#চুপকথা-৪
Zannatul Eva
তিয়াশ.
মায়াবতীকে নিজে থেকে ফোন করে এখন নিজেই বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। কী বলে কথা শুরু করবো ভেবে পাচ্ছি না। ওর কন্ঠস্বর শুনে বারবার মনে হচ্ছে, কারো কন্ঠ এত মধুর হতে পারে! তুমি মায়ার আবরণে মিলে মিশে একাকার বলেই তোমাকে আমার মায়াবতী ডাকতে ভালো লাগে।
কুহু ওপাশ থেকে বলল, হ্যালো কে বলছেন? কে? হ্যালো!
আমি মৃদু স্বরে বললাম, আপনার ফাইলটা ভুলে আমার অফিসে ফেলে চলে গেছেন। বায়োডাটা থেকে আপনার নাম্বারটা পেলাম। সময় করে এসে ফাইলটা নিয়ে যাবেন।
কুহু অস্থির গলায় বলল, আমি আসলে অনেক সরি। এই ভুলো মনার জন্য আর কী কী যন্ত্রণা পোহাতে হবে কে জানে। আমি কালকেই এসে নিয়ে যাবো। ভালো থাকবেন। শুভ রাত্রি।
এ কথা বলেই কুহু ফোন রেখে দিলো। কিন্তু আমার আরও কিছুক্ষণ ওর মায়াভরা কন্ঠস্বর শুনতে ইচ্ছে করছিলো। তবে কিছু অপেক্ষা মধুর হয়। কাল সকাল হলেই আমি যাকে চোখের সামনে দেখতে পাবো তার কন্ঠস্বর শোনার জন্য এখন এত অস্থির না হলেও চলবে।
কিছুক্ষণ পর হঠাৎ করে ফোনটা বেজে ওঠায় আমি বেশ চমকে গেলাম। ভাবলাম বোধহয় মায়াবতীর কল৷ কিন্তু না। রাতের বেলা এই সানি ব্যাটা ছাড়া আর কে আমার মাথা খাওয়ার জন্য ফোন করতে পারে!
হ্যাঁ বল।
কিছু ভাবলি? পরশু কিন্তু আমরা কক্সবাজার ঘুরতে যাচ্ছি। আঙ্কেলকে বলেছিস?
না বলিনি। আর আমার যাওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই। তোরা যা।
সানি বলল, ব্যাপার কী তোর? হঠাৎ এত ভাও খাচ্ছিস যে! আমাদের তো প্ল্যান হয়েছিলো আমরা যাবো। তাহলে এখন না করছিস কেন?
তোর কক্সবাজারের সৌন্দর্যের চেয়েও এখানে অপরূপ এক সৌন্দর্য আছে। তা ফেলে এত দূর কেন যাবো শুধু শুধু!
ঝেড়ে কাশো মামা। প্রেমেটেমে পড়েছিস নাকি?
প্রেম কিনা জানিনা তবে মায়ায় আটকে গেছি দোস্ত।
মেয়েটা কে?
জানিনা। শুধু নামটাই জানি।
তুই তো গেছিস মামা।কিন্তু আঙ্কেল তো তোর বিয়ে ঠিক করেছে রিয়ার সাথে। ভেবেছিস কী হবে!!
রিয়া আমাকে বিয়ে করবে না৷ ওর বয়ফ্রেন্ড আছে। তাছাড়া ওকে আমারও পছন্দ না। আমি যেমন চাই ও তেমন না।আমি এখন বিয়েটাই করতে চাইছি না। কিন্তু বাবাকে কে বোঝাবে বল! ছোট থেকে শুধু হুকুম পালন করে যাচ্ছি।
সানি বলল, তাহলে তুই আমাদের সাথে কক্সবাজার ট্যুরে যাচ্ছিস না?
না।
তারপরও ভেবে দেখিস একবার।তোকে ছাড়া ট্যুর জমবে না। প্লিজ মামা ভেবে দেখ আরেকবার।
তুই তো গার্লফ্রেন্ড নিয়ে যাচ্ছিস তাহলে সমস্যা কোথায়!
ওইটা গার্লফ্রেন্ড!! তোর ওকে গার্লফ্রেন্ড মনে হয়!
মনে না হওয়ার কী আছে! যদিও কখনও দেখিনি কিন্তু গার্লফ্রেন্ডকে তো গার্লফ্রেন্ডই বলব নাকি!
