চুপকথারা_বিষন্ন পর্ব-৩০

0
2917

#চুপকথারা_বিষন্ন
#জেরিন_আক্তার_নিপা
|পর্ব ৩০|

কথাদের বাড়িতে আসার পর থেকে নীড়ের মতিগতি কথার কাছে মোটেও সুবিধার মনে হচ্ছে না। যে লোক বিয়ের পর কোনোদিন শ্বশুরবাড়ি আসেনি, সে হঠাৎ একপ্রকার নিজে থেকে যেচেই শ্বশুরবাড়ি চলে এলো। নিজের বাড়িতে থেকে যে লোক তার সাথে ভালো করে কোনোদিন কথা বলেনি, এখানে এসে তার মুখেই খই ফুটছে। সেই খইও আবার গুড়ের মত মিষ্টি! মেনে নেওয়া যায় এগুলো! রাতারাতি একটা মানুষের এমন পরিবর্তন দেখে কথা কেন যে কারোরই মাথা ঘোরাবে। এই লোক চাচ্ছেটা কী? আলম ভাইদের বাড়ি থেকে এসে কথা না পেরে জিজ্ঞেসই করে ফেলল।

-সত্যি করে বলুন তো আপনি কে?”

কথার মুখে এমন আজব প্রশ্ন শুরু কপাল কুঁচকে ওর দিকে তাকাল নীড়। মেয়েটা সহজ জিনিস মেনে নিতে পারে না কেন? নীড় ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করলেও সমস্যা। আবার ভালো ব্যবহার করলে আরও বেশি সমস্যা। কত ভাবে নীড় ওকে বোঝাতে চাইছে, আমাদের মাঝে আমি সবকিছু ঠিক করে নিতে চাই কথা। কিন্তু এই মেয়ে সেটা না বুঝে প্রশ্ন করছে, আপনি কে? মানে বোকামির অ্যাওয়ার্ড থাকলে তা এই মেয়েকে দেওয়া যেত।
কথা তার প্রশ্নের উত্তরের জন্য নীড়ের দিকে তাকিয়ে আছে। নীড় দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ইশারা ইঙ্গিতে এ কিচ্ছু বুঝবে না। যা বলার খোলাখুলিই বলতে হবে।

-আমি কে তুমি জানো না? আমি কথার বর।”

-আপনি যা বলছেন বা করছেন তা কি আপনি নিজেই করছেন?”

-না। আমার ভেতরে থাকা কুটুসের শ্বশুর করছে।”

নীড় যে কথাকে হেলায় ফেলায় নিচ্ছে তা বুঝতে পেরে কথা গাল ফুলিয়ে আর কিছু বললোই না। এই লোকের মাথা গেছে। সোহান সারাদিন আসতে না পারলেও সন্ধ্যার পর এলো। আশা সোহানের আসাটা তেমন পছন্দ করল না। মুখ বাঁকিয়ে সে রান্নাঘরে চলে গেল। কথা সোহান ভাইয়ের সাথে কথা বলে ওদের একসাথে বসিয়ে রান্নাঘরে গেল। এবার বাড়ি এসে নতুন একটা জিনিস আবিস্কার করেছে কথা। মা তাকে দিয়ে রান্নাবান্না করাবে তো দূর, সে রান্নাঘরের দরজার সামনে গেলেও চেঁচিয়ে উঠছে। কোন কাজে হাত দিতে নিলেই ধমক দিয়ে তাকে তাড়িয়ে দিচ্ছে। কথাকে রান্নাঘরে ঢুকতে দেখে আশা চাপা গলায় ধমকে উঠে বলল,

-তুই কি আমাকে শান্তি দিবি না, মুখপোড়ি?”

-আমি আবার কী করলাম!”

