#চুপকথা-(১৯+২০)
Zannatul Eva
#চুপকথা-১৯
Zannatul Eva
তুমি! এখন এই সময়! ওদিকে সব ঠিক আছে তো? আপা, জাহিদ ভাইয়া, ডাব্বু সবাই ভালো আছে তো?
তিয়াশ বলল, আরে তুমি এতো হাইপার হচ্ছো কেন? সবাই ঠিক আছে। শুধু আমিই ঠিক নেই।
কেন? কী হয়েছে তোমার?
অসুখ।
মানে?
তোমায় দেখতে চাওয়ার অসুখ।
ফিসফিস করে কী বলছো? কী অসুখ হয়েছে তোমার?
আরে আমি মজা করছিলাম। তুমি একটুতেই এতো হাইপার হয়ে যাও। তাই একটু মজা করলাম। ভাবি তোমাদের নিতে পাঠালো। তুমি একা একা আন্টিকে নিয়ে আসবে তাই ভাবলাম বলেছে যখন, গিয়ে নিয়ে আসি তোমাদের।
আপাটা না! আমরা ঠিক চলে যেতাম। কী দরকার ছিল শুধু শুধু তোমাকে পাঠানোর।
কার সাথে কথা বলছিস কুহু?
তিয়াশ এসেছে মা। তোমার বড় মেয়ে পাঠিয়েছে আমাদের নিতে। তোমার মেয়ের আমার উপর ভরসা হচ্ছিলো না। আমি কী ছোটো নাকি!
ও তিয়াশ! কেমন আছো বাবা? পিহু আবার তোমাকে কেন পাঠাতে গেল? শুধু শুধু কষ্ট করে এলে।
না না আন্টি কষ্ট কেন হবে? এসেছি তো গাড়িতে। আপনাদের যেন অসুবিধে না হয় সেই জন্যই তো পাঠালো ভাবি আমাকে। চলুন গাড়িতে উঠে বসুন।
গাড়িতে যাওয়ার সময় পুরো রাস্তায় একটু পরপর তিয়াশ শুধু আমার দিকে তাকাচ্ছিলো। ওর এই চোখের চাহনি আমার অচেনা। বুকের ভেতরটায় কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে। ও কী আমায়? না না এসব কেন ভাবছি আমি! এসব একদম মাথাতে আনবি না কুহু। হয়তো তিয়াশের মনে এসব কিছুই নেই। শুধু শুধুই এসব ভাবছিস তুই। কিন্তু রেস্তোরাঁয় সেদিন জাহিদ ভাইয়ার বলা কথাটা তো মিথ্যে নয়। উনি সেদিন কেন বলেছিলো আমি তিয়াশের ঘুম কেঁড়ে দিয়েছি?
এসব ভাবতে ভাবতেই আমরা চলে এলাম। ডাব্বু তার নানুমনি আর খামনিকে পেয়ে ভীষণ খুশি।
তিয়াশদের বাড়িটা ভীষণ সুন্দর। তিনতলা বাড়ি। নিচতলা আর তিনতলা ভাড়া দেয়া। মাঝের তলায় ওরা থাকে। আমি হাঁটতে হাঁটতে তিয়াশের রুমের দিকে চলে এলাম। কিন্তু এসে যে এমন দৃশ্য দেখতে হবে সেটা বুঝতে পারিনি৷ রোগা পাতলা একটা ছেলে হাফ প্যান্ট পরে হাত-পা ছড়িয়ে বাচ্চাদের মতো উবুত হয়ে ঘুমোচ্ছে। কী অবস্থা! এটা তো তিয়াশ নয়। তাহলে কে? সে যাই হোক, হঠাৎ করে আমার নজর গেল তিয়াশের গিটারের দিকে। গিটারের পাশেই একটা সুন্দর ডায়েরি। আমি ডায়েরিটা খুলতে গিয়ে ভাবলাম, পার্সোনাল কিছু থাকতে পারে ডায়েরিতে। খোলাটা বোধহয় ঠিক হবে না। পরক্ষনেই আবার মনে পড়লো, তিয়াশের তো কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই। তাহলে আর এমন কী থাকবে ডায়েরিতে। খুলে দেখাই যায়। তবে এখানে আমার দাঁড়িয়ে থাকাটাও ঠিক হবে না। যাই আপার ঘরে গিয়ে নিরিবিলি ডায়েরিটা পড়ি।
আমি ডায়েরিটা নিয়ে চলে যাচ্ছিলাম এমন সময় কেউ একজন পেছন থেকে আমাকে ডাক দিলো, মিস কাদাবতী?
