#চুপকথা-২৫
Zannatul Eva
কিছু বলছো না যে? কিছু তো বলো। তুমি যদি চাও তাহলে সময় নিতে পারো। এক্ষুনি হ্যাঁ বলতে বলছি না আমি। কিন্তু কিছু তো অন্তত বলো। টেনশনে আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
আমি আর পিয়াশ পাশাপাশি হাঁটছি। কিছুক্ষণ পর আমি পিয়াশকে বললাম, আমার একটু সময় চাই। আশা করছি আপনি আমাকে চিন্তাভাবনা করার জন্য সেই সময়টুকু দেবেন।
পিয়াশ বলল, ইট’স ওকে। আমি অপেক্ষা করবো তোমার উত্তরের জন্য। তুমি সময় নাও। আচ্ছা আমরা কি এখন একে অপরের ভালো বন্ধু হতে পারি? না মানে বন্ধু হতে তো দোষ নেই।
আমি ভারী গলায় বললাম, আমাদের মধ্যে তো একটা আত্মীয়তা আছেই। বন্ধুত্ব করার চেয়ে বন্ধুত্ব রক্ষা করা কঠিন। আচ্ছা ধরুন এখন আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব হলো। কিন্তু পরে যদি আমার উত্তরটা ‘না’ হয়! তাহলে কি তখন বন্ধুত্বটা নষ্ট হয়ে যাবে? পারবেন সারাজীবন শুধু বন্ধু হয়েই থাকতে?
পিয়াশের মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল। মলিন স্বরে বলল, কিন্তু আমি তো তোমার সবচেয়ে কাছের মানুষ হতে চাই। বন্ধুত্বের চেয়েও বেশি কিছু।
আমি জানতাম পিয়াশ শুধু বন্ধু হয়ে থাকার জন্য রাজি হবে না। পৃথিবীর সব ছেলে তো আর এক হয় না। একজন নিজের মনের সব কথা চেপে রেখে ভাইয়ের স্বপ্ন পূরণ করার জন্য আপ্রান চেষ্টা করছে আর আরেকজন শুধু নিজের কথাই ভাবছে।
পিয়াশ বলল, চলো তোমাকে বাসায় পৌঁছে দেই।
প্রয়োজন নেই। আমি ঠিক চলে যাব। আপনাকে কষ্ট করতে হবে না আমার জন্য। আমি আসছি।
একথা বলেই আমি চলে এলাম। রাতে বেলকনিতে বসে বসে তিয়াশের কথা ভাবছিলাম। ও হঠাৎ কেন আমাকে এভাবে ইগনোর করছে! বুঝতে পারছি না। নাকি আমার ভাবনা গুলোই ভুল ছিল? আমি যেটাকে ভালোবাসা ভেবেছিলাম সেটা হয়তো নিছকই একটা বন্ধুত্বের অনুভূতি ছিল। তিয়াশ হয়তো সত্যিই আমাকে নিয়ে কখনো এসব ভাবেনি।
মা এসে আমার দরজায় নক করলো। বলল, আজ কি বাচ্চাদের পড়াবি না?
হ্যাঁ পড়াবো। ওরা এলে ওদের একটু বসতে বলো। মাথাটা ভীষণ ঝিমঝিম করছে। তাই একটু রেস্ট নিচ্ছিলাম।
তোর বাবা মারা যাওয়ার পর সংসারের সমস্ত দায়িত্ব তোর কাঁধে এসে পড়লো। সেই এইটুকু বয়স থেকে সংসারের হাল ধরেছিস। যখন মন খুলে ঘুরেফিরে বেড়ানোর বয়স তখন সেই বয়সে মাসকাবারির হিসেব নিয়ে বসলি। চাকরির সাথে সাথে টিউশন শুরু করলি। ছোটো হয়েও আমাদের সবার দায়িত্ব নিলি। তুই কবে এতো বড় হয়ে গেলিরে কুহু?
