#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৪৯
____________
রিকার্ডোদের দেওয়া গিফট বক্স খুলে মিতুল যারপরনাই অবাক। বক্সের ভিতর থেকে ছোট ফ্রেমে বাঁধানো ছবিটা হাতে তুলে নিলো মিতুল। এই ফ্রেমে বন্দি আছে ও এবং জোহান। ছবির ভিতরের জায়গাটা লেক লুইস। লেক লুইসের পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে ও আর জোহান। মিতুল মুগ্ধমনা হয়ে তাকিয়ে আছে দূরে লেক লুইস ঘেঁষে থাকা পাহাড়ের অপার সৌন্দর্যে। আর ঠিক ওর পাশে দাঁড়িয়েই জোহান মুগ্ধমনা হয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ছবি এটাই বলছে। এই ছবিটা তোলা না হলে মিতুল কখনোই জানতে পারতো না জোহান এই সময় এভাবে তাকিয়ে ছিল ওর দিকে। এটা ওর দৃষ্টির অগোচরে থেকে যেত। মিতুল ভালো করে জোহানের চাহনিটা পরখ করলো। কী মায়া লুকিয়ে আছে ওই চাহনিতে! এমন মায়াবী চোখে কেউ কি এর আগে ওর দিকে তাকিয়ে ছিল? না, আর কেউ তাকায়নি। মিতুলের ভিতরটা আবেগে আপ্লুত হয়ে উঠলো। এই ছবি কখন, কীভাবে তোলা হলো জানে না ও। ও নিশ্চিত জোহানও জানে না। এটা ওদের অগোচরে তোলা হয়েছে। দারুণ একটি মুহূর্ত ক্যামেরা বন্দি করেছে রিকার্ডো। আর গিফট হিসেবেও চমৎকার একটা গিফট। এর থেকে চমৎকার গিফট আর কী হতে পারে?
মিতুল আবার গিফট বক্সটার দিকে তাকালো। শুধু ওর এবং জোহানের ছবি নয়, ভিতরে আরও একটা ফ্রেম বাঁধানো ছবি আছে। মিতুল সেটাও হাতে তুলে নিলো। এটার ভিতরে ওকে দেখা যাচ্ছে জোহানসহ জোহানের সব ফ্রেন্ডসদের সাথে। এটা কখন তোলা হয়েছে জানে ও। প্রথম যেদিন জোহান ওকে নিজের ফ্রেন্ডসদের সাথে মিট করাতে রিকার্ডোর বাসায় নিয়ে গিয়েছিল, তখনকার এটা। তখন সবাই মিলে একটা ছবি তোলা হয়েছিল। সেটাই এটা। মিতুল ছবি দুটো বিছানার উপর রাখলো। বক্সের ভিতর আরও কিছু আছে। দেখলো একটা অ্যালবাম। জোহানের গানের অ্যালবাম এটা। ‘Guilty Summer’!