আমি পেছনে ঘুরে তাকিয়ে দেখলাম, কাল আমাকে গাড়িতে লিফট দিয়েছিলো, সেই রোগা পাতলা ছেলেটা৷ কী যেন নাম বলেছিলো? পিয়াশ! হ্যাঁ পিয়াশ। কিন্তু এ এখানে কী করছে!
আরে মিস কাদাবতী! আপনি এখনে? ও মাই গড! আপনি এখানে কী করে চলে এলেন? ওয়েট ওয়েট ওয়েট একটা চিমটি কেটে দেখি। আউচচচ…….
আমি ভ্রু কুঁচকিয়ে তাকিয়ে ওর কান্ডকারখানা দেখছি। ছেলেটা এমন করছে কেন আমাকে দেখে? আমি কি এলিয়েন নাকি!
এ তো স্বপ্ন নয় সত্যি। কাদাবতী আমার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ও মাই গুডনেস। বাই দ্যা ওয়ে, আপনি এখানে কী করে?
পিহু আমার বড় বোন।
ইউ মিন তুম বাড়ে মিয়ার কি শালী? শালী মাতলাব আধে ঘারওয়ালি!
কিহ!
ওসব ছাড়ুন। নাইচ টু মিট ইউ।
কিন্তু আপনি এখানে?
জাহিদ ভাইয়ার ছোটো ভাই। আপনার বোনের দেবর।
ও আচ্ছা, বুঝতে পেরেছি। সরি আমি আসলে হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছিলাম। আপনি ঘুমোচ্ছেন জানতাম না। আমি এক্ষুনি চলে যাচ্ছিলাম।
আরে কুল। নো প্রবলেম। এমনিতেও ক’দিন বাদে এই বাড়িটা তোমারই হবে।
কিছু বললেন?
বললাম, ইট’স ওকে। আমি কিছু মনে করি নি।
আচ্ছা আমি তাহলে আসছি।
একথা বলেই আমি তাড়াতাড়ি করে আপার রুমে চলে এলাম। ছেলেটাকে দেখলেই কেমন ইরিটিটিং লাগে। কেমন ছটফট করতে থাকে। অদ্ভুত ছেলে!
আপা জামাকাপড় গোছাতে গোছাতে বলল, কী রে একা একা কী বিড়বিড় করছিস?
তুই তো বলেছিলি তোর দেবর বিদেশে থাকে।
কালই তো এলো। একদম হুট করে। কাউকে কিচ্ছু না জানিয়ে। ছেলেটা প্রচন্ড চটপটে। হৈ-হুল্লোড় করতে ভালোবাসে। তিয়াশের একদম অপোজিট।
হুম বুঝলাম। আচ্ছা তুই আবার তিয়াশকে কেন পাঠালি আমাদের আনতে? আমরা কি একা একা চলতে পারি না?
আমি! আমি কখন পাঠালাম! তিয়াশ নিজেই তো আমার কাছে এসে বলল, আন্টিকে আর কুহু গিয়ে নিয়ে আসি। মানে গাড়ি থাকতে কষ্ট করে কেন আসবি এসব বলছিলো। তো আমি বললাম, ঠিক আছে যেতে চাইছে যখন, তখন যাক। ছেলেটা ভীষণ কেয়ারিং। তিয়াশকে আমার খুব পছন্দ। তোর জন্য এমন একটা ছেলে পেলে…….