-সোহান এখানে কী করতে আসছে? ওরে আবার তুই জামাইয়ের সাথে বসিয়ে দিয়ে আসছিস! তোর কি জীবনেও আক্কেল হবে না।”

কথা মা’র কথায় কান দিল না। সে যে কাজে এসেছিল তা করতে লাগল। সোহান ভাই নুডলস খেতে ভীষণ পছন্দ করে। তাকে যদি কেউ বড় একটা নুডলস এর গুদামে বসিয়ে দেয়, সে কয়েক দিনেই সব শেষ করে ফেলবে। কথার রাঁধতে ভালো লাগে। প্রিয় মানুষ গুলোকে রেঁধে খাওয়ানোর মাঝে যে সুখ আছে তা মনে হয় না পৃথিবীর অন্য কোন কাজে আছে।

-সোহানকে এক্ষুনি বিদায় কর। আপদ এসে সব আমার ঘাড়ে জুটে।”

-সোহান ভাই আপদ না। আমাদের পাশে যদি কেউ সবসময় থেকে থাকে সেটা সোহান ভাই-ই। তোমার বিপদের দিন এই আপদকে ছাড়া অন্য কাউকে পাশে পাও তুমি?”

আশা দাঁত কিড়মিড় করে বলল,

-বিয়ের পর তোর সাহস অনেক বেড়েছে, না! ভেবেছিস এখন আমি আর তোকে শাসন করতে পারব না। আমার সাথে এরকম চটাংচটাং কথা বলবি না।”

-তোমার সাথে শখের চোটে আমি কথা বলি না। না বলে থাকা যায় না বলেই বলি। বাধ্য হয়ে বলতে হয় বুঝলে।”

কথা চলে গেলে আশা রাগ সামলাতে না পেরে একটা কাঁচের গ্লাস ছুঁড়ে ভেঙে ফেলল। কথা ঘরে ঢোকার আগে মন ভালো করার চেষ্টা করল। একটা মানুষের মনে অন্যদের প্রতি কীভাবে এত বিষ থাকতে পারে! মা কাউকে আপন চোখে দেখতে পারে না কেন।
সোহান কথাকে দেখেই বুঝে ফেলল কাকী ওকে কিছু বলেছে। নীড়ের সামনে কিছুই বলল না সে৷ কথার মুখের দিকে তাকিয়ে নীড়েরও বুঝতে বাকি রইল না কথার মন খারাপ। সোহান জানে তার এই বাড়িতে আসা কাকী পছন্দ করে না। তবুও কথাটার জন্য আসে। সে ওঠার জন্য তাড়া দিতে লাগল। কথা অনেক জোর করল রাতে ওদের সাথে খেয়ে যেতে, সোহান তা শুনল না। সে হেসে বলল,

-পেট বেরিয়ে গেছে রে কথা। ভাবছি এখন থেকে আর রাতে খাব না। জানিসই তো পেটুক ছেলেদের মেয়েরা পছন্দ করে না।”

-মেয়েরা পছন্দ করলো কি না করলো তাতে তোমার কী? নুড়ি আপা তো তোমাকে পছন্দ করে।”

নীড় মনে মনে ভাবল কথার সম্পর্কে সোহানের থেকে ভালো কেউ জানবে না। সোহানের সাথে তাকে কথা বলতে হবে। তাই সে-ও সোহানের সাথে বেরুতে চাইল।

-কথা, আমিও একটু ঘুরে আসি।”

-আপনাদের কত সুবিধা তাই না! আপনারা রাত দশটা নাই বারোটা নাই মন চাইলে সারারাতই বাইরে কাটাতে পারেন। দোকানে বসে চা খেতে পারেন। ফাঁকা রাস্তায় একা-একা হাঁটতে পারেন। পুলের উপর বসে চাঁদ দেখতে পারেন। বিশাল মাঠে ঘাসের উপর শুয়ে গায়ে জোছনা মাখাতে পারেন। ছেলেদের কোন ভয় নেই। কোন বারণ নেই। পায়ে লোহার শেকল নেই।”

