#চুপকথা-২১
Zannatul Eva
বাহ! এতো সুন্দর করে কবিতা আবৃত্তি করো তুমি ভাই!! এটা তো জানতাম না। জানলে কী সারাদিন আর এতো টেনশন করা লাগতো আমার? শোনো তোমার সাথে আমার অনেক কথা আছে। ওয়াও হোয়াইট রোজ! তুমি মনে হয় খুব খোশমেজাজে আছো। ফুল, কবিতা, কী ব্যাপার হ্যাঁ?
পিয়াশকে দেখে খানিকটা ঘাবড়ে গেলাম। ও কী কিছু বুঝে ফেলল! না বোধহয়। বুঝলে তো কবিতার কথা বলতো না৷ ভালোই হয়েছে। ও ভেবেছে আমি কবিতা বলছি।
আমি গোলাপটা আড়াল করে বললাম, কী কথা বল।
আই এম ইন লাভ ভাই।
সত্যিই? কী বলছিস! তা আমার ভাই কার প্রেমে পড়লো এবার?
মিস কাদাবতী।
এই কাদাবতীটা আবার কে?
ইট’স কুহু ব্রো।
পিয়াশের মুখে কুহুর নামটা শোনা মাত্রই আমার বুকের ভেতরে ধাপ করে উঠলো। কী শুনছি আমি এটা! পিয়াশ কুহুকে?
আমি নিজেকে সামলে নিয়ে অনেকটা ভয়ে ভয়েই বললাম, নিশ্চয়ই আগের মতো আবারও ফ্লার্ট করার ইচ্ছে হয়েছে আমার ভাইয়ের। কিন্তু ভাই, যার তার সাথে তো ফ্লার্ট করা যায় না। কুহু তো টিনা, মিনাদের মতো না। ও অন্যরকম একটা মেয়ে। একদম আলাদা। সোসিয়্যাল মিডিয়ায় কোনো এক্টিভিটি নেই, মুখভর্তি কোনো ভারী মেকআপের আবরন নেই। ওয়েস্টার্ন ড্রেসের চাকচিক্য নেই। খুব সাধারণ হয়েও অসাধারণ একটা মেয়ে কুহু।
পিয়াশ বলল, সেই জন্যই তো ভাই সেই জন্যই। কখনও কোনো মেয়েকে এতোটা ভালো লাগেনি৷ ওর সাথে প্রথম দেখা হওয়ার পর থেকেই মনে হচ্ছিলো, কিছু তো একটা আছে ওর মধ্যে। নয়তো আমার মতো একটা ছেলে এভাবে ঘায়েল হতে পারে তুমি বলো ভাই। ও যখন আমার সামনে থাকে তখন আমার খুব ভালো লাগে। এটাই কী লাভ ভাই?
কিছুক্ষণের জন্য মনে হচ্ছে আমার কান দুটো স্তব্ধ হয়ে গেলে ভালো হতো। চারপাশটা কেমন যেন অন্ধকার হয়ে আসছে। হাত-পা কাঁপছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। অনুভূতিরা হারিয়ে যাচ্ছো বোধহয়। এই মুহুর্তে আমার পিয়াশকে কী বলা উচিত? জানিনা। আমি কিচ্ছু জানিনা। কিচ্ছু বুঝতে পারছি না আমি।
ভাই? এই ভাই! কী হলো তোমার?
পিয়াশের ডাকে আমার ভাবনার ঘোর কাটলো। আমি নিচু স্বরে বললাম, হ্যাঁ বল শুনছি।
পিয়াশ বলল, তুমি আমাকে হেল্প করবে তো ভাই? আমি কিন্তু তোমার মতো গুছিয়ে কথা বলতে পারি না। কুহু যদি আমাকে না করে দেয় আমি কিন্তু দুম করে পড়ে মরে যাবো। তোমার ছোটে মিয়া প্রেমে পড়েছে ভাই। ইট’স নট ফান৷ আই এম সিরিয়াস। এই প্রথমবার আমি সত্যি সত্যি কোনো মেয়ের প্রেমে পড়েছি। প্লিজ ভাই আমার হয়ে তুমি কুহুকে বলে দিবে?
আমার পায়ের তলা থেকে মনে হচ্ছে মাটি সরে যাচ্ছে। বুকের ভেতরটা কেমন শূন্য শূন্য লাগছে। হৃদপিণ্ডে কেমন একটা যন্ত্রণা অনুভব হচ্ছে। কাউকে হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণা। তবুও আমার নিজেকে সামলাতে হবে। আমি চোখ মুখ স্বাভাবিক করে বললাম, কী বলতে হবে?