অ্যালবামটার সাথে আবার একটি নেকলেস বক্স। এত কিছু দিয়েছে জোহানের ফ্রেন্ডসরা? মিতুল খুবই আবেগী হয়ে পড়ছে। বেশিক্ষণ থাকলো না ওর এই আবেগ ঘন মুহূর্ত। ধীরে ধীরে চিন্তারা এসে ভিড় জমালো মস্তিষ্কে। ওর এবং জোহানের একই সাথে থাকা ফ্রেম বন্দি ছবিটার দিকে তাকালো। এই ছবি কোথায় লুকাবে ও? এই ছবি যদি কেউ দেখে ফেলে তাহলে তো সর্বনাশ হয়ে যাবে! কোথায় লুকাবে এটা? কানাডা তো যেমন তেমন, কিন্তু বাংলাদেশ? মা-আব্বুর চোখে যদি একবার পড়ে তাহলে তো… মিতুল একটু থমকে গেল।
কী হবে তাহলে? মাথায় এখন সেটাও আসছে না। এখন কিছুতেই মা-আব্বুর সামনে জোহানকে ভালোবাসে সেটা প্রকাশ করা যাবে না। ধীরে ধীরে এটা তাদের বোঝাতে হবে। বাড়িতে যখন বিয়ের কথা উঠবে, তখন আস্তে আস্তে বুঝিয়ে বলবে তাদের। হুট করে এই ব্যাপারটা তারা জেনে গেলে বিরাট কেলেঙ্কারি হবে। আব্বু হয়তো রাগের মাথায় বাড়ি থেকেই বের করে দেবে ওকে। নয়তো বিয়েও দিয়ে দিতে পারে! মিতুলের কিছু সময় চিন্তায় কেটে গেল। পরে আবার মাথাটা হালকা হলো। কোনো টেনশন নেই। এই ছবি লুকানোর বুদ্ধি মেহরিনের কাছ থেকে নেবে ও। মেহরিনের মাথায় ভালো ভালো বুদ্ধিই আছে। মিতুলের চোখ আবারও ছুটে গেল ওর এবং জোহানের ছবিটার উপর। ছবিটা তুলে নিলো হাতে। জোহানকে দেখানো উচিত এটা?
মিতুল সব গিফটগুলো আবার বক্সে ভরে জোহানের রুমের দিকে চললো। প্যাসেজওয়েতে থেকে এদিক ওদিক চোখ বুলালো। কেউ নেই। জোহানের রুমের দরজায় আস্তে করে নক করলো। দরজা খুললো না। আবারও নক করলো। একটু পরই দরজা খুলে গেল।
জোহান মিতুলকে দেখে বললো,
“তুমি?”
মিতুল কোনো কথা না বলে জোহানকে ঠেলে রুমে ঢুকে গেল। তারপর দরজাটা চেপে বন্ধ করলো। জোহান বললো,
“এখানে এসেছো কেন?”
মিতুল গিফট বক্সটা জোহানের দিকে বাড়িয়ে দিলো।
“এটা আমাকে দিচ্ছ কেন?”
মিতুল বক্সটা বেডের উপর রেখে বললো,
“খুলে দেখো।”
“তোমার গিফট তুমি দেখবে। আমি দেখবো কেন?”
“খুলে দেখোই না।”
জোহান বিছানায় বসে গিফট বক্সটা খুললো। সবচেয়ে উপরে ওর এবং মিতুলের সেই ছবিটা। জোহান ছবিটা দেখে থতমত খেয়ে গেল। মিতুলের অগোচরে মিতুলকে দেখছিল, আর সেটা এভাবে ফাঁস করে দিলো রিকার্ডো? জোহান বিড়বিড় করে বললো,
“রিক আর কিছু পেল না তোলার জন্য? এটাই কেন তুলতে হলো?”
জোহান কথাটা বিড়বিড় করে বললেও মিতুলের কানে এলো। বললো,
“তুললো বলেই তো জানতে পারলাম, কেউ এতটা মায়াবী চোখেও তাকাতে পারে আমার দিকে।”
জোহান ভীষণ বিব্রত অবস্থায় পড়লো। মিতুলের দিকে তাকালো। মিতুলের মুখে হাসি। মিতুল এগিয়ে এলো ওর কাছে। বেডে বসে বললো,
“শুধু এটা নয়। আরও দিয়েছে তোমার ফ্রেন্ডসরা।”
মিতুল সব বের করে দেখালো। জোহান সেসবে আগ্রহ খুঁজে পেল না। ওর চিন্তা আটকে আছে ওর এবং মিতুলের ছবিতে। রিকার্ডো ছবিটা তুলেছিল ঠিক আছে, কিন্তু তা মিতুলকে কেন দেখাতে হবে? রিকার্ডো আসলেই বোকা! গোপন জিনিস গোপন রাখতে জানে না।
মিতুল গিফটগুলো নিয়ে কীসব যেন বলে চলছিল। জোহানের কানে সেসব ঢোকেনি। ও মিতুলের কথার মাঝেই হঠাৎ বলে উঠলো,
“আসলে এই ছবিতে যা দেখছো তা সত্যি নয়। আমি তোমাকে না। তোমার ওই পাশে থাকা ছোট একটা মেয়েকে দেখছিলাম। যেটা ক্যামেরায় এমন ভাবে এসেছে।”
মিতুল জোহানের কথা শুনে হেসে ফেললো।
“ও তাই না কি? কোন ছোট মেয়ে ছিল আমার পাশে?”