কথাগুলো বলতে বলতে কথা অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল। নীড় চুপ করে কথাকে দেখছে। কথার অনেক শখ আছে যা সে কোনোদিন পূরণ করতে পারেনি। কিন্তু নীড় মনে মনে কথা দিল, কথা যে শখ,ইচ্ছে গুলো পূরণ করতে পারেনি এখন থেকে সেগুলো পূরণ করার দায়িত্ব তার। সোহান কথার মাথায় হালকা চাপড় দিয়ে বলল,

-পৃথিবীতে এমন অনেক জিনিস আছে যা আমরা চাইলেও করতে পারি না। কিন্তু তোরা দিব্যি পারিস।”

-কী করতে পারো না তোমরা! সবই তো পারো।”

-উঁহু, অনেক কিছুই আমরা পারি না। কী বলো নীড়?”

-হুম।”

-কী পারো না সেটাই তো জানতে চাচ্ছি।”

-তোর মন খারাপ হলে কী করিস তুই? মুখ ফুলিয়ে বসে থাকিস। কষ্ট পেলে কান্না করিস। কিন্তু আমরা কি তা পারি?”
———-
দু’জনই চুপ করে হাঁটছে। মাঝে মাঝে সোহান টুকটাক কথা বলছে। নীড় তার কথার উত্তর দিচ্ছে। সোহানের সব কথাই কথাকে নিয়ে। সোহানকে দেখে নীড়ের আফসোস হচ্ছে। তার একটা বোন থাকলে সে-ও সোহানের মতই ভাই হতো।

-পাগলীটা এখনও কতটা অবুঝ তা তো ওর কথা শুনেই বুঝেছ। ছোট ছোট বিষয় নিয়ে কথা কষ্ট পায়। যে জিনিসটা আমাদের কাছে তুচ্ছ মনে হবে সেটাই ওর কাছে অনেক বড় কিছু। কথাটার মনটা শিশুদের মতোই।”

নীড় বুঝতে পারছে সোহান তাকে এসব কথা কেন বলছে। মনে মনে হাসল সে।

-ছোটো ছোট জিনিসে ও খুশি হয়ে যায়। ওকে খুশি করতে বিশেষ কিছুর প্রয়োজন হয় না। ধরো আজ পূর্ণিমা। তুমি ওকে চাঁদ দেখাতে নিয়ে গেলে। এতেই কথা জগতের সব পেয়ে গেছে এমন খুশি হবে।”

সোহান হাঁটতে হাঁটতে বলে যাচ্ছে। পেছন থেকে নীড় দাঁড়িয়ে পড়েছে এটা লক্ষ করেনি। কিছুটা এগিয়ে গিয়ে নীড়কে পাশে না পেয়ে পেছনে দেখল।

-আরে তুমি দাঁড়িয়ে গেলে কেন?”

-কোথাও বসা যাক।”

-ওহ হ্যাঁ হ্যাঁ।

ওরা একটা চায়ের দোকানে বসলো। সোহান দোকানে বসা লোকগুলোর সাথে নীড়ের পরিচয় করিয়ে দিল। দেখা গেল দু-এক জন বাদ দিয়ে বাকি সবাই কথাকে চিনে। কথার বর হিসেবে নীড়ের খাতিরযত্ন দ্বিগুণ হয়ে গেল। বয়স্ক দু’জন লোক কথার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কথার মত মেয়েই হয়না। পথেঘাটে দেখা হলেই সালাম দেয়। কত সুন্দর করে হেসে কথা বলে। পাড়ার সবার খোঁজ খবর নেয়। সোহান নীড়কে সামান্য ঠেলে বলল,

-কত গুণবতী বউ পেয়েছ দেখেছ!”

