#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৫৯
____________
শেষমেশ জায়িনের সাথে বিয়েটা হয়েই যাচ্ছে। তবে আশ্চর্যের বিষয় জোহান এ নিয়ে মোটেই চিন্তিত নয়। ওর মুখে কোনো চিন্তার ছাপ নেই। স্বাভাবিকতার গাঢ় রং আঁকা মুখে। মিতুল ওকে যত দেখেছে, তত অবাক হচ্ছে। এত চুপ, এত হাসিখুশি কী করে জোহান? এমন করছে যেন বড়ো ভাইয়ের বিয়েতে তার খুব আনন্দ হচ্ছে, মজা পাচ্ছে সে!
আর জায়িনও যে কী হাসিখুশি! লিভিং রুমে একগাদা মানুষের সমাগম। জায়িন তাদের সাথে হেসে হেসে উচ্চৈঃস্বরে কথা বলছে।
ভাইদের দেখেও মিতুল কম অবাক না। যে ভাইয়েরা শুরু থেকে ওর সাথে ছিল। এ বিয়েতে রাজি ছিল না, তারাও হুট করে পাল্টে গেছে। ছোট বোনের বিয়েতে ভাইদের যে ভূমিকা পালন করা উচিত, সেটাই করছে তারা। অথচ তাদের থাকা উচিত এখন মুখ ভার। ওর মতোই মন খারাপ। কিন্তু সবকিছু ওলটপালট! সবাই সবার আনন্দ ফুর্তি নিয়ে আছে। অথচ ওর দিকে তাকানোরই সময় নেই কারো।
মিতুল এখন নিজের রুমে। পরনে লাল টুকটুকে শাড়ি। মুখে ভারী সাজ। একটু আগে রুম থেকে বের হয়ে, বাসার পরিস্থিতিটা পরখ করে দেখছিল। আনন্দ যেন ধরে না এ বাসায়। সহ্য করতে না পেরে মিতুল আবার নিজের রুমে ফিরে এসেছে। কান্না পাচ্ছে ওর। এভাবে জায়িনের সাথে বিয়ে হবে, ও ভাবতে পারেনি। ওই অহংকারীটাকে বিয়ে করা অসম্ভব ওর কাছে। কিন্তু এই অসম্ভব জিনিসটা সত্যি হয়ে যাচ্ছে। বিয়ে হবে রাত একটায়। এখন বাজে বারোটা পঁয়তাল্লিশ। আর কতটুকু সময় বাকি? এত তাড়াতাড়ি যাচ্ছে কেন সময়টা? দরজা খোলার শব্দে সচকিত হলো মিতুল। একটু পর আয়নায় দেখা গেল জোহানের প্রতিচ্ছবি।
মিতুল দ্রুত পিছন ফিরলো।
“কংগ্রাচুলেশন মিতুল!” হাসি মুখে অভিনন্দন জানালো জোহান।
মিতুল এগিয়ে এলো কাছে। ধরা গলায় বললো,
“কংগ্রাচুলেশন? এমনটা পারছো কী করে জোহান? তোমার ব্রাদারের সাথে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে আমার, তুমি কিছু করবে না?”
“কী আর করবো? হ্যাঁ, চাইলে অনেক কিছু করতে পারি। কিন্তু আমি সেসব কিছুই করবো না। কারণ, ব্রাদারের সাথে তোমার বিয়ে হয়ে গেলে আমার কিছু যায় আসে না।”
জোহানের কথা শুনে মিতুলের মুখ কালো হয়ে গেল।
“কী বলছো এসব? তোমার কিছু যায় আসে না মানে? তুমি তো আমাকে ভালোবাসো। তোমার ব্রাদারের সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেলে তুমি…”
“ভালোবাসা?” মিতুলের কথার মাঝে বলে উঠলো জোহান। শ্লেষাত্মক হেসে ফেললো। বললো,
“কে ভালবাসে তোমাকে? নিজের দিকে তাকিয়ে দেখেছো একবার? কত খাটো তুমি! আমার মতো এত লম্বা একটা ছেলের যায় তোমার সাথে? মানায়? তুমি হলে এতটুকু পিচ্চি একটা মেয়ে…ওহ স্যরি! মেয়ে নয়। এলিয়েন! তুমি হলে পিচ্চি একটা এলিয়েন! তোমার মতো একটা পিচ্চি এলিয়েনকে কী দেখে ভালোবাসবো আমি?”
জোহানের কথায় স্তব্ধ মিতুল। দু কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠলো। অবিশ্বাসের সুতো প্যাঁচাচ্ছে ওর সারা শরীরে। এ কী শুনছে? মিতুলের চোখের কোল ছাপিয়ে বারি ধারা নামতে লাগলো। কাঁদো ভেজা কণ্ঠে বললো,
“এসব কী বলছো তুমি? ভালো…বাসো না আমাকে?”
জোহান নির্বিকার উত্তর দিলো,
“নো মিতুল। তোমাকে ভালোবাসার কোনো কারণ নেই। আমি কেন, পৃথিবীর কোনো ছেলেই তোমাকে ভালোবাসতে পারবে না। তুমি এত খাটো যে তোমাকে ভালোবাসা যায় না। আমার ব্রাদার তোমাকে কী দেখে বিয়ে করছে কে জানে! তোমাকে বিয়ে করা তো দূরের থাক, বিয়ের আশেপাশেও ঘেঁষতাম না আমি।”
মিতুল বাকরুদ্ধ।
“ইউ নো হোয়াট? এতদিন আমাদের মাঝে যে রিলেশন শব্দটা ছিল, ওটা ছিল মূল্যহীন। তোমার প্রতি আমার কখনও সত্যিকারের ফিলিংস ছিল না। সত্যিকার ফিলিংস বলছি কেন? তোমার প্রতি আমার মিথ্যা করেও কোনো ফিলিংস ছিল না। তুমি একটা অহেতুক পার্ট আমার জীবনে। আমার আশেপাশে কত সুন্দরী সুন্দরী মেয়েরা ঘুরঘুর করে, তুমি তো তাদের কাছে খুবই নগণ্য। কে তুমি? বাংলাদেশি ক্ষ্যাত একটা মেয়ে। তোমার মতো খাটো, ক্ষ্যাত মেয়েকে ভালোবাসা যায় না। ভালোবাসি না আমি তোমায়। আর বাসিওনি কোনোদিন। তোমার সাথে যেটা ছিল, ওটা ছিল শুধু মজা। এর বেশি কিচ্ছু না। বাংলাদেশি মেয়ের সাথে একটুখানি মজা করেছি শুধু। আর তুমিও বোকা, সেটা সত্যি ধরে বসে থাকবে কে বুঝেছে? মিতুল, তুমি খুব বোকা। আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে বোকা মেয়েটি হলে তুমি!”
মিতুল ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে বললো,
“জোহান! এতটা নিষ্ঠুর হয়ো না তুমি। আমি তোমাকে নিয়ে উঁচু গলায় কত কী বললাম মা-আব্বুকে। এখন তুমি এমন করলে আমার কী হবে? এমনটা করো না তুমি। আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। এভাবে ধোঁকা দিয়ো না আমায়।”
“স্যরি মিতুল। আমার কিছু করার নেই। এটাই সত্যি। আসলে ভুলটা বলতে গেলে তোমার ছিল। তুমি আমার এই সহজ মজাটুকু ধরতে পারোনি। অন্য যে কোনো মেয়ে হলেই এটা বুঝতে পারতো, অথচ তুমি বুঝতে পারোনি। আর তুমি বুঝতে পারোনি বলেই ব্যাপারটা আজ এতদূর গড়িয়েছে। তুমি ভেবে যাচ্ছিলে আমি তোমাকে ভালোবাসি, আর তোমার এমন ভাবনা দেখে, আমিও মজা করার বিষয়টি তাড়াতাড়ি ছাড়তে পারছিলাম না। যার কারণে এতদূর গড়িয়েছে ব্যাপারটা। তবে ব্যপারটা এখন খোলাসা হওয়া দরকার। আমার মনে সত্যিই তোমার জন্য কোনো অনুভূতি ছিল না। আমার মনের কানায় কানায় লেনির জন্য ভালোবাসার প্রাচুর্য তৈরি। লেনি আমার ভালোবাসা। সতেরো বছর বয়সে আমি ওর প্রেমে পড়েছিলাম। এই প্রেম এখনও আমার মাঝে বিরাজমান। আমার এবং লেনির মাঝে বলতে গেলে প্রায় দশ বছর ধরে রিলেশন চলছে। আমাদের দুজনের ভালোবাসার মাঝে তুমি ঢুকে গিয়েছিলে অহেতুক একটা কীটপতঙ্গ হিসেবে। আর কিছুই নয়।”
মিতুলের শরীর অসাড় হয়ে পড়ছে। কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলছে। কোনো রকমে বললো,
“তার মানে তুমি মিথ্যা বলেছিলে আমাকে? তুমি বলেছিলে, লেনি তোমাকে প্রপোজ করেছিল। অথচ তুমি একসেপ্ট করোনি। ওটা তাহলে ভুল ছিল, মিথ্যা ছিল। তুমি আমাকে এত দীর্ঘ একটা সময় ধরে ধোকা দিলে জোহান? এমনটা কী করে পারলে? আমি তো সত্যি সত্যি তোমাকে খুব ভালোবাসি।”
“আমাকে তুমি সত্যি সত্যি ভালোবাসলেও আমার কী করার আছে? আমি তো তোমাকে মিথ্যা মিথ্যাও ভালোবাসি না। আচ্ছা তুমি নিজেই একবার ভেবে দেখো। আমার সাথে কি তোমাকে মানায়? আমার মতো এত সুদর্শন, লম্বা একটা ছেলের সাথে তোমার মতো এত খাটো, পিচ্চি একটা এলিয়েনকে মানায় কোনো দিক থেকে? একসাথে দাঁড়ালেই তো লোকে নানান কথা বলবে। তুমি তো পড়ে থাকবে আমার হাঁটুরও নিচে।”
মিতুল অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে শুধু কাঁদতে লাগলো।
জোহান বললো,
“আমার ব্রাদার খুব ভালো। তোমার মতো এত খাটো একটা মেয়েকে সে বিয়ে করতে রাজি। তার মতো এত ভালো মানুষ আর হয়? কেঁদো না। একজন মহান মানুষকে তুমি বিয়ে করতে যাচ্ছ। যে কি না। তোমার মতো এত খাটো মেয়েকে বিয়ে করতে যাচ্ছে। কান্নাকাটি না করে, সুষ্ঠু ভাবে বিয়েটা করে নাও।”
বলে জোহান যাওয়ার জন্য ঘুরলো।
মিতুল দ্রুত জড়িয়ে ধরলো পিছন থেকে।
“এমন করো না। আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি! তুমি এমন করলে আমি মরে যাব।”
জোহান বিরক্ত কণ্ঠে বললো,
“ছাড়ো।”
“ছাড়বো না আমি। তুমি আগে বলো, তুমি যেসব বলেছো, একটা কথাও মন থেকে বলোনি। তুমি আসলে আমাকে ভালোবাসো।”
জোহান বিরক্তির পাশাপাশি চরম রেগেও গেল। মিতুলের হাতের বন্ধন ছাড়িয়ে নিতে নিতে হুংকার দিয়ে বললো,
“ছাড়ো আমায়।”
জোহান এত দ্রুত বেগে হাত ছাড়িয়ে নিলো যে মিতুল তাল সামলাতে পারলো না। পা টলে উঠলো। একটু দূরে ছিটকে পড়ে গেল মেঝেতে। পতন ঘটলো ওর। সেই সাথে পতন ঘটলো ওর ঘুমেরও। ‘আ’ মতন একটা বিকট শব্দ করে ঘুম থেকে জাগ্রত হলো ও। বুক ধড়ফড় করছে। শ্বাস ভারী। মুখে লেপ্টে আছে আতঙ্কের ছাপ। মিতুল কিছুটা সময় বিমূঢ় থেকে, হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠলো।
মেহরিন ড্রেসিং টেবিলের সামনে টুলে বসেছিল, মিতুলকে চিৎকার করতে দেখে ওর কাছে ছুটে এলো।
“কী হয়েছে?”