ধূর! কী সব বলছিস আপা!
কেন? তিয়াশকে তোর ভালো লাগে না?
ঠিকঠাক। কিন্তু…….
কিন্তু কী? তিয়াশের মতো ছেলে আজকাল চট করে পাওয়া যায় না। ওর জন্যই তো আজ আমি একটা সুন্দর পরিবার পেলাম। ডাব্বু তার নতুন বাবা পেলো। এমন ছেলেকে কেউ ভালো না বেসে থাকতে পারে? আমার যতদূর মনে হয় ও তোকে পছন্দ করে। জাহিদকে জিজ্ঞেস করেছিল আমি একবার। ঐ যে সেদিন রেস্তোরাঁয় ওই কথাটা বলল। কিন্তু জাহিদ ক্লিয়ার করে কিছু বলল না আমাকে জানিস! হয়তো তিয়াশ নিজেই তোকে বলতে চায়।
কী সব বলছিস আপা তুই! এসব আবার হয় নাকি। তুই জানিস না আমার পুরনো সেসব কথা? আর ওসব শুনলে কেউই তার ছেলের জন্য আমাকে বউ করে নিয়ে যাবে না।
কেন হয় না? শোন, পুরনো সব স্মৃতি ভুলে যা। সবটা কি আমাদের হাতে থাকে? কারো মরা বাঁচা তো আমাদের হাতে নেই। আল্লাহ যা চান তাই হয়। আমার মনে হয় না তিয়াশের মতো ছেলে এসব ব্যাপার নিয়ে ঘাটবে।
দেখ আপা, আমি চাই না কারো জীবনে আমার জন্য কোনো সমস্যা হোক। আমি যেমন আছি ভালো আছি।
আপার আর কোনো কথা বলল না। আমার দিকে তাকিয়ে শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
________________________
পিয়াশ.
ছোটো মা ভাই কোথায়?
কে জাহিদ? জাহিদ তো তোর ছোটো বাবার সাথে কোথায় একটা গেল।
আরে বাড়ে মিয়া না। আমি সারাক্ষণ ভাই ভাই বলে কাকে ডাকি?
ও তিয়াশ? তিয়াশ তো একটু আগে বাইরে গেল।
ভাইকে এখনই বাইরে যেতে হলো! এখন থাকলে মিস কাদাবতীকে দেখাতে পারতাম। কখন আসবে ভাই! একটা ফোন করে দেখি৷ রিং হচ্ছে। আরে আওয়াজটা তো ভাইর ঘর থেকেই আসছে। ফোনটা রেখে চলে গেছে মহারাজ। এখন আসা অবধি অপেক্ষা করতে হবে। পেটের মধ্যে গুরগুর করছে। মিস কাদাবতী এখন আমার খুব কাছে চলে এসেছে। আর এটা ভাইকে না বলা পর্যন্ত আমার শান্তি নেই।
___________________
তিয়াশ.
সাদা গোলাপ না হলুদ গোলাপ? কোনটা দিয়ে মনের কথা বলবো মায়াবতীকে?
ফুলের দোকানদার বলল, লাল গোলাপ দেন। হগ্গলে তো লাল গোলাপই তো দেয় দেহি।
আমি সাদা গোলাপ হাতে নিয়ে বললাম, সবাই তো লাল গোলাপই দেয়। আমি না হয় সাদা গোলাপ দিলাম। সাদা হচ্ছে, শুভ্রতার প্রতীক। এক গুচ্ছ সাদা গোলাপের মতো শুভ্রতা ছড়িয়ে পড়ুক মায়াবতীর জীবনে। হ্যাঁ, আজ আমি সাদা গোলাপ দিয়েই কুহুকে প্রপোজ করবো। একদম আমার নিজের মতো করে।
_____________
২০.
পিয়াশ.
