#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ১০
_____________
সারারাত মিতুলের দুই চোখের পাতা এক হয়নি। মনে কেবল ঘুরেছে জঙ্গলের ব্যাপারটা। কালকে রাতে কীসব সিরিয়াল কিলার নিয়ে ভেবেছে, যেটা অযৌক্তিক মনে হচ্ছে এখন। কিন্তু কোনো না কোনো গড়বড় তো অবশ্যই আছে। আর সেটা জানতে হলে ওকে ওই জঙ্গলের ভিতর ঢুকতে হবে। ও রাতেই মনস্থির করেছিল সকাল হলেই একবার ওই জঙ্গলে ঢুকে ব্যাপারটা দেখবে। যতই ভয় করুক না কেন একবার বিষয়টা দেখতেই হবে।
মিতুল ব্যাক ডোর থেকে গার্ডেনে নেমে পড়েছে। বাইরে শীতল পরিবেশ। বসন্ত কালেও এখানে বেশ শীত পড়ে। মিতুল গায়ের বেগুনি রঙের সোয়েটারটা ভালো করে আঁকড়ে ধরে এগিয়ে চলছে। ঘাসের উপর জমে থাকা শিশির বিন্দু পায়ের সাদা কেডস জোড়া ভিজিয়ে দিচ্ছে। জঙ্গলের ভিতর দুই-একটা পাখি ডাকছে অচেনা সুরে। ওর কাছে ভয়ংকর লাগছে ওই সুর। যেন ওকে জঙ্গলে ঢুকতে সাবধান করছে। কিন্তু ওই সাবধান বাণী শুনবে না ও। দেখবেই ব্যাপারটা। চারপাশটা অদ্ভুত রকমের নিস্তব্ধতায় ঘেরা। ভূতুড়ে মনে হচ্ছে কেমন। বাতাসের শীতল পরশ সোয়েটার ভেদ করে ভিতরে ঢুকে গায়ের লোম খাড়া করে দিচ্ছে। মিতুলের গলা শুকিয়ে যাচ্ছে বার বার। ঢোক গিলে গলাটা ভিজিয়ে নিতে চাইছে।
সূর্যের আলোয় চারিপাশ আলোকিত হলেও জঙ্গলের ভিতরে আলোর বিচরণ দেখা যাচ্ছে না ভালো করে। বড়ো বড়ো গাছের ফাঁক ফোকর দিয়ে একটু-আধটু আলো কোনো রকমে ঢুকেছে। যা জঙ্গলকে আলোকিত করতে পারছে না বললেই চলে।
মিতুল জঙ্গলে ঢোকার রাস্তা থেকে এখনও অনেক কদম পিছনে। জঙ্গলে ঢুকতে ভয় করছে ওর। হাত-পা একটু একটু কাঁপছেও বোধহয়। জঙ্গলে ঢুকতে চেয়ে কি ঠিক করছে? না কি ভুল?
হলে হোক ভুল। দেখতেই হবে কী আছে ওই গভীর জঙ্গলে। মিতুল ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত মন নিয়ে এগিয়ে চললো। কিন্তু রাস্তা পর্যন্ত যেতে পারলো না। একটা গম্ভীর পুরুষ কণ্ঠ যেমনি ওর চলন রোধ করলো, তেমনি থামিয়ে দিলো ওর হৃৎস্পন্দন। শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল ভয় স্রোত নেমে গেল। পিছন ঘুরে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না। জানে না কেন এত ভয় করছে। ভীতু মন নিয়ে পিছনের গম্ভীর কণ্ঠের মানুষটির দিকে ফিরলো ও।
ব্যাক ডোরে গম্ভীর কণ্ঠের মানুষ, অর্থাৎ জায়িন দাঁড়ানো।
মিতুল কী বলবে, কী করবে বুঝতে পারছে না। ও হঠাৎ জায়িনকে এত ভয় পাচ্ছে কেন?
“জঙ্গলে ঢোকার দরকার নেই। বিশেষ কিছু নেই ওখানে। গাছপালা এবং একটা উটকো জিনিস ছাড়া অন্যকিছুই দেখতে পাবে না। ওখানে না যাওয়াই ভালো।”
কথাগুলো বলে ঘরে ঢুকে গেল জায়িন।
মিতুল ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে ব্যাক ডোরের দিকে। জায়িন সরাসরি ওকে জঙ্গলে ঢুকতে নিষেধ করেছে? কেন?
