#চুপকথা-(১৪+১৫)
Zannatul Eva
সত্যিটা হচ্ছে, আমি তোমাকে সবসময় খুশি দেখতে চাই৷ আর তোমার কাছের মানুষ গুলো ভালো থাকলে তুমিও ভালো থাকবে আমি জানি৷ সেই জন্যই এতো কিছু করা।
পৃথিবীতে এতো এতো মানুষ থাকতে আমাকেই কেন খুশি দেখতে ইচ্ছে হলো আপনার?
এই কুহু চল। মা অনেকবার ফোন করে ফেলেছে এর মধ্যেই। এখন না ফিরলে খুব বকা খেতে হবে।
পুরো কথাটা বলার আগেই পিহু আর জাহিদ ভাইয়া চলে এলো। ওদেরকে রিকশায় তুলে দিয়ে আমরা বাসায় চলে এলাম৷ আজও মায়াবতীকে আমার মনের কথাটা বলা হলো না।
______________
পিহুকে কেমন লাগলো বলো তো? কথা বলে কী রকম মনে হলো? মানে সামনে এগোনো যাবে তো?
জাহিদ ভাইয়া হেসে বলল, আমার তো ভালোই লেগেছে। আর ওর তো কোন দোষ ছিল না। ডিভোর্সটা ওর তরফ থেকে হয়নি। মনটা খুব ভালো মনে হলো। আমার তো কোনো সমস্যা নেই ওকে বিয়ে করতে। আর তুই কুহুকে বলেছিস যে তুই ওকে পছন্দ করিস?
কখন আর বললাম! তার আগেই তো তোমরা কাবাব মে হাড্ডি হয়ে চলে এলে।
দেরি করিস না। বলে দে, বলে দে। পরে নয়তো দেখবি অন্য কারো হয়ে গেছে। তখন কিন্তু খুব পস্তাতে হবে। এসব কথা চেপে রাখতে নেই।
বলবো। খুব শীঘ্রই আমি মায়াবতীকে আমার মনের কথাগুলো বলবো।
ইতোমধ্যেই বাবার আগমন হলো। রুমে ঢুকেই কাশতে কাশতে বললেন, বাবা জাহিদ কেমন লাগছে দেশে? মামা-মামিকে তো ভুলেই গেছিস। ওহ শোন, তোর জন্য তোর মামি মেয়ে দেখবে বলেছে। কাল একবার চলিস তো আমাদের সাথে। আর তিয়াশ তুমিও চাইলে যেতে পারো।
জাহিদ ভাইয়া ভীষণ স্পষ্টভাষী ছেলে। যা বলার মুখের উপর বলে দেয়। কে কী ভাবলো তাতে তার কিছু যায় আসে না। ঠিক সেভাবেই বাবাকে স্পষ্টভাষায় জানিয়ে দিলো নিজের কথা।
মামা আমি মেয়ে পছন্দ করে নিয়েছি। আশা করছি আপনাদের ওকে খুব ভালো লাগবে। মেয়েটা ভীষণ ভালো।
কথোপকথনের মাঝেই মা চলে এলো। এসেই বলল, ও মা! তুই মেয়ে পছন্দ করে ফেলেছিস এরই মধ্যে! তা কেমন মেয়ে? বিদেশি নাকি আবার?
একদম বিশুদ্ধ খাটি বাঙালি মেয়ে। তোমাদের খুব পছন্দ হবে মামি। তোমরা চাইলে আমি তোমাদের নিয়ে যাবো ওকে দেখাতে। আর যদি যেতে না চাও তাহলেও কেনো সমস্যা নেই। আমি একাই চলে যাবো।
মা বলল, কেন রে! তোর মামি থাকতে একা কেন যাবি? আমি যাবো।
বাবা গম্ভীর স্বরে বলল, তা মেয়েটি কী করে? বড় ঘরে কোনো মেয়ে হবে নিশ্চয়ই!
জাহিদ ভাইয়া বলল, না মামা ও কোনো বড়লোক ঘরের মেয়ে নয়। আর ও তেমন কিছুই করে না। বলে রাখা ভালো যে ওর আগে একটা বিয়ে হইছিলো। কিন্তু আনফরচুনেটলি সেই বিয়েটা টেকেনি। ওর একটা ছেলেও আছে। দেখো আমি মানুষকে টাকা-পয়সা, সৌন্দর্য দিয়ে বিচার করি না। মানুষ হিসেবে সে কেমন সেটাই আমার কাছে বড়। আর মেয়েটি অসম্ভব ভালো। ভদ্র ফ্যামিলির মেয়ে। আশা করছি তোমরা কেউ আপত্তি করবে না।
মা বলল, না না আমরা কেন আপত্তি করবো…….
বাবা চেচিয়ে বলল, আহ তুমি থামো। বিদেশে থেকে তোমার মাথাটা কি খারাপ হয়ে গেছে জাহিদ। এমন একটা মেয়েকে তুমি বিয়ে করতে চাইছো। আমি কিছুতেই ওই মেয়েকে দেখতে যাবো না।
একথা বলেই বাবা গটগট করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
মামি বলল, সব সময় লোকটা এমন করে। বিয়ে করবি তুই অন্যের পছন্দ অপছন্দ নিয়ে তোকে একদম ভাবতে হবে না। আমি যাবো তোর সাথে।
__________________
আমাকে নিয়ে ওখানে যাওয়ার কারণটা কি জানতে পারি কুহু?
