#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৩২
____________
কার্লের বিয়েতে যাওয়া মিতুলের জন্য একটা যুদ্ধ সমান। মিতুল এই যুদ্ধে অংশ নিতে চায়নি। চোখের সামনে কার্লের বিয়ে দেখাটা হবে ওর জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ দৃশ্য। আর এই ভয়াবহ দৃশ্যটি ওর স্মৃতির পাতায় রয়ে যাবে একটি ভয়াবহ স্মৃতি হিসেবে। এই ভয়াবহ স্মৃতি ভীষণ তিক্ততায় তাড়া করে বেড়াবে ওকে সারাজীবন। কার্লের বিয়েতে যাবে না বলেই ডিসাইড করেছিল। সারারাত ভেবে এই সিদ্ধান্তই নিয়েছে ও। কিন্তু সকাল হতেই ওর মত পাল্টে গেল। কার্লের বিয়েতে যাবে ও। শেষ বারের মতো কার্লকে দেখবে। আজকে দেখার পর জীবনে আর কার্লের মুখ দেখবে না।
কার্লের বিয়ে বিকেলে। স্থানীয় একটি চার্চে বিয়ে হবে। মিতুল বিকেল নাগাদ কার্লের বিয়েতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলো। স্কার্ট এবং টপ পরেছে। গলায় পেঁচিয়েছে একটি স্কার্ফ। চুল বেঁধেছে কার্লের দেওয়া হেয়ার রাবার দিয়ে। কার্লের কাছ থেকে পাওয়া প্রথম উপহার ছিল এই হেয়ার রাবার। আর শেষ উপহার হিসেবেও এটাই থাকবে। এই হেয়ার রাবার দেওয়ার মাধ্যমেই ভালো লাগা জন্মেছিল কার্লের প্রতি। জীবনের প্রথম অনুভূতি! মিতুলের হৃদয়ে একটু ব্যথা হলো। কিন্তু প্রধান্য দিলো না সেসব।
বাড়ি থেকে বের হয়ে কতক দূর হাঁটতেই পিছনে শুনতে পেল জোহানের ডাক,
“হেই তুলতুল!”
মিতুল থেমে পিছন ফিরলো।
জোহানের ব্ল্যাক কারটি চোখের পলকে ওর পাশে এসে ব্রেক কষলো।
“গেট ইন।” জোহান গাড়িতে ওঠার তাগিদ করলো।
মিতুল কিছু না বলে তাকিয়ে রইল।
জোহান বললো,
“কার্লের বিয়েতে যাচ্ছ তো তুমি?”
মিতুল হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লো।
“আমিও সেখানে যাচ্ছি। তোমার সাথে সাথে আমাকেও না কি ইনভাইট করেছে? আমাকে সাথে না নিয়ে একা একা যাচ্ছ কেন তুমি? উঠে পড়ো।”
মিতুল কিছু না বলে গাড়িতে উঠে বসলো। দৃষ্টি রাখলো জানালার বাইরে। আজকের দিন মেঘলা। কিন্তু বৃষ্টি হওয়ার পূর্বাভাস নেই কোনো। মিতুলের এমন বৃষ্টিহীন মেঘলা দিন পছন্দ। তবে আজকে বৃষ্টি হলে মন্দ হতো না।
মিতুল কার্লের বিয়েতে গেল ঠিকই, কিন্তু সম্পূর্ণ বিয়ে পর্যন্ত থাকতে পারলো না। ওর হৃদয় ভাঙচুর হচ্ছিল। হৃদয় ভাঙার এমন করুণ আত্মকাহিনী নিয়ে কার্লের বিয়ে দেখা ওর জন্য অসম্ভব। মিতুল কাউকে কিছু না বলে চুপিচুপি চলে এলো বিয়ের মজলিশ থেকে।
ও যে চলে এসেছে তা জোহানও জানতে পারলো না। মিতুল কোনো কিছু না ভেবে একটা ট্যাক্সি নিয়ে সোজা বাড়ি চলে এলো। নিজের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। কষ্ট হচ্ছে। কষ্ট হচ্ছে ওর। হৃদয়ভাঙ্গার কষ্ট বুঝি এত নির্মম?