আগের থেকে ভয় আরও বেড়ে গেল ওর। জঙ্গলে যাই থাকুক না কেন, তার সাথে জোহান একা জড়িত নয়, জায়িনও যে এর সাথে জড়িত বিষয়টি খুব ভালো করেই বুঝতে পারলো মিতুল। এই দুই ভাই মিলে কী করছে এই জঙ্গলের ভিতর? সত্যি সত্যিই কি কোনো মার্ডার…
মোবাইলে রিংটোনের শব্দে মিতুলের ভাবনায় ছেদ পড়লো। পকেটে ফোন বাজছে।
মোবাইল স্কিনে মা নামটা দেখে মিতুলের মন হঠাৎ কেঁদে উঠলো।
“হ্যালো মা!”
“উঠে পড়েছো ঘুম থেকে?”
“হ্যাঁ মা। তোমায় অনেক মিস করছি মা! লাভ ইউ।”
মিতুলের মা হঠাৎ করে মিতুলের এত ভালোবাসার কারণ বুঝতে পারছেন না। তিনি আশঙ্কা করলেন মিতুল কিছু একটা ঝামেলা বাঁধিয়েছে।
“কী ঝামেলা করেছো তুমি?”
“আমি মরে গেলে তুমি খুব কষ্ট পাবে তাই না?” কথাটা বলতে মিতুলের নিজের মনই কষ্টে জর্জরিত হয়ে গেল।
“কী বলছো এসব আবোল-তাবোল?”
“দোয়া করো, আমি যেন একটি দীর্ঘ জীবন পাই…”
“হঠাৎ করে এসব কী বলছো তুমি? কী হয়েছে?”
মিতুল জোর করে মা’কে নিজের হাসি কণ্ঠ শোনালো।
“না, কিছু হয়নি। এমনি বললাম। দেখতে চাইছিলাম তুমি ঠিক কতটা চিন্তা করো আমাকে নিয়ে। সত্যিই মা, তুমি অনেক অনেক বেশি চিন্তা করো আমাকে নিয়ে। ঠিক আছে, তোমার সাথে পরে আবার কথা বলবো আমি। ব্রেকফাস্ট করবো এখন। রাখছি তাহলে।”
মিতুল ফোন কেটে দিয়ে ফোন সাইলেন্ট করে রাখলো। জানে মায়ের দুশ্চিন্তা একেবারে দূর করে দিতে পারেনি। এরপর মা অনেক বার কল দেবে ওকে। মায়ের সাথে কথা বলার মন নেই এখন। কিন্তু মাকে ও এরকম কথা কেন বললো? নিজেই বুঝতে পারছে না সেটা! জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে মিতুলের দু চোখ অশ্রু ভরাট হলো। না জানি কত মানুষের আত্মচিৎকার এই জঙ্গলের অন্ধকার রাজ্যের ভিতরই আটকা পড়ে আছে!
___________________
আজ সারাদিনে তুলতুলকে কোথাও দেখতে পায়নি। কোথায় উধাও হলো মেয়েটা? সকাল থেকে একবারও চোখে পড়েনি। ব্যাপারটা নিয়ে ভাবেনি এতক্ষণ। কিন্তু এখন না ভেবে উপায় পেল না। কোথায় গেল মেয়েটা? কার্লের কাছে গেছে না কি আবার? কার্লের কথা মনে উঠতেই জোহানের মেজাজ চরমে উঠলো। গ্যারেজে এসে গাড়ি নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়লো বাড়ি থেকে।
কার্লের রেস্টুরেন্টে এসে খুঁজলো। কার্লকে পেল, কিন্তু মিতুলকে দেখলো না কোথাও। এখানে আসেনি? কোথায় গেল তাহলে? অন্য কোনো ছেলের পিছনে ঘুরছে না কি?
