চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব-২৬

0
1932

#চৈতালি_পূর্ণিমা
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-২৬

“তোমার এখন মেডিসিন আছে। সুপ যে-টা খেতে দিয়ে গিয়েছিলাম খেয়েছিলে?”

গুরুগম্ভীর এক পুরুষালি কন্ঠ শুনে নিধি আর কেয়া দ্রুত পিছন ঘুরে তাকায়। মুহূর্তে নির্বাণকে দেখামাত্র ভূত দেখার মত চমকে উঠে দুইজনেই। নিজের বিস্ময় ভাব ধরে রাখতে না পেরে আচমকাই নিধি বলে, “স্যার আপনি এইখানে কি করছেন?”

নির্বাণ দৃষ্টি তুলে তাকায়। সামনে নিধি আর কেয়ার বিমূঢ় মুখশ্রী দেখে ভ্রু সংকুচিত হয়ে এলো তার। গভীর দৃষ্টিতে তাকালো নিধির পানে। ক্ষণেই নিধি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো, আমতা আমতা সুরে বলল, “না মানে, আপনি হসপিটালে যে? কাউকে কি দেখতে এসেছেন?”

নির্বাণ একপলক তাকালো স্পর্শীর দিকে। স্পর্শী এতক্ষণ নির্বাণের দিকেই তাকিয়ে ছিল, নির্বাণ তাকানো মাত্রই সে দ্রুত দৃষ্টি ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকায়৷ স্পর্শী জানে, নির্বাণ নিধি ও কেয়ার সামনে তাকে নিজের স্ত্রী হিসাবে পরিচয় দিবে না। বিয়ের প্রথম রাতেই বলে নির্বাণ দিয়েছিল, সে তার প্রফেশনাল আর পার্সোনাল লাইফ আলাদা আলাদা রাখতে চায়। এখন সে যদি তাকে স্ত্রী হিসাবে পরিচয় দেয় তাহলে হয়তো বিষয়টা কিছুটা হলেও ঘেটে যাবে। স্পর্শী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে, আনমনে তাকায় নিজের পায়ের বৃদ্ধা আঙুলটির দিকে।
নির্বাণের দৃষ্টি সরালো, নিধির প্রশ্নের প্রেক্ষিতে উত্তর দিল, “হ্যাঁ! তোমরা এইখানে কেন?”

নিধি বলে, “স্পর্শী অসুস্থ, ওকেই দেখতে এসেছিলাম। আপনি চিনেন, আমাদের ডিপার্টমেন্টেই পড়ে, ইফাত আরা স্পর্শী।”

কথাটা বলে নিধি হাত দিয়ে স্পর্শীর দিকে ইশারা করে। তা দেখে স্পর্শী হকচকিয়ে উঠে, গোলগোল দৃষ্টিতে তাকায় নিধির দিকে। নির্বাণ মৌনব্রত থেকে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকায় স্পর্শীর পানে৷
কেয়া মনে কিঞ্চিৎ সাহস জুগিয়ে জিজ্ঞেস করে, “স্যার আপনি কাকে দেখতে এসেছেন এইখানে? কে এডমিট?”

নির্বাণ স্পর্শীর দিকে তাকিয়েই উত্তর দিল, “আমার বউ!”

নিধি সে সময় স্পর্শীর কথায় বিশ্বাস করে নি যে নির্বাণ বিবাহিত, সে ভেবেছিল স্পর্শী এইভাবেই ফাজলামো করছে৷ যার দরুন নির্বাণের মুখ থেকে নিজের বউয়ের কথা শুনে অবাক না হয়ে পারলো না। অকস্মাৎ সে মুখ ফসকে বলে উঠে, “তার মানে আপনি সত্যি বিবাহিত?”

নির্বাণ স্পর্শীর দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিধির দিকে স্থাপন করে। ভ্রু দু’টি পুনরায় সংকুচিত করে রুক্ষ কন্ঠে বলে, “মিথ্যে বিবাহিত আবার কিভাবে হয়?”

নিধি এইবার থতমত খেয়ে যায়। কিছু বলার পূর্বেই কেয়া পাশ থেকে নিধির পেটে হালকা গুঁতো দিয়ে চাপা কন্ঠে বলল, “কার সামনে কি বলছিস তুই? একটু বুঝে শুনে তো কথা বলবি।”

নিধি অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় কেয়ার দিকে। কেয়া পরিস্থিতি সামাল দিতে বলে, “ওর কথা ধরবেন না স্যার। কখন কি বলে তার ঠিক-ঠিকানা নেই। বাদ দিন! তা ম্যাম এর কি হয়েছে? এখন কেমন আছেন তিনি?”