কিছুক্ষণের ভিতরই রাত নামলো। মিতুল ওর প্রিয় বন্ধবী মেহরিনের কাছে কল দিয়ে কান্নাকাটি করলো। কাঁদতে কাঁদতে শুধু একটি বাক্য বলেছিল,
“কার্ল বিয়ে করেছে আজকে।”
মেহরিন এরপর শতশত প্রশ্ন করলেও আর কিছু বলতে পারেনি মিতুল। কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করে ফোন কেটে দেয় শুধু।
_____________
রাতটা যেমন তেমন করে কাটলেও, সকালে সবকিছু ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করে স্বাভাবিক হতে চাইলো মিতুল। যদিও কার্লের ব্যাপারটা আঁকড়ে ধরে আছে ওকে। সকাল বেলা খুব লম্বা শাওয়ার নিয়েছে ও। মনে কিছুটা প্রশান্তি এসেছে তাতে। ব্রেকফাস্টের জন্য ডাইনিংএ এসে জোহানকে বসা দেখলো। মোবাইলের দিকে তাকিয়ে জোহান কী দেখে হাসছে কে জানে। কালকেও ও আর জোহান এক সাথে ব্রেকফাস্ট করেছিল। আজকেও ও যে সময় এলো, জোহানও সেসময় উপস্থিত। দুজনের খাওয়ার টাইম কীভাবে মিলে যাচ্ছে এভাবে?
“ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি আমার মুখই দেখবে শুধু? ব্রেকফাস্ট করবে না? না কি আমার মুখ দেখলেই খিদে মরে যাবে তোমার?”
মোবাইলে মুখ ডুবিয়েই জোহান হঠাৎ প্রশ্নগুলো ছুঁড়লো মিতুলের দিকে।
মিতুল দরজার কাছে দাঁড়ানো ছিল। কোনো কথা না বলে এসে চেয়ার টেনে বসলো। জোহানের পাশেও বসলো না। আর মুখোমুখিও বসলো না। জোহানের মুখোমুখি চেয়ারটার পাশেরটিতে বসলো।
ক্যামিলা ডাইনিং রুমে ঢুকলো দুই কাপ কফি নিয়ে। কাপ দুটো টেবিলে রেখে জোহানকে জিজ্ঞেস করলো,
“জোহান, কী দেবো তোমায়? মাফিন তৈরি করেছিলাম, খাবে তুমি?”
জোহান মোবাইল রেখে বললো,
“হুম দাও।”
ক্যামিলা জোহানের প্লেটে দুটো মাফিন উঠিয়ে দিলো। এরপর মিতুলকে জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি মাফিন খাও তো?”
মিতুল মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো।
ক্যামিলা হাসি মুখে মিতুলের প্লেটে দুটো মাফিন তুলে দিয়ে ফ্রুট স্যালাড আনতে বেরিয়ে গেল।
জোহান প্রথমেই একটা সিদ্ধ ডিমে কামড় দিয়ে বললো,
“কালকে কার্লের বিয়ে বেশ এনজ্য়াবল ছিল, কী বলো মিতুল?”
মিতুল কোনো উত্তর দিলো না। যেন জোহানের কথা শুনতেই পায়নি তেমন একটা ভাব করলো।
জোহানই আবার বললো,
“কার্লের গার্লফ্রেন্ড কিন্তু খুবই সুন্দর এবং সুইট। বিশেষ করে ওর রেড হেয়ার বেশ আকর্ষণীয়। আর হ্যাঁ, মেয়েটা লম্বাও অনেকখানি। প্রায় আমার কান পর্যন্ত হাইট।”
মিতুলের মোটেই ভালো লাগছে না এসব শুনতে। দু কান বিষ করছে। এই জোহানের আর কোনো প্যাঁচাল নেই না কি?
“মেয়েটির সাথে আমি অনেক ফটোও তুলেছি। চেয়েছিলাম আমি, তুমি, কার্ল এবং অলিভার, চারজন এক সাথে একটা ফটো তুলবো। কিন্তু তুমি কোথায় গিয়েছিলে বলো তো? শেষ মুহূর্তে তোমাকে কোথাও দেখতে পাইনি আমি। তোমার জন্য কিন্তু আমার এই চাওয়াটা পূর্ণ হলো না। তুমি কি…”
জোহানের কথা আর সহ্য হচ্ছে না মিতুলের।
“থামবে তুমি? চুপচাপ খেতে পারো না? এত কথা বলো কেন?”