ভাগ্যিস পড়াশোনাটা ধরে রেখেছিলাম। নয়তো কী করে সংসারের দায়িত্ব নিতাম বলো? চাকরি, টিউশন এসব কী করে করতাম! মেয়েদের পড়াশোনা করা যে কতটা দরকার সেটা এখন হারে হারে বুঝতে পারছি। শুধু বাবাই বুঝতে পারলো না। আপার পড়াশোনাটা শেষ না হতেই বিয়ে দিয়ে দিলো। তারপর কী হলো! আপা যদি পড়াশোনাটা শেষ করতো তাহলে কারো উপর নির্ভর হতে হতো না। তবে এখন জাহিদ ভাইয়া আছে তাই আর কোনো চিন্তা নেই। ভাইয়া খুব ভালো মানুষ। আপাকে ভীষণ সম্মান করে আর ভালো ও বাসে। ডাব্বু আর আপার জন্য আর কোনো চিন্তা নেই। আর কে বলেছে আমি বড় হয়ে গেছি? আজকে কিন্তু আমাকে খাইয়ে দিতে হবে। ঠিক ছোটবেলার মতো। না হলে কিন্তু আমি খাবোই না৷
তুই সত্যিই আর সেই ছোট্ট কুহুটি নেই৷ অনেক বড় হয়ে গেছিস। এবার তোকে একটা ভালো পাত্রের হাতে তুলে দিতে পারলেই আমার ছুটি। আর কিছু চাই না আমার।
আমি মা কে থামানোর জন্য বললাম, খুব খিদে পেয়েছে মা। তুমি গিয়ে খাবার বাড়ো আমি আসছি। তারপর আবার ওদেরকে পড়াতে বসবো। যাও যাও তাড়াতাড়ি যাও।
মা বলল, যাচ্ছি বাবা যাচ্ছি।
এরমধ্যেই হঠাৎ আমার ফোনটা বেজে উঠলো। তন্নীর ফোন। ফোন রিসিভ করে বললাম, হ্যাঁ বল।
তন্নী বলল, কী ব্যাপার মামা কোনো খোঁজটোজ নেই৷ প্রেম কেমন চলছে?
কিসের প্রেম?
তোর আর তিয়াশের প্রেম।
আমাদের মধ্যে কোনো প্রেম চলছে না। তিয়াশ আমাকে সেভাবে দেখে না। ও শুধু আমাকে বন্ধু ভাবে। কিন্তু একটা সত্যি কথা কি জানিস! ধীরে ধীরে কিভাবে যেন আমি তিয়াশের উপর খুব দুর্বল হয়ে পড়েছি। জানিনা কিভাবে এমনটা হলো।
আমি তো প্রথমেই বলেছিলাম তোদের দুজনের মধ্যে কিছু একটা তো হবেই। তবে তিয়াশ হয়তো তোর কাছে ব্যাপারটা চেপে যাচ্ছে। হয়তো ও চাইছে যেন তুই ওকে কথাটা বলিস। তাই হয়তো নিজে থেকে কিছু বলছে না।
আরে না। সেরকম হলে তো কোনো সমস্যাই ছিল না। আমি আমার মনের অনুভূতি ওকে জানিয়েছি। কিন্তু ও যেটা বলল সেটার জন্য আমি কোনো ভাবেই প্রস্তুত ছিলাম না।
কী এমন বলেছে?