মেহরিনকে দেখে মিতুল ঝরঝর করে কেঁদে দিলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো,
“মেহু, আমার জোহান…আমার জোহান…”
“জোহান কী?”
“আমার জোহান…”
কথা শেষ করলো না মিতুল। হঠাৎ আশপাশটা একটু খেয়াল হতেই থেমে গেছে ও।
কান্না ধীরে ধীরে স্থিতিশীল হতে লাগলো। নিজেকে আবিষ্কার করলো নিজ বিছানায়। কান্না থেমে শান্ত হয়ে গেল মিতুল। মনের মাঝে ভাবনা ঘুরপাক খেতে লাগলো। এটা কী? জোহান কোথায়? ওর পরনের শাড়ি কোথায়? মিতুল ধরফরিয়ে উঠে বসলো। আশেপাশে আরেকবার উদ্বিগ্ন দৃষ্টি বুলিয়ে নিলো। না, কোথাও কিছু নেই। শান্ত পরিবেশ। জোহান নেই এখানে। মিতুলের কপালে ভাঁজ পড়লো। মস্তিষ্ক চাপ প্রয়োগ করে মিতুলকে জাগিয়ে তুললো জাগতিক হুঁশে। স্বপ্ন ছিল ওটা?
উফ! কী বাজে স্বপ্ন! স্বপ্নটা একেবারে রিয়েল মনে হয়েছে। একদম মোটেই মনে হয়নি যে ওটা স্বপ্ন ছিল। মনে হয়েছে জোহান সত্যি সত্যি ওকে কথাগুলো শুনিয়েছে! মিতুল ভাবনার বহিরা তলে ডুবে গেল।
মেহরিন মিতুলকে এমন করতে দেখে, হাত দিয়ে মৃদু ঠ্যালা দিয়ে ডাকলো,
“মিতুল!”
মিতুল একটু কেঁপে উঠলো।
“আর ইউ ওকে?”
মিতুল ঘোরের ভিতর থেকেই বললো,
“হ্যাঁ…হ্যাঁ আমি ওকে।”
মেহরিন একটু স্বস্তি বোধ করলো।
“কোনো খারাপ স্বপ্ন দেখেছিস? এরকম চিৎকার করলি কেন?”
মিতুল চিন্তায় পড়ে গেল। জোরে চিৎকার করেছে? বাড়ির সবাই টের পেয়েছে না কি? উহ! সবাই যদি এসে জিজ্ঞেস করে কেন চিৎকার করছে, তখন কী বলবে? এই স্বপ্নের কথা তো কাউকে বলা যাবে না। এমনকি মেহরিনকেও বলতে পারবে না।
মেহরিন আবার জিজ্ঞেস করলো,
“কীরে কী স্বপ্ন দেখেছিস?”
মিতুল নিজের স্বপ্নের কথা সত্যি করে বলতে পারল না। আমতা আমতা করে বললো,
“দেখেছি আসলে…দেখেছি কেউ একজন ছুরি নিয়ে আমাকে মারতে এসেছে। ঠিক আমার বুক বরাবর ছুরিটা দিয়ে আঘাত করতে নিয়েছিল, তার আগেই ঘুমটা ভেঙে গেল।”
মেহরিন আঁতকে উঠলো,
“ওহ, কী ভয়ানক স্বপ্ন!”
মিতুলের ইতস্তত বোধ হলো। বললো,
“আমি ওয়াশরুমে যাচ্ছি।”
মিতুল যেন একপ্রকার পালিয়ে এলো ওয়াশরুমে। নিজের স্বপ্নটা নিয়ে ভাবতে লাগলো। ইশ, কী বাজে, ভয়ানক স্বপ্ন ছিল! ওর স্বপ্নগুলোরও তারিফ না করে পারা যায় না। একেকবার একেকটা চরম স্বপ্ন দেখে! আজকের স্বপ্নটা ছিল এ যাবৎ কালের দেখা সকল স্বপ্নের ঊর্ধ্বে। সব থেকে ফালতু, বীভৎস স্বপ্ন। সময়টা খারাপ যাচ্ছে, আর সেই সাথে ওর স্বপ্নরাও তাল মিলাচ্ছে। এই কঠিন একটা মুহূর্তে জোহানকে নিয়ে একটা ভালো স্বপ্ন দেখলেও তো পারতো। তাও তো মনটায় একটু শান্তি মিলতো। অথচ কী স্বপ্ন দেখলো এটা? কী করে এমন একটা স্বপ্ন দেখলো? জোহান ওর সাথে ওই রকম…ওহ না না। এ নিয়ে ভাবতে চায় না ও আর। জোহান কি জীবনে ওর সাথে এমন করতে পারে? এ নিয়ে ভাবাও যে ভুল। আর লেনি! জোহান লেনিকে…ওহ না। চিন্তায় চিন্তায় মাথা হ্যাং হয়ে গেছে ওর!
মিতুল ফ্রেশ হয়ে বের হলো। মেহরিন রুমে নেই। মিতুল টাওয়াল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো। মাথা থেকে এখনও স্বপ্নের ব্যাপারটা যায়নি। মিতুল নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। ও কি খুব খাটো? না, খুব বেশি খাটো তো নয়। ৫.২’ লম্বা। এমন লম্বাও অনেকে হয় না। ওর থেকেও কত খাটো মানুষ আছে। অথচ জোহান ওকে স্বপ্নে এমন ভাবে খাটো বলেছে, যেন ও একটা কলমের মতো ছোট। জোহান খুব বেশি বেশি করেছে। মিতুলের হঠাৎ খুব রাগ হলো। এমন ভাবে বলার অধিকার কে দিয়েছে জোহানকে? হোক এটা স্বপ্ন। তাই বলে এমন করে বলবে?
মিতুল এলোমেলো চুলগুলো আঁচড়িয়ে নিলো।
মনে আবার এখন অন্য চিন্তা ঘুরছে। হঠাৎ করে এমন একটা স্বপ্ন কেন দেখলো? কী কারণ? জোহান কি সত্যিই কোনো ভাবে…মিতুল নিজের চিন্তাকে জায়গাতেই স্থির করে দিলো। সত্যিই মাথাটা গেছে ওর। জোহানকে নিয়ে এমন ভাবনা কী করে উদয় হচ্ছে ওর মাঝে? নিজের ভাবনা দেখে নিজেই শিহরিত!