“কার্লের বিয়ে নিয়ে কথা বলছি দেখে তোমার হিংসা হচ্ছে? তোমার নিজের এখনও বিয়ে হয়নি দেখে তুমি অন্যের বিয়েকে হিংসা করছো? ওহ নো তুলতুল! এটা করা তোমার উচিত হচ্ছে না।”
মিতুলের মেজাজ এবার সত্যিই খারাপ হয়ে উঠছে। মিতুল অনেক কষ্টে নিজের মুখ বন্ধ রাখলো। জোহানের সাথে এখন কথা বললে ঝগড়া ছাড়া এ কথা সমাপ্তি পাবে না।
ক্যামিলা স্যালাড নিয়ে ফিরে এলো ডাইনিং রুমে। সাথে নুডুলসও নিয়ে এসেছে। সেগুলো টেবিলে রেখেই নিশ্চুপ চলে যায় ক্যামিলা।
জোহান আর কিছু বললো না। যে যার মতো ব্রেকফাস্ট করতে লাগলো। নীরবতা গেল কিছুক্ষণ। এর মাঝে জোহান হঠাৎ একটা আঙ্গুর হাতে নিয়ে সেটাকে খুঁটিয়ে নাটিয়ে দেখতে দেখতে বললো,
“ইউ নো তুলতুল? তুমিও না ঠিক এই আঙ্গুরটির মতো।”
জোহানের কথা কানে আসতেই কর্ণ খাড়া হয়ে উঠলো মিতুলের। ও চামচে ওঠানো নুডুলস মুখে না পুরেই চোখ তুলে তাকালো জোহানের দিকে।
জোহান বললো,
“তুমি এখন এই আঙ্গুরটির মতো আছো। কিন্তু যখন তুমি বৃদ্ধা হয়ে যাবে, তখন পরিণত হবে একটি শুকনো আঙ্গুরে। আই মিন কিশমিশ।”
জোহানের কথায় মিতুলের শিরা উপশিরা রাগে দপদপ করে উঠলো। অপমানের তীব্রক কথায় বিষিয়ে উঠলো মন। মিতুল দাঁড়িয়ে গেল চেয়ার ছেড়ে। হাতের কাঁটাচামচ দিয়ে সজোরে আঘাত করলো টেবিলে। বললো,
“আমি যদি কিশমিশ হই না, তবে তুমি হলে একটা শুকনো মরিচ।”
কথাটা বলেই মিতুল নিজের রুমের দিকে ছুটলো। ইতোমধ্যে দু চোখ দিয়ে পানি পড়ছে ওর। একে তো কার্লের জন্য হৃদয় ভেঙ্গে গেছে। আর এখন জোহানের এমন অপমান। দুটো একসাথে মিলে ওর মন বিদ্রোহ শুরু করলো ওর সাথে। বিষিয়ে উঠেছে ওর মন!
সোজা রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দিলো মিতুল। কেঁদে ফেললো ঝরঝর করে। এত বড়ো অপমান পেল আজ জোহানের থেকে? এত বড়ো? ওকে একটা আঙ্গুরের সাথে তুলনা করলো? বৃদ্ধা হলে কিশমিশের মতো হয়ে যাবে বললো? ও খাটো বলে জোহান ওকে এইভাবে খোঁটা দিচ্ছে? জোহানের জন্য ঘৃণায় মন ভরে যাচ্ছে মিতুলের। না, আর থাকবে না এখানে। চলে যাবে। চলে যাবে এখান থেকে। এত বড়ো অপমানের পর এখানে থাকার মানসিকতা ওর নেই।
___________
মিতুল রুমের ভিতর বসে অনেক কাঁদলো। আজকের মতো মন খারাপ আর জীবনে হয়নি। ও একটু খাটো বলে এভাবে তাচ্ছিল্য করতে পারলো জোহান? সারাদিনে রুম থেকে বের হয়নি। ক্যামিলা খাবারের জন্য ডাকতে এলে, বলে দিয়েছে খাবে না।
ক্যামিলা জানে মিতুলের এমন করার কারণ, তাই আর কাউকে জানালো না ব্যাপারটা।
জোহান ক্যামিলাকে আশ্বাস দিয়েছে সব ঠিক হয়ে যাবে।
সন্ধ্যায় যথারীতি আবার মিতুলকে ডাকতে এলো ক্যামিলা। তখন মিতুলের কান্না থেমে গেছে। কিন্তু মনে রয়ে গেছে ক্ষোভ, অভিমান এবং ঘৃণা।
ক্যামিলা দরজায় নক করে বললো,
