#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ১৫
_____________
মিতুলের সামনে ছোট্ট একটি ঘর। মিতুল বিস্ময়ে হতবাক! জঙ্গলের ভিতর ঘর এলো কোত্থেকে? ও কি ঠিক দেখছে? মিতুল দুই চোখ বন্ধ করে আবার খুললো। হ্যাঁ, সত্যি সত্যিই তো!
মিতুল দূরে দেখা আলো অনুসরণ করে এগোচ্ছিল। কিন্তু ওই দূর আলো পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি। একটু হাঁটতেই এই ঘরটা চোখে পড়তেই থেমে যায়। ঘরটা আগে একেবারেই খেয়াল করেনি। ওর দৃষ্টি ছিল কেবল ওই আলোর উপর। মিতুল হা হয়ে ঘরটা দেখছে। এই গভীর জঙ্গলে ঘর কেন? কার ঘর এটা? মিতুল ফ্ল্যাশ লাইটের আলো ফেলেছে ঘরের উপর। একটা সাইন বোর্ড চোখে পড়ছে। কী লেখা ওতে?
‘Ti… Time…House’? লেখাটা পড়তে পড়তে মিতুলের ভ্রু কুঁচকে গেছে। ‘Time House’ লেখা কেন? কী মানে এই লেখার? এই ঘরটার নাম ‘Time House’ না কি?
মিতুল ঘরটা দেখছে। দেখতে তো পুরোনো মনে হচ্ছে না। একটা দরজা দেখা যাচ্ছে। দরজার দুই পাশের দেয়ালে আবার দুইটা জানালা। কাঁচের জানালা দিয়ে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ভিতরে পর্দা টানানো জানালাতে। পর্দা গুলো পুরোনো না কি বোঝা যাচ্ছে না। এই ঘর কীসের? এই জঙ্গলের ভিতর ঘর নির্মাণ করলো কে?
“মিতুল…”
হঠাৎ করে জোহানের কণ্ঠ মিতুলকে ভয় পাইয়ে দিলো। জোহান যে ওর সাথে আছে সেটা ক্ষণিকের জন্য ভুলেই গিয়েছিল।
জোহান পকেট থেকে একটা চাবি বের করে মিতুলের সামনে ধরে বললো,
“ইট’স মাই হাউজ কী!”
মাই হাউজ? জোহানের ‘মাই হাউজ’ বলা কথাটা মিতুলকে বিস্ময়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে এলো। মিতুল একবার ঘরের দিকে, আরেক বার জোহানের দিকে তাকালো। অবাক হয়ে জানতে চাইলো,
“ইট’স ইওর?”
জোহানকে দেখে মনে হলো ওর কষ্ট হচ্ছে। একবার চোখ বন্ধ করে আবার খুলে বললো,
“ওপেন দ্য ডোর!”
মিতুল মোবাইল ধরা হাত দিয়ে জোহানের হাতের চাবি নিলো। এই ঘর কি সত্যিই জোহানের? মিতুল আস্তে আস্তে এগিয়ে এলো ঘরের দিকে। জোহানকে বসিয়ে দিলো ঘরের সামনে, দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে। তারপর জোহানের দেওয়া চাবি দিয়ে দরজা খুললো। একটা ভোঁতা শব্দ হলো দরজা খোলার। মিতুল ভেবেছিল দরজা খুলতে না খুলতেই ভ্যাপসা গন্ধ এসে নাকে লাগবে। কিন্তু না, তেমন কোনো গন্ধ পেল না। বরং একটা মিষ্টি সুগন্ধ টের পাওয়া গেল। মিতুল অন্ধকার ঘরের দিকে তাকিয়ে আছে। মোবাইল লাইটের আলো বেখেয়ালে ওর পায়ের কাছে পড়ে আছে। ও দেখছে সামনে শুধু অন্ধকার। চাঁদের আলো গ্লাস উইন্ডো এবং পর্দা ভেদ করে ভিতরে ঢুকতে পারেনি। তাও একটু আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে দরজার এক পাশ দিয়ে।