মিতুল পরিপাটি হয়ে রুম থেকে বের হলো। কালকে মা-আব্বুকে এত করে বুঝিয়েছে। তারপরও যদি তারা আজকে একই সুরে গান গায়, তাহলে আরেক দফা বুঝ দেবে। যে করেই হোক এ বিয়ে আটকাবেই।
মিতুলের পা থমকে গেল। লিভিং রুম এখনও চোখের সামনে দৃশ্যমান হয়নি। তবে লিভিং রুমে চলা সকল কথার সাউন্ড ওর কানে আসছে। খুব পরিচিত একটা কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছে। কার কণ্ঠ এটা? ছোট মামনির? মামনির নামটা মনে পড়তেই মিতুল পুলকিত হয়ে উঠলো। আনন্দের সাথে প্রায় দৌঁড়ে এলো লিভিং রুমে। এসেই মামনির পাশে বসে পড়লো। মামনি এবং ওর ষোলো বছরের কাজিন জেবিন এসেছে।
“তোমরা হঠাৎ?” পুলকিত কণ্ঠে বললো মিতুল।
মামনি কেমন একটা করে যেন বললেন,
“বাব্বাহ, মেয়ে তো দেখছি খুব আনন্দে আছে। বলি, আজ তোর বিয়ে বলে কি এত আনন্দে থাকতে হবে?”
মামনির কথায় লিভিং রুমে উপস্থিত রেশমী আন্টি, মেহরিন, জেবিন এবং নিচ তলার ভাড়াটিয়া আন্টি, ভাড়াটিয়া দুই আপু সকলে হাসলেন মামনির পাশাপাশি।
একেক জনের হাসির ধরণটা একেক রকম হলো। যেমন রেশমী আন্টি হাসলেন চাপা ভাবে, মেহরিন হাসলো মৃদু, জেবিন এবং ভাড়াটিয়া আন্টি একটু বেশি হাসলো। আপু দুইটা হাসলো আরও বেশি।
মেহরিনকে হাসতে দেখে মিতুল খানিক অবাক হলো। সকলের মুখে হাসি কিন্তু মিতুলের মুখ কালো হয়ে গেল। আজ বিয়ে মানে?
মিতুল দ্রুত কথা সেরে লিভিং রুম থেকে চলে এলো। মামনিরা এসে গেছে, আরও অতিথিরা আসবে, আজ বিয়ে, মানে কী এসবের? স্বপ্নটা কি তাহলে সত্যি হয়ে যাচ্ছে? যে বিয়ে আরও একদিন পর হওয়ার কথা, সেই বিয়ে আজকে এগিয়ে এলো কেন? জোহান কি তবে ভাইয়ের বিয়েতে মত দিয়ে দিয়েছে?
জোহান মত দেওয়ার জন্যই কি এই বিয়েটা আরও তাড়াতাড়ি হচ্ছে? মিতুলের হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠলো! না এটা কিছুতেই হতে পারে না।
মিতুল রুমে এসে দরজা আটকে মোবাইল তুলে নিলো হাতে। কল দিলো জোহানের কাছে। কোথায় জোহান? রিং হলো কিন্তু কল রিসিভ হলো না। আশ্চর্য তো! জোহান কল রিসিভ করছে না? মিতুল আবার কল দিলো। আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো। রিসিভ হলো না কল। মিতুলের মাথা সত্যিই এবার আউলা ঝাউলা লাগছে।
জোহান কল রিসিভ করছে না কেন? স্বপ্নটা কি তাহলে বাজে ভাবে সত্যি হয়ে যাচ্ছে?
“আহ!” আক্রোশ পূর্ণ ভাবে কিছুটা শব্দ করলো মিতুল।
এখনই জোহানের সাথে কথা বলা দরকার ওর। কিন্তু কীভাবে বলবে? কল যে রিসিভ করছে না। জোহান কোথায় আছে এই মুহূর্তে? রুমে? এখনও ঘুমাচ্ছে? মিতুলের মনে হলো জোহান রুমে। সত্যিই ঘুমাচ্ছে? না কি ওকে ইগ্নোর করছে?
লিভিং রুম পেরিয়ে তো এখন জোহানের রুমে যেতে পারবে না। সেখানে এখন মানুষজন বসে আছে। মিতুল উপায় না পেয়ে চললো মায়ের কাছে।
মাকে পেল তার রুমে। মা একা নয়। তার সাথে ওর বড়ো খালামনি, উপর তলার এক দাদি এবং সুরভি খালাও আছে। কী একটা বিষয় নিয়ে যেন আলোচনা করছিল।
মিতুল বড়ো খালামনিকে দেখে একটু বিস্মিত হলো। খালামনিও এসে গেছে?
মিতুলের খালামনি ওকে লক্ষ্য করে একগাল হেসে বললেন,
“কেমন আছিস মা?”
মিতুল শুকনো গলায় উত্তর দিলো,
“ভালো আছি।” চেষ্টা করেও একটু হাসতে পারলো না। কিন্তু সে কেমন আছে সেটা তো জিজ্ঞেস করতেই হয়,
“তুমি কেমন আছো?”
“ভালো। তা শেষ পর্যন্ত আমাদের মিতুল মায়ের বিয়ে হয়েই যাচ্ছে। হুম?”
খালামনি হাসলেন।
মিতুল হাসতেও পারলো না, আর কিছু বলতেও পারলো না। মা একা থাকলে ফট করে কথাটা মায়ের কাছে বলে দিতো। কিন্তু এদের সামনে এমন কথা বলবে কী করে? মিতুল মাকে বললো,
“মা, একটু এদিকে আসবে? তোমার সাথে কথা ছিল।”
মাহিরা জানালেন,
“আমি এখন ব্যস্ত। পরে শুনবো তোমার কথা।”
মিতুলের একটু রাগ হলো। আবার বললো,
“কথাটা খুব জরুরি। এখনই একটু এসো।”
মাহিরা কড়া গলায় বললেন,
“বললাম না যাও। পরে শুনছি।”
মিতুল আর কিছু বলতে পারলো না। খুব রাগ হলো। রাগের মাথায় আর না দাঁড়িয়ে চলে এলো। ভীষণ অস্থিরতা হচ্ছে। কী করবে এবার? জোহানের সাথে কথা বলা দরকার। জোহান ফোন ধরছে না কেন? মিতুল আবারও একবার কল দিলো। রিসিভ হলো না। মিতুল আর পারছে না! স্বপ্নটা কি সত্যি হয়ে যাচ্ছে না কি? মিতুল ধৈর্য ধরলো। খানিক রুমে বসে রইল। তারপর মিলানের কাছে কল দিলো।
ভাইয়ের সাথে কথা বলে মিতুল অবাক। হ্যাঁ, স্বপ্নের সাথে তো বাস্তব মিলে যাচ্ছে। ভাইয়েরা বাজারে গেছে। বিয়ে উপলক্ষ্যে বাজার করতে। মিতুল মোটেই আশা করেনি এটা। যারা এই বিয়েতে অমত পোষণ করেছিল, তারা হাসি মুখে এখন বাজার করছে? ভাইয়ের সাথে মিতুল বেশি কিছু বলতে পারলো না। ব্রো ব্যস্ততা দেখিয়ে ফোন কেটে দিয়েছে।
মিতুল আর সহ্য করতে পারছে না। কী হচ্ছে এটা? পাগল পাগল লাগছে ওর। স্বপ্নে যা দেখেছিল তা তো মিলে যাচ্ছে! উহু এভাবে আর বসে থাকা যাচ্ছে না। এই মুহূর্তে জোহানের সাথে কথা না বললেই নয়।
মিতুল রুম থেকে বের হলো। লিভিং রুমে বেশি কেউ নেই। জেবিন এবং ওর খালাতো ভাই আছে শুধু। ওর খালাতো ভাইয়ের বয়স কম। মাত্র দশ বছর। মেহরিন কোথায় গেল? এখানেই তো ছিল। মেহরিনটার কথাও কিছু বুঝতে পারছে না। এত বড়ো একটা ঘটনা ঘটছে, অথচ ওর সাথে কথা বলতে আসছে না একবার। মিতুল মেহরিনের চিন্তা বাদ দিলো। লিভিং রুমে কাজিনরা থাকলেও সেসব গ্রাহ্য করলো না। জোহানের রুমের দিকে গেল।
দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে রেখেছে জোহান। এই জোহানটা কোনো কাজের নয়। এমনি সময় দরজা আনলক রাখে, অথচ আজকে যখন এত গুরুত্বপূর্ণ, তখন লক করে রেখেছে। এখন কি কাজিনদের সামনে দরজা ধাক্কা ধাক্কি করবে? মিতুল বিরক্ত রাগ নিয়ে দরজায় নক করলো। খুললো না দরজা।
মিতুল দুই হাত হাত দিয়ে জোরে জোরে আঘাত করলো। এবারও খুললো না। আরও একবার নক করতে হলো। তারপর খুললো। দরজা খুলতেই জোহানকে দেখতে পেল। ঘুম ঘুম চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে বললো,
“তুমি?”
মিতুল কোনো কথা না বলে জোহানকে ঠেলে রুমে ঢুকে গেল। তারপর দরজা বন্ধ করে দিলো। কাজিনরা কী ভাববে সেদিকে ধ্যান দিলো না।
“তোমাকে কতবার কল দিয়েছি? কল রিসিভ করোনি কেন?”
“কখন কল দিয়েছো?”
“একটু আগেই। কম করে হলেও বিশ বার কল দিয়েছি।”
জোহান নিজের মোবাইল চেক করলো। হ্যাঁ, কল দিয়েছে মিতুল। তবে বিশবার নয়। এগারো বার। জোহান বললো,
“ফোন সাইলেন্ট ছিল।”
“এমন একটা সময়ে তুমি ফোন সাইলেন্ট করে রেখেছো? জানো কী হয়েছে?”
“কী হয়েছে?”
