখতে ছিলেন, মায়ের চেহারাও ঠিকমতো মনে নেই আমার। উনি আমার সৎমা। আমার দুই ভাই শিমুল, পলাশের মা উনি।’

নীড় কী বলবে ভেবে পেল না। শব্দ হারিয়ে গেল ওর। কথার মা যে ওর আপন মা না, ওর সৎমা আজকের আগে এটাও জানতো না নীড়। ছোটবেলায় কথার মা মারা গেছে। বাবাও বেঁচে নেই। সৎ মায়ের কাছে কথা কীভাবে ছিল এটা বুঝতে এখন অসুবিধা হচ্ছে না নীড়ের। এইজন্যই তো তার সম্পর্কে কোনকিছু না জেনে মেয়ে বিয়ে দিতে রাজি হয়ে গেছে। তাকে দেখেওনি পর্যন্ত। নীড় দেখতে কেমন? বয়স্ক, প্রতিবন্ধী এমনকি দুই সন্তানের বাপ হলেও কথার মায়ের কিছু আসতো যেতো না। তিনি নীড়ের বাবার টাকা দেখেছে। ছেলের সাথে না ছেলের বাবার টাকার সাথে কথার বিয়ে দিয়েছেন।

-কথা!’

-হু।’

-কাঁদছো তুমি?’

-না।’

-আমার যখন বারো বছর বয়স তখন আমার মা মারা যায়। মা’র ভীষণ বাজে একটা অসুখ হয়েছিল। দেশ বিদেশের অনেক ডাক্তার দেখিয়ে, অনেক টাকা খরচ করেও মা’কে বাঁচানো যায়নি। আমার এমন একটা বয়সে মা আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন যখন আমি উনাকে ছাড়া বেঁচে থাকার কথাও ভাবতে পারতাম না। এইদিক দিয়ে আমাদের দু’জনের জীবনের বড় একটা মিল আছে।’
—————
হঠাৎ নীড় ভীষণ ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লো। গায়ে ১০১° জ্বর। কোন কারণ ছাড়া হঠাৎ করেই জ্বর। যার কারণে কথার ব্যাপারটা নিয়ে বেশি ভাবতে পারেনি। বেচারা টানা তিনদিন ধরে বিছানায় পড়ে আছে। কথা ওর সবরকমের সেবাযত্ন করছে। ঘন্টায় দু’বার করে ওর গা মুছে দিচ্ছে। মাথায় পানি দিচ্ছে। ডাক্তারের ঔষধের পাশাপাশি ঘরোয়া উপায়েও নীড়কে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বেচারি কথা স্বামীর চিন্তায় এতটাই অস্থির হয়ে আছে নিজের দিকেও খেয়াল দেওয়ার সময় নেই। যাতে করে তাকেও দুর্বল মনে হচ্ছে।
দুপুরের দিকে নীড়ের জ্বর কিছুটা কমেছে। কথাকে দেখছে সে। সে কি কোনোভাবে এই মেয়েটার মায়ায় পড়ে যাচ্ছে! কথা কেন তার জন্য এত করছে? কেন তাকে ঋণী বানাচ্ছে?

-এখন কেমন লাগছে? উঠে বসতে পারবেন?’

নীড় অবসাদগ্রস্ত দৃষ্টিতে কথাকে দেখল। ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে তার। নিজে নিজে বসার শক্তিও যে নেই এটাও টের পাচ্ছে। তবুও কষ্ট করে বসতে বসতে বলল,

-আমি ঠিক আছি।’

-কচু ঠিক আছেন। পাগলেও বলে আমি পাগল না। এখন যেমন আপনি অসুস্থ হয়েও বলছেন, আমি ঠিক আছি।’

কথা নীড়কে বসতে সাহায্য করল। ওর পিঠের নিচে বালিশ রেখে বলল,

-আপনি বসুন। আমি আসছি। বিকালে যদি আর জ্বর না আসে তাহলে বাইরে হাঁটতে বেরুব।’