জোহান আশেপাশের আরও কয়েকটা রেস্টুরেন্টে খুঁজলো। কিন্তু পেল না।
পার্কেও খোঁজ করলো, তবে পাওয়া গেল না মিতুলকে।
সন্ধ্যা নামার খানিক আগে বাসায় ফিরলো জোহান। এর মাঝে রিকার্ডো ফোন করে লং ড্রাইভে যাওয়ার কথা বলেছিল। ও না করে দিয়েছে। কালকে সকালে যাবে বলেছে। মিতুলকে খুঁজে বের করতে হবে আগে। এই বোকা মেয়েটা কোথায় চলে গিয়েছে কে জানে! কোনো ছেলের সাথে ডেট করছে? বয়ফ্রেন্ড জুটিয়ে ফেলেছে? নিজের বয়ফ্রেন্ডের সাথে লং ড্রাইভে চলে গেছে দূরে কোথাও? এই নাকফুলো মেয়েটা…
জোহান ঘরে ঢোকা দিয়ে আবার থামলো। ক্যামিলা লনে আগাছা পরিষ্কার করছে। মেশিন দিয়ে কাটছে আগাছাগুলো। জোহান দরজায় দাঁড়িয়েই ডাকলো,
“সিস…”
“হ্যাঁ, বলো।”
“মিতুলকে দেখেছো কোথাও?”
“হ্যাঁ…”
জোহান অবাক। ও নিজে বাইরে এত এত জায়গায় খুঁজেও পেল না, তাহলে ক্যামিলা কোথায় দেখলো?
“কোথায় দেখেছো ওকে?”
“মিতুল তো নিজের রুমে।”
জোহানের চোখ কপালে উঠলো।
“নিজের রুমে?”
“হ্যাঁ। সকালে ব্রেকফাস্ট করতে না আসায় ডাকতে গিয়েছিলাম রুমে। তখন বললো ব্রেকফাস্ট করবে না, ঘুমাবে। চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল রাতে ঘুমায়নি, তাই ভাবলাম ঘুমাক। সেই যে ঘুমালো আর ওঠেনি। হয়তো ক্লান্ত সে জন্য এভাবে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। আমি ওর ঘুমে ডিস্টার্ব করিনি আর।”
জোহান সব শুনে মিতুলের রুমে চলে এলো। মিতুলের রুমের দরজা আনলক ছিল। একটু ঠ্যালা দিতেই খুলে যায়।
মিতুল উপুড় হয়ে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। সাদা কম্বল কোমর পর্যন্ত টেনে দেওয়া। মুখ নরম বালিশে কাত হয়ে ডুবে আছে। মুখে অসংখ্য চুল এসে পড়ে মুখটা আড়াল করে রেখেছে অনেকখানি।
জোহান ভাবতে পারছে না মিতুল নিজের রুমে ছিল, আর ও বাইরে বাইরে খুঁজে বেরিয়েছে ওকে! কেন সারাদিন রুমের ভিতরে থেকে ঘুমিয়েছে? জোহানের ইচ্ছা হলো সারাদিন ঘুমানোর অপরাধে মিতুলকে একটা কঠিন শাস্তি দেয়। জোহান মিতুলের কাঁধে আস্তে আলতো করে কয়েকটা চাপড় দিয়ে ডাকলো,
“মিতুল!”
মিতুল ঘুমের ঘোরেই বলে উঠলো,
“হুঁ?”
“তুমি এখনও ঘুমাচ্ছ? ওঠো।” কড়া গলায় আদেশ দিলো জোহান।
মিতুল নিদ্রা অবস্থাতেই বিড়বিড় করে বললো,
“ওঠো? কে ওঠো? আমি মিতুল! আমি রাবা!”
“হেই ব্যাঙ্গলি গার্ল! কীসব বলছো তুমি?”