“মিতুল দরজা খোলো। সকালে ব্রেকফাস্ট না করেই চলে এলে। এরপর সারাদিনে আর কিছু খেলেও না। এরকম করলে শরীর খারাপ হবে। দেখো, তুমি যদি এখন রুম থেকে বের না হও তবে আমি মনে ভীষণ কষ্ট পাবো। কেঁদে ফেলবো কিন্তু আমি। প্লিজ বের হও সুইটি।”
ক্যামিলার বার বার এমন অনুরোধ মিতুলকে আবেগে আপ্লুত করে দেয়। এই ক্যামিলা একমাত্র ব্যক্তি যে ওকে কেয়ার করে। ক্যামিলা ছাড়া আর কারো কেয়ার পায়নি কানাডা আসার পর। অথচ দেখো, যে মানুষটি ওকে এত কেয়ার করে, সেই মানুষটির ডাকেও এখন রুমে থেকে বের হতে ইচ্ছা করছে না।
মিতুল রুমের ভিতর বসেই বললো,
“ক্যামিলা, আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। তুমিই বলো, জোহান কী করে এমন একটা কথা বলতে পারলো আমায়! আমি একটু খাটো বলে আমাকে এভাবে তাচ্ছিল্য করবে ও? কতটুকু খাটো আমি যে আমাকে একটা আঙ্গুরের সাথে তুলনা করবে ও? মুখ দিয়ে যা খুশি বলে দেয়, মানুষের মনে কতটা আঘাত লাগে সেই কথায়, সেটা জানে ও? বোঝে কিছু?”
ক্যামিলা বললো,
“আমি বুঝতে পারছি ও একটা গুরুতর অন্যায় করে ফেলেছে। এখন এটার জন্য তুমি না খেয়ে থাকবে? রুম থেকে বের হবে না? দেখো পাগলামি করো না। আমি স্পেশাল ড্রিংক বানিয়েছি তোমার জন্য। তুমি তো আমার হাতে বানানো ড্রিংক পছন্দ করো। আমি বানিয়ে রেখেছি তোমার জন্য। এখন তুমি যদি সেটা পান না করো, তাহলে আমার মনে কতটা আঘাত লাগবে বুঝতে পারছো? প্লিজ সুইটি, দরজা খোলো। বের হও রুম থেকে।”
ক্যামিলার কথা শুনে মিতুলের খুব কষ্ট লাগছে। মিতুল আর দরজা না খুলে থাকতে পারলো না। দরজা খুলতে গেল।
দরজা খোলার সাথে সাথেই কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটা হাত খপ করে ওর ডান হাত আঁকড়ে ধরলো।
মিতুল ভালো করেই বুঝতে পারলো এই হাত ক্যামিলার নয়। হ্যাঁ, ঠিক তাই। এই হাত ক্যামিলার নয়। জোহান ওর হাত আঁকড়ে ধরেছে। মিতুল সন্দ্বিগ্ন চোখে জোহানের পাশে ক্যামিলার দিকে তাকালো। এর মাঝেই হাতে টান পড়লো ওর।
জোহান ওকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তাহলে এটা জোহানের কারসাজি ছিল? ওকে রুম থেকে বের করতে ক্যামিলাকে ইউজ করেছে? জোহানের প্রতি রাগ ক্ষোভ আরও বেড়ে গেল মিতুলের। মিতুল কড়া গলায় বললো,
“হাত ছাড়ো জোহান। আমি কিন্তু জোরে চিৎকার করবো।”
জোহান একেবারে ভাবলেশহীন। মিতুলের কথায় একটুও দমলো না। মিতুলের হাত তো ছাড়লোই না। উল্টো বললো,
“করো চিৎকার। সমস্যা নেই। কে শুনবে তোমার চিৎকার? কাকে ডাকবে তুমি চিৎকার করে? কেউ নেই বাড়িতে। মম শপে গেছে। ব্রাদার বন্ধুদের সাথে টাইমপাসে। ড্যাড আছে শুধু। কিন্তু সেও বোধহয় এতক্ষণে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছে। এখন তোমার হৃদয়ে যদি কোনো মায়া না থাকে, সারাদিন কাজে ব্যস্ত থাকা একজন ক্লান্ত-ঘুমন্ত মানুষের জন্য যদি তোমার কোনো দয়া না হয়, তবে তুমি জোরে চিৎকার করে জাগিয়ে দাও তাকে। তবে এতে তুমি একজন নির্দয় মানুষের পদবি পাবে তুলতুল।”
