চুপকথা পর্ব-৫

0
1616

#চুপকথা-৫
Zannatul Eva

কুহু.
গাড়ি ছুটে চলছে আপন গতিতে। আমি আর তন্নী এক সিটে বসেছি। তন্নী সানির সাথে বসবে বলছিলো কিন্তু আমি একা একা বোর হবো সেইজন্য আমার সাথেই বসে আছে বেচারি। কিন্তু আমি ওকে বারবার করে বলেছি সানির সাথে গিয়ে বসতে। প্রেমিক-প্রেমিকা বাসে পাশাপাশি সিটে বসে যাবে তার মধ্যে আমি ভিলেন হয়ে ঢুকে পড়লাম। একদম কাবাব মে হাড্ডি। আমি তন্নীকে আবারও বললাম, যা না ওর সাথে গিয়ে বোস।

তন্নী রাগি স্বরে বলল, কার সাথে গিয়ে বসবো আমি! দেখছিস না কেমন হাসাহাসিতে মেতে আছে। আমাকে তো একবারও বলল না ওর সাথে বসার জন্য। বন্ধুর সাথে বসে দিব্যি আছে।

আমি হেসে বললাম, সেটা তো সানিও বলতে পারে। হয়তো ওর বন্ধু বোর হবে বলে ও বেচারাও কিছু বলতে পারছে না। যেমন তুই আমার জন্য ভাবছিস।

তন্নী বলল, তুই চুপ কর। ওর খবর আমি জানিনা! আমাকে তো ও প্যারা মনে করে। ভুল করে বলে ফেলেছে একসাথে ট্যুর দেয়ার কথা। এখন তাই ইগনোর করছে।

ইতোমধ্যেই বসের ফোন চলে এলো। আমি একটু ঘাবড়ে গেলাম। তন্নীকে বললাম, ফোন করে কী বলবো!

তন্নী কপাল কুঁচকে বলল, ছুটি নিস নি তুই?

আমি না সূচক মাথা নাড়িয়ে বললাম, তোর মনে হয় ও ব্যাটা আমাকে ছুটি দেবে? আর কাল ওনার মেজাজ ভীষণ বিগড়ে ছিল তাই বলার সাহসও পাই নি। তোর জন্য আমি এত বড় একটা রিস্ক নিলাম। এরপর না আমার চাকরিটাই চলে যায়।

তন্নী আমার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে সুইচড অফ করে দিয়ে বলল, চিল মামা। ফোন রিসিভ করার কোনো দরকার নাই। ওটাকে একটু টাইট দেয়া দরকার। ফোন তুলবি না। ট্যুর দিয়ে এসে অফিস গিয়ে বলবি, অসুস্থ ছিলি। মানুষের অসুখ বিসুখ হতেই পারে।

মিথ্যে বলবো?

শোন, কখনো কখনো নিজের ভালোর জন্য একটু আধটু মিথ্যে বললে ক্ষতি হয় না। বরং ভালোই হয়। তুইও তো মানুষ। তোরও তো রিফ্রেশমেন্ট দরকার। সারাক্ষণ তোকে দিয়ে খাটায় আর স্যালারি বাড়ানোর বেলায় যত কিপ্টামি। ওর কপালে ঝাড়ু।

কিন্তু এভাবে ফোন টোন সুইচড অফ করে নেটওয়ার্কের বাইরে চলে গেলে বাসার সাবই তো চিন্তা করবে।

আমার ফোন থেকে ফোন করে নিবি আন্টিকে।

তারপরও……….

পুরো কথা শেষ করার আগেই তন্নী আমার কানে ইয়ারফোন গুঁজে দিয়ে বলল, থাম তো। গান শোন আর জার্নিটা এনজয় কর।

তন্নীর ফোনে সব ইংলিশ গান। গান বাজতে বাজতে এক সময় “Dust till down” গানটা শুরু হলো_____
Not tryna be indie
Not tryna be cool
Just tryna be in this
Tell me how you choose

Can you feel why you’re in this
Can you feel it through
All of the windows
Inside this room.

Cause I wanna touch you, baby
And I wanna feel you, too
I wanna see the sunrise and your sins.
Just me and you
Light it up, on the run.
Let’s make love, tonight
Make it up, fall in love, try…….