জোহান বললো,
“দেয়ালের ডান দিকে সুইচ বোর্ড।”
মিতুল এবার খেয়ালে এলো। মোবাইলের আলো ফেলে সুইচ বোর্ড খুঁজে, লাইট জ্বালালো ঘরে। মিতুলের চোখের সামনে এখন একটি ছোট লিভিং রুম ফুঁটে উঠেছে। মিতুল রুমটা দেখছে। মেঝে কার্পেটে ঢাকা। পশ্চিম দেয়ালের জানালার কাছে কয়েকটা নীল রঙের ফ্রিসিয়াস ফুলের টব। মিতুল বুঝতে পারলো, এই ফ্রিসিয়াস ফুলের মিষ্টি সুগন্ধই পাচ্ছে ও। এই জানালা থেকে বেশ কিছুটা দূরত্বে রাখা আছে একটা কাউচ। উত্তরের দেয়াল ঘেঁষে একটা ওয়ার্ডোব, তার পাশে ছোট্ট একটি টি টেবিল। টেবিলের উপর একটা ল্যাম্পশেড। আরও কিছু জিনিস পত্র দেখা গেল লিভিং রুমে। ওগুলো রুমের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য। পূর্ব দিকে আরও একটা দরজা দেখা যাচ্ছে। দরজার গায়ে ছোট একটি সাইন বোর্ড। কী যেন লেখা তাতে। কী লেখা আছে? মিতুল কয়েক পা এগিয়ে এলো দরজাটার দিকে। লেখা,
‘My lonely bedroom’
লেখাটা দেখে মিতুল ভীষণ অবাক। এটা আবার কেমন কথা?
উত্তর পূর্ব দেয়াল ঘেঁষে উত্তরের ওদিকটায় আরও একটা দরজা দেখতে পাচ্ছে। দরজাটা খোলা। মিতুল উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলো। কিচেন টিচেন হবে বোধহয়।
মিতুল সত্যি সত্যিই বিস্ময়ে হতবাক। কী দেখছে এসব? লিভিং রুম, বেডরুম, কিচেন! তাও আবার এত সাজানো, গোছানো, পরিপাটি? মনে হচ্ছে যেন এখানে কেউ নিয়মিত বসবাস করে। আচ্ছা, এটা কি কোনো সিক্রেট হাউজ না কি? মিতুল এর আগে কখনও এরকম সিক্রেট হাউজ দেখেনি। প্রথম দেখছে বলে একটু খুশি খুশি লাগছে। জোহান জঙ্গলের ভিতর সিক্রেট হাউজ তৈরি করেছে? বাহ, বেশ ভালো তো!
মিতুলের মাথায় হঠাৎ এক নতুন ভাবনা খেললো। জোহান কি তাহলে জঙ্গলে ঢুকে ওর এই সিক্রেট হাউজে আসতো?
মিতুল হীনমন্য, বিমূঢ়তায় নিজের মুখ চেপে ধরলো। ছি ছি! জোহান নিজের এই সিক্রেট হাউজে আসতো, আর ও কি না জোহানকে নিয়ে কীসব আজগুবি…
মিতুল আর ভাবতে পারছে না। নিজের কাছেই নিজেকে ছোট লাগছে। কী করে জোহানকে নিয়ে ওই রকমের চিন্তা ভাবনা করেছিল?
বাইরে থেকে জোহানের কণ্ঠ শোনা গেল,
“হেই…আমাকে কি এখানেই বসিয়ে রাখবে? বাইরে শীত পড়েছে। হাত পা জমে যাবে আমার!”
জোহানের কথায় মিতুলের ঘোর কেটে গেল। মিতুল হাতের মোবাইল এবং চাবি টেবিলে ল্যাম্পশেডের পাশে রেখে, দৌঁড়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। জোহানকে ধরে নিয়ে এলো ঘরের ভিতর। কাউচের উপর শুইয়ে দিলো ওকে। তারপর আবারও ঘরের এদিক ওদিক তাকিয়ে ঘরটাকে দেখতে লাগলো ভালো ভাবে। মিতুলের ভাবতে অবাক লাগছে জোহানের একটা সিক্রেট হাউজ আছে। আচ্ছা সিক্রেট হাউজে থাকতে কেমন লাগে? নিশ্চয়ই ভালো লাগে খুব?
“তুমি কি চাও আমি মরে যাই?”