মিস কাদাবতী, আপনি বাগানে কী করছেন একা একা? আমি আপনাকে পুরো বাড়ি খুঁজে খুঁজে হয়রান হলাম।
প্রথমত, আমার নাম কাদাবতী নয় কুহেলিকা। সবাই আমাকে কহু বলেই ডাকে। দ্বিতীয়য়ত, আপনি আমাকে খুঁজে খুঁজে কেন হয়রান হচ্ছিলেন? আমি কি বলেছি আপনাকে খুঁজতে আমাকে?
আপনি সবসময় এতো রেগে রেগে কথা বলেন কেন? আমরা তো আত্মীয়। আমরা একসাথে বাগানে হাঁটতে পারি, গল্প করতে পারি। যদি আপনি চান।
বাগানটা আপনাদের। আপনি চাইলে হাঁটতেই পারেন। আর বাকি রইলো গল্প করা। সেটাও না হয় নিজের সাথে করুন।
একথা বলেই কুহু বাগান থেকে চলে যাচ্ছিলো। আমি পেছন থেকে ওকে ডেকে বললাম, মিস কাদাবতী, আপনি রেগে গেলেন কেন?
কিন্তু ও কোনো জবাব না দিয়ে সোজা ভেতরে চলে গেল। মিস কাদাবতীকে ইমপ্রেস করা খুব কঠিন মনে হচ্ছে। এ তো টিনা, মিনা, রিনাদের মতো নয়। ওরা হলে এতোক্ষণে আমর সাথে ঘুরতে যেতেও রাজি হয়ে যেতো। কিন্তু মিস কাদাবতী তো আমাকে পাত্তাই দিচ্ছে না। ভাই যে কখন আসবে! একমাত্র ভাই-ই পারবে আমাকে হেল্প করতে। ভালো মেয়েদের মনে কিভাবে ঢুকতে হয় সেটা ভাই-ই বলতে পারবে। টিনা, মিনা হলে আমি ঠিক ম্যানেজ করে নিতাম। কিন্তু মিস কাদাবতী তো অন্য লেভেলের। একে কী করে ইমপ্রেস করবো?
__________________
তিয়াশ.
মা এখন রান্নাঘরে আছে। বাকিরাও যার যার মতো ব্যস্ত। এই ফাকেই ফুল গুলো লুকিয়ে ফেলতে হবে। ঠিক সময় কুহুকে ডেকে আমার মনের কথা বলে দিবো। পিয়াশ যদি একবার দেখে ফেলে তাহলে আর রক্ষে নেই। সারাক্ষণ এই নিয়ে লেগ পুল করবে আমাকে।
আমি পা টিপে টিপে নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছিলাম এমন সময় ভাবি পেছন থেকে ডেকে বলল, কী ব্যাপার দেবর সাহেব? সাদা গোলাপ কার জন্য? আমি কিন্তু ধরে ফেলেছি।
ধরে যখন ফেলেছো তখন তোমাকেই আমাকে হেল্প করতে হবে। তোমার বোনের মনে কী চলছে বলো না আমাকে। আমি ভীষণ নার্ভাস। খুব ভয় করছে। যদি ও না করে দেয়!
ভাবি বলল, আমার বোন ভীষণ ভালো মেয়ে। এটা হয়তো তোমাকে বলার প্রয়োজন ছিল না তবে একটা কথা না বললেই নয়। কুহুর কিন্তু একটা পুরনো অতীত আছে। আর সবকিছুর আগে তোমার অবশ্যই এটা জেনে নেয়া দরকার।
আমি অবাক হয়ে বললাম, অতীত! কী অতীত!