এখনো বুঝতে পারছিস না! তিয়াশ আমাকে বলল ওর একটা ভাই আছে খুবই ভালো। তার একটা
ভালো এবং সুন্দর মনের মেয়ে চাই। আর আমার বোনের থেকে ভালো মনের মেয়ে কটা আছে পৃথিবীতে?
সেই জন্যই তোকে নিয়ে যেতে বলেছিলো ওর ভাইয়ের সাথে আলাপ করাতে।
শুধু ভালো হলেই হয় না রে বনু। আমি তো সবটা বলেছি ওনাকে। এসব জানার পর হয়তো আর কখনও যোগাযোগই করবে না। আমাকে নিয়ে ভাবা বাদ দে এবার। আমি বেশ আছি ডাব্বুকে নিয়ে। আর ওনার পরিবারের কেউ আমার সম্পর্কে জানলে আমাকে মেনে নেবে না। কেন শুধু শুধু এসব করছিস?
ওনার বাবা-মা মারা গেছেন। তাই উনি সবসময় বিদেশেই থাকেন। মাঝে মাঝে দেশে আসেন অবশ্য। এখন তুই যদি রাজি থাকিস আমি মায়ের সাথে কথা বলবো।
বড় আপা কথা ঘুরিয়ে বলল,
আচ্ছা তোমাদের মধ্যে কী চলছে বলতো! তোরা কি দুজন দুজনকে……
কি বলছিস আপা! রকম কিচ্ছু না। আমরা জাস্ট বন্ধু। ট্যুরে একসাথে ছিলাম সেখান থেকে আলাপ। তুই যা ভাবছিস ওরকম কিচ্ছু না।
তাহলে ওর ভাই জাহিদ তখন কেন বলল যে আমার ভাইয়ের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে!
সে আমি কী জানি!! আমি জানিনা। ঘুমা তো অনেক রাত হয়েছে। আর কাল আমাকে জানাস। ছেলেটা খুবই ভালো আপা। আজকাল এরকম ছেলে খুঁজে পাওয়া খুব মুশকিল।
আপা কিছু বলল না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের রুমে চলে গেল।
পরের দিন হুট করেই তিয়াশরা আমাদের বাসায় চলে এলো আপাকে দেখতে।
________________
১৫.
বড় আপাকে দেখতে এসেই পাকা কথা বলে গেল তিয়াশের মা। আপাও আর অমত করলো না। যেহেতু জাহিদ ভাইয়া সবটা জেনে শুনেই আপাকে বিয়ে করতে চাইছে। তাই আর অমত করার মতো কোনো কারণও নেই। সামনের শুক্রবারেই বিয়ের দিন ঠিক করা হলো। আপা আর জাহিদ ভাইয়া দুজনেই চায় খুব সাধারণ ভাবে তাদের বিয়েটা হবে। সেরকম ভাবেই সবটা আয়োজন করলাম আমরা। বিয়ের পর আপাকে নিয়ে কোথায় থাকবে সেটাও ঠিক করে ফেললো ওরা। জাহিদ ভাইয়াদের বাড়িটা খালিই পড়ে আছে। বাবা-মায়ের স্মৃতি মনে পড়বে বলে উনি যখন বিদেশ থেকে আসতেন তখন সেখানে না গিয়ে হোটেলে উঠতেন। কিন্তু নতুন বউকে নিয়ে তো আর হোটেলে উঠা যায় না। তাই নিজের বাড়িতেই থাকবেন বলে ঠিক করলেন এখন থেকে। অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা বিয়ের সমস্ত কেনাকাটা শেষ করলাম৷
বিয়ের দিন সবাই খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লো কাজে। মায়ের উপর দিয়ে সকাল থেকেই খুব ধকল যাচ্ছে। পরিবারে বাবা না থাকলে যে কত সমস্যা প্রতিটা পদে পদে টের পেয়েছি আমরা। বাবাকে ভীষণ মিস করি। এখন বাবা বেঁচে থাকলে সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিতেন। আর অনেক খুশিও হতেন আপাকে দেখে। দূর থেকে নিশ্চয়ই বাবা দেখছেন আমাদের। এসব ভাবতে ভাবতেই তন্নী এসে বলল, বরপক্ষ চলে এসেছে।
সবাই এসেছে কিন্তু তিয়াশের বাবা আসেন নি। আপাকে দেখতে এলো ওনারা তখনও তো তিয়াশের বাবা আসেন নি। উনি কি রাজি হন নি এই বিয়েতে! তিয়াশকে জিজ্ঞেস করতে হবে কথাটা। ওদের সাথে সানিও এসেছে। তন্নী বারবার সানির দিকে আড় চোখে তাকাছে। যেখানেই যাক এ দুটোর প্রেম চলতেই থাকে। আবার ঝগড়া লাগতেও সময় লাগে না।
বিয়ে পড়ানো শেষে তিয়াশ আমার কানে কানে বলল, এখন কিন্তু আমাদের নতুন একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেল। আমরা আত্মীয় হলাম। এখন অন্তত আপনি আজ্ঞে করে আমার বয়সটা বাড়িয়ে দিও না। সম্পর্কে কিন্তু আমি তোমার বেয়াই হই।
আমি মৃদু হাসলাম। পাশ থেকে তন্নী বলল, জো হুকুম বেয়াই সাব। এখন মানে মানে হাজার পাঁচেক টাকা ছাড়ো নয়তো দুলা মিয়ার খালি পায়েই বাড়ি ফিরতে হবে।
তিয়াশ অবাক হয়ে বলল, জুতোটা কখন চুরি হলো! এটা কিন্তু একদম ঠিক হয় নি।
তন্নী বলল, ঠিক হয় নি মানে! বিয়ের দিন শালীরা দুলাভাইয়ের জুতো লুকোবে না তা হয় নাকি! এটাই তো মজা। টাকা ছাড়ো ঝটপট।
তিয়াশ বলল, তাহলে তোমার বান্ধবীকে আগে বলতে বলো।
তন্নী বলল, কী!
