চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব-২৬বর্ধিতাংশ]

0
1947

#চৈতালি_পূর্ণিমা
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-২৬ [বর্ধিতাংশ]

“আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না তুই নির্বাণ স্যারের বউ।”

দীর্ঘ আলাপের শেষ পর্যায়ে এসে আকস্মিক নিধি কথাটা বলে উঠলো। নিধির কথা শুনে কেয়াও সেই কথায় সাঁই জানিয়ে বলে, “সেম আমারও। সব স্বপ্ন লাগছে।”

নিধি ও কেয়ার কথা শুনে স্পর্শী চোখ তুলে তাকায়, “তো এতে আমি কি করব?”

নিধি জিহ্বার ডগা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে, “এমন কিছু করে দেখা যাতে আমরা বিশ্বাস করতে বাধ্য হই তুই স্যারের বউ। মানে তোকে আর স্যারকে পাশাপাশি দেখে যেন স্বামী-স্ত্রী ভাইবটা আসে।”

স্পর্শী ক্রুদ্ধ নয়নে নিধির দিকে তাকায়। দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “চুমু খাই তাকে সবার সামনে? তখন নিশ্চয়ই পিউর স্বামী-স্ত্রী ভাইবটা পাবি। কি বল! ডাকব নাকি তোদের নির্বাণ স্যারকে?”

মুহূর্তেই নিধি মুখ বিকৃতি করে বলে, “আস্তাগফিরুল্লাহ দোস্ত! কিসব নাউজুবিল্লাহ মার্কা কথা বলোস তুই? বেডরুমের কার্যকলাপ পাবলিকে ফাঁস করতে চাস। ছিহ! তোকে আমার ফ্রেন্ড বলতেও লজ্জা করছে।”

স্পর্শীর লেগ পুল করার উদ্দেশ্যে কেয়াও নিধির সঙ্গ দিয়ে বলল, “আজ তুই বিবাহিত বলে আমাদের মত সিঙ্গেলদের এইভাবে হেনেস্তা করছিস? ভুলে যাস না একদা তুইও সিঙ্গেলই ছিলি।”

নিধি সুক্ষ্ম কন্ঠে বলে, “বিয়ে হতে না হতেই তোর মধ্যে বিবাহিত মহিলাদের ভাবসাব এসে পড়েছে ভাই। তোর সাথে এখন আর মিশা যাবে না, নাহলে দেখা যাবে তোর সঙ্গ দোষে আমরা নষ্ট হয়ে গিয়েছি।”

কেয়া নিধির কথায় তাল মিলিয়ে বলেই, “একদম খাঁটি কথা বলেছিস। স্পর্শীর সাথে আসলেই মিশা যাবে না এখন।”

স্পর্শী রোষানল দৃষ্টিতে তাকায়। তীক্ষ্ণ স্বরে বলে, “মিশবি না, তাই না? যা এখনই বের হো এইখান থেকে। যাহ!”

নিধি বিদ্রুপের সুরে বলে, “না গেলে কি করবি? আমাদের বায়োলজির মূল বিষয়বস্তু প্রেকটিক্যালি দেখাবি?”

কথাটা বলে শেষ করতে না করতে নিধি আর কেয়া উচ্চস্বরে হেসে উঠে। ওদের হাসি দেখে স্পর্শীর নিজের কপাল নিজেরই চাপড়াতে ইচ্ছে করলো।এমন হারামি বন্ধুদের সামনে টু আওয়াজ করাই যেখানে দায় সমান সেখানে সে তো তাদের এলাহি কান্ড করার সুযোগ দিয়ে দিয়েছে৷ এরা কি এখন আর মৌন থাকবে? স্পর্শী নিজের রাগ সংযত করে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “নিধির বাচ্চা তোকে তো আমি…”