আমার প্রথম বিয়ের পরপরই বাবা কুহুর বিয়ে ঠিক করেছিলো। যদিও ওদের দুজনের মধ্যে কোনো প্রেম ছিল না। ছেলেটা কুহুকে পছন্দ করতো। বাসায় বিয়ের প্রপোজাল নিয়ে আসে। ছেলে ওয়েল সেটেল্ড তাই বাবাও রাজি হয়ে যায়। কুহুও অমত করে নি। হয়তো বাবার কথা ভেবেই রাজি হয়ে গিয়েছিলো। বিয়ের দিন, তারিখ সব ঠিক। বিয়ের ঠিক আগের দিন খবর এলো, রাফসান বাইক এক্সিডেন্টে করেছে। হাসপাতাল নিতে নিতে রাস্তায়ই ও মারা যায়। সেই মুহুর্তে কুহুকে অনেক কিছু সহ্য করতে হয়েছে। রাফসানের বাড়ির লোকও কিছু বলতে বাদ রাখেনি।
কিন্তু ওর এক্সিডেন্টের সাথে কুহুর কী সম্পর্ক?
সবাই তখন বলতে শুরু করে, কুহু অপয়া। বিয়ের আগেই স্বামীকে খেয়ে ফেলেছে। এতো খারাপ খারাপ কথা বলছিলো তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। আমাদের সমাজের মানুষ গুলোকে তো জানোই, এরা সব কিছুর জন্য মেয়েদেরকেই দায়ী করে। এখনও মানুষের ভেতরে কত কুসংস্কারে ছেয়ে আছে। একজনের মৃত্যু হয়েছে সেই দায় ভার অন্য জন কেন নেবে বলো তো? এখনও অনেকেই শুনলে বলে, মেয়েটা নিশ্চয়ই আপয়া। এসব কিছু দাঁতে দাঁত চেপে শুনে যায় আমার বোনটা৷ কখনও কখনও প্রতিবাদ করে কিন্তু রেজাল্ট শূন্য। একজন দুই জনের মুখ বন্ধ করা যায় কিন্তু গোটা সমাজের সব মানুষদের মুখ কী করে বন্ধ করবে ও?
আমি কিছু বলার আগেই জাহিদ ভাইয়া আর বাবা চলে এলো। ভাবি আমাকে ইশারা দিতেই আমি তাড়াতাড়ি ফুল গুলো লুকিয়ে আমার রুমে চলে এলাম। এসে ভাবতে লাগলাম, কুহু এতোটা চাপা স্বভাবের মেয়ে! কখনও তো বলল না আমাকে এসব। অবশ্য এসব বলার মতো তেমন কাছের কেউই বা হতে পারলাম কই! বিশ্বাস করো কুহু, তোমার অতীত নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই। আমি তোমাকে ভালোবাসি এর চেয়ে বড় সত্যি আর কিছু হতে পারে না। তোমার বর্তমান এখন তোমার সামনে। বাকি সবটা ভুলে যাও। তোমাকে আমি এতো ভালোবাসবো যে, অতীতের একফোঁটা কষ্টও তোমাকে ছুঁতে সাহস পাবে না। এখন শুধু তোমাকে কথা গুলো বলার অপেক্ষা।
পিয়াশটা আবার কোথায় গেল! ঘরেও নেই। ও থাকতে বাড়ি এতো শান্ত কী করে আছে?