জোহানের কথা শুনে মিতুল জোহানের দিকে তাকালো।
“কীসব কথা বলছো তুমি? আমি কেন চাইবো যে তুমি মরে যাও? আমাকে কি তোমার হার্টলেস মনে হয়? আমি মোটেই হার্টলেস নই। আমি কখনও কারো জন্য মৃত্যু চাইতে পারি না।”
“না চাইলে এমন চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছো কেন? তোমার কি উচিত নয় আমার ট্রিটমেন্ট করা?”
মিতুল অবাক হয়ে বললো,
“ট্রিটমেন্ট? আমি কি ডাক্তার? না কি আমি ডাক্তারি পড়ি? আমি কীভাবে তোমার ট্রিটমেন্ট করবো? আর তাছাড়া ট্রিটমেন্ট করতে অনেক কিছুর প্রয়োজন হয়। আমার কাছে কি আছে সেসব?”
“আমি কোনো অপারেশনের রোগী নই যে, আমার ট্রিটমেন্ট করতে তোমার ডাক্তার হতে হবে। এটা একটা সিম্পল ট্রিটমেন্ট। তুমি চাইলেই পারবে…ওই যে ওখানে বেডরুম লেখা ডোরটা দেখতে পাচ্ছ? ওই রুমের ভিতর ফার্স্ট এইড বক্স আছে। নিয়ে এসো সেটা। এবং ট্রিটমেন্ট করো আমার।”
মিতুল নিরাশ চেয়ে আছে জোহানের দিকে। ও বুঝতে পারছে না ও কী করে জোহানের ট্রিটমেন্ট করবে? ট্রিটমেন্ট করা কি ওর কাজ? সেটা তো ডাক্তারের কাজ।
“কী হলো দাঁড়িয়ে আছো কেন? যাও।”
জোহানের অবস্থা ভালো লাগছে না মিতুলের। রক্ত…
মিতুল বললো,
“যাচ্ছি।”
মিতুল জোহানের বেডরুমে প্রবেশ করলো। দেয়াল হাতড়ে সুইচ বোর্ডটা পেল। লাইট জ্বালালো। বেড রুম আলোকিত হয়েছে। লিভিং রুমটাই ছোট ছিল, বেড রুমটা তার থেকে আরও ছোট। সব জিনিস পত্র গাদাগাদি করে রাখা। তেমন কিছু নেই এখানে। একটা সাদা চাদরে ঢাকা বেড। বাম পাশের দেয়াল ঘেঁষে রাখা একটা ক্লোজেট। ক্লোজেটের পাশে একটা ওয়ার্ডোব। জানালার কাছে একটা টেবিল। টেবিলের সাথে আবার একটা চেয়ার। বই, পেন, নোটবুক, সাদা পেপার এসব ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে টেবিলের উপর। রুমের ওই কোণে আবার গিটার সহ কয়েকটি বাদ্যযন্ত্র। গিটারটা চেনা চেনা লাগছে না মিতুলের। জোহানের কাছে আগে যে গিটারটা দেখেছে, এটা সেটা না। জোহানের কি দুটো গিটার?
একটা গিটার নিয়েও এমন গভীর চিন্তা করার কারণে, মিতুলের নিজের প্রতিই নিজের বিরক্ত লাগলো।
ফার্স্ট এইড বক্স কোথায়? জোহান তো বললো রুমের ভিতর আছে, কোথায় আছে সেটা তো বললো না। মিতুল এখান থেকেই চেঁচিয়ে জানতে চাইলো,
“এ রুমের কোথায় রেখেছো ফার্স্ট এইড বক্স?”