জোহান যতক্ষণে কথাগুলো বললো, ততক্ষণে সিঁড়ি বেয়ে হলরুমে নেমে গেছে ওরা।
মিতুল চিৎকার করতে পারলো না। চিৎকার করাটা যুক্তি সঙ্গত মনে হলো না ওর। জোহান ওকে নিয়ে গ্যারেজে এলো। গাড়িতে ঢুকে বসতে বাধ্য করলো ওকে। তারপর নিজেও এসে বসলো। গাড়ি স্টার্ট দিলো।
বাড়ি থেকে বের হয়ে মুক্ত খোলা রাস্তায় পদার্পণ করলো গাড়ি। মিতুল বুক ভর্তি ঘৃণা নিয়ে তাকিয়ে আছে জোহানের দিকে। চোখ ভিজে উঠছে ওর। এই মানুষটা এত এত অপমান করেছে ওকে! অপমানগুলো ওর জীবনের বাজে স্মৃতি হয়ে থাকবে। জীবনের সুখের সময়গুলোতে সেই অপমান মনে পড়লেও হৃদয় হু হু করে কেঁদে উঠবে। একটা আঙ্গুরের সাথে তুলনা করেছিল ওকে সেটা তো এই ইহজমনে ভুলতে পারবে না। এবং এর জন্য জীবনে ক্ষমাও করতে পারবে না জোহানকে।
ত্রিশ চল্লিশ মিনিটের মধ্যে একটা লেকের পাশে গাড়ি পার্ক করলো জোহান। গাড়ি থামতেই মিতুল নেমে গেল গাড়ি থেকে। আশেপাশে তাকালো। প্রায় জনমানবহীন জায়গা। বেশি মানুষজন দেখা যাচ্ছে না এখানে। রাস্তার বাম পাশে কিছুটা সমতল জায়গা। তারপরই সমতল জায়গা শেষ হয়ে বিপুল জলরাশির লেক।
জোহান গাড়ি থেকে নামতে নামতে বললো,
“এর আগে তো আমার নামাতে হতো তোমাকে গাড়ি থেকে। আজকে নিজ থেকেই এত দ্রুত নেমে গেলে কীভাবে?”
জোহানের কথা কানে আসতে মিতুল তাকালো জোহানের দিকে। এক নজর দেখে জোহানের থেকে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়ালো ও। জোহানকে দেখলেও ওর হৃদয় ঘৃণার জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে। চোখেও পানি এসে যাচ্ছে।
জোহান মিতুলকে এমন করতে দেখে খুব নরম কণ্ঠে বললো,
“হেই তুলতুল, রাগ করেছো আমার সাথে?”
জোহানের কথা বর্শার ধারালো ফলার মতো হৃদয়ে এসে বিঁধলো মিতুলের। বর্শা ফলার আঘাতে রক্তক্ষরণ হলো ওর হৃদয়ে। দু চোখ থেকে সত্যিই এবার টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়লো।
মিতুলকে চুপ করে থাকতে দেখে জোহান বললো,
“কথা বলবে না আমার সাথে?”
জোহানের কথা শুনে আর চুপ করে থাকতে পারলো না মিতুল। জোহানের দিকে অশ্রু ঝরা চোখেই তাকিয়ে বলে উঠলো,
“তোমার কি মন নেই জোহান? কোনো কিছু অনুভব করতে পারো না তুমি? মুখে যখন যা আসে তখন তাই বলে দাও। এতে মানুষের মনে কতটা কষ্ট লাগে সেটা বোঝো তুমি? তুমি লম্বা বলে কি খাটো মানুষদের মানুষ বলে মনে হয় না তোমার? কী ভাবো তাদের? আঙ্গুর? আমি না হয় একটু খাটো, তাই বলে তুমি আমাকে এভাবে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করবে?”