তিয়াশ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, হাম আপকে হ্যা কন?
তিয়াশের তাকানো যেন আমার সবটা এলোমেলো করে দিলো! ও কী শুনতে চাইছে? নতুন সম্পর্কের নাম! নাকি অন্য কিছু?
তন্নী আমাকে খোঁচা মেরে বলল, কী মামা! কী শুনতে চাইছে তোমার রোমিও? জলদি জলদি বলো নয়তো টাকাটা পেতে দেরি হচ্ছে যে।
আমি কী জানি! টাকা লাগবে না। তুই জুতো ফেরত দিয়ে দে।
না না না তা হচ্ছে না। এই টাকা তো উসুল করতেই হবে। দুজন মিলে শপিং করবো। এই কুহু বলে দে না।
কী বলবো? আমি কী করে জানবো ও কী শুনতে চাইছে!
তিয়াশ আর সানি বলল, হার মেনে নিয়ে জুতো ফেরত দিয়ে দিলেই হয়।
তন্নী বলল, এতো সহজে হার মানছি না। পেয়সে দে দো জুতে লে লো!
তিয়াশ এবার আরও কঠিন হলো। বলল, পেহলে জাবাব দে দো ফির জুতে লে লো।
বড় আপা বলল, তোরা কী করছিস বলতো সব কটা মিলে! এই কুহু জুতোটা দিয়ে দে না।
তন্নী বলল, বাব্বাহ! পিহুপা তুমি তো এখন থেকেই তোমার বরের সাপোর্ট করছো। আমরা একদিনেই পর হয়ে গেলাম! যাই বলেন জিজু আপনি কিন্তু এমন ভালো, মিষ্টি বউ পেয়ে জিতছেন।
তিয়াশ বলল, আমাদের ভাই কি কম নাকি! তোমরাও জিতেছো সেটা স্বীকার করো।
আমি মৃদু স্বরে বললাম, একদিনেই কি সম্পর্কের বিচার করা যায়! সম্পর্ক যত পুরনো হয় দুজনের প্রতি ভালোবাসা ততো গভীর হয়। কে কার কী এবং কতটা আপন হতে পারলো, কে জিতলো কে হারলো সেটা সময়ই বলে দেবে। তখন আর আলাদা করে প্রশ্ন করতে হবে না, হাম আপকে হ্যা কন?
জাহিদ ভাইয়া বলল, আরে বাহ! আমার শালী তো ভালোবাসার পিএইচডি করে বসে আছে। কী ছোট গিন্নি মনের মানুষ টানুস আছে? নাকি আমাকে দেখতে হবে? আমার হাতে কিন্তু সুপাত্রের খোঁজ আছে হা হা হা হা……
সবাই হো হো করে হেসে উঠলো।
তিয়াশ ফিসফিস করে বলল, আমি আমার উত্তর পেয়ে গেছি।
এরপর জাহিদ ভাইয়াকে বলল, টাকা দিয়ে আমাদের শান্ত করতে। জাহিদ ভাইয়া টাকা দিলো। আমরাও জুতো ফেরত দিয়ে দিলাম। আপা চলে গেল শ্বশুরবাড়ি ডাব্বুকে সাথে করে। আপাকে বিদায় দিয়ে মা কাঁদতে কাঁদতে বলল, আজকে আমি অনেক খুশি। এই চোখের পানি দুঃখের না সুখের। মেয়েটার জীবনটা নতুন করে গুছিয়ে দিতে পেরেছি এবার দু চোখ বুঝলেও আমার শান্তি।
_______________________
আপার বিয়ের জন্য অফিস থেকে ছুটি নিয়েছিলাম। ছুটি শেষ। তাই আজকে অফিস যেতেই হবে। সকাল সকাল নাস্তা সেরেই বেরিয়ে পড়লাম। পথেই তিয়াশের সাথে দেখা হয়ে গেল।
চলবে……..