স্পর্শী নিজের শেষ করার পূর্বেই দরজার দিকে তার নজর গেল। সেখানে নির্বাণকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে আপনা-আপনি নীরব হয়ে গেল। এক মুহূর্তের জন্য মাথায় চিন্তা এলো, “নির্বাণ কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছে, সে সব শুনে ফেললো না তো?” পরমুহূর্তে ভাবলো, “নাহ! সে হয়তো মাত্রই এসেছে।” কথাটা ভেবেই ক্ষান্ত হলো সে।
স্পর্শীকে চুপ হতে দেখে কেয়া আর নিধির পিছন ঘুরে তাকালো। নির্বাণকে দেখামাত্র তারাও দ্রুত ভদ্রভাবে বসে, ঠোঁটের কোণে সরু হাসি ফুটালো। নির্বাণ একমুহূর্ত অপেক্ষা করে ধীর পায়ে সামনের দিকে এগিয়ে আসলো, নিঃশব্দে স্পর্শী কাছে এসে দাঁড়িয়ে হাতে থাকা ফ্রুটসের প্লেটটা এগিয়ে দিল, “এইগুলো খেয়ে নাও। মেডিসিন খেয়েছ অনেক সময় হয়ে গিয়েছে।”

কথাটা বলে বিচক্ষণ দৃষ্টির সহিতে স্পর্শীর মাথার উপর ঝুলতে থাকা স্যালাইনটা পর্যবেক্ষণ করে নিল। আর কতটুকু বাকি। এমন সময় চারদিকে মিষ্টি এক কলধ্বনি গুঞ্জিত হলো। আছরের আযান দিচ্ছে। মুহূর্তেই কেয়া কিছুটা আশঙ্কা নিয়ে ঘড়ি দেখলো। তারা এইখানে এসেছে প্রায় তিন ঘন্টা হতে চললো। তৎক্ষনাৎ কেয়া চাপা স্বরে বলে উঠলো, “আয় হায়! এত দেরি হয়ে গিয়েছে, খেয়ালই তো করিনি।”

কেয়ার চাপা আর্তনাদ শুনে নিধিও একবার ঘড়ির দিকে চোখ বুলালো। আসলেই দেরি হয়ে গিয়েছে দেখে সেও তাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। ইফতারের আগে বাসায় ঢুকতে হবে তাদের। এমনেই এখন বের হলেও জ্যামে পড়তে হবে নির্ঘাত। সব বিবেচনা করে নিধি ব্যস্ত কন্ঠে বলে উঠলো, “স্পর্শী, আজ যাই৷ পরে বাসায় এসে দেখা করে যাব নে একদিন।”

স্পর্শী মাথা দুলিয়ে বলল, “আচ্ছা, সাবধানে যাস।”

নিধি স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে ছোট করে “হুম” বলল, অতঃপর নির্বাণের দিকে তাকিয়ে বলল, “আজ তাহলে আসি স্যার ভাইয়া।”

অদ্ভুত এক নামে নিজের সম্মোধন শুনে নির্বাণ কপালে তিনটি সুক্ষ্ম রেখার ভাঁজ পড়লো। সে গম্ভীরমুখে জিজ্ঞেস করলো, “স্যার ভাইয়া মানে?”

নির্বাণের গাম্ভীর্যপূর্ণ কন্ঠ শুনে নিধি কিছুটা চুপসে গেল। সে কেন ভুলে গেল এইটা তাদের হিটলার স্যার। তার ফাজলামো করার দুঃসাহসিকতা দেখানো মানেই বাঘের মুখে হাত দেওয়া। নিধি আড়ষ্ট ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে বকা খাওয়ার ভয়ে মাথা নুইয়ে বলে, “না মানে, আপনি তো এখন আমাদের দুলাভাই প্লাস স্যারও। আপনাকে ঠিক কি বলে ডাকব বুঝতে না পেরে ভাবলাম, স্যার ভাইয়া ডাকি। সরি স্যার! আর এমন হবে না।”

নিধির সহজ-সরল স্বীকার নির্বাণের অভিব্যক্তি নম্র হলো, “ভার্সিটি এরিয়াতে আমি সবার জন্যই স্যার। এর বাইরে তোমরা ভাইয়া বলে সম্মোধন করতে পারো, সমস্যা নেই।”

