#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৪৬
____________
মিতুলের সাথে অপরিচিত জায়িনকে দেখে কার্ল জিজ্ঞেস করলো,
“হু ইজ হি?”
মিতুল যতটা সম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়েছে। বললো,
“হি ইজ জায়িন আহমেদ।”
কার্ল একটু মনে করার চেষ্টা করে বললো,
“ওহ, জাইন? জোহ্যানের বিগ ব্রো?”
বিস্ময়ে জায়িনের ভ্রু জোড়া একেবারে কুঁচকে আছে। কারা এরা? জায়িন মিতুলকে প্রশ্ন করলো,
“এরা কারা? কীভাবে চেনো তুমি এদের?”
মিতুল পরিচয় করিয়ে দিলো,
“ও হলো কার্ল। আমার ফ্রেন্ড। আর এ হলো ওর ওয়াইফ অলিভার।”
জায়িনের যদিও ভালো লাগেনি কার্ল এবং অলিভারকে, তবুও হাসার চেষ্টা করে ‘হাই’ জানালো।
মিতুল বললো,
“একটা রেস্টুরেন্টে কার্লের সাথে আমার দেখা হয়েছিল। ও সেখানকার স্টাফ। তো সেই দেখা থেকেই পরিচয়, বন্ধুত্ব।”
মিতুল চাইছিল সংক্ষেপে কথাবার্তা শেষ করে দ্রুত কেটে পড়বে কার্লের সামনে থেকে। কিন্তু কার্ল যেতে দিলো না। জোরাজুরি করে ওদের একটা টেবিলে এনে বসালো।
জায়িনের মোটেই ভালো লাগছে না এরকম অপরিচিত মানুষ জনের সাথে একসাথে বসতে। তবুও ধৈর্য ধরে বসলো।
কার্ল মিতুলকে ডেকে নিয়ে গেল ওপাশে আলাদা ভাবে কথা বলার জন্য।
মিতুলের মোটেই এরকম করে কথা বলতে ইচ্ছা করছিল না কার্লের সাথে। কিন্তু না এসে কোনো উপায় ছিল না। কার্ল প্রথমেই বললো,
“এটা কিন্তু আমি আগেই ধারণা করেছিলাম।”
মিতুল অবাক হয়ে বললো,
“কী?”
“এই যে তুমি এবং জোহ্যান খুব শীঘ্রই রিলেশনে জড়িয়ে যাবে সেটা।”
মিতুল বিস্ময়ের চূড়ায় পৌঁছে গেল। কার্ল কীভাবে জানলো ও এবং জোহান রিলেশনশিপে আছে? মিতুল প্রশ্নটা করেই ফেললো,
“তুমি কীভাবে জানলে আমি এবং জোহান রিলেশনে আছি?”
“জোহান গত পরশু আমার সাথে দেখা করে বলেছে এটা। কেন তুমি জানতে না ও আমার সাথে দেখা করেছে?”
মিতুল জানতো কী, ও তো জানার ধারে কাছেও ছিল না। জোহান ওকে না জানিয়ে কীভাবে কার্লকে বলে দিলো এটা? এটা কেন বেছে বেছে কার্লকেই বলতে হবে? শত হলেও কার্ল তো ওর প্রথম ভালো লাগা ছিল। জোহানের প্রতি একটু রাগ হলো মিতুলের।
কার্ল বললো,
“কংগ্রাচুলেশন! আমি খুব খুশি হয়েছি। তোমাদের বিয়ে দেখার অপেক্ষায় থাকবো আমি।”
মিতুলের অস্বস্তি হচ্ছে। কার্লের সামনে ঠিক স্বাভাবিক থাকতে পারছে না। মিতুল একটু হাসার চেষ্টা করে ধন্যবাদ জানালো। আর মনে মনে শুকরিয়া আদায় করলো। ভাগ্যিস কার্ল আলাদা করে ডেকে এনে এসব কথা বললো। জায়িনের সামনে যদি এসব কথা বলতো তাহলে…
না, আর ভাবতেই পারছে না ও।
কার্ল এবং অলিভারের সাথে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে বাড়ি ফিরলো জায়িন, মিতুল।
