চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব-১৮

0
2009

#চৈতালি_পূর্ণিমা
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-১৮

ড্রয়িংরুমে বসেছে আজ জমপেশ আড্ডা। বাড়ির ছোট-বড় সকলেই এক জোট হয়ে নানান কথার সুর তুলছে। মাঝেমধ্যে হাসির রোল পড়ছে উচ্চস্বরে। কথায় কথায় জানা গেল মাহিনের বিয়ের জন্যই নির্বাণের বিয়েটা চটজলদি সাড়তে হয়েছে। শেখ বাড়ির নিয়ম অনুযায়ী বড় ছেলের আগে ছোট ছেলে বিয়ে করতে পারবে না। আর শেখ বাড়ির বড় ছেলে হিসাবে নির্বাণকেই ধরা হয়। কয়েক বছর ধরেই নির্বাণকে বিয়ের জন্য বলা হচ্ছিল কিন্তু নির্বাণ বিয়ে করতে ইচ্ছুক নয় বলে তারা কথা আগাতে পারেনি। এর মাঝে মাহিন এসে ওর পছন্দের কথা জানায়। পাত্রীপক্ষের ব্যাকগ্রাউন্ড ভালো থাকায় বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়ে যায়। কিন্তু বিয়েটা আটকে থাকে নির্বাণের বিয়ের জন্য। অবশেষে নির্বাণও সম্মতি জানায় বিয়ের জন্য আর পুরো ব্যাপারটাই সে ছেড়ে দেয় নিলুফা ও রাদিনের উপর। কেন না, তার ভরসা ছিল তাদের পছন্দের উপর। ঘটকের মাধ্যমে স্পর্শীকে নাকি রাদিন-ই পছন্দ করেছিলেন নির্বাণের জন্য। অতঃপর নির্বাণকে বিষয়টা জানানো হলে সে পাত্রীকে না দেখেই তাদের সাথে যাওয়ার জন্য রাজী হয়ে যায়। কথা ছিল তাদের মেয়ে পছন্দ হলে আংটি পড়িয়ে রাখবেন আর খুব দ্রুত আয়োজন করে বিয়ের পর্ব চুকিয়ে নিবেন। এরপর মাহিনেরটা। কিন্তু পাত্রীপক্ষ চাইছিলেন বিয়েটা পড়েই হোক তাই দুই পক্ষ সেদিনই বসে পরামর্শ করে সিন্ধান্ত নেন নির্বাণ আর স্পর্শীর কাবিন করিয়ে রাখবেন এবং পরবর্তীতে আয়োজন করে নিবেন।

সব শুনে স্পর্শী ধাতস্থ হয়ে বসেছিল। নির্বাণের সাথে তার বিয়ে কাকতালীয়, অনাকাঙ্ক্ষিতভাবেই হয়েছিল তা সে পূর্বেই বুঝেছিল। তবে আগেরকার মত এখন তার বিশ্রী অনুভূতি হয় না সম্পর্কটা নিয়ে। অপ্রিয় মানুষটাকেও আর অসহ্য লাগে না। বরং অন্যরকম এক মগ্নতা,স্নিগ্ধতা কাজ করে। ভালোলাগার ফুল ফুটে মনে। নিজের এমন পরিবর্তন স্পর্শী সনাক্ত করেছে ঠিক-ই কিন্তু গুরুত্ব দেয়নি। নামবিহীন অনুভূতিগুলো অতি মিষ্ট হয় বলে হয়তো৷

আড্ডা ভাঙ্গে রাত ন’টা নাগাদ৷ গৃহকর্মীরা ছুটে রান্নাঘরে দিকে, রাতের আয়োজন এখনো বাকি৷ ছোট, বড় সকলে উঠে চলে যায় নিজ নিজ রুমে। কয়েকজন দিয়ে বসে টিভির সামনে, বাকি অবসর কাটাতে। স্পর্শীও চলে যায় নিজের রুমে। রুমে এসে সর্বপ্রথম তার চোখ যায় বিছানার দিকে, কোলে একটা ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছে নির্বাণ। দৃষ্টি স্থির ল্যাপটপের স্ক্রিনে, কিছুক্ষণ পর পর নিঃশব্দে ঠোঁট নাড়িয়ে কি যেন বিরবির করছে। স্পর্শী একপলক সেদিক তাকিয়ে রুমে প্রবেশ করে। ক্ষণেই নির্বাণ বলে উঠে,

“ফ্রেশ না-হয়ে বিছানায় আসবা না। একবারে ড্রেস চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে দ্যান আসবে৷”

স্পর্শী সচকিত দৃষ্টিতে নির্বাণের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কেনো?”