“ছিল একটা রাশিয়ান মেয়ে। গোল্ডেন হেয়ার।”
মিতুল আবারও হেসে ফেললো। বললো,
“আমাকে এতটাই বোকা ভাবো? এমন আজগুবি একটা কথা বলবে সেটাও বিশ্বাস করবো আমি? তুমি কোনো গোল্ডেন হেয়ারের রাশিয়ান মেয়েকে নয়, আমার দিকেই তাকিয়ে ছিলে।”
জোহান আর কিছু বলতে পারলো না।
মিতুল সব গিফট গুটিয়ে চলে যাওয়া দিয়েও দরজার কাছে গিয়ে থামলো। বললো,
“একটা কথা বলবো।”
“কী কথা?”
“আমাকে সাইকেল করে ঘুরতে নিয়ে যাবে?”
“এখন?”
“না। যখন সবাই ঘুমিয়ে যাবে। আমরা চুপিচুপি ঘুরতে যাব। এটা হবে তোমার সাথে শেষ সাইকেল ঘোরা।”
“শেষ বলছো কেন? আমরা তো আরও অনেক বার সাইকেলে ঘুরবো।”
“সেটা কবে ঘোরা হবে তার তো ঠিক নেই, এবারের মতো তো এটাই শেষ।”
এসব বলতে মিতুলের ভিতরটা ক্ষয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাইরে তা ধরা দিলো না। মুখে একটু হাসি ফুঁটিয়ে চলে গেল।
জোহান অপলক তাকিয়ে রইল শূন্য দরজায়।
পুরো বাড়ি যখন ঘুমে তলিয়ে গেল, তখন গ্যারেজে এলো জোহান আর মিতুল।
সাইকেলে উঠে বসলো দুজন। জোহান সাইকেল চালাতে শুরু করার আগে মিতুল বললো,
“আস্তে চালাবে না। খুব দ্রুত চালাবে। যাতে তোমাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরতে হয়।”
“আঁকড়ে ধরার জন্য দ্রুত সাইকেল চালাতে হবে না আমার, এমনিতেই ধরতে পারো তুমি।”
জোহান আর কথা না বাড়িয়ে সাইকেল চালাতে শুরু করলো।
মিতুলও কিছু বললো না। শুধু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো জোহানকে। জোহানের পিঠে মাথা ঠেকালো পরম আবেশে। জোহানের সাথে এরকম করে আর কবে সাইকেলে ঘোরা হবে তা জানে না ও। কোনো ঠিক নেই তার! মিতুল চোখ বন্ধ করলো। চোখের পাতা ভিজে উঠলো অশ্রুতে। একটু পরে মিতুল চোখ খুললো। জোহানকে ডাকলো,
“জোহান!”
