চুপকথা পর্ব-৩

0
1891

#চুপকথা-৩
Zannatul Eva

উপরওয়ালা হয়তো চাইছেন মায়াবতী সবসময় আমার চোখের সামনে থাকে। ওকে দেখার জন্য, জানার জন্য আমাকে যেন বারবার ওই কফিশপে ছুটে না যেতে হয় সেই জন্যই বোধহয় ওকে একদম আমার হাতের নাগালে নিয়ে এলো।

আমি মৃদু হেসে বললাম, বলুন আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি!

এটা আপনার…….!

হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন। তবে আমার নয় আমাদের। মানে আমার বাবার অফিস। আজ সকালেই আমি এখানে জয়েন করেছি। তাও বাবার জোরাজুরিতে। আমার আসলে নিজে থেকে কিছু করার ইচ্ছে আছে। এটা তো বাবার কোম্পানি। আমি চাই আমার নিজের আলাদা একটা পরিচয় হোক। আপনি হঠাৎ এখানে?

কুহু শান্ত গলায় বলল, আমার একটা চাকরির খুব দরকার।

আমি কপাল কুঁচকে বললাম, আপনি তো অলরেডি একটা চাকরি করছেন। তাহলে!

হ্যাঁ তবে ওখান থেকে যদি বেশি বেতনের চাকরি পাই তাহলে ওটা ছেড়ে দিবো। আমাকে আমার এক কলিগ আপনার মানে আপনার বাবার অফিসের ঠিকানাটা দিয়ে বলেছিলো এখানে ট্রাই করতে। ইন্টারভিউয়ের জন্য আমাকে ডাকা হয়েছে।

একথা বলেই কুহু নিজের হাতের ফাইলটা আমার দিকে এগিয়ে দিলো।

আমি ফাইলটা নেড়েচেড়ে বললাম, আপনি কাল থেকে জয়েন করুন।

কুহু অবাক হয়ে বলল, আপনি তো আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। এভাবে কিছু না জেনে শুনে আমাকে চাকরি দিয়ে দিলেন! এটা তো ঠিক না।

আমি মৃদু হেসে বললাম, আমি তো আপনাকে আগে থেকেই চিনি। তাহলে শুধু শুধু আপনার ইন্টারভিউ নিয়ে বিব্রত করার কী দরকার!!

দেখুন মি.

তিয়াশ। তিয়াশ আহমেদ।

দেখুন মি. তিয়াশ আহমেদ, আমি চাই না কেউ আমাকে এমনি এমনি চাকরি দিক। আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং আমার সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে তারপর যদি মনে হয় আমি এই কাজটার জন্য যোগ্য তবেই আমাকে সিলেক্ট করা হলে আমি খুশি হবো। আমি ফ্রি তে কিছু পেতে পছন্দ করি না৷ যোগ্যতা দিয়ে অর্জন করতে চাই।

আসলে আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন। আমি চাই কোনো রকম ঝামেলা ছাড়াই আপনার চাকরিটা হোক। আপনার সুবিধার জন্যই।

ওই যে বললাম, কুহেলিকা ফ্রিতে কিছু পেতে পছন্দ করে না। আসছি, ধন্যবাদ।

একথা বলেই কুহু আমার কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল। আমি অদ্ভুত দৃষ্টিতে ওর চলে যাওয়া দেখছিলাম। একটা মানুষের সব কিছু কী করে এতোটা মুগ্ধ করতে পারে কাউকে! কিছুক্ষণ আগেও তোমাকে কেবল মায়াবতী ভাবতাম। কিন্তু তুমি শুধুই মায়াবতী নও। তুমি আত্মবিশ্বাসী এবং চমৎকার এক নারী। যেখানে আজকাল মানুষ একটা চাকরির পাওয়ার আশায় যে কোনো কিছু করতে রাজি থাকে সেখানে তুমি এভাবে আমাকে প্রত্যাখ্যান করে চলে গেলে! এই জন্যই হয়তো তুমি আলাদা। তাই তোমার প্রতি আমি বারবার আকর্ষিত হই। তোমাকে আরও বেশি জানতে ইচ্ছে করছে। আরও বেশি কৌতূহলী হয়ে উঠছি আমি। কিন্তু বারবার তুমি হারিয়ে যাচ্ছো। তবে আমি জানি আমাদের আবার দেখা হবে। হতেই হবে।
কারন মায়াবতী ভুল করে নিজের ফাইলটা ফেলে চলে গেছে। এই ফাইলের সূত্র ধরেই আমাদের আবারও দেখা হবে। খুব শীঘ্রই।
_________________________