জোহানের থেকে কোনো উত্তর এলো না। গলার শক্তি কমে গিয়েছে না কি ওর? গিয়েছে বোধহয়। তা না হলে বজ্র কণ্ঠ ভেসে আসতো ওখান থেকে। মিতুল ওয়ার্ডোবের দিকে এগিয়ে গেল। ওয়ার্ডোবের ভিতরই রেখেছে বোধহয়। মিতুল উপরের ড্রয়ার খুললো। কীসব কাগজ পত্র দেখা যাচ্ছে। ফার্স্ট এইড বক্সের চিহ্ন নেই কোথাও। দ্বিতীয় ড্রয়ারটি খুললো। কতগুলো ইংলিশ নভেল রাখা। তার সাথে…এটা কী? নোটবুক? মিতুল নোট বুকটা হাতে তুলে নিলো। খুলে দেখতে চাইছিল কী লিখে রেখেছে। কিন্তু, খুললো না। কারো পার্সোনাল জিনিসে হাত দেওয়ার শিক্ষা ও পায়নি। নিশ্চয়ই এর ভিতর গান টান লিখে রেখেছে? হ্যাঁ, সেটাই। গান ছাড়া আর লিখবে কী? আর কিছু জানে? নিজের জীবনী লেখার মতো মানুষ তো আর জোহান না! মিতুল রেখে দিলো নোটবুকটা। তৃতীয় ড্রয়ার খুলতে ফার্স্ট এইড বক্স দেখতে পেল। মিতুল বক্সটা নিয়ে বেরিয়ে এলো বেডরুম থেকে।
দেয়ালের ওই দিকে একটা টুল ছিল সেটা নিয়ে এসে জোহানের কাছে বসলো। ফার্স্ট এইড বক্স খুলে দেখলো, প্রয়োজনীয় সব কিছুই আছে। প্রথমে কী করা উচিত? মিতুল জোহানের দিকে তাকালো। জোহান ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। মিতুলের মনে হলো আগে নাকের রক্ত মুছে দেওয়া উচিত। মিতুল একে একে জীবাণুনাশক দিয়ে ক্ষত স্থান গুলো পরিষ্কার করলো সব। তারপর পেট্রোলিয়াম জেলি লাগিয়ে দিলো। এসব করতে বার বার বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হচ্ছিল মিতুলকে। কারণ, জোহান পুরো সময়টা ওর দিকেই তাকিয়ে ছিল।
আর এসব কি ওর কাজ? মিতুল জোহানের কপালে ফুলে থাকা স্থানে প্লাস্টার লাগিয়ে দিতে দিতে বললো,
“যতটুকু পারলাম, ততটুকু করে দিলাম। ঔষধ যা লাগে তুমি খেয়ে নিয়ো। আর ডক্টরও দেখিয়ে এসো একবার।”
মিতুল একটু থেমে আবার বললো,
“আচ্ছা, তোমার এখানে ঘর ওঠানোর রহস্যটা কী? এটা কি তোমার সিক্রেট হাউজ? শখের বশে তৈরি করছো না কি?”
বেশ কৌতূহল নিয়েই প্রশ্ন করলো মিতুল।
“সিক্রেট হাউজ হলে কী করবে?”
“কিছু না। এমনিই জানতে চাইলাম। সিক্রেট হাউজে থাকাটা বোধহয় মজার। আমি কোনো দিন ভাবতে পারিনি এখানে এসে আমি একটা সিক্রেট হাউজ দেখতে পাবো। তাও ভালো, যা ভেবেছিলাম তা অন্তত হয়নি।”
জোহান বাঁকা চোখে তাকিয়ে বললো,
“কী ভেবেছিলে?”
মিতুল হকচকিয়ে গেল। কিন্তু দ্রুতই বললো,
“নাথিং।”
মিতুল বক্সের ভিতর সব গুছিয়ে রেখে বক্সটা ফ্লোরে নামিয়ে রাখলো। জোহান চোখ বুজেছে। মিতুল বললো,
“এখানেই ঘুমাবে তুমি?”
উত্তর দিলো না জোহান।
মিতুলের রাগ হলো। মিতুল এবার একটু বেশি জোরেই বললো,
“তুমি কি এখানেই ঘুমাবে?”
“কেন? তুমিও কি ঘুমাবে এখানে?”
ঘুমানোর কথা মনে হতেই মিতুলের মনে পড়লো, আরে ও তো এখন এক গভীর জঙ্গলের ভিতর আছে! বাইরের কী অবস্থা সেটা তো ও জানে না। রেশমী আন্টি এখনও বাড়িতে না দেখলে কী বলবে? খুঁজবে না? মিতুলের চিন্তা শুরু হয়ে গেল আবার। মিতুল জোহানকে ডাকলো,
“এই জোহান।”
জোহান চোখ বুজে থেকেই বললো,
“কী?”