বলবে যে, তোমার ভাইটা অনেক ভালোবাসে তার কাদাবতীকে। ওহ তোমাকে তো বলাই হয় নি আমি কেন ওকে কাদাবতী বলে ডাকি। ব্যাপারটা হচ্ছে সেদিন বাড়িতে আসার সময় পথে যখন বৃষ্টি নামলো তখন ও ছাতা হাতে রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো। আমার গাড়ি পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ওর গায়ে কাঁদা ছিটে গিয়ে একদম কাঁদায় মেখে গিয়েছিলো। সেই থেকে ওর নাম দিয়েছি, মিস কাদাবতী। ওর পুরো নামটা খুব কঠিন। কী যেন বলেছিলো, ও হ্যাঁ কুহেলিকা। ছোট্ট করে কুহু কিন্তু তার চেয়ে আমার ওকে কাদাবতী বলে ডাকতেই খুব ভালো লাগে। এই নামটা একান্তই আমার। এই নাম ধরে শুধু আমিই ওকে ডাকবো। ভাই আমাকে একটু শিখিয়ে দিবে কিভাবে মনের কথা বলতে হয়? আমি যেভাবে বলবো তাতে অন্য কোনো মেয়ে হলে তো পটে যাবে। কিন্তু কুহু তো তেমন মেয়ে না বলো। ওকে কী করে ইমপ্রেস করবো ভাই? তুমিই আমার একমাত্র আশা ভরসা।
একথা বলেই পিয়াশ আমাকে জড়িয়ে ধরলো। নিজেকে সামলাতে গিয়ে হাতে থাকা গোলাপটা চেপে ধরতেই কাঁটা গুলো হাতে ফুটে গেল। খানিকটা রক্ত বেরিয়েছে দেখা যাচ্ছে। বাইরের রক্তক্ষরণ তো দেখা যায় কিন্তু হৃদয়ে যে রক্তরক্ষণ হয় সেটা তো কাউকে দেখানো যায় না।
আমি পিয়াশের পিঠে হাত বুলিয়ে বললাম, চিন্তা করিস না। তোর ভাই থাকতে তোর চিন্তা কিসের!
পিয়াশ আমার হাত দুটো শক্ত করে ধরে বলল, লাভ ইউ ভাই। এ কী! তোমার হাতে তো কাঁটা ফুটে গেছে। উফফ কী যে করোনা তুমি। চলো নিচে গিয়ে ঔষুধ লাগিয়ে দিচ্ছি।
আমি মনে মনে বললাম, বাইরে ওষুধ লাগালে কী ভেতরের ক্ষত সারে? পৃথিবীতে এমন কোনো ওষুধ নেই যা মানুষের মনের ভেতরের ক্ষতকে সারাতে পারে। এই ক্ষত কেবল সেই মানুষটাই সারাতে পারবে। কিন্তু যেই মানুষটা কখনও আমার হবে না সে কী করে আমার ক্ষত সারাবে! সারাজীবন বুকের ভেতরে এই ক্ষত বয়ে বেড়াতে হবে। সারাজীবন।
___________________
রাতে খাবার টেবিলে খেতে বসে দেখলাম, কুহু নেই। সবাই তো আছে। কুহুকে দেখতে পাচ্ছি না কেন! এরমধ্যেই পিয়াশ ভাবিকে বলল, তোমার বোন কোথায়? খাবে না?
ভাবি বলল, কুহুর তো পা মচকে গেছে। ওই যে তখন ছাদে জামাকাপড় আনতে যাচ্ছিলো তখনই তো সিড়িতে পা টা মচকে গেল। খুব ব্যাথা করছে। তাই আমিই না করেছি আসতে।
তার মানে এই জন্যই তখন কুহু ছাদে আসতে পারেনি। হয়তো এটাই হওয়ার ছিল।
মা বলল, তাহলে ওর খাবারটা ঘরে দিয়ে এসো বউ মা। আহারে খুব ব্যাথা করছে নিশ্চয়ই মেয়েটার। আর তোমার মামার খাবারটা আলাদা করে রাখতে হবে। আজকে ফিরতে একটু দেরি হবে তার। চলো হাতে হাতে করে ফেলি দুজন। সবাইকে খেতে দিয়ে দেই।
ভাবি বলল, আচ্ছা মামি মা। সবাইকে খাবার দিয়েই আমি যাব কুহুর কাছে।
পিয়াশ মুখ ভার করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
একটু পরেই টুং করে আমার ফোনে একটা মেসেজ এলো। পিয়াশ মেসেজ করেছে_____
ভাই বলো না কী করলে কাদাবতীকে ইমপ্রেস করতে পারবো?
আমি ওকে রিপ্লাই করলাম_____
তুই বরং ওর জন্য ব্যাথার ওষুধ নিয়ে আয়।
পিয়াশ বলল, সাথে চকলেট আনবো? মেয়েরা তো চকলেট খেতে পছন্দ করে। যদিও আমি জানিনা কাদাবতী কী খেতে পছন্দ করে। তুমি কী জানো?
আমার তখন কক্সবাজারের কথা মনে পড়লো। সমুদ্র পাড়ে বসে আমি আর কুহু চা খেয়েছিলাম। সাথে ছিল কুহুর ফেভারিট বনরুটি। পিয়াশকে বললাম, আসার সময় দোকান থেকে বনরুটি নিয়ে আসিস। কুহু দুধ চায়ে বনরুটি ভিজিয়ে খেতে খুব পছন্দ করে। চা টা না হয় বাসায় করে নিবি।
উফফ ভাই ইউ আর গ্রেট!