“বলো।”
“আমি ছাড়া আর কোনো মেয়েকে জীবনে সাইকেলে উঠাবে না। এ জায়গাটা শুধু আমার। আমিই কেবল তোমার সাইকেলে উঠে তোমাকে এভাবে আঁকড়ে ধরবো। আর কেউ পারবে না।”
জোহানের সাইকেলের গতি ধীরই ছিল। প্রথমে জোরে চালালেও পরে ধীর করে ফেলে গতি। মিতুলের কথা যেন ধীর গতিটাকে আরও ধীর করে দিলো।
মিতুল আবারও ডেকে উঠলো জোহানকে,
“শোনো…”
জোহানের সাড়া দিতে হলো না। মিতুল তার আগেই বলতে লাগলো,
“আর কখনো কোনো মেয়েকে জড়িয়ে ধরবে না তুমি। যদি কেউ জড়িয়ে ধরতে আসে তবে দূরে সরে যাবে। তোমার উষ্ণ আলিঙ্গন অন্য কারো জন্য নয়। ওটা শুধু আমার প্রাপ্তি হবে।”
থামলো মিতুল।
জোহান কিছু বললো না। শুধু নীরবে শুনে গেল। হয়তো অন্যসময় হলে মিতুলের কথা নিয়ে অনেক মজা করতো। কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। হৃদয়টা ছটফট করেই চলছে!
জোহান আবারও পিছন থেকে মিতুলের কণ্ঠ শুনতে পেল,
“আরও একটা কথা, তোমার যে বাংলা শেখার তিনটা বই আছে, ওগুলো আর কখনো স্পর্শ করবে না। একদমই বাংলা শিখবে না তুমি। আমি রেগে গেলে বাংলাতে বকবো তোমায়। আমার বকুনিগুলো তোমার কাছে বোধগম্য না থাক। তুমি শুধু, ‘চু চু’ করবে, কখনও যেন ‘চুবিয়ে’ না বলতে পারো।”
জোহান চুপচাপ মিতুলের উপদেশ শুনতে লাগলো। মিতুলের বলা এখনও শেষ হয়নি। ও আবার বলতে শুরু করলো,
“আর হ্যাঁ, মদ! জীবনে আর একবারও মদ জাতীয় কিছু স্পর্শ করবে না। যদি করো, তবে সত্যি সত্যিই আর কানাডা আসবো না আমি। আমাকে আর দেখতে পাবে না কোনোদিন। সুতরাং ওগুলো একদম ছুঁয়ে দেখবে না। তোমার বন্ধুরা ড্রিঙ্কস করলে, তুমি তাদের সাথে জুস দিয়ে চিয়ার্স করবে।”
জোহান নীরব থাকলো। ড্রিঙ্কস করা আগেই ছেড়ে দিয়েছে ও। আগে বেশিই মমের জন্য কষ্ট হতো বলে ড্রিংকস করতো। কিন্তু মিতুল আসার পর কমে গেছে সেটা। ধীরে ধীরে একেবারে নিঃশেষ হয়ে গেছে।
মিতুল নিশ্চুপ। জোহান মিতুলকে নিশ্চুপ দেখে বললো,
“আর কিছু বলবে না?”
“হুম, বলবো।”
“বলো তাহলে।”
“তুমি লেনির প্রোপোজ একসেপ্ট না করে একেবারে ঠিক কাজ করেছিলে।”
জোহান মিতুলের কথা শুনে হেসে দিলো।
“লেনি?”
“হুম।”
জোহান সাইকেল থামালো। মিতুল সাথে সাথে জোহানকে ছেড়ে দিলো। জোহান মিতুলের দিকে ফিরে বললো,
“তুমি চলে গেলে তোমাকে কতটা মিস করবো সেই পরিমাণটা আমি হিসেব করতে পারছি না তুলতুল!”