“আজ আমার বিয়ে। বিকেলে তোমার ব্রাদারের সাথে বিয়ে হচ্ছে।”
জোহানের মস্তিষ্ক নড়ে উঠলো। চোখে ঘুমের ছিটে ফোঁটাও রইল না আর।
“হোয়াট?”
“হ্যাঁ। মানুষজন আসতে শুরু করে দিয়েছে। যে বিয়ে পরশু হবার কথা, সে বিয়ে আজকে এনে ফিক্সড করেছে।”
জোহান কয়েক সেকেন্ড অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইল। তারপর দরজার দিকে পা বাড়ালেই মিতুল হাত টেনে ধরলো।
“কোথায় যাচ্ছ?”
“কালকে যাদের এত বুঝালাম, তারা এখনও একই সিদ্ধান্তে অটল রয়ে গেছে! সিদ্ধান্ত আবার এগিয়ে এনেছে। যে বিয়ে পরশু হওয়ার কথা, সে বিয়ে না কি আজকে হবে! তোমার কী ধারণা? আমি এখনও চুপ থাকবো? থাকবো না আমি। যাদের এত বোঝানোর পরও বুঝলো না, তাদের এবার অন্য উপায়ে বোঝাবো আমি। থ্রেড দেবো তাদের। যদি এই বিয়ে না থামে, তাহলে আমি সত্যিই তোমাকে নিয়ে চলে যাব।”
“পাগল হয়ে গেছ? আবারও সেই পালিয়ে যাওয়ার কথা বলছো?”
“উফ, মিতুল এটাকে পালিয়ে যাওয়া বলে না। এটাকে চলে যাওয়া বলে। ঠিক আছে, যাই বলুক না কেন এটাকে, আমি যে তোমাকে নিয়ে সত্যিই চলে যাব এমনটা না। এটা শুধু তাদের বলবো। হুমকি দেবো তাদের। ঠাণ্ডা মাথায় তাদের যেটা বুঝিয়ে পারোনি। গরম করে বললে সেটা ইজিলি বুঝে যাবে তারা।”
জোহান আবারও যাওয়া দিলে মিতুল হাত টেনে ধরলো।
“এমনটা করবে না। বাড়িতে অনেক মানুষজন আছে এখন। এভাবে বললে হবে না। শান্ত মাথায় বোঝাতে হবে তাদের।”
“এখনও শান্ত?”
“হুম। আমি কথা বলবো মায়ের সাথে। যখন তুমি এই বিয়েতে মত দাওনি, তাহলে বিয়েটা থেমে যাওয়ার বদলে আরও এগিয়ে এলো কেন, সেটাই জিজ্ঞেস করবো আমি। তুমি থাকো। আমি যাচ্ছি। ভেবো না যে এই বিয়ে হবে। যে করেই হোক এই বিয়ে আটকাবোই।”
মিতুল বেরিয়ে এলো। সকাল এখন দশটা বাজে। ভাইয়েরা বাজার দিয়ে আবার বাইরে বেরিয়ে গেছে। ভাইদের সাথে দেখা হয়নি মিতুলের। মিতুল সোজা কিচেনে এলো।
সবাই এখন কিচেনেই আছে। হাতে হাতে সব কাজ তাড়াতাড়ি সেরে ফেলবে। মাহিরা মসলা ব্লেন্ড করছিলেন, মিতুল ডাকলো,
“মা, একটু এদিকে এসো।”
“দেখছো না কাজে ব্যস্ত? পরে।”
“পরে নয় এখনই এসো। তোমার সাথে এখনই কথা বলতে হবে আমার। তাড়াতাড়ি এসো।”
মিতুল অশান্ত। ভিতরে ছটফটানি।
মাহিরা আর না গিয়ে পারলেন না। মেহরিনের কাছে নিজের কাজ গছিয়ে দিয়ে মিতুলের কাছে গেলেন।
মিতুল মাকে নিজের রুমে নিয়ে এলো।
“এসব কী মা? আজ বিকেলে আমার বিয়ে, মানে কী এসবের? কাল এত করে বোঝালাম, তারপরও অবুঝপনা করছো? বিয়ে থামানোর বদলে, যে বিয়ে ছিল আরও একদিন পর, সেই বিয়ে উল্টো আজকে ট্রান্সফার করে আনলে? কেন করছো এমন? সত্যিই তোমরা আমার অমতে জোর করে বিয়ে দেবে আমার? জানো না মেয়ের সম্মতি ছাড়া বিয়ে হয় না?”
“মেয়ের সম্মতি নিয়েই তো বিয়ে দিচ্ছি।”
“মেয়ের সম্মতি? কখন সম্মতি দিলাম আমি?” অবাক কণ্ঠ মিতুলের।
“মানে কী? জোহানকে বিয়ে করতে চাও না তুমি?”
“অবশ্যই না। ওই অহংকারীটাকে মরে গেলেও বিয়ে করবো না আমি। ওকে বিয়ে করা অসম্ভব! কেমন করে বোঝাবো তোমাদের? এই বিয়ে ভেঙে দাও তোমরা! প্লিজ!” উত্তেজনায় মিতুল একেবারেই খেয়াল করলো না মাহিরা ঠিক কার নাম উচ্চারণ করেছে।
“তোমার সমস্যা কী? আজ এই কথা বলছো, কাল ওই কথা বলছো। এখন কী চাও? জায়িনের সাথে যে বিয়ে ভেঙে জোহানের সাথে ঠিক করেছি, সেটা আবার ভেঙে জায়িনের সাথে ঠিক করি?”
“হ্যাঁ, তাই ক…” কথাটা বলতে গিয়েও মিতুল হঠাৎ ব্রেক কষলো। মায়ের কথাগুলো তীক্ষ্ম চাপ সৃষ্টি করলো মস্তিষ্কে। মা কী বললো এইমাত্র? মায়ের কথা যখন ভালো ভাবে ধারণ করলো মস্তিষ্ক, তখন সচকিত হয়ে উঠলো মিতুল। বিস্মিত দৃষ্টি ফেললো মায়ের উপর। বিস্ময় আষ্টেপৃষ্ঠে ধরলো ওকে। কিছুতেই না। মা এই মাত্র কিছুতেই…মিতুলের ভাবনা আর বেশিদূর এগোতে পারলো না।
“কী? বিয়ে করতে চাও না জোহানকে?”
মিতুল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। ও হতবাক!
মাহিরা ক্ষুদ্র শ্বাস ত্যাগ করে বললেন,
“পারলাম না। মেয়ের এত কান্নাকাটি দেখে নিজেকে শক্ত করে রাখতে পারলাম না আর। আমি তো মা। অনেক সময় কঠিন থাকার চেষ্টা করলেও, গলিত মনটা কখন হঠাৎ আরও গলে ওঠে বোঝা যায় না।”
মিতুল একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মায়ের দিকে। হঠাৎ কেন যেন চোখে জল চিকচিক করে উঠলো।
মাহিরা বললেন,
“জায়িনের সাথে তুমি সুখে থাকবে, শান্তিতে থাকবে, এটা ভেবেই ওর সাথে বিয়ে দিতে চাইছিলাম তোমাকে। কারণ, জোহানের কথা যেরকম শুনেছি, তাতে ওর সাথে ভালো থাকবে না ভেবেই প্রথমে এত কঠিন ছিলাম। কিন্তু কাল যখন জোহানের কথা অমন ভাবে বললে, তখন মনে হলো, না আমার মেয়েটা অবুঝ নয়। বুঝদার হয়েছে। ওর কথাকে ভরসা করে, ওর সুখে থাকার বিষয়টা ওর কাছেই ছেড়ে দিতে পারি। আর তাই জায়িনের সাথে বিয়ে ভেঙে, এখন জোহানের সাথে ঠিক করেছি। আজ জায়িনের সাথে বিয়ে নয় তোমার, জোহানের সাথে বিয়ে।”
মিতুলের ভিতরটা খুব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছে। জল টলমল চোখে তাকিয়ে থেকে বললো,
“কী করে সম্ভব হলো এটা? রেশমী আন্টিকে বলা মাত্রই মেনে নিয়েছে সে?”
“তেমনটাই তো ঘটলো। রেশমী শুধু বললো,
‘যেটা ভালো হবে, সেটাই করা হবে।’
আমি যাওয়ার আগে জায়িন হয়তো কিছু বলেছিল ওর মাকে। আমি রেশমীর রুমে ঢোকার আগে জায়িনকে বের হতে দেখেছিলাম।”
মিতুল এই মুহূর্তে কী করবে বুঝতে পারছে না। আনন্দে হাসিও পাচ্ছে, আবার কান্নাও পাচ্ছে। মিতুল হাসলোও না, কাঁদলোও না। ও করলো ভিন্ন কিছু। হুট করে জড়িয়ে ধরলো মাকে। বললো,
“লাভ ইউ মা! আমি জানতাম তুমি বুঝবে। কারণ, তোমরা তো এমন নও। অনেক ভালোবাসি তোমাদের!”
“হয়েছে ছাড়। কাজ আছে তো আমার।”
“উঁহু, ছাড়বো না।”
“এটা কী পাগলামি? রান্না বান্না করতে হবে না না কি?”
মিতুল ছাড়লো মাকে। মাহিরা বললেন,
“বিকেলে রেশমীদের বাড়ি থেকে মানুষজন আসবে। তাদের সাথে ভালো আচরণ করবে।”
মিতুল মাথা নাড়লো। মাহিরা আর কিছু না বলে একটু মায়া ভরা হাসি উপহার দিয়ে চলে গেলেন।
_______________
মিতুলের কোনো খোঁজ নেই। এই বিয়ে আটকাবো বলে সেই যে গেল, আর ফেরেনি। ভিতরে ভিতরে রাগে শেষ হয়ে যাচ্ছে জোহান। এটা কী করে হয়? এত করে বোঝালো, অথচ তারপরও এমন!