পিয়াশ তৎক্ষনাৎ খাবার টেবিল থেকে উঠে পড়লো।
ভাবি বলল, এ কী উঠলে যে! খাবে না?
পিয়াশ যেতে যেতে বলল, এসে খাবো। আমার একটু কাজ আছে।
একথা বলেই পিয়াশ চলে গেল। আমার কিছু ভালো লাগছে না। হাতে কাটা ফুটায় খুব ব্যাথাও করছে। কিন্তু সেই ব্যাথা আমার মনের ব্যাথাকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। তীব্র যন্ত্রণায় ভেতরটা ভেঙ্গেচুরে যাচ্ছে। আমিও না খেয়ে উঠে পরলাম
মা বলল, এ কী তুই আবার উঠছিস কেন? পিয়াশ তো এসে খাবে বলল। তোদের দুই ভাইয়ের যে কী হয় না মাঝে মাঝে। ছোট থেকেই দুটোর সব কিছুতে মিল।
ভাবি বলল, তোমার হাতে কী হয়েছে তিয়াশ?
ওই কাঁটা ফুটে গিয়েছিলো কিভাবে যেন।
ভাবি মুচকি হেসে আস্তে বলল, প্রিয়তমার জন্য ফুল আনতে গিয়ে বোধহয় এই কান্ড বাঁধিয়েছো।
আমি কিছু বললাম না। স্বাভাবিক ভাবেই চলে যাচ্ছিলাম।
মা অস্থির হয়ে বলল, সে কী কথা! দেখি দেখি হাতখানা।
এতো অস্থির হয়ো না তো মা। পিয়াশ ওষুধ লাগিয়ে লাগিয়ে দিয়েছে।
দেখেছো বউ মা বলেছিলাম না! এরা হচ্ছে মানিকজোড়। এক ভাইয়ের ব্যাথায় আরেক ভাই ব্যাথা পায়। আয় আমি খাইয়ে দিচ্ছি নিজের হাতে।
ভালো লাগছে না মা। খেতে ইচ্ছে করছে না। প্লিজ জোর করো না।
আজকালকার ছেলে-মেয়েদের যে কী হয় বুঝি না বাপু আমি।
________________________
কুহু.
পায়ের ব্যাথা নিয়ে বসে থাকলে তো চলবে না আপা। কাল তো বাড়িতে ফিরতেই হবে। অফিস জয়েন করতে হবে গিয়ে। বস এমনিতেই আমার উপর রেগে থাকে সবসময়৷ কাল প্লিজ আমাদের আটকাস না।
আপা বলল, তুই আর তোর বস!
মা তুমি যে ডাক্তারের কাছ থেকে এলে তারপর তো আর আলাপ করা হলো না তোমার সাথে। কী বলল ডাক্তার?
পরীক্ষা নীরিক্ষা তো করলো। রিপোর্ট দেখে ওষুধ দিবে বলছে।
ভাবি আসবো?
আরে পিয়াশ! এসো এসো। অনুমতি লাগবে নাকি আবার আসার জন্য!
পিয়াশ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, পায়ের ব্যাথাটা তো এমনি এমনি কমবে না। তাই ওষুধ নিয়ে এলাম। ওষুধটা খেয়ে নিলে ভালো হতো।
আপা বলল, ওষুধ এনেছো? ভালোই হয়েছে।
আর এগুলো………
আরে! চা, বনরুটি! এটা তো কুহুর খুব প্রিয়।
পিয়াশ বলল, আচ্ছা ভাবি আমি তাহলে আসছি।
যাওয়ার আগে একবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল, মনে করে ওষুধটা খেয়ে নিবেন কিন্তু আপনি।
একথা বলেই পিয়াশ চলে গেল।
মা বলল, এই বাড়ির মানুষ গুলো ভীষণ ভালো। অনেক ভাগ্য করে এমন শ্বশুরবাড়ি পেয়েছিস পিহু। আল্লাহর কাছে কত কান্নাকাটি করতাম তোর আর ডাব্বুর জন্য। আল্লাহ ঠিক আমার কথা কবুল করছেন।
আপা বলল, সবটাই সম্ভব হয়েছে তিয়াশের জন্য। ছেলেটা সত্যিই খুব ভালো।
আপা আমার কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলল, তোর কত খেয়াল রাখছে দেখছিস! ছেলেটাকে ফিরিয়ে দিস না কুহু। খুব ভুল করবি তাহলে।
সত্যিই তো তিয়াশ আমার খুব খেয়াল রাখছে। আমি কী খেতে ভালোবাসি সেটাও ও জানে। আমার জন্য ভাইকে দিয়ে ওষুধ, খাবার পাঠালো। কক্সবাজারেও একবার আমাকে সারপ্রাইজ দিয়েছিলো। কাউকে ভালো না বাসলে কি কেই এতোটা ভাবে কারো জন্য! একটু একটু করে আমিও বোধহয় তিয়াশের উপর দুর্বল হয়ে পড়ছি। ওর কথা ভাবলে আনমনেই ঠোঁটের কোনো হাসি চলে আসে। এটাই কী ভালোবাসা?
চলবে……..