মিতুলের এমনিতেই কান্না উদ্বেল ভাব। জোহানের এই কথায় চোখ ফেঁটে অশ্রু গড়িয়ে পড়ার মতো অবস্থা। মিতুল খুব কষ্টে নিজের কান্না চেপে রাখলো।
________________
এই রুমে আর থাকা হবে না মিতুলের। উইন্ডোর কাছে দাঁড়ালে চেরি গাছগুলো দেখতে পাবে না আর। আজকে শেষ দিন ওর। কানাডাতে শুধু আজ একটা দিন অবশিষ্ট আছে। কাল সকালেই বিদায় নিতে হবে কানাডার বুক থেকে। মিতুলের জানা ছিল না জোহান কালকে টরন্টো যাচ্ছে। ওর মন খারাপ হবে দেখে জোহান জানায়নি আগে। কিন্তু কালকে রাতে বলেছে। সাইকেল ভ্রমণ শেষে যখন বাড়ি ফিরেছিল তখন বলেছে কথাটা। সত্যিই, কথাটা শুনে মিতুলের খুব বেশি মন খারাপ হয়েছে। শেষ মুহূর্তে জোহানকে দেখতে পাবে না! জোহানের ফ্লাইট ওর আগে। ওর ফ্লাইট সকাল নয়টায়, আর জোহানের সকাল ছয়টায়। তিন ঘণ্টার ব্যবধান। ভাবা যায়? এই তিন ঘণ্টা কানাডা থাকলেও ও জোহানকে দেখতে পাবে না! এই তিন ঘণ্টা সময় তো খুব কম নয়! এই তিন ঘণ্টা সময়ে জোহানকে আরও ভালো করে দেখে নেওয়া যেত। মিতুল দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
আজ অনেক কাজ ওর হাতে। দুপুরে রান্না করবে ও। মূলত জোহানের জন্য। কিন্তু বাড়ির সবাইকেই খাওয়াবে। মিতুল কী কী রান্না করবে সব ঠিক করে রেখেছে। ভাত, মাছ আর মুরগি। এই তিন আইটেম ও রান্না করবে। এর থেকে বেশি কিছু রান্না করার প্রয়োজন হলে ক্যামিলা করবে।
দুপুরে রান্না করতে সুবিধাই হলো মিতুলের। কেউ বাড়িতে ছিল না। রেশমী আন্টিও শপে গেছেন আজকে। তবে যেকোনো সময় চলে আসতে পারেন। তার আসা যাওয়ার ধরা বাধা নিয়ম নেই। যখন খুশি তখন যেতে পারেন, আবার আসতে পারেন।
রান্না শেষে মিতুল গোসলটা সেরে নিলো। জোহানকে সকালে একবার দেখেছিল। যখন জিম থেকে ফিরেছিল জোহান। এরপর আর একবারও দেখেনি। জিম থেকে ফিরে ঘুম দিয়েছে। জোহান বড্ড বেশি ঘুমায়। মিতুল এই জিনিসটা ঠাহর করতে পেরেছে। ঘুমকাতুরে একটা!
মিতুল খয়েরি রঙের থ্রি পিস পরেছে। কানাডা আসার পর যে থ্রি পিসটা প্রথম পরেছিল। মিতুল এর আগে জানতো জোহান থ্রি পিস খুব অপছন্দ করে। কিন্তু তা না। আসলে জোহানের থ্রি পিস পছন্দ। কালকে বললো, থ্রি পিসে না কি ওকে খুব সুন্দর লাগে। জোহানই আজকে এই থ্রি পিসটা পরতে বলেছে। জোহান আসলে খুব কঠিন একটা মানুষ। সহজে বোঝা যায় না ওকে। কালকে বললো ওকে থ্রি পিসে খুব সুন্দর লাগে। অথচ প্রথম যেদিন ওকে থ্রি পিস পরা দেখেছিল, সেদিন কত কী বলেই না অপমান করেছিল। উহ! সেসব আর মনে করতে চায় না ও। পুরোনো অপমানগুলোর কথা মনে পড়লে মাঝে মধ্যে এখনও খুব রাগ হয় জোহানের প্রতি। তবে আজকে কোনো রাগ নয়। আজকে কানাডাতে শেষ দিন, জোহানের সাথেও শেষ দিন। সুতরাং রাগের ধার কাছ দিয়েও যাবে না আজ। মিতুল ঠিক করেছে আজকে নিজ হাতে খাইয়ে দেবে জোহানকে। বাড়িতে বসে এই রিস্ক নেওয়া যায় না। রেশমী আন্টি ফেরেননি এখনও। তবে কখন ফিরবে তার কোনো ঠিক নেই। যখন তখন চলে আসতে পারে। জোহানের খাবার নিয়ে টাইম হাউজে যাবে ও।
যেমন ভাবনা তেমন কাজ। মিতুল জোহানের খাবার নিয়ে টাইম হাউজে এসেছে। দরজা লক। চাবি তো নেই ওর কাছে। মিতুল হাতের ট্রে সিঁড়িতে নামিয়ে রেখে জোহানকে কল দিলো। ঘুমকাতুরে উঠেছে কি না সেটাই সন্দেহ। কল রিসিভ হলো। ও প্রান্ত থেকে ঘুম ঘুম কণ্ঠ শোনা গেল,
“ইট’স জোহান। হু স্পিকিং?”