এমনটা কারো কাছ থেকে আশা করেনি। এখনও কীভাবে মিতুলের সাথে ব্রাদারের বিয়ের ব্যাপার নিয়ে এতটা এগোতে পারে ফ্যামিলির লোকজন? নাহ, আর এভাবে বসে থাকা যাচ্ছে না। জোহান ধৈর্য ধরে রাখতে পারলো না। বের হলো।
লিভিং রুমে অপরিচিত একটা মেয়ে দেখে একটু থমকে গেল। কে এই মেয়ে জানা নেই ওর। মিতুল বলে গিয়েছিল বাড়িতে না কি মানুষজন আসতে শুরু করেছে। তাদের ভিতরই কেউ একজন হবে। জোহান ভিতরের দিকে গেল। দেখা হয়ে গেল মেহরিনের সাথে।
“কোথায় যাচ্ছ?” মেহরিন জিজ্ঞেস করলো।
জোহান প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে, নিজে প্রশ্ন করলো,
“আজকে কি সত্যিই মিতুলের বিয়ে হচ্ছে?”
“হুম, হচ্ছে তো। বিয়ের আভাসটা কি এই সবে পেলে?”
জোহান এবারও উত্তর দিলো না। আরেকটু বেশি রাগ হলো। প্রশ্ন করে বসলো,
“মিতুল কোথায়?”
“আছে হয়তো ওর রুমে। নিজেই গিয়ে দেখো। হয়তো নিজের বিয়ে নিয়ে গভীর ভাবনায় ডুবে আছে।”
____________
আকাশ আজকে এত মেঘলা কেন? আজ তো সূর্য রশ্মিতে ঝলমল করার কথা। খুশির বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার কথা এই শহরের কানায় কানায়। অথচ আজকে আকাশ মেঘলা! মনে হচ্ছে যে কোনো সময় বৃষ্টি নামবে।
প্রকৃতি বড়ো আজব! এটা এই প্রথম বারের মতো খেয়াল করছে না মিতুল। এর আগেও করেছে। তবে আজকে একটু বেশি আজব মনে হচ্ছে। আজকে ওদের খুশির দিন, অথচ দেখো, আকাশটা আজ কেমন মুখ ভার করে আছে। এতদিন যখন ওদের মুখ ভার ছিল, তখন তো ঠিকই হাসছিল। তাহলে আজ কী হয়েছে?
দরজা খোলার শব্দ হলো, সেই সাথে জোহানের কণ্ঠও শোনা গেল,
“তুমি তো বললে বিয়ে আটকাবে, কিন্তু তুমি তো রুমে ঢুকে বসে আছো। আটকিয়েছো বিয়ে?”
জোহানের কণ্ঠ কানে আসতে মিতুলের হৃদয় বলে উঠলো,
“আহা, আমার জোহান!”
মিতুলের জোহানের দিকে ফিরতেও লজ্জা লাগছে। হাসি পাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। কী করবে? জোহানকে এমন লজ্জা মাখা হাসি মুখ কী করে দেখাবে? উহু, পারবে না।
মিতুল খুব কষ্টে চেহারা আঁটসাঁট করে পিছন ফিরলো। তবে এই আঁটসাঁট ভাব রইল না আর। জোহানকে দেখার সাথে সাথে মুখ থেকে ফিক করে হাসি বেরিয়ে গেল। সেই সাথে বললো,
“বিয়েটা হচ্ছে!”
কথাটা বলে মিতুলের হাসির মাত্রা বেড়ে গেল।
জোহানের ভ্রু কুঁচকালো। চেহারা রূপ নিলো বিস্ময়ে। মুখ থেকে অবিশ্বাসের সুরে বেরিয়ে এলো,
“হোয়াট?”
মিতুল হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।
জোহান মিতুলের হাসি মুখ থেকে যারপরনাই অবাক,
“তুমি হাসছো মিতুল? ব্রাদারের সাথে বিয়ে হচ্ছে তোমার, তুমি খুশি?”
মিতুল কিছু বলতে পারলো না। হাসি থামছে না ওর। ক্ষণে ক্ষণে উদয় হচ্ছে।
জোহানের বিস্ময়ের ঘোর অটল। মিতুল হেসে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। এমন করছে কেন মিতুল? মাথায় কোনো সমস্যা দেখা দিয়েছে? জোহানের ভয় হলো। বললো,
“দেখো, হাসি থামাও। তোমার এমন হাসি দেখে ভয় করছে আমার। দয়া করে, বন্ধ করো এটা। কী হয়েছে সেটা খুলে বলো।”
“তুমি বের হও রুম থেকে।”
মিতুলের কথা জোহানকে আরও বিস্ময়ের গভীরে ঢেলে দিলো।
“আমাকে বের হয়ে যেতে বলছো?”
“হ্যাঁ। তুমি এক্ষুণি বের হও।”
“বের হবো না। কী হয়েছে সেটা বলো।”
জোহান নিজ থেকে বেরোতে নারাজ দেখে মিতুল নিজেই জোহানকে জোর করে ঠেলে রুম থেকে বের করে দিলো। তারপর বললো,
“এখন আমি যেই কথাটা বলবো, সেটা শুনে চুপচাপ চলে যাবে তুমি।”
বিস্ময়াকুল জোহান কিছু বলতে পারলো না। শুধু তাকিয়ে রইল।
কথাটা বলতেও মিতুলকে লজ্জা আর হাসির বেড়িবাঁধ বেঁধে রাখছে। মিতুল সব সামলে নিয়ে বললো,
“বিকেলে আমার বিয়েটা তোমার সাথেই হচ্ছে জোহান। শেষমেশ হচ্ছে আমাদের বিয়ে।”
কথাটা বলে দরজাটা দ্রুত বন্ধ করে দিলো মিতুল।
দরজার বাইরে জোহান দাঁড়িয়ে রইল কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কী বললো মিতুল? বিয়েটা তোমার সাথেই হচ্ছে মানে?
____________
বিকেল পাঁচটা দশ।
কাজী সাহেব এসে বসে আছে অনেকক্ষণ ধরে। লিভিং রুমে সবাই উপস্থিত। তবে কনে নেই। নাহিদ সাহেব অধৈর্য হয়ে বললেন,
“আর কতক্ষণ? ডাকো ওকে।”
“হ্যাঁ, যাচ্ছি আমি।” মাহিরা আবারও একবার ডাকতে চলে গেলেন মিতুলকে।
লিভিং রুমটা মানুষের সমাগমে পরিপূর্ণ। ঢাকায় যেসকল আত্মীয় স্বজন আছে তাদের নিয়ে ক্ষুদ্র পরিসরে বিয়েটা হচ্ছে। বিয়েটা হচ্ছে ঘরোয়া ভাবে। তেমন আনুষ্ঠানিকতার ছোঁয়া নেই। তবে পরে খুব বড়ো করে অনুষ্ঠান করা হবে। মিতুলের অনার্স কমপ্লিট হতে এখনও প্রায় এক বছর লাগবে। ততদিন বাংলাদেশই আছে ও। একবছর পরে যখন মিতুলকে কানাডা নিয়ে যাওয়া হবে, তখন হবে অনুষ্ঠানটা। জোহানরাও সপরিবারে আবার বাংলাদেশে আসবে তখন। এক বছর পরই ও পার্মানেন্টলি কানাডা এবং জোহানের কাছে থাকবে।
ঢাকায় যে আত্মীয় স্বজনের বসবাস তাদের মধ্য থেকে রেশমীদের বাড়ি থেকে এসেছে জোহানের দাদি, আঙ্কল, চারজন কাজিন, মামা, মামি। মিতুলদের দিক থেকে আছে, ছোট চাচা, মামনি, খালা এবং দুই কাজিন। এছাড়াও এসেছেন নাহিদ সাহেবের দুই জন ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং এই বিল্ডিংয়ের ভাড়াটিয়ারা।
জোহান বসে আছে গ্র্যান্ডমাদারের পাশে। এক পাশে গ্র্যান্ডমাদার এবং অন্য পাশে মিলান। গ্র্যান্ডমাদার বাংলায় কীসব বলে চলেছেন। সেসব কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না জোহানের। দাদি জানে জোহান বাংলা বোঝে না খুব একটা, বলতে গেলে বোঝেই না, তারপরও অহেতুক বকে চলেছেন।
অন্য সময় হলে গ্র্যান্ডমাদারের কথা না বুঝলেও মনোযোগ দিয়ে শুনতো জোহান। বোঝার চেষ্টা করতো। কিন্তু এখন গ্র্যান্ডমাদারের কথায় কোনো ধ্যান নেই ওর। ও আছে অন্য ভাবনায়। সবকিছু এখনও ওর কাছে কেমন স্বপ্নের মতো ঠেকছে। কোত্থেকে কী হয়ে গেল? জানতো ব্রাদারের সাথে বিয়ে হবে না মিতুলের। কিন্তু বিয়েটা এভাবে, এত দ্রুত ওর সাথে হয়ে যাবে সেটা ভাবেনি। ভেবে উঠতে এখনও বেশ বেগ পেতে হচ্ছে।
জোহানের চোখ একবার দূরে দাঁড়ানো মমের দিকে চলে গেল। মম অন্যমনস্ক!