কথাটা নিধির কর্ণকুহরে তরঙ্গিত হওয়া মাত্র সে মাথা তুলে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে নির্বাণের পানে তাকালো৷ কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টে ঢুকার পর থেকেই সে এবং সবাই সর্বদা নির্বাণকে গম্ভীর অথবা কর্কশ কন্ঠেই কথা বলতে দেখেছে, তাকে নম কন্ঠে কথা বলতে দেখেছে এমন সংখ্যক মানুষের সংখ্যা হাতে গোনা যাবে। যার দরুন, নির্বাণের কোমল কন্ঠে বলা কথাটি হজম করতে নিধির বেশ বেগ পেতে হলো। বিষয়টা এমন ঠেকলো, এ যেন বাঘের মুখে মধুচ্ছন্দা। কেয়ার অবস্থাও বিপরীতমুখী নয়। নিধি কোনরকম নিজের ডানে-বামে হ্যাঁ সূচক মাথা দুলালো।
অতঃপর কেয়া,নিধি সৌজন্যতার খাতিরে নির্বাণকে নিজের বাসায় দাওয়াত দিয়ে বেরিয়ে গেল নিজ গন্তব্যের উদ্দেশে৷

নিধি, কেয়া চলে যেতেই নির্বাণ স্পর্শীর কাছে টুল টেনে বসলো। নিজ হাতেই স্পর্শীকে ফল খায়িয়ে দিয়ে, পানি খায়িয়ে দিল। অকস্মাৎ স্পর্শী বলে উঠে, “এই গরমের মধ্যে মাস্ক পড়ে থাকতে সমস্যা হয় না আপনার?”

নির্বাণ মাস্কের আড়ালে কিঞ্চিৎ হেসে বলে, “না! অভ্যাস আছে।”

স্পর্শী নিচু স্বরে বলল, “আপনি বাসায় চলে যান, আজ থাকার প্রয়োজন নেই।”

“কেন?”

“হসপিটালে থাকতে আপনার অসুবিধা হচ্ছে, দেখেই বোঝা যাচ্ছে। বাসায় যান, বিশ্রাম নিন। গতকাল থেকে হসপিটালেই পড়ে আছেন। এমনেও আজকের রাতটাই ব্যাপার, কালকে তো বোধহয় ডিসচার্জ হয়েই যাব আমি। মা থাকবে নে আমার সাথে।”

নির্বাণ নিজের পকেট থেকে নিজের রুমালটা বের করে সপ্তপর্ণে স্পর্শীর ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা পানির বিন্দুগুলো মুছে দিল। ধীর কন্ঠে বলল, “তোমাকে বেশি বুঝতে বলেনি কেউ। আমি ঠিক আছি, বিশ্রাম নেওয়ার প্রয়োজন নেই আমার।”

স্পর্শী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো, কথা বাড়ালো না। নির্বাণ স্মিথ হেসে হঠাৎ স্পর্শীর খুব নিকটে এসে কানের কাছে মুখ স্থির করে বলে, “এমনেও, তোমার মনের নিষিদ্ধ ইচ্ছাটা পূরণ করতে হলে তো আমার থাকা লাগবেই।”

নির্বাণের ঠান্ডা,শীতল কন্ঠের ফিসফিসানিতে স্পর্শী কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠে। অস্ফুটস্বরে বলে, “মানে? কিসের ইচ্ছে? কিসের কি?”

“মানে এইটাই রোজা আছি বলে বেঁচে গিয়েছ, অন্যথায় বায়োলজির প্রেকটিক্যাল ক্লাসটা এখনই নিয়ে নিতাম।”

নির্বাণের কথার মর্মার্থ বুঝতে পেরে স্পর্শীর কান গরম হয়ে আসে, মেদুর গালে ছড়ায় এক মুঠো রক্তিমা। তার মানে অসভ্য লোকটা তখন তাদের সব কথাই শুনেছে। কি লজ্জার বিষয়! স্পর্শী এক হাত দিয়ে আলতো করে নির্বাণের বুকে ধাক্কা দিয়ে বলে, “কথার কি শ্রী! ছিহ!”

নির্বাণ স্পর্শীর নিকট থেকে সরে এসে ভ্রু কুঁচকে বলে, “তুমি বললে ঠিক আর আমি বললেই ছিহ?”

স্পর্শী অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখে বলল, “ঘুম পাচ্ছে আমার, ঘুমাবো আমি। আপনি নামাযে যান, ওয়াক্ত পেড়িয়ে যাচ্ছে।”

কথাটা বলেই স্পর্শী ধীর গতিতে বিছানায় শুয়ে পড়লো, নির্বাণ দ্বিরুক্তি করলো না। সে জানে মেয়েটা লজ্জায় সংকীর্ণ হয়ে আছে। তাকে এখন কিছু বলা মানেই রক্তজবার আবরণে গভীরভাবে আবৃত করা।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here