“আমি বাড়ি যাব।”
“তো যাও।” জোহানের গা ছাড়া ভাব।
“যাও মানে? আমাকে গভীর জঙ্গলে নিয়ে এসেছো তুমি। এখন আমি এই গভীর জঙ্গল পেরিয়ে যাব কী করে?”
“যেভাবে এসেছো, সেভাবে চলে যাও।” জোহানের যেন বিন্দু মাত্র চিন্তা নেই ওর জন্য।
মিতুলের মাথায় রাজ্যের চিন্তা ভর করলো। এসেছিল তো কৌতূহলে পড়ে। কৌতূহলের কাছে এসব ভয় ডর তুচ্ছ করে দিয়েছিল। তাছাড়া জোহানও তো সাথে ছিল। কিন্তু এখন? না না কিছুতেই এখন একা একা যেতে পারবে না। ভয়ে হার্ট অ্যাটাক করে মরে যেতে পারে! মিতুল জোহানের দিকে তাকালো।
জোহান চোখ বন্ধ করেই শুয়ে আছে।
মিতুল বললো,
“আমি কিছুতেই একা একা যেতে পারব না। কিছুতেই না।”
জোহান চোখ মেলে তাকালো। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে কেমন একটা ভাব নিয়েই যেন বললো,
“ঠিক আছে, যাওয়ার দরকার নেই। আজকে রাতে এখানেই থাকো আমার সাথে।”
মিতুল টুল ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেল।
“অসম্ভব! কিছুতেই এখানে থাকবো না আমি। এখানে থাকার থেকে তো জঙ্গল পেরিয়ে একা একা চলে যাওয়াও ভালো…”
“ঠিক আছে, যাও তবে।” বলে জোহান আবার চোখ বুজলো।
মিতুল পড়লো মহা মুশকিলে। এখানে জোহানের সাথে থাকার কথা তো দুঃস্বপ্নেও ভাববে না ও। কারণ এখানে থাকলে তো ওদিকে বাড়ির সবাই খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে যাবে। তারা তো আর জানবে না যে এখানে জোহানের সাথে সিক্রেট হাউজে আছে। তারা তো জঙ্গলকে হিসেবের ভিতরেই ধরবে না। আর তাছাড়া, জোহানের সাথে এই ঘরে একা থাকা, এটা জাস্ট ও ভাবতেই পারবে না। থাকা তো অনেক দূরের কথা।
আবার ওদিকে, একা একাও যেতে পারবে না এই জঙ্গল পেরিয়ে। কী করবে এখন?
মিতুলের মাথায় হঠাৎ সমাধান এলো। জোহানের দিকে তাকালো। ঘুমিয়ে পড়েছে না কি? মিতুল ডাকলো,
“এই জোহান, শুনছো?”
জোহান চোখ খুলে বললো,
“এ কি তুমি এখনও যাওনি?”
“বলছিলাম কী, তুমি আমাকে জঙ্গল পেরিয়ে বাড়িতে দিয়ে আসো না।”
“হোয়াট?”
“তুমিই তো এখানে নিয়ে এসেছো। এখন তোমার কি উচিত নয় আমাকে আবার ফিরিয়ে দিয়ে আসা?”
“তোমার কি কোনো কমনসেন্স নেই? আমি একজন আহত মানুষ। যেই আহত মানুষটিকে তুমি নিজে এখানে আসতে সাহায্য করলে, সে একা একা হেঁটে আসতে পারছিল না বলে। সেই মানুষটাকে তুমি আবার হেঁটে হেঁটে এই জঙ্গল পেরিয়ে তোমাকে দিয়ে আসতে বলছো? আমি এই জঙ্গল পেরোনো তো দূরের কথা, এই কাউচ ছেড়ে নামবো সেই শক্তিটুকুই তো নেই আমার। আমি ভীষণ দুর্বল।”
মিতুলের রাগ হচ্ছে, খুব খুব রাগ হচ্ছে। রাগ নিয়েই বললো,
“তোমাকে কে বলেছিল এখানে ঘর নির্মাণ করতে? তুমি এখানে সিক্রেট হাউজ তৈরি করেছো কেন? আর করেছো করেছো, আমাকে কেন আনলে এখানে? নিজের দিকটাই ভাবো শুধু? আর মানুষের ভাবনা কে ভাববে? খুব দুর্বলতা দেখাচ্ছ তাই না? যখন তুমি এতটাই দুর্বল যে কাউকে নিয়ে আসলে, তাকে আবার ফেরত দিয়ে আসতে পারবে না, তাহলে এনেছিলে কেন এখানে? কেন এনেছিলে?” চাপা গর্জন করে উঠলো মিতুল।
মিতুল রাগে ফুঁসছে।
নাক ফুলো তুলতুলকে দেখতে পাচ্ছে জোহান। জোহান মিতুলের মতো কোনো রিয়াক্ট করলো না। খুব শান্ত ভাবেই বললো,
“সিসকে ফোন করো।”
“কাকে ফোন করবো?”