” দিঘিপাড় থেকে এসে ফ্রেশ হয়েছিলে? হওনি, এসে সোজা আড্ডায় বসে গেলে। দেখো এখনো জামায় নোংরা কাঁদামাটি লেগে আছে।”

স্পর্শী দ্রুত পিছনে ঘাড় ঘুরিয়ে জামা টেনে দেখার চেষ্টা করলো এখনো মাটি লেগে আছে কি-না। জামার এক কর্ণারে সামান্য মাটি লেগে আছে, যা চোখে পড়ার মত নয়। স্পর্শী নির্বাণের দিকে তাকিয়ে বলল, “আচ্ছা, চেঞ্জ করে নিচ্ছি।”

নির্বাণের ল্যাপটপের স্ক্রিনে মনোযোগ দিয়ে বলে, “একবারে শাওয়ার নিয়ে আসবে।”

স্পর্শী চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলে, “আবার শাওয়ার কেন?”

“মাটিতে বসেছিলে, শরীরে কত জীবাণু নিয়ে ঘুরছ সে হিসাব আছে? ”

স্পর্শী সরু কন্ঠে বলে, “তাই বলে এই রাত-বিরেতে শাওয়ার নিতে হবে? বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না?”

নির্বাণ প্রখর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, “মোটেও না! আমার সাথে থাকতে হলে হাইজেন মেইনটেইন করতে হবে। এমন নোংরা থাকা যাবে না।”

স্পর্শী রোষাগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, “তাহলে আমি থাকবো না আপনার সাথে।”

“আমি ছাড়া তোমার কোন গতি নেই। থাকতে তোমাকে আমার সাথেই হবে। তাই কথা না বাড়িয়ে যা বলেছি তা কর, যাও।”

নির্বাণের প্রথম দিকের কথাগুলো শুনে স্পর্শী থমকালো। গোলগাল চোখে দেখতে থাকলো শ্যাম মানবটিকে। পরবর্তীতে আগের কথা রেশ ধরে মুখ ফুলালো সে, বিতৃষ্ণা মুখ ঘুরিয়ে নিল। দৃঢ় কন্ঠে কিছু বলতে চাইলো কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলো, এমন একরোখা মানুষকে আদৌ কিছু বলে লাভ আছে? অবশেষে না পেরে স্পর্শী ফুঁসতে ফুঁসতে চলে গেল ফ্রেশ হতে৷

__________________

তোয়ালে দিয়ে ভালোমতো চুল মুছে স্পর্শী বিছানায় এসে বসলো। আড়চোখে একবার তাকালো নির্বাণের দিকে। নির্বাণ তখনও ল্যাপটপ নিয়েই ব্যস্ত। স্পর্শী আনমনে নির্বাণকে কিছু কটুক্তি শুনিয়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল৷ অতঃপর মোবাইল হাতে নিতেই রিংটোন বেজে উঠলো তার। সালেহা কল করেছেন। স্পর্শী কল রিসিভ করে কিয়ৎক্ষণ তার সাথে কথা বললো। তাদের কথার মাঝেই স্পৃহা এসে সালেহা থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে কথা বলা শুরু করলো,

“আপু, তুমি কবে আসবে?”

স্পর্শী কিঞ্চিৎ হেসে বলে, “এইতো দুই-তিনের মধ্যে এসে পড়ব, কেন কি হয়েছে? পার্শিয়া জ্বালাচ্ছে?”

“জ্বালাচ্ছে মানে? পুরো ঘর উঠিয়ে রেখেছে৷ ঘন্টাখানেক পর পর তোমার রুমে গিয়ে দেখে আসে তুমি আছো কি-না। তোমায় না পেলে তোমার ছবির সামনে গিয়ে যে চিল্লানি দেয়৷ আল্লাহ!”

“এ আর নতুন কি? তা কিছু খাওয়াতে পেরেছিস?”

স্পৃহা অবসন্ন কন্ঠে বলে, “প্রথমদিন একবারেই খাওয়াতে পারিনি। পরেরদিন নিজ থেকে এসেই খেয়েছে। আপু শুনো, শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় এই আপদটারে নিয়ে যাবে। একে আমি পালতে পারবো না।”

স্পর্শী এইবার আড়চোখে নির্বাণের দিকে তাকায়। মনে পড়ে যায় তার বিয়ের দ্বিতীয় দিনের কথা। কিভাবে নির্বাণ পার্শিয়াকে রুম থেকে বের করে দিতে বলেছিল। যতটুকু সে বুঝেছে ইহকালে নির্বাণ পার্শিয়াকে নিজের বাসায় ঢুকতে দিবে না৷ স্পর্শী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলে, “দেখা যাক।”