রান্নাঘরে গিয়ে মাকে জিজ্ঞেস করলাম, পিয়াশ কোথায়? কুহুর মাও তখন মায়ের পাশেই ছিল। দুই বেয়ান মিলে গল্প করছে আর রান্না করছে। আমার মায়ের সাথে সবার খুব তাড়াতাড়িই ভাব হয়ে যায়। কী আর করার মায়ের ভেতর এতো মায়া, মমতা আছে যে, যার সাথেই কথা বলে তার সাথেই খুব আপন হয়ে যায়। কুহুও একদম মায়ের মতো। এই জন্যই আমি ওকে মায়াবতী বলে ডাকি।
মা প্রতিত্তোরে বলল, পিয়াশ? পিয়াশ তো কিছুক্ষণ আগেই তোকে খুঁজছিলো। এখন আবার তুই ওকে খুঁজছিস। কী ব্যাপার বলতো তোদের? আর বলবেন না আপা, দুটোতে এতো ভাব! অন্যদের বেলায় দেখি ভাইয়ে ভাইয়ে মারপিট করে। আর এই দুটোর গলায় গলায় ভাব। পিয়াশ তো তিয়াশকে ভাই ভাই ডেকে পাগল করে দেয় সারাক্ষণ। ওরা দুজন হলো মালিক জোর।
ইতোমধ্যেই ড্রয়িং রুম থেকে বাবার ডাক এলো। আমি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে ড্রয়িং রুমে গেলাম। বাবা বলল, কী করো তুমি সারাক্ষণ? পিয়াশকে সময় দিচ্ছো না? ও তো দেখি মাঠের দিকে গিয়ে পাড়ার বদমাশ ছেলে গুলোর সাথে ক্রিকেট খেলতে শুরু করে দিয়েছে। তুমি ওর সাথে সাথে থাকতে পারছো না? পাড়ার ওই ছেলে গুলোর কোনো ক্লাস আছে? ওসব ছেলেদের সাথে এই বাড়ির ছেলেরা মেলামেশা করবে কেন! ওই তো পিয়াশ এসে গেছে।
তুমি বিদেশ থেকে পড়াশোনা করে এসেছো তোমার ক্লাস হাই লেভেলের। তুমি কেন ওসব ছেলেছোকরাদের সাথে কথা বলবে! পিয়াশ, তোমাকে আমি ওয়ার্নিং দিচ্ছি। এরপর যেন আর কখনও না শুনি তুমি ওসব চালচুলোহীন ছেলে গুলোর সাথে মিশেছো। ইজ ইট ক্লিয়ার?
পিয়াশ কিছু বলতে যাবে আমি ইশারা করে না করায় আর কিছু বলল না। বাবা কখনোই কারো কথা শোনে না। শুধু শুধু তর্ক বাড়িয়ে কী লাভ! তাই পিয়াশকে থামিয়ে দেয়াটাই বেটার মনে হয়েছে।
বাবা বলল, তিয়াশ তুমি এই ফাইল গুলো একটু চেক করে দেখো তো। মিঃ জসিমের সাথে আমার আজকে একটা মিটিং আছে। তার আগে ফাইল গুলো একবার ভালো করে দেখে নাও। তারপর আরও কিছু কাজ আছে সেগুলো আমি তোমাকে পরে বুঝিয়ে দিচ্ছি।
পিয়াশ.
ধুর! ভাইকে তো ছোটো বাবা ছাড়ছেই না। কখন বলবো কাদাবতীর কথা ভাইকে। এই ভাই…. ভাই…….
কী হয়েছে পিয়াশ? দেখছো তো তিয়াশ একটা কাজ করছে। ওকে ডিস্টার্ব না করে পাশে বসে তুমিও কাজ গুলো একবার দেখে নাও। শোনো, সারাজীবন বিদেশে কাটবে না। আমার অবর্তমানে তোমাদের দুই ভাইকেই সব কাজ সামলাতে হবে। তিয়াশ যদিও সবটা বুঝে ফেলেছে এই কয়দিনে। তুমি তিয়াশের সাথে থাকলে তুমিও শিখে যাবে।
আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালাম। কিন্তু ছোটো বাবার কোনো কথাই আমার মাথায় ঢুকলো না। আমার চিন্তা জুরে এখন শুধু মিস কাদাবতী। ওকে কিভাবে ইমপ্রেস করতে হবে সেটা ভেবে ভেবেই সবটা গুলিয়ে যাচ্ছে। ছোটো বাবা নিজের ঘরে চলে যাওয়ার পর আমি ভাইকে বললাম, ভাই তোমার সাথে আমার গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। শোনোনা প্লিজ।
ভাই ফাইল দেখতে দেখতে বলল, কী কথা?
________________________
কুহু.
কখন বাড়ি যাবো! দুইদিনের ছুটি নিয়েছি। বস একদম ছুটি দিতে চায় না। কত বলে কয়ে দুটো দিনের ছুটি নিয়েছি। তার জন্য আবার আমাকে দিয়ে এক্সট্রা কাজও করিয়ে নেবে।
বাড়ি গিয়ে আর কী হবে সখী? তোমার রোমিও তো এখানে।
রোমিও! কে রোমিও?