“তোমার ঘুম এখনও ভাঙেনি?”
“এটা কি তুলতুল?”
“হ্যাঁ, আমি। তোমার টাইম হাউজের সামনে বসে আছি লাঞ্চ নিয়ে। দ্রুত আসো।”
কল কেটে দেওয়ার দশ, পনেরো মিনিট পরই জোহানকে দেখা গেল। কোনো ঘুম ঘুম ভাব নেই জোহানের মাঝে। বাদামি চুল, পোশাক-আশাক সবই পরিপাটি। হঠাৎ করে গোছানো স্বভাবের হয়ে গেল না কি জোহান?
জোহান কিছু না বলেই দরজা খুললো। তারপর বললো,
“স্যরি এত সময় ঘুমানোর জন্য।”
“তোমার ঘুম তুমি ঘুমাবে, এখানে আমাকে স্যরি বলার কী আছে?”
“আছে অনেক কিছু, সেটা উল্লেখ করতে চাই না। ভিতরে এসো।”
মিতুল ট্রে নিয়ে টাইম হাউজে প্রবেশ করলো। ফ্রিসিয়াস ফুলের মিষ্টি সুবাস এসে নাকে লাগলো। মিতুলের হঠাৎ কৌতূহল হলো, জোহানের প্রিয় ফুল কী? একদিন বারান্দা থেকে লাল রঙা একটা ফুল কানে গুঁজেছিল, সেদিন জোহান বলেছিল, এটা ওর প্রিয় ফুল নয়। ওর ব্রাদারের প্রিয়। জোহানের প্রিয় ফুল কী? এই ফ্রিসিয়াস না কি?
মিতুল প্রশ্নটা করেই বসলো জোহানকে,
“ফ্রিসিয়াস কি তোমার প্রিয় ফুল?”
জোহান উত্তর দিলো,
“কোনো ফুলই আমার প্রিয় নয়। তবে ফ্রিসিয়াস ফুল একটু একটু পছন্দ করি। স্মেলটা ভালো লাগে আমার।”
জোহানের কথা শুনে মিতুল অবাক। বললো,
“তুমিই বোধহয় প্রথম ব্যক্তি যার কি না ফুল পছন্দ নয়।”
জোহান একটু হাসলো।
মিতুল বললো,
“আমার কিন্তু ফুল ভীষণ প্রিয়। পরের বার যখন আসবো তখন তোমার টাইম হাউজ আমি ফুলে ফুলে ভরিয়ে দেবো। আপত্তি করতে পারবে না।”
“ফুলে ফুলে ভরিয়ে দিয়ো সমস্যা নেই। তবে এত ফুলের মাঝে আমার জন্যও একটু জায়গা রেখো।”
মিতুল হাসলো। কাউচের সামনের টি টেবিলে ট্রে রাখলো। এটা নতুন টি টেবিল। কিছুদিন আগে জোহান কিনেছে। মিতুল হেয়ার রাবার দিয়ে চুলগুলো বেঁধে নিলো। জোহানের দেওয়া হেয়ার রাবার এটা। সাথে সাথেই রাখে।
জোহান বললো,
“নিজে রান্না করেছো?”