“ক্যামিলা। ফোন করে এখানে আসতে বলো।”
“মানে?” মিতুল অবাক হলো।
“ক্যামিলা জানে তোমার এই সিক্রেট হাউজের ব্যাপারে?” মিতুলের রাগ কেটে গিয়ে এখন আবার কৌতূহলে পরিণত হলো।
জোহান কোনো উত্তর দিলো না।
মিতুলই আবার হতাশ হয়ে বললো,
“যাক, আমি তো ভেবেছিলাম এটা তোমার সিক্রেট হাউজ। কিন্তু না, এখন তো দেখছি তুমি ছাড়াও তোমার এই হাউজের ব্যাপারে আরও মানুষ জানে। আচ্ছা, তোমার ফ্যামিলির সবাই-ই কি জানে? তাহলে এটা কি তোমার সিক্রেট হাউজ নয়?”
“নো, এটা আমার সিক্রেট হাউজ নয়। এটা আমার টাইম হাউজ। সেটা নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। যদি এখান থেকে যেতে চাও, তবে সিসকে ফোন করো। আর যদি না যেতে চাও, তবে থেকেও যেতে পারো আমার সাথে আমার টাইম হাউজে। তোমাকে থাকতে দেবো আমি।”
“দরকার নেই। কোনো দরকার নেই তোমার এখানে থাকতে দেওয়ার। মরে যাব, তবুও এখানে থাকবো না আমি।”
বলে নিজের মোবাইল আনতে টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল। ক্যামিলাকে ফোন করলো। মিতুলের মনে হয়েছিল যে ও এই জঙ্গলের ভিতরে জোহানের সিক্রেট হাউজে আছে শুনে, ক্যামিলা অবাক হবে। কিন্তু ক্যামিলা অবাক হলো না। তার কণ্ঠ শোনালো খুবই স্বাভাবিক। যেন এখানে থাকাটা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার।
ক্যামিলার আসতে যতক্ষণ সময় লাগলো, ততক্ষণ মিতুল জোহানের ধারে কাছেও গেল না আর। ঘুরে ঘুরে ওর টাইম হাউজ দেখতে লাগলো। কিচেনটা আগে দেখেনি। সেটাও দেখে নিলো একবার। কিচেনটা খুবই ছোট। তবে বেশ ভালোই দেখা গেল। চুলো আছে, কফি তৈরির মেশিন আছে, ফ্রিজ আছে, বসে খাওয়ার জন্য একটা ছোট টেবিল, আর দুটো চেয়ারও আছে। মিতুলের মনে হলো বেশ ভালো সিক্রেট হাউজই বানিয়েছে জোহান। ওহ না, সিক্রেট হাউজ তো না। এটা না কি আবার টাইম হাউজ। কিন্তু এটা বানাতে কত টাকা খরচ হয়েছে? এটা নির্মাণের জন্য টাকা পেল কোথায়? শুনেছে তো জোহান কোনো কাজ কর্ম করে না। গান গেয়ে কয় টাকাই বা পায়? আচ্ছা এটা কি তবে রেশমী আন্টি নির্মাণ করে দিয়েছে? হ্যাঁ, রেশমী আন্টিই দিয়েছে নিশ্চয়ই। মিতুল এসব ভাবতে ভাবতে লিভিং রুমে পায়চারি করছিল। এর মাঝেই দেখতে পেল ক্যামিলা এসেছে।
ক্যামিলা এসে প্রথমে তাকালো জোহানের দিকে। মিতুলকে একনজর দেখে নিয়ে জোহানের কাছে গেল।
“আর ইউ ও কে?”