কে আবার! আমার একমাত্র শান্তশিষ্ট, হ্যান্ডসাম, ভদ্র দেবর তিয়াশ।
কী বলছিস আপা তুই এসব! তোর মাথাটা না গেছে।
আমার মাথা কেন যাবে! তিয়াশ তোকে প্রপোজ করবে। তোর জন্য সাদা গোলাপ নিয়ে এসেছে। আমি ধরে ফেলাতে সে কী লজ্জা!
আপার কথা শুনে ভয়ে আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিলো। তিয়াশকে আমার ভালো লাগে। কিন্তু এতোটা কখনও ভাবি নি। কোথায় আমি আর কোথায় তিয়াশ! বামুন হয়ে চাঁদে হাত দেয়ার ইচ্ছে বা সাহস কোনোটাই আমার নেই। কিন্তু তিয়াশকে দেখলে মনে হয় ও একটা ভরসার হাত। যার হাত ধরে সব বিপদ মোকাবেলা করে ফেলতে পারবো আমি। কক্সবাজারের সেসব ঘটনা গুলো মনে পড়তেই আমার ঠোঁটের কোনো এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো।
আপা বলল, দেখ দেখ দেখ তুইও কিভাবে ব্লাশ করছিস ইশশশ! তোদের জুটিটা কিন্তু একদম ফাটাফাটি হবে। শোন, তিয়াশের মতো ছেলেকে যে রিজেক্ট করবে, সে নিজের পায়ে নিজেই কুড়োল মারবে।
আমি ভীষণ দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে গেলাম। একমন বলছে তিয়াশকে ভালোবাসতে আরেক মন বলছে ভালোবাসিস না। আমার সবটা কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে ভালো হয় যদি আমি রুম থেকেই বের না হই। তাহলে আর তিয়াশ আমাকে প্রপোজও করতে পারবে না। ও বললে হয়তো আমি ওকে ফিরিয়ে দিতে পারবো না। আর ওকে এক্সেপ্ট করে নিতেও খুব ভয় করছে। তিয়াশ খুব ভালো ছেলে। ও আমার থেকেও ভালো কাউকে ডিজার্ব করে।
_________________________
পিয়াশ.
ভাইকে মিস কাদাবতীর কথাটা বলার আগেই ছোটো মা এসে বলল, দুটোয় মিলে কী গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর করছিস? এই তিয়াশ বাবা তোর আন্টিকে নিয়ে একটু ডাক্তার খানায় যেতে পারবি?
ভাই বলল, কেন? কী হয়েছে আন্টির?
ছোটো মা বলল, আমার মতো আপারও হাঁটুতে প্রচন্ড ব্যাথা। বয়স হয়েছে কি না। আমাদের যেই পারিবারিক ডাক্তার ওনাকে একবার দেখিয়ে নিলে ভালো হতো। ওই যে তোর ডাক্তার আংকেল। একটু নিয়ে যাবি?