কুহু.
ডাব্বু খেয়েছে বড় আপা? ঘুম পারিয়ে দিয়েছো তো? পড়তে বসিয়েছিলে? ঘুমানোর আগে দুধটা খাইয়েছো?

বড় আপা আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে হেসে বলল, আপনার রাজপুত্রকে পড়াশোনা করিয়ে, খাবার খাইয়ে তারপর ঘুম পারিয়েছি। ও হ্যাঁ ঘুমানোর আগে তাকে দিয়ে দুধের গ্লাস পুরো ফিনিশ করিয়েছি। আর কিছু ম্যাডাম?

আমি হেসে বললাম, ওভাবে বলছো কেন গো? জানোই তো ডাব্বু আমার কত আদরের। খালামনি হয়ে এটুকু খেয়াল রাখতে পারবো না!!

আদর দিয়ে দিয়ে বাদর হচ্ছে। হ্যাঁ রে কুহু নতুন চাকরিটা হলো? আজকে ইন্টারভিউ ছিল না?

হয় নি। আমিই করবো না বলে দিছি।

বড় আপা অবাক হয়ে বলল, কেন?

একটা ছেলে। আমার সাথে মাত্র দু’দিন দেখা হয়েছে। তাও সে আমাকে ভালো মত চেনে না সে কি না আমাকে বলল ইন্টারভিউ ছাড়াই আমার চাকরি কনফার্ম হয়ে গেছে! কেমন অদ্ভুত না! আর তুই তো জানিস ফ্রিতে কিছু নেয়া আমি একদমই পছন্দ করি না। তাই না করে দিয়েছি। অন্য কোথাও ট্রাই করবো। কোথাও না কোথাও হয়ে যাবে।

আরে ছেলেটা হয়তো ভালো তাই তোকে ইন্টারভিউয়ের ঝুট-ঝামেলায় ফেলতে চায় নি। তাই বলে তুই না করে দিবি! একটু বেশি বেশি হয়ে গেল না?

ছেলেটাকে অবশ্য দেখে খারাপ মনে হয় না কিন্তু তাও ফ্রিতে চাকরির অফার দেয়া মানুষদের বিশ্বাস করতে নেই। এরাই তারপর সুযোগ পেলে আসল রূপ বের করে। চিন্তা করিস না। কোথাও না কোথাও ঠিক একটা চাকরির ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

বড় আপা বলল, এত কনফিডেন্স কী করে পাস বল তো? তোর থেকে বয়সে বড় হয়েও আমি নিজেকে শক্ত রাখতে পারি না। তোর এই ধৈর্য্য শক্তির জন্যই হয়তো একদিন তুই অনেক দূর যাবি।

বয়সটা কোনো ব্যাপার না বড় আপা। নিজের মনকে কন্ট্রোল করতে পারলেই সব সহজ।

বড় আপা একটা হাসি দিয়ে বলল, চা খাবি?

হলে মন্দ হয় না।

আমি এক্ষুনি বানাচ্ছি ওয়েট।

আমি ততক্ষণে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। বড় আপা চা করে নিয়ে এলো। দুজন একসাথে বসে চা খেলাম৷ বড় আপা ঘুমোতে চলে গেল। হঠাৎ করে ফোনটা বেজে উঠলো। তন্নী ফোন করেছে। আমি বেলকনিতে গিয়ে ফোনটা রিসিভ করলাম।

ওপাশ থেকে তন্নী বলল, দোস্ত হুট করেই ট্যুর প্ল্যান করে ফেললাম।

আমি বেলকনির গাছ গুলোতে হাত বুলিয়ে বললাম, ভালো তো। তা কোথায় ট্যুর দিচ্ছিস? একা নাকি বয়ফ্রেন্ড নিয়ে?