কাল রাতের কথা কেন যেন মনে পড়ে যাচ্ছে রেশমীর। কাল রাতে জোহান রুম থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর, তিনি অনেকক্ষণ ধরে ভাবনায় মশগুল ছিলেন। বিয়েটা জায়িনের সাথে দেওয়া ঠিক হবে? না কি জোহানের সাথে? জোহানের সাথে বিয়েটা ঠিক করলে জায়িন কীভাবে নেবে? প্রথমে জায়িনের সাথে বিয়েটা ঠিক করে, এখন জোহানের সাথে বিয়েটা দিলে ঠিক কেমন হবে ব্যাপারটা? অন্যদিকে জায়িনের সাথে বিয়েটা দিলে জোহানের কী হবে? আরও অনেক কিছুই ভাবছিলেন তিনি। কিন্তু কোনোটাই বুঝে উঠতে পারছিলেন না। তার ভাবনার মাঝেই হঠাৎ জায়িন আসে। এসে বললো,
“স্যরি মম! এই বিয়েটা করছি না আমি।”
জায়িনের কথা শুনে তিনি অবাক হয়ে বললেন,
“কী বলছো তুমি?”
জায়িন শান্ত কণ্ঠে বললো,
“মিতুলের বিয়ে আমার সাথে নয়, বিয়েটা জোহানের সাথে হওয়া উচিত। আসলেই জোহানের অনেক কিছু পাওয়ার ছিল আমাদের থেকে। মিতুলও ওরই প্রাপ্তি। ওর এবারের প্রাপ্তিটা ওরই থাক।”
জায়িন এইটুকুই বলে শুধু। তারপর আর কিছু না বলে বেরিয়ে যায় রুম থেকে।
জায়িন বেরিয়ে যাওয়ার পর পরই মাহিরা আসে রুমে। জোহানের সাথে মিতুলের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে। বেশ জড়তা নিয়ে এই প্রস্তাব দিয়েছিল মাহিরা। এমনকি দুদিন পরের বিয়ে, মাহিরাই আজকে এগিয়ে এনেছে।
রেশমী একবার লিভিং রুমে চোখ বুলিয়ে নিলো। এখানে সবাই উপস্থিত থাকলেও জায়িন নেই। জায়িন না থাকার কারণে কেমন শূণ্যতা শূণ্যতা লাগছে তার।
জায়িন সকাল থেকেই এ বাড়িতে নেই। সকালে একটা জরুরি কাজ আছে বলে বেরিয়ে যায়। আর ফেরেনি। তিনি কল দিয়ে জানতে পারেন জায়িন একটা হোটেলে আছে। রাতে ফিরবে।
রেশমী এখানে উপস্থিত মানুষগুলোকে দেখে নিলো ভালো করে। সবাই স্বাভাবিক। হাসিখুশি। এর মাঝে জোহানকে হাসিখুশি লাগছে না। হয়তো পুরো ব্যাপারটা বুঝে উঠতেই সমস্যা হচ্ছে ওর। রেশমী জানে না এই বিয়েতে সে খুশি না অখুশি। ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না সেটা। তবে খারাপ যে লাগছে না সেটা বুঝতে পারছে।
___________
মাহিরা দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলেন।
“হলো তোমার?”
মিতুলের সাজ এখনও সম্পূর্ণ হয়নি। মিতুলের পরনে কানাডা থাকতে জোহানের পাঞ্জাবি বাজার থেকে কিনে দেওয়া সেই লাল লেহেঙ্গা। হাতে সেখান থেকে লেহেঙ্গার সাথে ম্যাচিং করে কেনা লাল চুড়ি। গলায় জোহানের দেওয়া সেই ডায়মন্ড নেকলেস। বিয়ে উপলক্ষ্যে মিতুলের জন্য আলাদা শাড়ি, গহনা দেওয়া হলেও, মিতুল সেসব পরেনি। এমন করেই সাজতে ইচ্ছা হলো ওর। জোহানের দেওয়া এসব জিনিস দিয়ে সাজতেই বেশি ভালো লেগেছে। মিতুলের এখন মেকআপ ফিনিসিং চলছে। মুখে সেটিং পাউডার দিচ্ছে।
মিতুলের সাথে রুমে আছে এখন মেহরিন। মেহরিন সেই অনেকক্ষণ ধরে মিতুলের সাজ দেখে যাচ্ছে। এর আগে এত সময় নিয়ে কখনো সাজতে দেখেনি মিতুলকে। ভারী সাজেও এত সময় লাগতো না মিতুলের। আর আজ করেছে হালকা পাতলা মেকআপ। তা করতেও তার সময় লাগলো বহু।
সাজ চলাকালীন একটু পর পরই আবার মিতুল মেহরিনের কাছে জিজ্ঞেস করছিল, ‘কেমন লাগছে আমায়? ভালো লাগছে তো?’
মেহরিন কতবার যে এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে তার হিসেব নেই।
মাহিরা বললেন,
“তুমি কি সাজতে সাজতে রাত বানিয়ে ফেলবে? সাজগোজে তো বেশ অভিজ্ঞ তুমি, তারপরেও এত সময় লাগছে কেন? দ্রুত করো।”
মিতুল মনে মনে বললো,
“এটাই তো আমার যত্ন করে সাজার সময় মা। এখন এত যত্ন করে না সাজলে কখন সাজবো? বিয়ের সময়ের সাজের মতো কি কোনো সাজ আছে? পরে কি এমন একটা মুহূর্ত আসবে আমার জন্য? এখন সাজতে সাজতে রাত বানিয়ে ফেললেও বা কী?”
কিন্তু মুখে বললো,
“হয়ে গেছে মা।”
মেকআপ কমপ্লিট। মিতুল দ্রুত চুলও পরিপাটি করে নিলো। তারপর মাথায় ওড়না টেনে মায়ের সাথে সাথে বের হলো।
লিভিং রুমে এসে প্রথমেই চোখ পড়লো জোহানের উপর। জোহানের দৃষ্টি জোড়াও ওর উপর এসেই স্থির হলো। মিতুল ভেবেছিল জোহানকে আজ পাঞ্জাবি পরা দেখবে। কিন্তু জোহান পাঞ্জাবি পরেনি। ওর পরনে জিন্স, হোয়াইট শার্ট। হোয়াইট শার্ট দেখে মিতুলের মন অভিযোগ তুললো। হোয়াইট শার্ট কেন পরেছে? আজকে একটা রঙিন শার্ট পরা যেত না? এ পর্যন্ত জোহানকে হোয়াইট ড্রেসই বেশি পরতে দেখেছে। হোয়াইট পছন্দ বলে কি আজকে বিয়ের দিনও হোয়াইট শার্ট পরতে হবে? বিয়ের দিনে একটা রঙিন উজ্জ্বল ড্রেসই তো পরা উচিত ছিল। তা নয়। হোয়াইট সেজে বসে আছে।
মিতুলকে জোহানের পাশে বসানো হলো। মিতুলের এতক্ষণ লজ্জা লজ্জা ভাব ছিল না। কিন্তু যেই জোহানের পাশে বসলো, সেই লজ্জা বশ করে ফেললো ওকে। এত মানুষের সামনে জোহানের পাশে বসে থাকতে লজ্জায় শেষ হয়ে যাচ্ছে। কেন ওকে জোহানের পাশেই বসাতে হলো? হায় হায় এ কেমন পরিস্থিতি? কতক্ষণ এভাবে বসে থাকতে হবে? চোখ তুলে তো তাকাতে পারবে না। মাথা নিচু করে কতক্ষণ বসে থাকতে হবে?
বিয়েটা হয়ে গেল।
কবুল বলার সময় মিতুল উপলব্ধি করতে পারলো ‘লজ্জা’ কী জিনিস! এমন লজ্জা জীবনে পায়নি ও। মুখ থেকে তো ‘কবুল’ শব্দটা বেরই হচ্ছিল না। এর মধ্যেই হঠাৎ আবার পেয়ে বসেছিল হাসি। এত লোকের মাঝে কি হাসা যায়? হাসি চেপে রাখার কষ্টটাও বুঝতে পারলো মিতুল। হাসি চেপে রাখা খুবই দুঃসাহসিক একটা কাজ। এটা সবার দ্বারা সম্ভব নয়। ওর দ্বারা সম্ভব হলো অতি কষ্টে!
_______________
বাইরে অন্ধকার, বৃষ্টি পড়ছে গুঁড়ি গুঁড়ি। অথচ আজকে রাতটা এমন থাকার কথা ছিল না। আজকে জোৎস্না থাকার কথা ছিল। জোৎস্নার শুভ্র, মোহনীয়তা মেখে থাকার কথা ছিল পুরো শহরের। কিন্তু কোথায় কী? কোথায় জোৎস্না? আর জোৎস্নার মোহনীয়তা?
মিতুল এতদিন মনে মনে আশা পোষণ করেছে, জোৎস্না থাকাকালীন সময়ে ওর বিয়ে হবে। হ্যাঁ, ভাগ্য গুনে তাই হয়েছে। এখন জোৎস্নার সময়ই চলছে। কালকেও চাঁদটা শুভ্র আলো ছড়িয়েছে। কিন্তু আজ? আজ অন্ধকার! আজকেও একটা বড়ো চাঁদ উঠতো আকাশে। জোৎস্না ছড়িয়ে থাকতো। কিন্তু আবহাওয়া সব শেষ করে দিলো। এতদিন থাকতে আজকে কেন বৃষ্টি নামতে হলো? কোথায় ভেবেছিল, ছাদে গিয়ে জোৎস্নার মাঝে রাতটা কাটিয়ে দেবে। সে আর হলো না। এই বৃষ্টির মাঝে ছাদে যাবে কী করে? এই বৃষ্টিতে কি ছাদে রাত কাটানো সম্ভব?