ওইটা আস্ত একটা প্যারার কারখানা।সারাক্ষণ প্যারার উপরে রাখে আমাকে। জাস্ট একবার মুখের বলা বলছি যে তুমিও চলো আমাদের সাথে ট্যুরে।ওমনি রাজি হয়ে গেল। এখন আমার ট্যুর আর ট্যুর থাকবে না।মনে হবে টিচারদের সাথে গেছি। সারাক্ষণ এটা কেন করলাম, ওটা কেন করলাম, ওই মেয়েটার দিকে কেন দেখলাম।
আমি হাসতে হাসতে বললাম, তোদের এসব শুনে প্রেমের ইচ্ছে নাই হয়ে গেছিলো। কিন্তু ওকে দেখার পর থেকে আমার পুরো ভাবনাটাই বদলে গেল। ও একদম অন্যরকম।
প্রথম প্রথম সবই অন্যরকম লাগে মামা। কয়েকটা দিন গেলে তখন সব ঘেটেঘুটে শেষ। প্রেমময় জীবন প্যারাময় জীবনে পরিনত হয়৷ তুই কিন্তু আরও একবার ভেবে দেখিস। তোকে ছাড়া ট্যুর জমবে না৷ রাখছি এখন।
______________________
সকালে অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিলাম এমন সময় মা এসে বলল, একটা সুখবর আছে।
এই একটা মানুষকে আমার পৃথিবীর সবচেয়ে মায়াবী নারী বলে মনে হয়। তবে কুহুকে দেখার পর থেকে মনে হচ্ছে আমার মায়ের পরে যদি কোনো মায়াবী নারী থেকে থাকে তাহলে সেটা কুহু।
সে যাই হোক। আমার মা। জাহানারা ইমাম। নানাভাইয়ের নামের সাথে মিল রেখে মায়ের নাম রাখা হয়েছিলো, জাহানারা ইমাম। এ বাড়ির সবচেয়ে শান্তশিষ্ট সদস্য। বাবার সাথে কখনও মন খুলে কথা বলতে পারে না। কারন বাবা কখনও কারও কথার মূল্যায়নই করে না। মায়ের মতো একটা মানুষ কী করে যে বাবার সাথে সংসার করে যাচ্ছে এতগুলো বছর ধরে তা বোঝা মুশকিল। মায়ের গানের গলা বেশ ভালো ছিল। বিয়ের আগে গান করতো। বাবার সাথে বিয়ে হওয়ার পর থেকে সব কিছু ভুলে গেছে। নিজের সাধ আহ্লাদ বলতে কিছুই নেই এখন।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললাম, কী সুখবর? এ বাড়িতে তো মন খারাপ করা খবর ছাড়া আর কোনো খবর আসতে দেখি না কখনও। হঠাৎ করে সুখবর কোথা থেকে এলো!
মা বলল, রিয়া তোকে বিয়ে করবে না।
আমি হতাশ হয়ে বললাম, সেটা আমিও জানি রিয়া আমাকে বিয়ে করতে চায় না। কিন্তু তাতে কী হবে! বাবাকে কে বোঝাবে? আর ও তো ওর বাবাকেও এটা বলতে পারছে না। সবটা আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে দিব্যি আছে। এখন আমি যদি বলি আমি বিয়ে করতে চাই না তাহলে বাবা কী করবে ভাবতে পারছো?
মা হাসতে হাসতে বলল, তোকে কিছু করতে হবে না। রিয়ার বাবাই ফোন করে বলল তোর বাবাকে সবটা। এখন লজ্জায়, অপমানে নিজেই ঘরের দরজা বন্ধ করে ঘাপটি মেরে বসে আছে। ঠিক হয়েছে। বিয়ে করবে ছেলে। আর বউ পছন্দ করবে তার বাপ! সব ব্যাপারে নিজের পছন্দ অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার অভ্যেস কবে যাবে তোর বাবার বলতো?
আমি খুশিতে মাকে জড়িয়ে ধরলাম। ইতোমধ্যেই বাবা চলে এলো। বলল, মনির যেটা করেছে একদম ঠিক করেনি। ও আমার বন্ধু হয়ে কথার খেলাপ করেছে। অবশ্য আজকালকার ছেলে-মেয়ে গুলো খুবই বেয়াদব। বাবা-মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে প্রেম ভালোবাসার কথা বলে। সে যাই হোক, পৃথিবীতে মেয়ের অভাব নেই। ওর মেয়ের থেকে হাজার গুন ভালো মেয়েকে আমি আমার ছেলের বউ করে নিয়ে আসবো। তুমি অফিস যাবে না?
আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালাম।
বাবা বলল, এটা কী পরেছো? এই শার্টটায় তোমাকে একদম মানাচ্ছে না। আর এটা কী টাই পরেছো!! এখনও নিজের জন্য বেস্ট জামাকাপড়টাই চুজ করতে পারে না সে কী করে নিজের জন্য বউ চুজ করবে!! এসব দায়িত্ব বাবা-মায়ের উপরই ছেড়ে দেয়া উচিত।
বাবা আলমারি থেকে অন্য একটা শার্ট আর টাই বের করে বলল, পারফেক্ট। চেঞ্জ করে নাও।
একথা বলেই বাবা চলে গেল। আমার মাথাটা আবারও চট করে গরম হয়ে গেল।মায়ের দিকে তাকিয়ে বললাম, দেখেছো! আবারও নিজের পছন্দ অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছে। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে মা।
মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কয়টা দিন কোথাও ঘুরে আসতে পারিস তো।দম আটকে যাওয়ার আগে কোথাও চলে যা। একটু প্রান খুলে শ্বাস নিয়ে আয়।
আমি মনে মনে বললাম, মায়াবতীর ঘোর না কাটা পর্যন্ত অন্য কোথাও হারাতে পারবো না মা। অবশ্য মায়াবতীর ঘোর আদৌ কখনও কাটবে কিনা জানিনা।
আমি চেঞ্জ করে অফিস চলে এলাম। মায়াবতীর জন্য অপেক্ষা করছি। অফিসে আসার কারন একটাই। সেটা হলো মায়াবতী। এছাড়া আমার অফিসে এসে কোনো কাজ নেই। আমাকে কিছুই করতে হয় না৷ বাবা আগে থেকেই সব কাজ করে রাখে। আমি শুধু বসে থাকি। ব্যাপারটা আমার কাছে চরম অপমানের বলে মনে হলেও বাবার তাতে কিছু যায় আসে না। আমি কি এতোটাই অকাজের? কাজ না করলে শুধু শুধু অফিসে আসার কী দরকার!! এসব ভাবলে আমার আবারও দম বন্ধ হয়ে আসে।
ইতোমধ্যেই মায়াবতী চলে এলো। এক মুহুর্তেই আমার সমস্ত অস্থিরতা দূর হয়ে গেল। খুব সাধারণ তবুও অসাধারণ এক নারী। পরনে সাদা সেলোয়ার-কামিজ, হাত ভর্তি সাদা কাঁচের চুরি, কপালে স্টোনের টিপ, খোলা চুল। মুখে সেই টোল পড়া হাসি। কুহুই একমাত্র নারী যাকে আমার মায়ের মতো এত মায়াবী দেখতে লাগে।
আমি চোখ সরিয়ে নিয়ে বললাম, আমি আপনারই অপেক্ষা করছিলাম।
কুহু বলল, কেন?
আপনাকে দেখবো বলে।
কী!
না মানে আপনাকে ফাইলটা ফিরিয়ে দেবো সেই জন্য। এত তাড়াতাড়ি আসবেন ভাবিনি।
কুহু হেসে বলল, আসলে আমি কয়েকদিন ঢাকার বাইরে থাকবো। হাতে অনেক কাজ। সেগুলো শেষ করতে হবে। ফাইলটা নিয়ে গেলে আমি একটু হাফ ছেড়ে বাঁচবো। এত ভুলো মন আমার। ভীষণ টেনশনে ছিলাম। ফাইলটা হারিয়ে না যায় কোনোভাবে সেইজন্য।
হারাতে দিলে না হারাবে! খুব যত্নে রাখবো সারাজীবন।
কিছু বললেন?
হুম! না কিছু না। আপনি কী খাবেন? চা না কফি?
আমাকে এক্ষুনি অফিস যেতে হবে। সব কাজ শেষ করতে হবে। হাতে একদম সময় নেই। ভালো থাকবেন।
একথা বলেই কুহু চলে গেল। কুহু যেহেতু ঢাকার বাইরে চলে যাচ্ছে তাহলে আমিই বা শুধু শুধু এখানে থেকে কী করবো! এর থেকে ভালো সানির সাথে কক্সবাজার ট্যুর দিয়ে আসি।
সানিকে ফোন করে বলে দিলাম আমি যাবো।
__________________
মহাখালী বাস টার্মিনালে পৌঁছে গিয়ে দেখলাম এই ট্যুরে কুহুও আমাদের সাথে যাচ্ছে। আমি কুহুকে দেখে যতোটা না অবাক হয়েছি তার চেয়ে বেশি অবাক হয়েছে কুহু। পরে সানির থেকে জানতে পরলাম, তন্নী মানে কুহুর বান্ধবী তন্নীই হলো সানির গার্লফ্রেন্ড। ভাগ্যিস ওরা এই ট্যুরটার প্ল্যান করেছিলো। উপরওয়ালাকে বারবার ধন্যবাদ দিচ্ছিলাম আমাকে কুহুর সন্নিকটে এনে দেওয়ার জন্য।
এরপর ঠিক সময়ে আমাদের কক্সবাজার যাত্রা শুরু হলো।
চলবে……..