রুমে ঢুকে শাড়ি পাল্টে, মুখের মেকআপ তুলে ফ্রেশ হলো মিতুল। তারপর একটু নিচে যাবে বলে বের হলো রুম থেকে। জায়িনের রুমের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় থেমে গেল ও। ভিতর থেকে একটু রাগি গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। মিতুলের ভিতরটা অজানা ভয়ের আশঙ্কায় কেঁপে উঠলো। মিতুল কান পাতলো দরজায়। জায়িনের কথা শুনে মনে হলো ফ্রেডির সাথে কথা বলছে। মিতুল কথা বলার বিষয়টাও ধরতে পারলো। ডিনারের সময় ও যে ফ্রেডির নামে মিথ্যা বলেছিল, সেটা নিয়েই কথা বলছে জায়িন। মিতুল ভয়ে ভয়ে ঢোক গিললো।
জায়িনের সব কথা শুনে ফ্রেডি ফোনের ও প্রান্ত থেকে বললো,
“আরে আমি তো তোর দুটো রিলেশন ছিল সে ব্যাপারেই কাউকে বলিনি, তাহলে তোর গার্লফ্রেন্ডসরা নিজেরা ব্রেকআপ করে চলে গেছে, সেটা কীভাবে কাউকে বলতে পারি? আর মিতুলের কথা বলছিস? ওর সাথে তো আমার সেদিনের পর থেকে আর দেখাই হয়নি। জোহান ওকে সেদিন আমার সামনে থেকে টেনে নিয়ে যাওয়ার পর এক সেকেন্ডের জন্যও দেখা হয়নি ওর সাথে আমার। তাহলে আমি ওকে এ ব্যাপারে বললাম কখন?”
জায়িন ফ্রেডির কথা মোটেই বিশ্বাস করলো না। আত্মবিশ্বাসের সাথে বললো,
“তুই-ই বলেছিস ওকে। আমি নিশ্চিত তুই ছিলি এটা। ফার্স্ট মিটেই হয়তো এই কথাটা বলেছিস ওকে।”
“ফার্স্ট মিট…ফার্স্ট মিটেও তো আমি ওর সাথে তেমন কথা বলতে পারিনি। সে বারও জোহান এসে ঢুকে পড়লো কথা বলার মাঝে। আর ফার্স্ট মিটে কি কেউ এসব ব্যাপার নিয়ে কথা বলে?”
“বলে। আর কেউ না বললেও তুই বলিস। শোন, তোর সাথে এখন কথা বলতে চাই না আমি। তোর উপর এখন রাগ আমার। নেক্সট তিন দিন তুই আমার সাথে কোনো কথা বলতে আসিস না!”
“ওহ জায়িন, এটা অতিরিক্ত! আমি কাউকে কিছু বলিনি তোর ব্যাপারে।”
জায়িন এবং ফ্রেডির মাঝে আরও কিছুক্ষণ বাকবিতন্ডা চললো। মিতুল কান সরালো না দরজা থেকে। মনোযোগ সহকারে শুনতে লাগলো ভিতরে জায়িনের কথা। ওর মনে ধরা পড়ে যাওয়ার তীব্র আশঙ্কা!
জোহান সিঁড়ি বেয়ে দ্বিতীয় তলায় উঠতেই ব্রাদারের রুমের দরজায় মিতুলকে একেবারে কান মিশিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। জোহান বিস্মিত কণ্ঠে বললো,
“কী করছো তুমি?”
হঠাৎ করে জোহানের গলা মিতুলের হাত পা ভয়ে নাড়িয়ে দিলো। জোহানকে দেখতে পেয়েই মিতুল জায়িনের দরজার কাছ থেকে সরে দৌঁড়ে জোহানের কাছে এলো। কোনো কথা না বলে জোহানকে হাত ধরে টেনে নিয়ে এলো বারান্দায়।
“এসব কী করছো তুমি? এরকম আজব আচরণ করছো কেন?” নিজের হাত ছাড়িয়ে নিতে নিতে বললো জোহান।
“আমি বোধহয় ধরা পড়ে যাব জোহান!”
“…’ধরা’ মানে?”
মিতুল জোহানকে সব খুলে বললো।
“এখন আমি কী করবো? তোমার ব্রাদার যদি জানে আমি যা বলেছি তা মিথ্যা, আসলে ফ্রেডি নয় তুমি আমাকে বলেছিলে তার রিলেশন সম্পর্কে, তখন?”
“সে আমি কী জানি? আমি কি তোমাকে আমার বদলে ফ্রেডির নাম বলতে বলেছিলাম?”
“তোমার ভালোর জন্যই তো বলিনি।”
“এখানে আমার ভালো হলো কোত্থেকে? কী ভালো করেছো তুমি আমার?”