মিতুল বাইরে থেকে চোখ এনে জোহানের দিকে তাকালো। জোহান বেডের উপর বসা। সেই কখন থেকে শুধু আনমনে হেসে যাচ্ছে। এত হাসছে কেন বুঝতে পারছে না ও। পাগল ছাড়া এরকম কেউ হাসে?
মিতুলের খুব বিরক্ত লাগলো। এমনিতেই আজ আবহাওয়ার এই দশা, তার উপর আবার জোহান পাগলের মতো হাসছে! দুই মিলে মেজাজ তুমুল খারাপ। বিয়ের পর পাগল হয়ে গেল না কি জোহান?
মিতুল জোহানের থেকে চোখ সরিয়ে আবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। এই বৃষ্টি থামবে কখন?
পিছন থেকে জোহানের হাসির শব্দের সাথে জোহানের কণ্ঠও ভেসে আসলো কানে,
“হেই তুলতুল, আমি তোমাকে সত্যি সত্যি বিয়ে করে ফেললাম না কি?”
মিতুলের মেজাজ এবার আরও বিগড়ে গেল। কী আহাম্মকের মতো প্রশ্ন! বিয়ের পর দেখছে, জোহান সত্যিই পাগল হয়ে গেছে। মিতুলের জোহানের প্রশ্নে যা জবাব দিতে ইচ্ছা হলো, তা হলো,
“না, আমরা সত্যি সত্যি নয়, মিথ্যা মিথ্যা বিয়ে করেছি। এই সবাই মিলে একটু মজা করলাম আরকি!”
কিন্তু মুখে কিছু বললো না। জানালার দিকে মুখ করেই দাঁড়িয়ে রইল।
ফের জোহানের কণ্ঠ শোনা গেল,
“আমার তো মানতেই কষ্ট হচ্ছে আমি তোমাকে সত্যি সত্যি বিয়ে করে ফেলেছি। আমার তো মনে হচ্ছে, আমি কোনো স্বপ দেখছি। সুন্দর একটা স্বপ্ন। মিষ্টি! আমি কি তোমাকে সত্যিই বিয়ে করে ফেলেছি?”
মিতুলের মেজাজ আর নিয়ন্ত্রণ হলো না। পিছন ফিরে বলে ফেললো,
“দেখো, আমার মন এখন একদমই ভালো নেই। তোমার এমন পাগলামি বন্ধ করো।”
“কেন? তোমার মন ভালো নেই কেন? আমাকে বিয়ে করে খুশি হওনি?” জোহান খানিক দুশ্চিন্তা নিয়ে বললো।
মিতুল উত্তর না দিয়ে আবার জানলার দিকে ঘুরলো। তারপর বললো,
“ভেবেছিলাম, আজকে রাতে দুজন ছাদে গিয়ে সময় কাটাবো। আকাশে থাকবে সুন্দর একটা চাঁদ। চাঁদের সাথে সময় কাটবে আমাদের। কিন্তু তা তো হলো না। চাঁদের বদলে বৃষ্টি নেমেছে!”
জোহান একটু মিষ্টি হেসে মিতুলের পাশে এসে দাঁড়ালো। চোখ রাখলো বাইরে। বৃষ্টি পড়ছে। জোহান বললো,
“বৃষ্টি নেমেছে তো কী হয়েছে? আমরা তো এখনও ছাদে যেতে পারি। চাঁদের জায়গায় চাঁদ নেই। কিন্তু ছাদ তো ঠিকই আছে।”
“মানে কী? এই বৃষ্টির মাঝে ছাদে যাব আমরা?”
“গেলে ক্ষতি কী? তোমার মনে আছে কী বলেছিলাম আমি? বলেছিলাম, বাংলাদেশের বৃষ্টিতে প্রথম ভিজবো তোমার সাথে। যদিও এমন বৃষ্টির কথা বলিনি। ঝুম বৃষ্টির কথা বলেছিলাম। কিন্তু আজকে যখন এই বৃষ্টি নেমেছে, এই বৃষ্টিতেই ভিজি চলো।
“তোমার মাথা সত্যিই খারাপ হয়ে গেছে? এই রাত্রি বেলা তোমার সাথে বৃষ্টিতে ভিজবো আমি? পারবো না। কালকে দিনে ভিজবো।”
“বৃষ্টি কি তোমার জন্য কাল দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করবে? এখনই ছাদে যাব আমরা।”
“অসম্ভব এই রাতে বৃষ্টিতে ভিজবো না আমি। তোমার ইচ্ছা হলে তুমি একা যাও।”
“যেতেই হবে তোমাকে।”
জোহান মিতুলকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে, মিতুলের এক হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো। তারপর নিয়ে যেতে লাগলো দরজার দিকে।
দরজার কাছাকাছি আসতেই মিতুল বললো,
“এক মিনিট, এক মিনিট…”
জোহান থামলো।
“কী?”
মিতুল একটা ছাতা নিলো সাথে।
জোহান বললো,
“ছাতা দিয়ে কী করবে?”
“বাংলাদেশের বৃষ্টি সুবিধার নয়। ভিজলে যখন তখন জ্বর আসতে পারে। আমরা ছাদে যাব ঠিকই, বৃষ্টি দেখবো ঠিকই, কিন্তু ভিজবো না।”
কথাগুলো বলে মিতুল নিজেই জোহানের হাত ধরে বললো,
“চলো।”
লিভিং রুম থেকে একটু দূরে থাকতেই মিতুল দাঁড়িয়ে গেল। জোহানকেও বললো,
“দাঁড়াও।”
“কী হয়েছে?”
“শুনতে পাচ্ছ না? লিভিং রুমে মানুষজন কথা বলছে?”
“তো?”
“তাদের সামনে দিয়ে বাইরে বের হবো কী করে? কী ভাববে তারা?”
“এখানে ভাবাভাবির কী আছে? আমরা তো যাচ্ছি ছাদে। ঘর থেকে বের হয়ে, কোথাও চুরি তো করতে যাচ্ছি না। চলো।”
জোহান মিতুলের বারণ না শুনে ওকে নিয়ে লিভিং রুম পর্যন্ত এসে গেল।
লিভিং রুমে প্রথম পা রেখেই মিতুল লজ্জায় মরে যায় যায় অবস্থা। এই জোহানের কোনো লজ্জা শরম নেই। এত লোকের মাঝ দিয়ে কেন এখন ছাদে যেতে হবে?
লিভিং রুমে এখন সবাই আছে। মা, ভাইয়েরা, রেশমী আন্টি, মেহরিন, মামনি, জেবিন, জোহানের দুটো কাজিন সবাই। শুধু আব্বু নেই। হয়তো রুমে রেস্ট নিচ্ছে। বাকি যারা এসেছিল বিয়েতে, তারা খাওয়া দাওয়া শেষ করে চলে গেছে।
এত লোকের সামনে থেকে ছাদে গেলে কী ভাববে তারা? এই জোহান…না, সত্যিই পারা যাবে না জোহানকে নিয়ে। ইশ, লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে ওর।
জোহান কাউকে ভ্রুক্ষেপ না মিতুলকে নিয়ে সোজা দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। মেহরিনের কথায় থামতে হলো,
“কোথায় যাচ্ছিস তোরা?”
মিতুল মনে মনে ভাবলো, শেষ সব শেষ! কী উত্তর দেবে এখন? কী বলবে? আমরা দুজন ছাদে বৃষ্টি বিলাস করতে যাচ্ছি?
মিতুল মনে মনে উত্তর খুঁজতে লাগলো। অন্য কিছু বলা যায়?
জোহান বাংলা বুঝতে পারেনি। তবে আন্দাজ করতে পেরেছে। মিতুলের হয়ে ও’ই উত্তরটা দিয়ে দিলো,
“আমরা দুজন ছাদে যাচ্ছি।”
জোহানের কথা শুনে মিতুল বিরক্তি, লজ্জায় চোখ বুজে ফেললো। মন বলে উঠলো,
‘এই জোহান সত্যিই আহাম্মক। লজ্জা শরম নেই ওর। এত মানুষের মাঝে এত সহজ ভাবে কী করে বলে দিলো কথাটা?’
জোহানের কথায় সবারই ভ্রুকুটি হলো। মাহিরা বললেন,
“ছাদে যাচ্ছ? এই বৃষ্টির মাঝে ছাদে যাচ্ছ কেন?”
জোহান উত্তরটা দেবে ঠিক করেছিল, কিন্তু মিতুল বলার সুযোগ দিলো না। তার আগে মিতুল নিজে বলে উঠলো,
“বৃষ্টি থাকলে কোনো সমস্যা নেই। ছাতা নিয়েছি তো। ভিজবো না আমরা।”
মেহরিন মুখ খুললো। কিছুটা টেনে বললো,
“ওহ…আমি বুঝতে পেরে গেছি। এটা হলো রোমান্টিকতা। বাসর রাতে দুজন বৃষ্টি বিলাস করবে। বৃষ্টিতে ভিজবে দুজন। দেখছো না, কী সুন্দর করে আবার হাতও ধরে আছে।”
মেহরিনের কথায় মিতুলের টনক নড়লো। জোহান লিভিং রুমে এসেও ওর হাত ধরে রেখেছে, সেটা একটিবার খেয়াল করেনি ও। মিতুল এক টানে হাতটা ছাড়িয়ে নিলো। এই লজ্জা কোথায় রাখবে? একটু মাটি ফাঁক হয়ে যাক, মুখ লুকাবে ও। জোহান সবার সামনে এরকম বেশর্মার মতো ওর হাত ধরে রেখেছিল? ছি ছি সবাই কী ভাবলো?