“হুম। ভাত, মাছ, মুরগি।”
বলতে বলতে কিচেনের দিকে গেল। পানি নিয়ে এলো এবং হাত ধুয়ে এসেছে।
মিতুলের পরনে যে থ্রি পিস সেটা আগে খেয়াল করেনি জোহান। খেয়াল হতেই বললো,
“বিয়ের পর বেশিই থ্রি পিস পরবে তুলতুল। খুব সুন্দর লাগে তোমাকে।”
মিতুল লজ্জা পেল জোহানের থেকে প্রশংসা শুনে। মানুষ শাড়ি পরলে প্রশংসা করে। আর জোহান ওকে থ্রি পিসে প্রশংসা করছে। ভালো লাগলো মিতুলের। মিতুল লজ্জা মাখা মুখ নিয়ে জোহানের পাশে বসলো। লজ্জাটা কোনো রকমে চেপে রেখে বললো,
“আজকে আমি খাইয়ে দেবো তোমায়।”
বলে খাবারের উপর থেকে ঢাকনা সরালো।
“মাছ দিয়ে খাবে আগে? না কি মুরগি দিয়ে?”
“মুরগি দিয়ে। মাছ তেমন পছন্দ নয় আমার। শেষে এক লোকমা খাবো মাছ দিয়ে। আমি বাংলাদেশি মাছ পছন্দ করি। ফুটি(পুঁটি), টেংরা(ট্যাংরা), শি…শিং আরও আছে অনেক। যেগুলোর নাম মনে নেই আমার। বাংলাদেশে গিয়ে আমার গ্র্যান্ডমাদারের কাছ থেকে জেনে বলবো তোমায়।”
জোহানের উচ্চারিত মাছের নামগুলো শুনে মুখ টিপে হাসলো মিতুল। ফুটি! টেংরা! মিতুল জোহানের মতো করে বললো,
“ফুটি, টেংরা মাছ পছন্দ তোমার? কী করে এগুলো পছন্দ হয়ে গেল তোমার?”
“বাংলাদেশে যখন গিয়েছিলাম, তখন এই মাছ খেয়েছি। ফুটি মাছগুলো ছিল খুবই ছোট ছোট। পান্তা ভাতের সাথে খেতে দিয়েছিল আমার গ্র্যান্ডমাদার।”
মিতুল অবাক হয়ে বললো,
“তুমি পান্তা ভাতও খাও?”
“খাই তো।”
মিতুল হেসে ফেললো। বললো,
“ঠিক আছে, তুমি যখন বাংলাদেশ যাবে তখন আমি পুঁটি মাছ দিয়ে তোমাকে পান্তা ভাত খেতে দেবো।”
“আমি ফুটি মাছের থেকে টেংরা মাছ বেশি পছন্দ করি।”
“ঠিক আছে, আমি তোমাকে ট্যাংরা মাছও রেঁধে খাওয়াবো।”
“শুধু ফুটি, টেংরা না তো। আমার তো আরও অনেক মাছ পছন্দ। সেগুলো খাওয়াবে না?”
“সবই খাওয়াবো। আগে তো বাংলাদেশ যাও।”
মিতুল জোহানের কথা মতো মুরগি দিয়ে খাইয়ে দিতে লাগলো জোহানকে।
জোহান একসময় বললো,
“বিয়ের পর আমাকে প্রতিদিন এভাবে খাইয়ে দিতে হবে। দেবে তো?”
মিতুল আবার লজ্জায় পড়ে গেল। বিয়ের কথা শুনলেই ওর লজ্জা লাগে। মিতুল ঠোঁটের কোণে একটু হাসি ফুঁটিয়ে বললো,
“হুম দেবো।”
(চলবে)