“কোনো ভালো করিনি?”
“আমি তো দেখতে পাচ্ছি না। আর যদি ভালো করেও থাকো, তবে এখন আমার কিছু করার নেই। নিজের ঝামেলা নিজে সামলাও।”
মিতুলের মাথায় এবার রাগ চড়ে গেল।
“ও, তোমার ভালো করতে গিয়ে এখন আমার নিজের ঝামেলা নিজের সামলাতে হবে? ঠিক আছে, নিজের ঝামেলা নিজেই বুঝে নেবো আমি। একবার বাংলাদেশে যাই, আর জীবনে আসবো না এই কানাডা। কানাডার কোনো প্রান্তে তুমি আমার ছায়া দেখতে পাবে না আর কোনোদিন। এই আমি বলে দিলাম।”
“হেই তুলতুল, এত রুড সাজছো কেন তুমি? আমাকে ছেড়ে বাংলাদেশে তুমি একা একা থাকতে পারবে? কষ্ট হবে না তোমার?”
“তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না কেন? কে তুমি আমার? অবশ্যই পারব আমি। বিন্দু মাত্র কষ্ট হবে না আমার। বিপদে যাকে পাশে পাইনি তার জন্য আবার কী কষ্ট হবে?”
“কিন্তু আমার যে খুব কষ্ট হবে। কষ্টটা আমার অসুখ হয়ে দাঁড়াবে। মরণব্যাধি অসুখ। তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না আমি। তুমি কানাডা এসে আমার পাল্টে যাওয়া জীবনে আরও পরিবর্তন এনে দিয়েছো। আমার জীবন আরও বেশি চঞ্চল করে তুলেছো তুমি। আমার ভিতরের চাপা কষ্টটাও প্রায় মুছে গেছে তোমার কারণে। তুমি আমার ঝাপসা অন্ধকার জীবনে এক চিলতে আলো।”
মিতুলের ভিতরটা আবেগী হয়ে উঠছে। মিতুল বুঝতে পারছে জোহান ওকে ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করছে। মিতুল যথাসাধ্য কঠিন থাকার চেষ্টা করে বললো,
“যত যাই বলো না কেন লাভ হবে না। একবার চলে গেলে আর আসবো না কানাডা।”
বলে মিতুল দ্রুত পায়ে বারান্দা ত্যাগ করলো।
পিছন থেকে ডেকেও আর লাভ হলো না। মিতুল রুমে এসে দরজা বন্ধ করলেই জোহানের ম্যাসেজ এলো।
‘তোমার আসতে হবে না কানাডা। আমি গিয়ে নিয়ে আসবো। স্বেচ্ছায় না এলে জোর করে নিয়ে আসবো। তারপর ছোট্ট টাইম হাউজে থেকে আমরা আমাদের সংসার কাহিনী লিখবো। কী বলো, শ্রেষ্ঠ একটা কাহিনী হবে না এটা? জো এবং তুলতুলের সংসার কাহিনী!’
ম্যাসেজটা দেখে মিতুলের চোখ কপালে উঠলো। হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরলো ও। কী লিখলো জোহান এটা? জো, তুলতুলের সংসার কাহিনী? সংসার পর্যন্ত চলে গেছে জোহান? জোহানের লজ্জা কি আরও কমে যাচ্ছে?