মিতুলের চোখ থেকে অনবরত নোনা জল ঝরছেই।
মিতুলের কান্না দেখে জোহানের বাকরুদ্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। জোহান দ্রুত মিতুলকে বোঝানোর চেষ্টা করে বললো,
“উহ মিতুল, তুমি এটাকে সিরিয়াসলি নিয়েছো? আমি তো সেরকম অর্থে বলিনি কথাটা। আমি তো জাস্ট মজা করেছি তোমার সাথে।”
মিতুল জোহানের কাছ থেকে সরে লেকের পাড়ে যেতে যেতে বললো,
“মানুষকে খুব বোকা ভাবো তুমি, তাই না? ভাবো পৃথিবীতে যত বুদ্ধি আছে তা সব তোমার মাথায়। বিশ্ব সেরা একজন বুদ্ধিমান তুমি। ভাবো, মানুষকে যখন যা বোঝাবে, মানুষ সেটাই অন্ধের মতো বিশ্বাস করবে।
প্রথমে অপমান করে বলবে, একটা আঙ্গুরের মতো তুমি। পরে আবার বলবে, ওটা জাস্ট ফান করে বলেছো। আর মানুষ সেটাই অন্ধের মতো বিশ্বাস করে নেবে। না জোহান, না। মানুষকে এতটা বোকা ভেবো না তুমি। আমি খাটো বলে আমাকে অপমান, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে আঙ্গুর বলেছো, সেটা খুব করে বুঝতে পারি আমি। অবুঝ নই আমি। এত বোকা ভেবো না আমাকে।”
বলতে বলতে লেকের পাড়ে এসে গেছে মিতুল।
আর ওর পিছন পিছন জোহান। জোহান বললো,
“লিসন মিতুল, আমি এটা নিয়ে মোটেই তোমাকে বোকা ভাবছি না। বোঝার চেষ্টা করো তুমি। আমি মোটেই তোমাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করিনি। বিলিভ মি।”
মিতুল পিছনে তাকালো। ওর দুই চোখ দিয়ে এখনও পানি ঝরছে। মিতুল বললো,
“কী বুঝবো? কী বোঝার চেষ্টা করবো আমি?”
মিতুল জোহানের থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে আবার বললো,
“না, আসলে ঠিকই আছে। আমি বোকাই। কানাডা ঘুরতে আসা আমার জীবনের সবথেকে বড়ো বোকামিই ছিল। আর এই বোকামিটা সারাজীবন আমাকে পিষে মারবে। আর তার জন্য দায়ী শুধু তোমরা।”
কথাটা বলার পরই মিতুলের কান্নার গতি আরও বেড়ে গেল। শব্দ করে কাঁদছে ও।
এমন পরিস্থিতিতে জোহানের দিশেহারা লাগছে। মিতুলকে শান্ত করার জন্য বললো,
“আই অ্যাম স্যরি, মিতুল! আমি বুঝতে পারিনি ব্যাপারটা তুমি এভাবে নেবে। আই অ্যাম রিয়েলি স্যরি। প্লিজ, কান্না থামাও তুমি।”
জোহানের বিশ্বাস ছিল মিতুল একটু শান্ত হবে। কিন্তু মিতুল তার ধারে কাছ দিয়েও গেল না। মিতুল আগের থেকে আরও জোর তেজি গলায় বলে উঠলো,
“শুধু আঙ্গুর বলেই যে আমাকে ছোট করেছো সেটা নয়। কথায় কথায় বাংলাদেশ নিয়েও নানাভাবে ছোট করে কথা বলো আমাকে। আচ্ছা বাংলাদেশ কি তোমার নিজের কেনা সম্পত্তি? কোন সাহসে, কোন অধিকারে বাংলাদেশ নিয়ে তুমি এভাবে কথা বলো? কোন সাহসে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করো বাংলাদেশকে?”
এমন পরিস্থিতিতেও জোহান এবার হেসে ফেললো মিতুলের কথা শুনে।
যা দেখে মিতুলের মেজাজ আরও চড়াও হলো। এমন একটা সিরিয়াস মুহূর্তে জোহান হাসছে?