আর মেহরিনই বা কী? এতটা পাজি হলো কবে? সবার সামনে এরকম একটা কথা বললো কী করে ও? এখানে বয়স্করাও আছে, সেদিকে কি খেয়াল নেই ওর? পাজি একটা!
মেহরিন বাংলা বলার কারণে জোহান বুঝতে পারেনি ঠিক করে। তবে দেখলো সবাই মিটিমিটি করে হাসছে।
সবার ধ্যান যখন মিতুল এবং জোহানের দিকে, নাবিল তখন মেহরিনের কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললো,
“আমাদের বাসর রাতেও কিন্তু আমরা এই রোমান্টিকতা পালন করতে পারি।”
নাবিল মেহরিনের পাশেই বসেছিল। নাবিলের কথা কানে আসতেই মেহরিনের হাসির রেশ মুছে গেল। কঠিন চোখে একবার তাকালো নাবিলের দিকে। তারপর একবার অন্য সবার উপর চোখ বুলালো। না কেউ খেয়াল করেনি।
মেহরিনের ধারণা ভুল। কেউ খেয়াল না করলেও মিতুল ঠিকই করেছে। দেখেছে ওর ভাইয়া মেহরিনের কানে ফিসফিস করে কিছু বলেছে। ঘটনাটা দেখেও মিতুলের লজ্জা লাগলো। প্রায় অনেক দিন যাবৎ নাবিল এবং মেহরিনের মাঝে মন দেওয়া নেওয়া চলছে। এটা কেউ জানে না এখন পর্যন্ত। শুধু মিতুল জানে। ভাইয়া এবং মেহরিন এত মানুষের তোয়াক্কা না করে এরকম প্রেম করছে, পাশাপাশি বসে আছে, অথচ ওর বিয়ে চলাকালীন সবার সামনে জোহানের পাশে একটু বসতেই লজ্জা লাগছিল। এমন কেন ও? মেহরিনের মতো হতে পারে না কেন?
লিভিং রুমের ফাড়াটা কাটিয়ে ছাদে আসতে সক্ষম হলো ওরা। আসার সময় একজনকে নিচে নেমে যেতে দেখলো। হয়তো সেও বৃষ্টি বিলাস করতে এসেছিল ছাদে।
মিতুল ছাতা খুলতে চাইছিল, কিন্তু জোহান খুলতে দিলো না। মিতুল মেনে নিলো। ছাদে এখন গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মাঝেই দাঁড়িয়ে আছে ওরা। মিতুলের মনে ঘুরতে থাকা কথাটা এবার বলে ফেললো,
“তুমি লিভিং রুমে সবার সামনে ওভাবে আমার হাত ধরে রেখেছিলে কেন?”
“হাত ধরে রেখেছিলাম তো কী হয়েছে? এখন আমরা বিবাহিত দম্পতি। হাত ধরে রাখলেই বা কী, আর জড়িয়ে ধরলেই বা কী?”
“অনেক কিছু। বেশরমার মতো কথা বলো না। এটা তোমার কানাডা নয়। এটা বাংলাদেশ।”
“বাব্বাহ, আমার তুলতুল দেখছি রাগীর পাশাপাশি, খুব লজ্জাবতীও।”
জোহানের কথায় মিতুল লজ্জায় পড়ে গেল আবার।
জোহান হাসলো। রেলিংয়ের দিকে যেতে যেতে বললো,
“শেষমেশ আমাদের বিয়েটা হয়েই গেল তুলতুল।”
মিতুল পিছন থেকে তাকিয়ে রইল। বৃষ্টির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফোঁটা ছুঁয়ে দিচ্ছে। এখন ঝুম বৃষ্টি থাকলে ভিজে একাকার হয়ে যেত। কিন্তু এই বৃষ্টির ভিজিয়ে দিতে সময় লাগছে।
জোহান দূরে দৃষ্টি রেখে বললো,
“আজকে দিনটা যেন খুব নিশ্চিন্ত লাগছে। তোমারও লাগছে এমন?”
মিতুল জোহানের কাছে এগিয়ে এলো। জোহানের পাশে দাঁড়িয়ে রেলিংয়ে হাত রেখে বললো,
“হুহ্, লাগছে। ভাবতে পারিনি আমাদের বিয়েটা এভাবে হয়ে যাবে।”
জোহান মিতুলের দিকে তাকালো। মিতুলও তাকালো।
জোহান হঠাৎ মিতুলের পিছনে এসে দাঁড়ালো। পিছন থেকে মিতুলকে জড়িয়ে ধরে, মিতুলের কাঁধে চিবুক ডুবিয়ে বললো,
“আমাদের এখন বিয়ে হয়ে গেছে। আমরা এতটা কাছাকাছি থাকলেও এখন সমস্যা নেই। আমরা এখন ঘুরতে গিয়ে এক চাদর, এক বালিশে মাথা রেখে, পাশাপাশি শুতে পারি।”
জোহানের আকস্মিক এমন কাণ্ডে মিতুল কিছুটা চমকে গেল।
মিতুলের এই মুহূর্তে যে অনুভূতি হচ্ছে, সেটা অপরিচিত। অচেনা মিষ্টি এক অনুভূতি! হৃদয়ে মৃদু কাঁপন হচ্ছে। সেই সাথে এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বৃষ্টির ফোঁটাদের মনে হচ্ছে ভালোবাসার বার্তা বহনকারী শুভ্র সুখময় বারি ধারা।
মিতুল শুকনো একটা ঢোক গিলে বললো,
“হুম, পারি।”
জোহান নীরব হাসলো। মিতুলকে ছেড়ে দিয়ে নিজের দিকে ফিরিয়ে বললো,
“এখন আমরা চুমুও খেতে পারি, তাই না?”
জোহানের কথায় মিতুলের হৃদয় যেন একটু বেশি কেঁপে উঠলো। মুখে কথা নেই ওর। কিছু বলতে পারলো না।
জোহান হেসে মিতুলের কপালে চুমু এঁকে দিলো।
মিতুল পড়লো এবার বিব্রত অবস্থায়। এখানে দাঁড়িয়ে থাকাই কষ্ট সাধ্য হয়ে পড়ছে। কিছুতেই জোহানের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না আর। কিন্তু ও টের পাচ্ছে ও একটুও নড়ছে না। একেবারে স্থির।
জোহান বললো,
“আমার উষ্ণ আলিঙ্গন অন্য সব মেয়েদের জন্য তো নিষেধাজ্ঞা জারি করে দিয়েছো। এটা শুধু তোমার প্রাপ্তি। তাহলে আজ দূরে দাঁড়িয়ে কেন? নেবে না আমার উষ্ণ আলিঙ্গনের পরশ?”
কথাটা বলেই জোহান মিতুলের এক হাত ধরে টেনে একেবারে কাছাকাছি এনে ফেললো। তারপর বললো,
“এখন আমরা জড়িয়েও ধরতে পারি!”
জোহান মিতুলকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো।
মিতুলের মাঝ থেকে সকল বিব্রত বোধ হারিয়ে গেল। মন অনুভব করলো গভীর প্রশান্তি। এটাই সেই ক্ষণ! যেই ক্ষণের অপেক্ষায় ছিল ও। সেদিন এই ক্ষণটি আসার আগেই জোহানকে জড়িয়ে ধরেছিল। কঠিন পরিস্থিতির মাঝে জোহানের চেরি ব্লসম দেওয়ায় আবেগী আপ্লুত মন সেদিন বাঁধ মানেনি। কিন্তু ও একদমই চায়নি সেদিন জোহানকে ওভাবে জড়িয়ে ধরতে। জোহানের উষ্ণ বক্ষে মুখ লুকানোর জন্য এই ক্ষণটিরই অপেক্ষা করছিল ও।
মিতুলের কানে জোহানের শান্ত কণ্ঠ ভেসে এলো,
“এই জায়গাটা শুধুই আমার লিটল এঞ্জেলের! আমার লিটল এঞ্জেল চাইলেই যখন তখন এই জায়গাটা দখল করতে পারে। এটা তার জন্য উন্মুক্ত! আমার লিটল এঞ্জেল সারা জীবনের জন্য আমার হয়ে গেছে। আমি ধন্য, আমি পূর্ণ! আমার জীবনে পাওয়া সবথেকে শ্রেষ্ঠ উপহার আমার লিটল এঞ্জেল!”
জোহানের কথায় মিতুলের মনে শুভ্র অনুভূতির ছোঁয়া লাগলো। নিজেকে মনে হলো, সুখী একজন মানুষ। এই পৃথিবীর সুখী মানুষগুলোর মধ্যে ও একজন। মিতুল মনে মনে বললো,
“আমিও ধন্য তোমায় পেয়ে। আমিও পূর্ণ! তুমি আমার ভালোবাসা। আমার অতি সযতনে আপন একটি মানুষ। ভালোবাসি, খুব বেশি ভালোবাসি তোমায়!”
(চলবে)
_______________
(গল্পটা একেবারেই শেষের পথে। আর মাত্র একটা পার্ট বাকি আছে।)