এই গানটা আগে এতোবার শুনেছি যে, এটার উপর এখন একরকম বিরক্তি এসে গেছে। এই গানটা আমি শুনতে চাই না। প্রতিটা মানুষের জীবনেই এমন কোনো গান কিংবা এমন কোনো জায়গা থাকে, সেই গান শুনলে বা সেই জায়গায় গেলে কারো কথা মনে পড়ে যায়৷ তাই সেসব কিছু ইগনোর করা উচিত যা আমাদের পুরনো স্মৃতি মনে করায়।

এসব ভাবতে ভাবতে গানটা শেষ হয়ে গেল।
আমি চোখ দুটো বন্ধ করে বাসের জানালার কাঁচে মাথা এলিয়ে দিলাম। কিছুক্ষণ পর তন্নী আমাকে ডেকে বলল, ইয়ারফোন রাখ মামা এখানে লাইভ গান হচ্ছে। দেখ কী সুন্দর গাইছে ছেলেটা।

কী যেন নাম! ও হ্যাঁ তিয়াশ। তিয়াশ আহমেদ। গিটারের তারে সুর বেঁধেছে। পুরো বাস জুড়ে সবাই ভীষণ এনজয় করছে ওর গান।

তিয়াশ এক পর্যায় সিট থেকে উঠে গান গাইতে শুরু করলো_____
“আমি যে মাতাল হাওয়ারই মত হয়ে,
যেতে যেতে পায়ে পায়ে গেছি জড়িয়ে।
কি করি ভেবে যে মরি বলবে কী লোকে!
মন্দ করেছে আমাকে ঐ দু’টি চোখে।
কি নামে ডেকে বলবো তোমাকে
মন্দ করেছে আমাকে ঐ দুটি চোখে।

পালাতে পারিনি আমি যে দিশাহারা,
দুটি চোখ যেন আমায় দিচ্ছে পাহারা।
ধরা পড়ে গেছি আমি নিজেরই কাছে।
জানি না তোমার মনেও কি এত প্রেম আছে,
সত্যি যদি হয় বলুক যা বলছে নিন্দুকে
মন্দ করেছে আমাকে ঐ দুটি চোখে।
কি নামে ডেকে বলবো তোমাকে
মন্দ করেছে আমাকে ঐ দু’টি চোখে।”

তিয়াশ গান শেষ করে তন্নীকে বলল, একসাথে সময় কাটাবে বলে ট্যুর প্ল্যান করলে আর এখন দু’জন দুই জায়গায় বসে আছো কেন? যাও সানির পাশে গিয়ে বসো।

তন্নী বলল, কিন্তু কুহু? ও তো বোর হবে।

তিয়াশ মৃদু হেসে বলল, তোমার বান্ধবী বোর হবে না কথা দিচ্ছি। তোমার বান্ধবীর মন ভালো রাখার দায়িত্ব তুমি আমার উপর ছেড়ে দাও।

আমি হালকা কপাল কুঁচকালাম। ছেলেটা ভীষণ অদ্ভুত! কেমন যেন। ভালো না খারাপ এখনি তার সংজ্ঞা দিতে পারছি না। তবে এ পর্যন্ত যতটুকু চিনেছি ভালোই মনে হয়েছে। কিন্তু মাত্র কয়েকদিন একটা মানুষকে চেনার জন্য যথেষ্ট নয়। একসাথে অনেক বছর থেকেও মানুষ চেনা যায় না। সময় লাগে। অনেকটা সময়। আবার অনেক সময় ধরেও চেনা যায় না। মানুষ বড়ই অদ্ভুত! তাকে চেনা বড় দায়।

তন্নী উঠে গিয়ে সানির পাশে বসলো। তবে সানির সাথে কথা বলছে না। রাগ করে জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। সানি বারবার তন্নীর রাগ ভাঙ্গানোর চেষ্টা করছে। ওদের দুজনের খুনসুটি দেখে আমি আনমনে হেসে উঠলাম।

তিয়াশ বলল, মেয়েরা ভীষণ অদ্ভুত! তাদের মন বোঝা ভীষণ কঠিন। নিজেই ওর সাথে যাবে বলে লাফাচ্ছিলো আর এখন রাগ করে আছে। বেচারা সানির এবার পুরো রাস্তা রাগ ভাঙ্গাতে ভাঙ্গাতে কাটবে। আপনারা মেয়েরা এতো অভিমানী কেন বলুন তো?

আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম, ক’টা মেয়ে দেখেছেন এ পর্যন্ত? কাউকে এক দেখায় জাজ করা ঠিক না। পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষ আলাদা। তাদের জীবনের ধরন আলাদা। আচার-আচরণ আলাদা। কেউ একটু বেশি রাগি আবার কারো রাগ কম। কেউ অভিমানী আবার কেউ অল্পতেই নরম হয়ে যায়। ছেলেদের একটা কমন ডায়লগ হচ্ছে, সব মেয়েরা এক। কিন্তু এটা তো ঠিক নয় তাই না? সবাই তো এক হয় না।

তিয়াশ বলল, আপনি ভুল বুঝছেন। আমি আসলে ওভাবে বলিনি। আমি বলেছি মেয়েরা অভিমানী। পান থেকে চুন খসলেই অভিমান করে। যদিও আমি কখনও এরকম সিচুয়েশন ফেস করিনি। যেটুকু জানি সবটাই বন্ধুদের কাছ থেকে শুনে উপলব্ধি করেছি।

আমি বললাম, আপনার গার্লফ্রেন্ড বোধহয় খুব নরম মনের মানুষ। আপনি যে অন্য একটা মেয়ের পাশে বসে ট্যুর দিচ্ছেন সে জানে?

তিয়াশ ইতস্তত হয়ে বলল, আমার কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই৷ আপনি বোধহয় তখন আমার কথা গুলো মনোযোগ দিয়ে শোনেন নি। শুনলে এই প্রশ্নটা করতেন না৷ আমি বলেছিলাম, আমাকে কখনও ওরকম সিচুয়েশনে পড়তে হয় নি। কারন আমি রিলেশনশিপে নেই।

ও আচ্ছা। তাহলে ঠিক আছে। নয়তো তন্নীর মতো আপনার গার্লফ্রেন্ডও রাগ করতো।

তিয়াশ হেসে বলল, এই যে একটু আগেই আপনি বললেন সবাই এক না। তাহলে এখন যে এমন কথা বলছেন!

আমি জানালার দিকে তাকিয়ে বললাম, আর কোনো কিছুতে মিল না থাকলেও এই একটা
ব্যাপারে প্রতিটা মেয়েরই মিল থাকবে। সেটা হচ্ছে জেলাসি। নারীরা তার প্রিয় পুরুষের পাশে অন্য কোনো নারীর ছায়াকেও হিংসে করে। আর আপনি তো আমার পাশে বসে যাচ্ছেন।

সে আমার পরম সৌভাগ্য।

কিছু বললেন?

বললাম, এই জন্যই রিলেশনশিপে নেই বলে নিজেকে পরম সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে। কিন্তু আপনার বয়ফ্রেন্ড যদি জানে আপনি একটা ছেলের পাশে বসে ট্যুর দিচ্ছেন তখন? না মানে ছেলেদেরও তো জেলাসি হয়।

আমি হেসে বললাম, সেই চান্স নেই। কারন আমিও আপনার মতোই সিঙ্গেল।

আপনি সিঙ্গেল!! যাক বাঁচা গেল।

মানে!

না মানে বললাম, হাফ ছেড়ে বাঁচা গেল। আমার জন্য যদি আপনার বয়ফ্রেন্ড জেলাস হতো তাহলে নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হতো। এখন আর সেই চান্স নেই।

দু’জনেই হেসে উঠলাম।

বাস ছুটে চলছে আমাদের গন্তব্যে। রাত হয়ে গেছে। বাসের কেউ কেউ ঘুমোচ্ছে। কেউ কেউ তার সঙ্গীর সাথে গল্প করছে, কেউ গান শুনছে, কেউ ফোনালাপ করছে। তিয়াশ ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি ব্যাগ থেকে গল্পের বই বের করলাম। “কাল পুরুষ” বইটায় হাত বোলালাম। অফিসের কাজের চাপে আজকাল আর বই পড়া হয় না। গাড়িতে বোরিং লাগলে বই পড়ে সময় কাটাবো বলে কয়েকটা বই নিয়ে এসেছি। কিন্তু এর মধ্যেই পেছনের সিটের একটা বাচ্চা মেয়ে বমি করতে শুরু করলো। বমি হলে ভীষণ কষ্ট হয়। ছোট বেলায় যখন বমি হতো তখন খুব খারাপ লাগতো। তবে ভাগ্য ভালো আমার বাস জার্নিতে বমিটমি হয় না। কিন্তু মেয়েটা খুব বেশিই বমি করছে। বমির ভকভক শব্দে আমি আর বই পড়ায় মন দিতে পারলাম না। ড্রাইভারকে বললাম, বাসটা সামনে কোথায় একটা থামাতে। কোনো ফার্মেসি থেকে বমির ঔষধ আর কিছু খাবার দাবার কিনে নেয়া যাবে। ড্রাইভার ভীষণ বিরক্ত হয়ে বলল, এসব আজাইরা যাত্রীগো লেইগা যতো ঝামেলা হয়। বাচ্চারে ঘুম পাড়ায়া রাহেন এহন গাড়ি থামামু না।