জোহান মুখে একটু হাসি ধরে রেখে বললো,
“এই বোকা মেয়ে, কে বললো যে আমি বাংলাদেশকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করি? ভুল। ভুল এটা। আমি মোটেই বাংলাদেশকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করি না। বাংলাদেশ নিয়ে এর আগে আমি নেগেটিভ যা বলেছি, তা সবই ছিল তোমার জন্য। মজা করেছি তোমার সাথে। তোমাকে রাগানোর জন্যই ওসব বলতাম আমি।”
মিতুল কিছুতেই বিশ্বাস করলো না। বললো,
“মিথ্যা। আমাকে বৃথা মিথ্যা বুঝ দিতে এসো না।”
জোহান দুই পাশে মাথা নাড়িয়ে বললো,
“একদমই মিথ্যা নয়। আমি কী করে বাংলাদেশ নিয়ে ওরকম কথা বলতে পারি মন থেকে? আমার মম, ড্যাড, আমার রিলেটিভসরা সবাই-ই তো বাংলাদেশি। আর তাছাড়া আমার সুন্দরী, খাঁটি মনের মানুষটাও যে বাংলাদেশেই থাকে।”
মিতুলের মস্তিষ্ক সচকিত হয়ে উঠলো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো জোহানের দিকে। ওর গলার তেজ হঠাৎ কোথায় যেন হারিয়ে গেল। খুবই শান্ত, ছোট কণ্ঠে বললো,
“বাংলাদেশেও তোমার সুন্দরী, খাঁটি মনের মানুষ আছে? এখানে এত এত গার্লফ্রেন্ড তোমার…বাংলাদেশেও আছে?”
জোহান হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়িয়ে বললো,
“হুম আছে তো। তাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি। বাংলাদেশের ভিতর আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ হলো সে। শি ইজ মাই…”
থামলো জোহান। বলার আগে একবার মিতুলের অভিব্যক্তি দেখে নিলো ভালো করে। তারপর মৃদু হেসে বললো,
“শি ইজ মাই সুইটি। মাই গ্র্যান্ডমাদার!”
মিতুলের মনে হলো এইমাত্র যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো ও। টের পাচ্ছে স্বস্তি ফিরে এসেছে ওর মাঝে। মিতুল বড়ো করে একটু শ্বাস নিলো। তারপর বললো,
“আর থাকবো না। থাকবো না আর কানাডা। খুব শীঘ্রই বাংলাদেশের ফ্লাইট ধরবো আমি। কানাডা আমার জন্য নরক হয়ে গেছে। এই কানাডা এত কিছু দিয়েছে আমাকে যার ভার সামলাতে পারছি না আমি আর। কানাডা আসার পর আর কিছু পাওয়ারই বাকি নেই আমার। সব পেয়েছি আমি। কিছুই বাকি নেই আর। অপমান, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য, কষ্ট, অবহেলা, হৃদয়ভাঙ্গা সব। হৃদয় ভাঙ্গার কষ্ট কেমন হয় সেটাও ভালো করেই জেনেছি। কিছুই আর বাকি নেই।”
বলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালেই জোহান মিতুলের এক হাত টেনে ধরলো। বললো,
“সব পাওনি তুলতুল। এখনও একটা জিনিস বাকি আছে। অপমান, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য, কষ্ট, অবহেলা, হৃদয়ভাঙ্গা পেয়েছো। কিন্তু এখনও যে একটা জিনিস পাওয়া বাকি। সেটা না নিয়েই দেশে ফিরবে তুমি?”
মিতুল পিছন ফিরে বললো,
“কী বাকি? কিছুই বাকি নেই আর। আমার হিসাবের খাতা একদম পরিপূর্ণ। আর ফাঁকা নেই এতটুকু।”
“উহু, হিসাবের খাতা পরিপূর্ণ নয় তোমার। এখনও একটা জিনিস পাওয়া বাকি তোমার।”
মিতুল কয়েক সেকেন্ড কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইল জোহানের দিকে। তারপর জিজ্ঞেস করলো,
“কী বাকি আছে আর?”
জোহান মিতুলের কানের কাছে মুখ এনে বাংলাতে ফিসফিস করে বললো,
“ভালোবাসা!”
(চলবে)