____________
অনেকগুলো দিন কেটে গেল। জোহান এবং মিতুলের প্রেম সকলের অগোচরে ভালোই এগিয়েছে। গাঢ় হয়েছে ওদের প্রেম। তবে মাঝে মধ্যেই তুমুল ঝগড়া বেঁধে যায় ওর এবং জোহানের মাঝে। আর মিতুল তখনই জোহানকে বাংলাদেশ চলে গেলে আর কানাডা আসবে না বলে হুমকি দেয়।
এত কদিনে মিতুল আবার বেশ কেয়ারিংও হয়ে গেছে জোহানের প্রতি। এই তো এখন। এখনই জোহানের জন্য যত্ন করে কফি তৈরি করছে ও। কফি বানাচ্ছে মেশিনে। জোহানই তো ওকে মেশিনে কফি বানাতে শিখিয়েছিল। কফি বানানো হলে, ক্যামিলার বানিয়ে দেওয়া ব্রেকফাস্ট নিয়ে জোহানের টাইম হাউজে যাবে। জোহানের সাথে কাল রাত থেকে দেখা হয়নি ওর। সন্ধ্যা বেলায় জোহান বন্ধুদের সাথে মিট করার জন্য বেরিয়ে গিয়েছিল। এসেছিল অনেক দেরিতে। ততক্ষণে ও ঘুমিয়ে গিয়েছিল। সকালে উঠে ক্যামিলার কাছ থেকে শুনলো জোহান টাইম হাউজে। তাই এখন টাইম হাউজে ব্রেকফাস্ট নিয়ে যাবে জোহানের জন্য। কফি বানানো হয়ে গেছে। ক্যামিলা জোহানের ব্রেকফাস্ট ট্রেতে করে সাজিয়ে দিলে, মিতুল কিচেন থেকে বের হলো ট্রে নিয়ে। এখান থেকেই হলরুমে চোখ পড়লো। জায়িন বসে আছে। ল্যাপটপ নিয়ে ব্যস্ত সে। জায়িনের অহংকারী ভাবটা অনেকটাই কমে গেছে বলে মিতুলের ধারণা। জায়িন এখন নিজে এসেই মাঝে মধ্যে কথা বলে ওর সাথে। যখন ও লন, হলরুম কিংবা বারান্দায় একাকী বসে থাকে। এর মধ্যে দুই, তিন বার জায়িন ওকে বাইরেও ঘুরতে নিয়ে গিয়েছিল। তবে মিতুলের জায়িনের সাথে ঘুরতে যেতে ভালো লাগে না। জোহানের সাথে ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছা করে ওর। সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে মনের তৃপ্তি নিয়ে ঘোরেও জোহানের সাথে।
জোহান একদিন ক্যালগারিতে একটা ফাংশনে গিয়েছিল। দুই দিন ছিল সেখানে। মিতুলের তখন কিছুই ভালো লাগতো না। মোবাইল নিয়ে বসে থাকতো সবসময়। কখন জোহান কল দেবে সেই আশায়। ওর মস্তিষ্ক, হৃদয় সকল স্থান জুড়েই কেবল জোহানের বসবাস এখন। মিতুল কিচেনের সামনে দাঁড়িয়েই এসব ভাবলো। তারপর চুপিচুপি ধীর পা ফেলে বেরিয়ে এলো ব্যাক ডোর দিয়ে।
মিতুল টাইম হাউজে এসে দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করলো। দরজা লক করা ছিল না। জোহানকে দেখতে পেল কাউচের উপর শোয়া। ঘুমিয়ে আছে বোধহয়। দরজা খোলা রেখে এভাবে ঘুমিয়ে ছিল? মিতুলের খানিক বিরক্ত লাগলো। মিতুল জোহানের কাছে এসে দাঁড়াতে ওর চোখ চলে গেল জোহানের গালে। গালের উপরিভাগের অংশটা কিছুটা লাল। মিতুলের মন আপনা থেকেই জানান দিলো ওই রাবিশগুলো আবারও মেরেছে জোহানকে। নিশ্চয়ই ঘুষি মেরে জোহানের গাল লাল বানিয়ে ফেলেছে! রাবিশগুলোর প্রতি ভীষণ রাগ এবং জোহানের জন্য ভীষণ মায়া অনুভব হলো মিতুলের।
মিতুল জোহানকে ঘুম থেকে জাগানোর জন্য ডাকলো,
“জোহান!”