‘ম্যাম’ সম্মোধন শুনে স্পর্শীর বিষম খাওয়া উপক্রম।
নিবার্ণ গম্ভীরমুখে বলে, “অপারেশন হয়েছিল কাল, ভালো আছে এখন।”

কেয়া বলে, “আলহামদুলিল্লাহ! তবে স্যার, আপনি বোধহয় ভুল কেবিনে চলে এসেছেন। এইটা স্পর্শীর কেবিন, ম্যাম হয়তো অন্য কেবিনে আছেন।”

নির্বাণ চোখ ঘুড়িয়ে তাকালো স্পর্শীর দিকে। স্পর্শী ঠোঁট চিপে হাসছে৷ নির্বাণ শাণিত দৃষ্টিতে তাকাতেই স্পর্শী ঠোঁট দু’টো আরও চেপে ধরে, হাসি থামানোর অসাধ্য চেষ্টা। সেই সাথে অপেক্ষা, নির্বাণের উত্তর শোনার। কি বানোয়াট কাহিনী শুনাবে নির্বাণ এখন কে জানে?
নির্বাণ একবার কেয়ার দিকে তাকায়। শান্ত কন্ঠে বলে, “নাহ! আমি ভুল কেবিনে আসিনি। তোমাদের ম্যাম এই কেবিনেই আছে।”

নিধি আশ্চর্যান্বিত কন্ঠে বলে উঠে, “মানে? এই কেবিনে কোথায়?”

“এই কেবিনের রোগীই আমার বউ। সাথে তোমাদের ম্যাম।”

কথাটা শোনামাত্র কেয়া আর নিধি গোলগোল চোখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে। বিষয়টা হজম করতে তাদের বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। এইদিকে, ঘটনাক্রমে স্পর্শী নিজেও স্তম্ভিত। সে ভাবেনি নির্বাণ তাকে এইভাবে পরিচয় করিয়ে দিবে। সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে নির্বাণের মুখ পানে। নিধির একবার স্পর্শীর দিকে তাকাচ্ছে, আরেকবার নির্বাণের দিকে। অকস্মাৎ নিধি স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে বলে উঠে, “ঘটনা কি সত্য?”

স্পর্শী থতমত খেয়ে বলে, “কিসের ঘটনা, কিসের সত্য?”

“তুমি কি সত্যি স্যারের বউ?”

স্পর্শী এইবার নির্বাণের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “বলেন, আমি কি আপনার বউ?”

কথাটা বলে স্পর্শী দ্রুত গতিতে বাম হাত নাড়াতে নিলে খুব জোরে ক্যানোলাতে টান পড়ে, সাথে সাথে সে ব্যথায় চাপা আর্তনাদ করে উঠে। আর্তনাদ শোনামাত্র নির্বাণ দ্রুত স্পর্শীর দিকে এগিয়ে আসে, হাতের ব্যাগগুলো বেডের পাশে মেঝেতে রেখে স্পর্শী ডান হাতটা সন্তপর্ণে নিজের হাতে নিয়ে শাণিত কন্ঠে বলে, “সাবধানে হাত নাড়াচাড়া করতে পারো না? এত কিসের তাড়া তোমার? পেলে তো ব্যথা এখন। সকালেও একই কান্ড করেছ।”

স্পর্শী মুখ ছোট করে বলে, “ঠিক আছি আমি।”

নির্বাণ প্রত্যুত্তর করলো না। খুব সতর্কতার সাথে স্পর্শীর হাত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকলো। সকালে টান খেয়ে রক্ত বেরিয়ে পড়েছিল স্পর্শী, এখন আবার এমন হলে রগ ফুলে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। এইদিকে নিধি আর কেয়া দৃশ্যটা কোন রকম হজম করে যাচ্ছে, নিজের চোখকে যেন বিশ্বাসই করতে পাচ্ছে না তারা। সবকিছুই তাদের নিকট কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ কেয়া চাপা কন্ঠে নিধিকে বলে উঠে, “তার মানে, স্পর্শী বিয়ে তখন নির্বাণ স্যারের সাথেই হয়েছিল? এই জন্যই স্পর্শী বলেছিল, আমরা তার বরকে চিনি।”

নিধি বলে, ” কিন্তু কেমনে কি? স্পর্শী কিভাবে নির্বাণ স্যারের বউ হয়? যেখানে স্পর্শী স্যারকে দুই চোক্ষে দেখতে পারে না, সেখানে তারা বিয়ে করে সংসার করতাছে? কেমনে সম্ভব ভাই?”