ড্রাইভারের সাথে আমার কথোপকথনে তিয়াশের ঘুম ভাঙ্গলো। ও বলল, চাচা বাস থামান সামনে কোথাও। আমার খুব জোর পেয়েছে। তারপর আপনার বাস নষ্ট হলে দোষ দিতে পারবেন না।

তিয়াশের কথা শুনে আমি হেসে ফেললাম। ড্রাইভার চোখে মুখে বিরক্তি নিয়ে সামনের একটা বাজারে এসে বাস থামালেন।

এতক্ষণে তন্নীর রাগ কমেছে। সানির কাঁধে মাথা রেখে দিব্যি ঘুমোচ্ছে। তন্নীকে দেখে মনে হচ্ছে একটা ভরসার কাঁধ পেয়ে নিজের ভার ছেড়ে দিয়েছে সানির উপর। প্রত্যেকটা মেয়েরই এমন একটা ভরসার কাঁধ প্রয়োজন। যার কাঁধে মাথা রাখলে সারাদিনের সমস্ত ক্লান্তি একনিমিষেই দূর হয়ে যাবে। ওদের দুজনকে দেখে খুব ভালো লাগছে। জাগাতে ইচ্ছে করছিলো না। কিন্তু তাও ওদেরকে জাগিয়ে বললাম, বাস থেমেছে। নেমে কিছু খাবার দাবার কিনে নিতে পারিস।
আমাদের সাথে সাথে তন্নী এবং সানি দুজনেই নামলো।

তিয়াশ আশেপাশে তাকিয়ে জায়গাটা পরিদর্শন করছে। আমি বললাম, আপনি দাঁড়িয়ে আছেন যে! আপনার না খুব জোর………

তিয়াশ হেসে বলল, ওটা না বললে ড্রাইভার চাচা গাড়ি থামাতেন না।

আমার খুব জোর হাসি পেল। কিন্তু আমি হাসিটা চেপে রেখে বললাম, আইডিয়াটা দারুন।

তন্নী চিপস, কোক আরও কী কী যেন কিনলো। আমাকে বলল, তুই কী খাবি বল?

আমি বললাম, শুধু শুধু এত খাবার কিনে টাকা নষ্ট করিস না। আমার এখন দুধ চায়ের মধ্যে বনরুটি ভিজিয়ে খেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সেটা তো পসিবল না। বাস এতক্ষণ বসে থাকবে না।

তন্নী বলল, তোর যত অদ্ভুত অদ্ভুত ইচ্ছে হয়। চিপস চলবে?

আমি বললাম, আমি এখন অন্য কিছু খাবো না। তুই নে তোর যা ইচ্ছে।

তন্নী আরও কী কী যেন কিনলো। আমি ততক্ষণে তন্নীর ফোন থেকে মাকে কল করে কথা বলে নিলাম।

সানি আড়ালে গিয়ে সিগারেট খাচ্ছে। তন্নী সেটা দেখা মাত্রই আবারও খিটখিট শুরু করে দিয়েছে। সিগারেট দেখলে আমারও রাগ ওঠে। সিগারেট খাওয়া লোকজনদেরও আমি ভীষন অপছন্দ করি। এ ব্যাপারে আমি তন্নীর সাথে এক মত।

তন্নী সানিকে রেখে বাসে উঠে গেল। সানি সিগারেট ফেলে তন্নীর পেছন পেছন গেল। সবাই যার যার কাজ সেরে দ্রুত বাসে উঠে বসলো। বাস আবারও ছুটে চলল তার আপন গতিতে।

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here