স্পৃহা আরও কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন কেটে দেয়৷ কিয়ৎক্ষণ পরেই আঁধার আকাশ গর্জন করে উঠলো, বাতাসের বেগ বাড়লো হু হু করে। বৈশাখী ঝড়ের আর্বিভাব ঘটলো ধরণীর বুকে। স্পর্শী একপলক জানালার বাহিরে তাকালো। কাঁচা মাটির সুবাস নিঃশ্বাসে মিশে যেতেই মন প্রফুল্লচিত্ত হলো। স্পর্শী স্থিরচিত্তে এগিয়ে গেল জানালার দিকে, লোহার গরাদের মধ্য দিয়ে হাত বের করে বৃষ্টি ছোঁয়ার চেষ্টা করলো। দখিনা বাতাস চলতে শুরু করলে শীতল কণাগুলো খুব আদুরে ভঙ্গিতে এসে পরশ বুলায় স্পর্শীর চোখে মুখে। জানালার ধারে লাগোয়া কাঠগোলাপের গাছটি কেঁপে উঠে, নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকায় শ্যামময়ী নারীর সিক্ত হাতের পানে। নারীর বাহুর প্রেমে পড়েই কয়েকটি শুভ্রে মোড়ানো ফুল লুটিয়ে পড়ে তার বাহুতে। স্পর্শী চমকায়, বেশ চমকায়। কিন্তু পরমুহূর্তেই প্রফুল্লচিত্তে হেসে উঠে।অকস্মাৎ পিছন থেকে কেউ স্পর্শীর বাহু টেনে ভিতরে নিয়ে আসে। বেসামাল হয়ে উঠায় হাত থেকে ছুটে নিম্নে অতুল আঁধারে হারিয়ে যায় ফুলগুলো৷ স্পর্শী ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে তাকায় পাশে। নির্বাণ জানালা আঁটকে স্পর্শীর দিকে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

“এই অবেলার বৃষ্টিতে ভিজছো কেন? ঠান্ডা লেগে যাবে তোমার।”

স্পর্শী কপট রাগ দেখিয়ে বলে, “বৃষ্টির জন্য কি-না জানি তবে আপনার খুঁতখুঁত স্বভাবের জন্য আমার ঠিকই ঠান্ডা লেগে যাবে। তাই খামাখা বৃষ্টিকে দোষা করবেন না।”

মুহূর্তেই নির্বাণ দুইজনের মাঝে দুরত্ব ঘুচিয়ে দিয়ে স্পর্শীর ওড়নার একাংশ নিয়ে খুব সপ্তপর্ণে স্পর্শীর মুখে পড়ে থাকা বৃষ্টি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কথাগুলো মুছে দিল।
অতঃপর স্পর্শী থেকে সরে এসে বলল, “সেটা আমার জন্য না তোমার ঠিক মত চুল না মুছার জন্য লাগবে। একদিনও ঠিক মত চুল মুছো না তুমি৷ এখনো তোমার চুল ভেজা। দেখো!”

স্পর্শী প্রথমে নির্বাণের কাছে আসায় ধাতস্থ হলেও তার পরবর্তীতে কথাতে একদফা নিজের আর্দ্র চুলের দিকে তাকিয়ে থমকালো। অতঃপর নিজের দোষ ঢাকতে বলে, “সেটাও তো আপনার জন্যই। না আপনি এত রাতে আমাকে শাওয়ার নিতে বলতেন, আর না আমার চুল ভেজা থাকতো।”

নির্বাণ ভ্রু কুঁচকে বলে, “নিজের দোষ আমার উপর চাপাতে চাচ্ছ?”

স্পর্শী থমথম খেয়ে বলে, “একদম না। যেটা সত্য সেটাই বলছি।”

ক্ষণে রাতের খাবারের জন্য আলিয়ার ডাক পড়তেই
নির্বাণ মন্থর কন্ঠে বলল, “ঝগড়া করার ইচ্ছে হলে পড়ে করিও৷ এখন চল খেতে, নানাজান দেরি করা পছন্দ করেন না।”

কথাটা বলেই নির্বাণ বেড়িয়ে যায়। স্পর্শীও দ্বিরুক্তি না করে মাথার ওড়নাটা ঠিক করে ছুটলো নির্বাণের পিছু পিছু৷ কিন্তু এই ফাঁকে স্পর্শী বুঝলোই না নির্বাণের প্রতি থাকা সংশয়, জড়তা, অস্বস্তি সে আজ কাটিয়ে উঠেছে৷ ধীরে ধীরে সেও অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে নির্বাণের সহিতে।

#চলবে

শারীরিক অসুস্থতার কারণে গল্প দিতে দেরি হয়ে গেল। দুঃখিত! চেয়েছিলাম আজ বড় পর্ব দিয়ে পুষিয়ে দিতে কিন্তু সকাল থেকেই তীব্র মাথাব্যথা থাকায় সেটা সম্ভব হলো না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here