“সেটা বাদ দে, আগে ভাব স্যারের সাথে আমাদের সম্পর্কটা কি? আমরা তার স্টুডেন্ট নাকি শালিকা? আর তাকে এখন কি ডাকবো আমরা? দুলাভাই নাকি ভাইয়া নাকি স্যার? স্যারকে স্যার ডাকলে স্পর্শীকে আবার ম্যাম ডাকতে হবে। আবার স্পর্শীকে ওর নাম ধরে ডাকলে স্যারকে দুলাভাই বা ভাইয়া ডাকতে হবে৷ কিন্তু কথা হচ্ছে, স্যারকে ভাইয়া কিভাবে ডাকি? আবার স্পর্শীকে ম্যাম কিভাবে ডাকি?”

“বইন তুই থাম। মাথা ঘুরাইতাসে আমার, জ্ঞান হারাবো আমি। ধর আমায়!”

কেয়া নিধির কথার তোয়াক্কা না করে নির্বাণ ও স্পর্শীর দিকে তাকায়। নির্বাণ স্পর্শীর হাত ভালো মত দেখে সরে আসে। মন্থর কন্ঠে বলে, “আমি নার্সকে ডেকে নিয়ে আসছি, সে একবার চেক করলে বুঝা যাবে সব ঠিক আছে কি-না। তুমি বেশি হাত নাড়াচাড়া করবে না।”

স্পর্শী আপত্তিকর কন্ঠে বলে,”নার্সকে ডাকতে হবে না, আমি ঠিক আছি।”

“ঠিক আছো বলেই তো আজ এই অবস্থা। তাই না?”

নিবার্ণের খোঁচা শুনে স্পর্শী ঘুচে বসে রইল। প্রত্যুত্তর করলো না। নির্বাণ স্পর্শীর দিকে একপলক তাকিয়ে অতঃপর কেয়া এবং নিধির দিকে তাকালো, “তোমরা থাকো, আমি আসছি একটু পরে।”

কথাটা বলে নির্বাণ লম্বা লম্বা পা ফেলে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল। নির্বাণ বেরিয়ে যেতেই নিধি আর কেয়া হুমড়ি খেয়ে পড়ে স্পর্শীর উপর। নিধি অস্ফুট কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “সত্যি কি নির্বাণ স্যার তোর জামাই?”

স্পর্শী নির্বিকার কন্ঠে বলল, “হ্যাঁ, আমারই জামাই।”

কেয়া বলে, “এত বড় কথা আমাদের একবার জানাইলিও না তুই? এমন মীরজাফরগিরি করলি?”

নিধি হতাশাজনক স্বরে বলে, “বইন আমাকে একটু বুঝাবি তুই হিটলারে বউ কিভাবে হলি? হাও?”

স্পর্শী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। ধীরে সুস্থে একদম শুরু থেকে সবই বলে গেল তাদের। সবটা শুনে কেয়া বলে উঠে, “তোর কাহিনীর সামনে বাংলা সিনেমাও ফেইল। এমন কাকতালীয় ঘটনা আদৌ জীবনে ঘটে?”

স্পর্শী নির্বিকার কন্ঠে বলে, “কে জানে?”

নিধি বলে, “আচ্ছা শুন না, আমার না একটা প্রশ্ন আছে।”

স্পর্শী ভ্রু কুঞ্চিত করে বলে, “কি?”

“স্যার আর তোর বাচ্চা আমাকে কি ডাকবে?”

কেয়ে হাসতে হাসতে বলে, “গুড কুয়েশ্চন!”

স্পর্শী রাগান্বিত নয়নে নিধির দিকে তাকিয়ে বলে, “আগে বাচ্চা হোক তারপর ভাবিস তোকে সে কি ডাকবে। বাচ্চার হওয়ার খবর নাই সে আসছে তাকে আমার বাচ্চা কি বলে ডাকবে জানতে।”

নিধি কিছু বলতে যাবে তার আগে নির্বাণ একজন নার্স নিয়ে ফিরে আসে৷ যার দরুন, নিধি ভদ্র বাচ্চার মত চুপ হয়ে যায়।

#চলবে
পর্বটা তুলনামূলক ছোট হয়েছে জানি। কিন্তু এখন আর লেখা সম্ভব নয়, ঘুমে সব সংলাপ উল্টাপাল্টা লেখছি। গুছাতে পারছি না। তাই এখন এতটুকুই দিলাম।
তবে, এই পর্বের একটা ‘বর্ধিতাংশ পর্ব’ কাল বা পরশু দেওয়ার চেষ্টা করবো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here