“বেঙ্গল? আমি রয়েল বেঙ্গল টাইগার খাবো না। আমি ভাত চাই। রুই মাছ দিয়ে ভাত খাবো আমি।”
অস্পষ্ট জড়ানো বাংলা শব্দগুলো কিছুই জোহানের বোধগম্য হলো না। তাছাড়া মিতুলের ঘুমের ঘোরে এভাবে কথা বলা জোহানের ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে গেল। জোহান হাত দিয়ে জোরে মিতুলের পিঠে আঘাত করে বললো,
“এই ওঠো তাড়াতাড়ি।”
মিতুলের চোখের পাতা কম্পিত হয়ে খুলে গেল। সামনে ঝাপসা করে একটা বিদেশি ছেলেকে বসে থাকতে দেখতে পেল। বিদেশি ছেলেটার মুখে যখন জোহানকে খেয়াল হলো, তখন হুঁশ ফিরলো মিতুলের। জোহানকে দেখে চোখে আতঙ্ক ভর করলো ওর। চকিতে শোয়া থেকে উঠে জোহানের থেকে অনেকটা দূরে ছিটকে গেল ও।
“তু-তুমি এখানে?”
মিতুলের মুখে আতঙ্কের গাঢ় ছায়া।
জোহান অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
রুমের খোলা দরজায় চোখ পড়তে হা হয়ে গেল মিতুলের মুখ। দরজার দিকে অঙ্গুলি করে বললো,
“দরজা খুললে কীভাবে তুমি? দরজা তো আমি বন্ধ করে ঘুমিয়েছিলাম। কীভাবে খুললে তুমি?”
জোহান নির্বিকার তাকিয়ে বললো,
“দরজা যদি তুমি বন্ধ করেই ঘুমাও তাহলে কি আমি অলৌকিক শক্তির মাধ্যমে সেটা খুলে ভিতরে ঢুকেছি? সারাদিন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে তোমার মাথা কি ড্যামেজ হয়ে গেছে? লিসন, তোমার রুমের দরজা খোলাই ছিল। খোলা রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছো।”
মিতুল একটু সময় ভেবে বললো,
“থাকুক খোলা। সেটা বিষয় না। তুমি কেন চোরের মতো আমার রুমে ঢুকেছো সেটা বলো? কী করতে চাইছিলে তুমি?”
জোহান একটু হেসে দুষ্টুমির সুরে বললো,
“তোমার কী মনে হয়? কী করতাম আমি?”
মিতুল রেগে গিয়ে একটা বালিশ ছুঁড়ে মারলো জোহানের দিকে। জোহান ক্যাচ ধরে ফেললো।
মিতুল বললো,
“বেরিয়ে যাও এখান থেকে।”
“তোমার রুমে থাকতে আসিনি আমি। আমার থাকার অনেক জায়গা আছে। নিজের পানিশমেন্টের জন্য রেডি হও।” বলে বালিশটা ছুঁড়ে মিতুলের কাছে পাঠিয়ে দিলো আবার।
মিতুলও জোহানের মতো ক্যাচ ধরলো।
“পানিশমেন্ট মানে?” অবাক কণ্ঠে জানতে চাইলো মিতুল।
জোহান রুম থেকে যেতে যেতে বললো,
“রুমে বসে থেকে আমাকে বাইরে বাইরে ঘুরিয়েছো তুমি, খুঁজিয়েছো তোমায়।
বুঝলে, এডমন্টনের এক প্রান্ত ঘোরা শেষ! আমার শক্তি অপচয় হয়েছে, কারের অয়েল ফুরিয়েছে। এর পানিশমেন্ট নেবে না তুমি?”
“কী বলছো এসব?” জোহানের কথার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝলো না।
দরজার কাছে গিয়ে থামলো জোহান। মিতুলের দিকে ফিরে বললো,
“রাতে সুন্দর করে রেডি হয়ে থাকবে। তোমায় নিয়ে পার্টিতে যাব আমি। নিয়ে যাব মানে যাবই। আমার কথা অমান্য করার চেষ্টা করো না একদম। যদি চেষ্টা করো, তাহলে তোমার ওই ফুলো নাক কেটে জঙ্গলের হিংস্র প্রাণীগুলোকে খাওয়াবো আমি।”
মিতুল হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। কী সাংঘাতিক কথাবার্তা! গা শিউরে উঠছে।
জোহান ফিচেল হেসে চলে যায়।
মিতুলের জঙ্গলের কথা মনে পড়ে গেল। চিন্তার রাজ্য এসে নিমেষেই ভর করলো ওর মাথাতে। কী আছে ওই জঙ্গলে? সত্যিই কি কোনো হিংস্র প্রাণী আছে?
(চলবে)