একটা ডাকেই জোহান জাগলো। মিতুলকে দেখে ঘুম ঘুম চোখে উঠে বসলো। মুখটা ফোলা ফোলা দেখাচ্ছে জোহানের। বাচ্চা বাচ্চা ছাপটা আরও ভালো ভাবে ফুঁটে উঠেছে তাই। কালো চুলগুলো উস্কোখুস্কো। কালো চুল! হ্যাঁ, কালো। জোহান নিজের হেয়ার কালার চেঞ্জ করেছে। বাদামি চুলগুলো কালো করে ফেলেছে। মিতুল তাতে মোটেই খুশি হয়নি। জোহানের বাদামি চুলই ওর প্রিয় ছিল। মিতুল জোহানকে হুকুম দিয়েছে খুব শীঘ্রই চুলগুলো আবার বাদামি করে ফেলার জন্য। বাদামি চুলে জোহানকে বিদেশি বিদেশি লাগতো। এখনও একটু একটু বিদেশি বিদেশিই লাগছে। তবে অতটা না। কিন্তু বাদামি চুলে লাগতো। কানাডা আসার প্রথম দিনেই তো জোহানকে বিদেশি ছেলে ভেবে ভুল করেছিল ও। ভুল করার মেইন কারণটা ছিল জোহানের বাদামি চুল এবং চোখ। মিতুলের মাঝে মধ্যে মনে হতো জোহান ফেস সার্জারি করেছে। এ নিয়ে একদিন জোহানকে প্রশ্নও করেছিল। মিতুলের প্রশ্ন শুনে জোহান হাসতে হাসতেই কাহিল। জোহান বলেছিল,
“এরকম একটা কথা তোমার মনে আসলো কী করে তুলতুল? ফেস সার্জারি…”
পুরো কথা শেষ না করেই জোহান আবার উচ্চৈঃশব্দে হেসে ওঠে। হাসি থেমেছিল খুব সময় নিয়ে। বলেছিল,
“সার্জারি করিনি আমি। এমনকি চোখে লেন্সও লাগাইনি। এমন চোখ তো অনেক বাংলাদেশিদেরই হয়ে থাকে। আমার দুই দুইটা কাজিনের চোখও এমন। আর হ্যাঁ, আমার লাভলি গ্রান্ডমাদারের চোখও আমার মতো। তবে আমি চুলে কালার করেছি সেটা ঠিক। আর তুমি যে বললে আমাকে কানাডিয়ানদের মতো লাগে, কোথায় লাগে? আমি তো দেখিনি কোনোদিন। আমার মম, ড্যাড দুজনই তো বাংলাদেশি। আমি কী করে কানাডিয়ানদের মতো হবো?”
“আমি জানি তোমার মম, ড্যাড দুজনই বাংলাদেশি। আর তোমার চেহারায় যে রেশমী আন্টির সদৃশভাব আছে, সেটাও জানি আমি। তবে তোমাকে দেখতে কিন্তু বিদেশি বিদেশিই লাগে।”
জোহান আবারও হেসে ফেলে।
“ওহ মিতুল, চুপ করো। তুমি এভাবে কথা বলতে থাকলে আমি কিন্তু হাসতে হাসতে মরে যাব।”
“তুমি আমার কথাকে ইয়ার্কি ভাবছো? তুমি জানো, আমি তোমাকে প্রথম যেদিন দেখেছিলাম, সেদিন বিদেশি ভেবে ভুল করেছিলাম?”
“ও তোমার চোখের ভুল। আমি দেখতে অত্যাধিক মাত্রার সুন্দর তো, সেজন্য তোমার অমন মনে হয়। এখানকার ছেলেরা তো ফর্সা হ্যান্ডসাম টাইপের হয় বেশির ভাগ। সেজন্য আমাকেও ওদের সাথে গুলিয়ে ফেলেছো।”
মিতুল গভীর ভাবে ভেবে দেখেছে জোহানের কথাটা। এটা কি ওর চোখের ভুল? না, এটা ওর চোখের ভুল নয়। চোখের ভুল হলে তো জায়িনকেও গুলিয়ে ফেলতো বিদেশি ভেবে। জায়িনও তো সুন্দর, ফর্সা, হ্যান্ডসাম একটি ছেলে। আসলে জোহানকে বিদেশি বিদেশিই লাগে। হোক সার্জারি করেনি জোহান। কিন্তু ফর্সা, হ্যান্ডসাম, বাদামি চুল, চোখে ওকে বিদেশি ছেলেই লাগে। জোহান সেটা খেয়াল করেনি হয়তো।
মিতুল পুরোনো স্মৃতিতে ডুবে গিয়েছিল। জোহানের কণ্ঠ ধ্বনিতে বর্তমানে ফিরে আসতে হলো আবার।
জোহান ঘুম ঘুম দৃষ্টি জোড়া ওর উপর ফেলে বললো,
“এত সকালে তুমি এখানে কেন?”
মিতুল জোহানের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে নিজেই পাল্টা প্রশ্ন করলো,
“তুমি নিজের চুলগুলো কবে বাদামি করবে আবার?”
“নেক্সট মানডে’তে।”
“মানডে’তে কেন? সানডে’র কী হলো?”
“তোমাকে না বললাম উইকেন্ডে আমরা কিছু বন্ধুরা মিলে বেড়াতে যাচ্ছি।”
মিতুল আর এ বিষয়ে কথা বাড়ালো না। অন্য প্রসঙ্গে এলো,
“তোমার গাল লাল কেন? ওই রাবিশগুলো আবার মেরেছে তোমায়?”