তন্নী বলল, একলা ট্যুর দিয়ে মজা আছে! সানির বন্ধুরা সবাই মিলে কক্সবাজার যাচ্ছে। ও আমাকেও যেতে বলল। বয়ফ্রেন্ড একলা ছাড়ার জিনিস না দোস্ত। তাই চট করে আমিও যাবো বলে দিছি।

আমি হেসে বললাম, তুই পারিস বটে। বেচারাকে এখনও সন্দেহ করিস?

তন্নী জোরালো কন্ঠে বলল, সন্দেহ করি না। কিন্তু ওর মাইয়া বান্ধবী গুলারে দিয়া বিশ্বাস নাই। আমার ভালো বয়ফ্রেন্ডটার মাথা চিবিয়ে খেয়ে ছাড়বে একলা পেয়ে। তার চেয়ে যখন যাওয়ার চান্স পাচ্ছি তাহলে শুধু শুধু মিস করবো কেন এমন সুযোগ!!

আঙ্কেল যেতে দিবে তোকে?

আমি একলা যাচ্ছি নাকি? তুইও তো যাচ্ছিস। আর তুই সাথে যাচ্ছিস শুনলে বাপি জীবনেও না করবে না। তুই তো জানিস বাপি তোকে কত ভরসা করে। আমার চেয়েও বেশি।

আমি অবাক হয়ে বললাম, আমি যাচ্ছি মানে? কেমনে কী!! আমি যেতে পারবো না। আমার প্রচুর কাজ আছে। তাছাড়া ট্যুর দেয়ার মতো হাতে এত টাকা-পয়সাও নেই। তুই যা।

তন্নী রেগেমেগে বলল, তোর যাওয়ার সব খরচ আমার। তুই খালি আমার সাথে যাবি। প্লিজ দোস্ত আমার মন ভাঙ্গিস না। সানিটা আমাকে রেখে একলা চলে গেলে আমি এখানে টেনশনেই মরে যাবো। প্লিজ দোস্ত তুই আমার একমাত্র ভরসা।

আরে আমার তো ছুটি নাই। বস ছুটি দিবে না কিছুতেই। কিভাবে যাবো আমি?

তোর বসের কপালে ঝাড়ু। ব্যাটা তোকে দিয়ে গাদাগাদা কাজ করায় আর স্যালারি দেয়ার বেলায় কঞ্জুস। ও ব্যাটারে একটা শিক্ষা দেয়া দরকার। তুই ছাড়া যে ওর অফিস চলবে না সেটা একটু ফিল করতে দে। ক’দিন বেপাত্তা হয়ে যা। দেখবি ব্যাটা ঠিক হয়ে গেছে।

বললেই হলো! আমি যেতে পারবো না। আমাকে ছাড় প্লিজ।

আমি কিছু জানিনা। তুই যাচ্ছিস আমার সাথে এটাই কনফার্ম।

আরে…….

যাহ! ফোন কেটে দিলো তুফানি! এই মেয়ে আসলেই একটা তুফানি৷ সানির কপালে যে কী দুঃখ অপেক্ষা করছে!

ফোনটা রেখে ব্যাগ থেকে ফাইলটা বের করতে গিয়ে হঠাৎ মনে পড়লো, আমি তো ফাইলটা আনতে ভুলে গেছি। শীট! কি যেন ওই ছেলেটার নাম! তিয়াশ। হ্যাঁ তিয়াশ আহমেদ। নাম্বারও তো নেই যে ফোন করে জিজ্ঞেস করবো ফাইলের কথা। এখন আমাকে আবারও ওখানে যেতে হবে। এই ভুলো মন নিয়ে আমি কী করি! সব ভুলে যাই। এত কনফিডেন্স নিয়ে কথা বলে আসলাম আর ভুল করে নিজের ফাইলটাই রেখে চলে এসেছি। ধুর!

এমন সময়ই ফোন বেজে উঠলো। স্ক্রিনে অচেনা নাম্বার দেখে আমি তাড়াতাড়ি করে ফোনটা রিসিভ করলাম।

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here