“মনে হচ্ছে ও কে আছি। তুলতুল আমার যে চিকিৎসা করলো, ও কে না থেকে উপায় কী?”
কথাটা বলতে বলতে মিতুলের দিকে তাকালো।
মিতুল বুঝতে পারলো না, জোহান ওর প্রশংসা করলো? না কি অপমান?
ক্যামিলা আর কোনো প্রশ্ন করলো না। মিতুলের দিকে তাকিয়ে বললো,
“মিতুল, লেট’স গো।”
মিতুল ক্যামিলার পিছন পিছন বের হচ্ছিল ঘর থেকে। জোহানের কথায় থেমে গেল,
“মিতুল শোনো।”
“কী?”
“বাড়ির অন্য কেউ যেন না জানে আমার মার খাওয়ার ব্যাপারে। যদি জানে, তবে তোমার কপালে খারাপ আছে। বুঝলে? ভীষণ খারাপ আছে।”
“আমার বয়েই গেছে তোমার কথা বলে বেড়াতে। আর তুমি কি ভাবছো আমি তোমাকে ভয় পাই? ভয় দেখাচ্ছ আমায়? কান খুলে শুনে রাখো, আমি তোমাকে কখনও ভয় পাইনি, আর ভবিষ্যতেও পাবো না। অযথা ভয় দেখাতে আসবে না বলে দিলাম।”
কথা গুলো বলে মিতুল মনে মনে হেসে উঠলো। ও না কি জোহানকে ভয় পায়নি কোনো দিন। আজকের দিনটা পর্যন্তও জোহানকে কতটাই না ভয় পেয়েছিল। এমনকি ভয়ে কাঁপাকাঁপিও শুরু হয়ে গিয়েছিল। এগুলো তো গোপন। বেশ ভালোই কথা শুনাতে পেরেছে জোহানকে। মুখেও নীরব হাসি ফুঁটলো এবার।
মিতুল ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লো। দরজাটা টেনে দিয়ে গেল।
জোহান তাকিয়ে রইল বন্ধ দরজার দিকে। চোখে মার খাওয়ার দৃশ্যটা ভেসে উঠছে। লাথি, থাপ্পড় সবই ভেসে উঠছে। জোহান ভাবছে আজকে কেন মার খেলো ও? ওর কাছে তো গাড়ি ছিল। ও না থেমে তো সোজা গাড়ি চালিয়েই চলে আসতে পারতো। গাড়ি চালিয়ে আসলে ওই রাবিশগুলোই তো নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে রাস্তা ছেড়ে দিতে বাধ্য থাকতো। কিন্তু ও কেন করলো না সেটা? আর গাড়ি চালিয়ে ওদেরকে অতিক্রম না করে, আবার ওখান থেকে ব্যাকও তো করতে পারতো। কেন করলো না? বোকার মতো কেন গাড়ি থেকে নেমে ওদের কাছে গিয়ে, নিজের মার খাওয়ার রাস্তাটা নিজেই পরিষ্কার করলো? কেন?
আর শুধু ওরাই কেন মেরে গেল? ঘুষি, থাপ্পড় ও নিজেও তো মারতে পারতো। মারলো না কেন? নিজেকে ওদের কাছে মার খাওয়ার জন্য ছেড়ে দিয়ে কেন বলেছিল,
“মারবি? মার তবে। নিজেকে আজ তোদের কাছে ছেড়ে দিলাম। নে শুরু কর।”
কেন বলেছিল এই কথা?
কোথাও ওর নিজেরই মার খাওয়ার ইচ্ছা জাগেনি তো আজকে? নিজ ইচ্ছাতেই কি মারটা খেলো?
কথাটা মনে করে হাসলো জোহান।
আর হাসির সাথে এক ফোঁটা পানিও গড়িয়ে পড়ল চোখের কোণ বেয়ে। হয়তো একটু কষ্টে, একটু দুঃখে, কিছুটা বা অভিমানে!
(চলবে)