জোহান গালের লাল স্থানটায় হাত দিয়ে বললো,
“এটা তেমন কিছু না।”
“তেমন কিছু না বললেই হলো? ওই গবেটদের আমি পুলিশে দেবো।”
“তাহলে আমার নামটাও বলে দিয়ো পুলিশদের কাছে। ঝামেলা তো শুধু ওরা একা’রা করে না এখন। আমরাও করি।”
“হ্যাঁ, তোমার নামটাও পুলিশের কাছে বলা উচিত। আচ্ছা এই মারামারির সমাপ্তি ঘটাতে পারো না তোমরা? একটু সমঝোতা করতে পারো না? যদি এমন মারামারি করতে থাকো, তাহলে তো তোমার ট্রিটমেন্ট করতে করতেই আমার জীবন কেটে যাবে।”
“আমি তো সেটাই চাই। তুমি আমার একান্ত ডক্টর হয়ে থাকো সারাজীবন।”
জোহান একটু থেমে আবার বললো,
“আসলে কী জানো, আমি চাই না যে ওদের সাথে আমার মারামারির কোনো সমাপ্তি হোক। সত্যি কথা বলতে ওদের সাথে মারামারি করতে করতে ওদের বড্ড ভালোবেসে ফেলেছি আমি। এখন ওদের সাথে মারামারি না হলে অসুস্থ হয়ে যাব আমি।”
মিতুলের মুখ হা হয়ে গেছে জোহানের কথা শুনে।
“ওদের ভালোবেসে ফেলেছো মানে? ওদের কীভাবে ভালোবাসতে পারো? এমন শত্রুদেরও কেউ ভালোবাসে?”
“বাসে। অনেকেই হয়তো বাসে। এতগুলো বছর ধরে মারামারি করতে করতে আলাদা একটা মায়ার জন্ম হয়েছে ওদের প্রতি। ভালোবেসে ফেলেছি ওদের।”
“ওদের ভালোবাসলে তাহলে আমি কী? আমাকে ভালোবাসো না তুমি?”
“আরে ওদের ভালোবাসা আর তোমার ভালোবাসা কি এক হলো? তুমি তো আমার পুরো হৃদয় দখল করে আছো। আর ওরা হৃদয়ের আনাচে কানাচে একটুখানি জায়গা করে পড়ে আছে।”
মিতুল লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেললো। মিতুল একটা জিনিস লক্ষ্য করছে। জোহানের যেমন দিনদিন লজ্জা কমে যাচ্ছে, ওর তেমনি লজ্জা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। মিতুল মাথা নুইয়ে রেখেই বললো,
“ফ্রেশ হয়ে এসো।”
জোহান কোনো কথা না বলে বেডরুমে চলে গেল।
মিতুল ভাবছে অন্যকথা। ওই রাবিশগুলোর সাথে ভালোবাসা-বাসি করতে করতে যদি জোহান এই জীবনে মারামারি না থামায়, তাহলে কেমন হবে? এই মারামারির সমাপ্তি যদি না ঘটায়, তাহলে তো সত্যি সত্যিই ওর জীবনটা জোহানের ট্রিটমেন্ট করতে করতেই কেটে যাবে। অসম্ভব! এই ভালোবাসা-বাসি ও সহ্য করবে না।
মিতুল টাইম হাউজের ছোট্ট কিচেনে এসে টেবিলের উপর ট্রে রাখলো। কফি একেবারে ঠান্ডা হয়ে গেছে। হলে হোক।
জোহান এসে গেল। চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললো,
“কী কী এনেছো?”
মিতুল জোহানের সামনের চেয়ারে বসে ঢাকনা সরালো খাবারের উপর থেকে। ফ্রিটারস, ব্রেড, জেলি, ফ্রেশ স্যালাড এবং সাথে এক কাপ কফি।
“এই সামান্য ব্রেকফাস্ট এনেছো? আর কিছু ছিল না?”
মিতুল বিরক্ত কণ্ঠে বললো,
“ভাত ছিল। রেশমী আন্টি সকাল বেলা ভাত রান্না করতে বলেছিলেন খাবে বলে। তোমার জন্য ভাত নিয়ে আসলে তুমি খেতে?”