হ্যাঁ যাবো না কেন! কিন্তু বাবা তো আমাকে এসব ফাইল ধরিয়ে দিয়ে গেল।
রাখ ওসব এখন। আগে তোর আন্টিকে নিয়ে যা। আপা আপনি তিয়াশের সাথে যান। আশা করছি এই ডাক্তারের ঔষধ খেয়ে আপনার হাঁটুর ব্যাথা কিছুটা হলেও কমবে। যা বাবা আন্টিকে নিয়ে যা।
আমি বললাম, ছোটো মা আমিও যাব ভাইয়ের সাথে।
না তোমাকে যেতে হবে না। তুমি জার্নি করে এসেছো এখন বাসায়ই থাকো। তোমার জন্য আমি রান্না করছি তোমার প্রিয় খাবার। চিড়ের পোলাও খেতে ভালোবাসো না তুমি? এক কাজ কর তুই বরং তোর ছোটো বাবার সাথে থাক। ফাইল টাইল ঘাটাঘাটি করতে সাহায্য কর। তিয়াশ যাক আপাকে নিয়ে।
ওকে, যেমন তোমার ইচ্ছে।
ভাই কুহুর মাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। আমি সারাদিন বাসায়ই রইলাম। মিস কাদাবতীকে কী করে ইমপ্রেস করা যায় ভাবতে লাগলাম।
___________________
সন্ধেবেলা আন্টিকে নিয়ে ডাক্তারখানা থেকে ফিরেই দেখলাম কুহু ডাব্বুকে নিয়ে খেলছে। কুহুর এই বাচ্চামিপনা দেখাটা মিস হয়ে যেতো এখন না আসলে। সাদা ড্রেসে কুহুকে অপরূপ সুন্দরী লাগছে। এমন এক দিন কি সত্যিই আসবে? যেদিন কুহু পার্মানেন্টলি এ বাড়ির সদস্য হয়ে যাবে। ঠিক এভাবেই খেলবে, হাসবে আমাদের বাচ্চাকে নিয়ে। আমি বোধহয় একটু বেশি বেশিই ভেবে ফেলছি। অবশ্য নিজের প্রেমিকাকে এভাবে চোখের সামনে ঘুরঘুর করতে দেখলে কারোই হুঁশ থাকার কথা না। আবারও বেশি বেশি ভেবে ফেলছিস তিয়াশ। কুহু এখনও তোর প্রেমিকা হয় হয় নি।
আমি আড়াল থেকে দাঁড়িয়ে কুহুকে দেখছিলাম এমন সময় মা বলল, সন্ধ্যে হয়ে গেছে এখনও ছাদ থেকে জামাকাপড় গুলো আনা হয় নি।
ভাবি বলল, আমি এক্ষুনি গিয়ে নিয়ে আসছি মামি মা।
কুহু বলল, দাঁড়া আপা আমি যাচ্ছি। তোকে যেতে হবে না। তুই ডাব্বুকে কিছু খেতে দে। ওর খিদে পেয়েছে বলছিলো আমাকে।
ভাবি বলল, আচ্ছা।
এই সুযোগ! এখনি ফুল গুলো দিয়ে কুহুকে বলে দিবো আমি ওকে কতটা ভালোবাসি।
কুহু ছাদে যাওয়ার আগেই আমি ছাদে চলে গেলাম। অপেক্ষা করতে থাকলাম ওর আসার।
কিছক্ষুণ পরেই কারো পায়ের আওয়াজ পেলাম। কুহু এসে গেছে! আমি পেছন দিকে ঘোরা অবস্থায়ই কথা গুলো বলতে শুরু করলাম………
যেদিন তোমাকে প্রথম দেখেছিলাম ঠিক সেই মুহুর্ত থেকেই আমার তোমাকে ভালো লেগেছিলো। আমাদের বারবার দেখা হওয়াটা কাকতালীয় ছিল কিনা জানিনা কিন্তু কিছু তো একটা ব্যাপার ছিল। নয়তো বারবার তোমার সাথে কেন দেখা হবে বলো! তোমার চুল, তোমার হাসি, তোমার চোখ সবটাই আমাকে মুগ্ধ করেছে। তোমার কথা বলার ধরন, তোমার উদারতা সব কিছু আমাকে ছুঁয়ে গেছে। তোমাকে আমি মনে মনে মায়াবতী বলে ডাকি। যার মায়া আমাকে সারাক্ষণ আচ্ছন্ন করে রাখে। তোমার ব্যক্তিত্ব বরাবরই আমাকে মুগ্ধ করে। আমি শুধু তোমার হাসির প্রেমে পড়িনি আমি তোমার ব্যক্তিত্বের প্রেমেও পড়েছি। আমি তোমাকে ভালোবাসি মায়াবতী। খুব ভালোবাসি।
কথা গুলো বলে আমি পেছন ফিরে তাকাতেই রীতিমতো অবাক হয়ে গেলাম।
চলবে……