-সেটাই তো দেখছি।”

দোকানি ওদের থেকে চায়ের দাম নিল না। নীড় দাম দিতে গেলে লজ্জিত মুখে বলল,

-ছি ছি! আপনি আমাগো কথা রাণীর স্বামী। আমাগো পাড়ার জামাই। না,না। আপনার থেকে দাম নিতে পারমু না। কথারে নিয়া আমাগো বাড়ি আইসেন একদিন। জামাল দোকানদার কইলেই কথা আমারে চিনব।”

রাস্তায় বেরিয়ে নীড় চুপ করে আছে। কথার ব্যাপারে সোহানকে কীভাবে জিজ্ঞেস করবে ভাবছে।

-কথাকে তো তুমি ছোট থেকে চেনো, না?”

-হুম। কথার মা আমাকে ভীষণ স্নেহ করতো। নিজের ছেলের মতই দেখত।”

-ওর কত বছর বয়সে তিনি মারা যান?”

সোহান নীড়ের মুখের দিকে চেয়ে কিছু ভাবল। তার মানে নীড় জানে, কথার আসল মা বেঁচে নেই।

-কথার যখন তিন বছর বয়স। কাকীর কী যেন একটা অসুখ হয়েছিল।”

-ওর বাবা দ্বিতীয় বিয়ে কবে করেন?”

-কাকী মারা যাবার এক বছর পরই ধরো। আসলে কথা তো তখন খুব ছোট ছিল। মূলত কথার জন্যই কাকা দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন।”

-হুম। কথা তো খুব ছোট ছিল, বাবার বিয়ে ও কীভাবে নিয়েছিল।”

-তখন হয়তো ও বুঝেই নি সংসারে সৎমা এসেছে। কিন্তু বুঝ হওয়ার পর থেকে স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছে। কথাটা এমন মানুষ, ওর খারাপ লাগাটা ও নিজের মধ্যে চেপে রাখে। নিজের খুশিটা সবার সাথে ভাগ করে নেয়। ওকে সহজে বোঝা যায় না।”

-এখন যিনি আছেন তিনি কথাকে কীভাবে গ্রহণ করেছিলেন?”

সোহান দীর্ঘশ্বাস চাপল। এসব কথা নীড়কে বলা যাবে না। যতই হোক জামাই সে। একদিন না একদিন শ্বশুরবাড়ির কথা তুলতে পারে। নীড়ও সোহানের ইতস্তত ভাব বুঝতে পারল। পাড়ার রাস্তার সামনে এসে দাঁড়াল নীড়। এখান থেকে একটু সামনেই কথাদের বাড়ি। নীড় আশ্বস্ত করা গলায় সোহানকে বলল,

-কথার সম্পর্কে সবকিছু জানা আমার জন্য ভীষণ জরুরি। ওর অতীত সম্পর্কে সবকিছু জানতে হবে আমাকে। নইলে আমি কথাকে সাহায্য করতে পারব না। ওকে সুন্দর গোছালো একটা জীবন দিতে পারব না। আমি জানি, কথার সম্পর্কে তোমার থেকে ভালো আর কেউ জানবে না। তাই দয়া করে আমার থেকে কিছু লোকাবে না। কথার মাঝে কখনও কোন ধরনের অস্বাভাবিকতা লক্ষ করেছ তুমি? কথার এমন কোন আচরণ তোমার চোখে পড়েছে যা স্বাভাবিক না। বা কথার আচরণের সাথে যায় না এমন কিছু করতে দেখছ ওকে? প্লিজ সোহান, আমাকে বলো।”

চলবে_

বিঃদ্রঃ পর্ব দেরি করে দিলে গল্প পড়ার আগ্রহ কমে যায়। এমনটা সবার ক্ষেত্রেই হয়। কিন্তু কী করব বলুন? অলসতা আমাকে ছাড়ছে না। রোজা রেখে একদমই লিখতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু ঈদের আগে এই গল্প শেষ করব ইনশাআল্লাহ।
এডিট ছাড়া পর্ব মাত্রই লিখে পোস্ট করে দিলাম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here