জোহান কিছু না বলে কফিতে চুমুক দিলো। মুখ বিকৃত করে বললো,
“এটা তো একেবারে ঠান্ডা।”
“ঠান্ডা থাকবে সেটাই তো স্বাভাবিক। তোমার জন্য তো আর কফি ঘণ্টার পর ঘণ্টা গরম থাকবে না। ঠান্ডা কফিই খাও।”
“আমি ঠান্ডা কফি খাই না। শুধু তোমাকে খুশি করার জন্য আর এক চুমুক খাবো আমি।”
জোহান কাপে চুমুক দেওয়ার জন্য কাপটা মুখের কাছে আনলো।
মিতুল আনমনে তাকিয়ে রইল জোহানের দিকে। মনটা বেশ খারাপ হয়ে পড়লো ওর। বাংলাদেশে ফেরার সময় প্রায় ঘনিয়ে এসেছে। আর অল্প কিছুদিন আছে এখানে। জোহানকে ছেড়ে দেশে গিয়ে কীভাবে থাকবে সেটা ভেবেই বার বার চিন্তায় পড়ে যায় ও। হৃদয়ে ব্যথা হয়। জোহানের হয়তো খেয়ালই নেই যে ওর কানাডা থেকে চলে যাওয়ার সময় খুব সন্নিকটে। মিতুলও জোহানকে বলেনি। আজকে বলবে ঠিক করেছে।
জোহান ব্রেডের গায়ে কামড় বসাতে যাবে এমন সময় মিতুল বললো,
“কানাডা থাকার সময় প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। খুব শীঘ্রই বাংলাদেশে ফিরতে হবে আমার।”
জোহানের আর ব্রেডের গায়ে কামড় বসানো হলো না। মিতুলের দিকে তাকালো। মিতুলের মুখটা কালো হয়ে আছে। জোহান বললো,
“আর কতদিন বাকি আছে?”
মিতুল শুকনো মুখে বললো,
“এইতো অল্প কিছুদিন!”
জোহানের মুখ গম্ভীরপূর্ণ হলো কিছু সময়ের জন্য। হঠাৎই আবার সেই গম্ভীর মুখে হাসি ফুঁটিয়ে বললো,
“যাও বাংলাদেশ, সমস্যা নেই। পরে তো আবার তোমাকে কানাডা নিয়েই আসবো আমি। কোনো ট্যুরিস্ট হিসেবে নয়। বিয়ে করে একেবারে বউ বানিয়ে নিয়ে আসবো তোমায়।”
জোহানের কথায় মিতুলের মন খারাপিটা কোথায় যেন ছুটে পালালো। মিতুল একটু হাসলো। লজ্জা লজ্জা একটা ভাবও দেখা দিলো ওর মাঝে।
জোহান খাচ্ছে নিশ্চিন্ত মনে।
মিতুল হঠাৎ বললো,
“একা একাই তো সেই থেকে খেয়ে যাচ্ছ। আমি যে সামনে আছি সেটা কি ভুলে গেছো?”
“তুমিও খাবে?”
মিতুল টেবিলের অপর প্রান্ত থেকে উঠে গিয়ে জোহানের পাশে গিয়ে বসলো চেয়ার নিয়ে। জোহান অবাক হচ্ছে।
মিতুল বললো,
“হুম খাবো আমি। তুমি খাইয়ে দেবে আমায়।”
জোহানের মুখে চমকিত ভাব ফুঁটে উঠলো।
মিতুল মুচকি হাসছে।
জোহানও নিজের চমকপ্রদ মুখে এক চিলতে হাসি ফোঁটালো। তারপর ফ্রিটারসের এক টুকরো চামচে গেঁথে মিতুলের মুখের দিকে নিয়ে আসলেই মিতুল বললো,
“উঁহু, চামচ দিয়ে খাবো না আমি। হাত। হাতে খাবো। হাত দিয়ে খাইয়ে দাও।”
জোহান আরও বেশি চমকে উঠলো। মিতুলের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,
“এটা কি সত্যিই আমার তুলতুল?”
মিতুল শান্ত কণ্ঠে বললো,
“হুম, এটা আমি। তোমার তুলতুল। শত সহস্র ফুল প্রাপ্তিদার প্রিয়তমা তোমার। যে খুব সংগোপনে এসে কড়া নেড়েছিল তোমার হৃদয়ের…”
মিতুল হঠাৎ জোহানের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
“এটা আমি, কেবল তোমারই লিটল এঞ্জেল।”
(চলবে)