নীড় প্রতিবাদ করারও সময় পেলো না। তার আগেই কথা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বিছানায় ঘুসি মেরে রাগ প্রকাশ করল নীড়।

-এই মেয়ে আমার কোন কথা শুনে না কেন? আমাকে কি ও ভয় পায় না! এই মেয়ের কিছু করতে হবে। দিনদিন আমার মাথায় গেঁড়ে বসছে। চিন্তাভাবনায় তো অনেক আগেই…

ঠিক বিশ মিনিট পর কথা ঘরে আসে। তার হাতে কিসের যেন একটা বাটি। তাতে কালো রঙের কী একটা তরল পদার্থ দেখা যাচ্ছে। ভ্রু কুঁচকে ফেলল নীড়। এই মেয়ে আবার কী করতে চাইছে! হাসি হাসি মুখে কথা নীড়ের পাশে এসে বসলো। নীড় ওর হাতের দিকে তাকিয়ে অসহ্যরকম বিরক্তি নিয়ে বলল,

-এটা কী?’

-কাড়া। আপনার জ্বর ভালো করার জন্য ঘরোয়া উপায়ে…

-থামো, থামো। তোমার ওসব কাড়া টাড়া আমার লাগবে না। ডক্টরের উপর যথেষ্ট ভরসা আছে আমার।’

কথা মন খারাপ করে বলল,

-ইউটিউব দেখে কত কষ্ট করে বানালাম আমি। আর আপনি এরকম করছেন!’

-ইউটিউব দেখে বানিয়েছ! তাহলে তো আরও আগে খাওয়া যাবে না।’

-কেন?’

-বিষ টিষ বানিয়ে আমাকে খাওয়াতে চাইবে আমি তা খেয়ে নেব!’

-এটা বিষ নাকি?’

-চেহারা দেখে তো বিষের থেকেও ভয়ংকর মনে হচ্ছে।’

-মোটেও না। একটু মুখে নিয়ে তো দেখুন।’

নীড় মুখ সরিয়ে নিল।

-না। কক্ষনো না।’

-একটু খান।’

-জীবনেও না।’

-আপনাকে খেতেই হবে। কষ্ট করে বানিয়েছি আমি।’

-এই মেয়ে, তার ছিঁড়া। তুমি পাগল নাকি হ্যাঁ! কষ্ট করে বিষ এনে তখন তো এটাও জোর করবে কষ্ট করে এনেছি খেতেই হবে।’

-এটা বিষ না। আমি নিজের হাতে বানিয়েছি। ওই মহিলা যা যা উপকরণ দিতে বলেছে সেগুলোই দিয়েছি। আদা, কালোজিরে, মধু, লে…

-চুপ। তোমার এসব শুনতে চেয়েছি আমি! আমি খাব না। মানে খাব না। এটাই শেষ কথা।’

-না এটাই শেষ কথা না। কথা নিজে আপনাকে খেতে বলছে, আপনি এটাই শেষ কথা বলেন কীভাবে?’

-এখন আমার আর কোন ডাউট নেই। তুমি সত্যিই পাগল। তোমার জায়গা তো পাগলাগারদে হওয়া উচিত ছিল।’

-আপনি যা কিছুই বলেন, এটা তো আপনাকে খেতেই হবে। হ্যাঁ মানছি দেখতে খারাপ হয়েছে। খেতেও একটু খারাপ হতে পারে। তবে উপকারী সব জিনিসই স্বাদে খারাপ হয়। এটা খেলে আপনি মরবেন না। নিজের স্বামীকে মারব নাকি আমি? আপনি মরলে তো আমিই বিধবা হবো। কোন মেয়েই চাইবে না সে বিধবার জীবন বাঁচুক। তাই আপনার কোন চিন্তা নেই। চোখ বুজে টুক করে গিলে ফেলুন তো। নিন মুখ খুলুন।’

চলবে_

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here