ও বলেছে ওর কাজিন পিয়াশ আমাকে ভালোবাসে। ও না। ও শুধু আমাকে বন্ধু ভাবে। বিশ্বাস কর তন্নী আমার পিয়াশকে একদমই পছন্দ না। ওকে দেখলেই আমার কেমন ইরিটিটিং লাগে।
তাহলে না করে দে।
সেটা করতে পারলে তো বেঁচেই যাই। সেটা তো পারছিনা তিয়াশের জন্য। ও বলেছে ওর ভাই যেন কষ্ট না পায়। আমি যদি সত্যিই ওকে ভালোবেসে থাকি তাহলে যেন ওর ভাইয়ের প্রপোজাল এক্সেপ্ট করে নিই। আমি বোধহয় তিয়াশকে ভালোবেসে ফেলেছি। তাই ওর কথা ফেলতেও পারছিনা। আবার পিয়াশকে কিছুতেই এক্সেপ্ট করতে পারছি না। কারণ দুই নৌকায় পা দিয়ে চলা যায় না। যাকে ভালোবাসি তাকে ছেড়ে তারই ছোটো ভাইকে ভালোবাসতে পারবো না আমি।
তন্নী বলল, তাহলে তুই সেটা ডিরেক্ট জানিয়ে দে পিয়াশকে। তোর মন যেটা চায় তুই সেটাই কর। ভালোবাসা অন্তত জোর করে হয় না দোস্ত। এখানের মনের জোর চলে। অন্য কারো কথায় কখনও নিজের মনের অনুভূতি পাল্টে ফেলা যায় না। সেটা কোনো ভাবেই সম্ভব নয়। তুই পিয়াশকে বলে দে যে তুই তিয়াশকে ভালোবাসিস।
দুই ভাইয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করতে চাইছি না আমি। তাই আমি পিয়াশের কাছ থেকে সময় চেয়েছি। তবে সময় নিই আর যাই করি। আমার উত্তর সবসময়ই “না” হবে।
দেখ যেটা তোর ভালো মনে হয় সেটাই কর। রাখছি তাহলে সানি তখন থেকে ফোন করে যাচ্ছে। দেখছে ফোনটা এনগেজড তারপরও কন্টিনিউয়াসলি কল করে যাচ্ছে। এটাকে নিয়ে আর পারলাম না।
আচ্ছা কথা বলে নে আগে। বাই তাহলে।
টাটা।
ফোন রেখে আমি বুকশেলফ থেকে বই নিতে এলাম। হঠাৎ তিয়াশের সেই ডায়েরিটা আমার চোখে পড়লো। আরে! এটা তো পড়াই হলো না আর। নিশ্চয়ই গানের ডায়েরি হবে। গান ছাড়া আর এমন কী লিখবে!
ডায়েরিটা খুলে কয়েকটা পাতা উল্টাতেই দেখলাম একটা পাতায় অনেক কিছু লেখা_____
“যেদিন তোমাকে প্রথম দেখেছিলাম ঠিক সেই মুহুর্ত থেকেই আমার তোমাকে ভালো লেগেছিলো। আমাদের বারবার দেখা হওয়াটা কাকতালীয় ছিল কিনা জানিনা কিন্তু কিছু তো একটা ব্যাপার ছিল। নয়তো বারবার তোমার সাথে কেন দেখা হবে বলো! তোমার চুল, তোমার হাসি, তোমার চোখ সবটাই আমাকে মুগ্ধ করেছে। তোমার কথা বলার ধরন, তোমার উদারতা সব কিছু আমাকে ছুঁয়ে গেছে। তোমাকে আমি মনে মনে মায়াবতী বলে ডাকি। যার মায়া আমাকে সারাক্ষণ আচ্ছন্ন করে রাখে। তোমার ব্যক্তিত্ব বরাবরই আমাকে মুগ্ধ করে। আমি শুধু তোমার হাসির প্রেমে পড়িনি আমি তোমার ব্যক্তিত্বের প্রেমেও পড়েছি। আমি তোমাকে ভালোবাসি মায়াবতী। খুব ভালোবাসি। তুমি আমার হবে কুহু?
লেখাটা পড়া মাত্রই আমার হাত-পা কাঁপতে শুরু করলো। আমি তাহলে সত্যিই ভেবেছিলাম। আমার ভাবনা ভুল ছিল না। তিয়াশ আমাকে ভালোবাসে। কিন্তু ওর ভাইয়ের জন্য আমার কাছ থেকে সমস্ত কথা লুকিয়ে গেছে। ঠিক আছে। তুমি যদি নিজের ভালোবাসাকে এভাবে বিসর্জন দিতে পারো তাহলে আমিও দেখতে চাই যে, তুমি তোমার নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে নিজেরই ভাইয়ের বউ হিসেবে কী করে মেনে নাও। তোমার সহ্য ক্ষমতা কত সেটা এবার আমিও দেখতে চাই।
আমি তৎক্ষনাৎ পিয়াশকে ফোন করলাম৷ পিয়াশ ফোন তুলতেই বললাম, আমি আপনার সাথে দেখা করতে চাই। কোথায়, কখন সেটা আমি পরে জানিয়ে দিবো। কাল অবশ্যই আপনি আসবেন। ইট’স আর্জেন্ট।
চলবে……..