#চৈতালি_পূর্ণিমা
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-৬ [বর্ধিতাংশ]
“আমি মানুষটা কি আসলেই তোমার বড্ড অপ্রিয়?”
কথাটা কর্ণকুহর হতেই স্পর্শীর পিলে চমকে উঠে, ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় নির্বাণের পানে। নির্বাণের দৃষ্টি তখন রাস্তাতে নিবদ্ধ, দেহভঙ্গি বেশ অমায়িক। হঠাৎ এমন প্রশ্নের মানে খুঁজে পেল না স্পর্শী। নির্বাণ কি তাহলে দুপুরের কথাগুলো শুনে ফেলেছিল? কথাটা মস্তিষ্ক জুড়ে তরঙ্গিত হতেই স্পর্শীর হৃদস্পন্দন তার বাদ্যযন্ত্রের ন্যায় বাজতে থাকে। বিচলিত হয়ে উঠে মন। নির্বাণের প্রশ্নের কি উত্তর দিবে সে এখন? সত্য বলা দুষ্কর হলেও মিথ্যাই বা কি বলবে? দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে। নিজেকে স্বাভাবিক করতে ফাঁকা কয়েকটা ঢোক গিলে। আনমনে কথা গুছিয়ে নিয়ে মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলে,
“তেমন কিছু নয়।”
নির্বাণ সামনের দিকে তাকিয়েই বলে, “তাহলে কেমন কিছু?”
স্পর্শী এইবার প্রত্যুত্তর করার মত কিছু খুঁজে পেল না। তাই চুপ করে রইলো। যেখানে নির্বাণের সবটাই জানা, সেখানে কি মিথ্যা বলা সাজে? স্পর্শীকে নীরব থাকতে দেখে নির্বাণ বলে, “আমি সত্যিটা শুনতে চাইছি তোমার থেকে। কোন ধরনের বানোয়াট কাহিনী নয়।”
স্পর্শী জানালার বাহিরে মুখ করে মিনমিনে স্বরে বলে, “হ্যাঁ! আপনি আমার অপ্রিয়। তবে এতটাও না।”
“অপ্রিয় হওয়ার কারণ?”
“কারণ তো আর আপনার অজানা নয়। আপনার কঠোর ব্যক্তিত্বের জন্যই কম-বেশি ভার্সিটির সকলের কাছেই আপনি অপ্রিয়।”
নির্বাণের শান্ত কন্ঠে বলে, “আমি অন্যদেরটা নয় বরং তোমার কাছে অপ্রিয় হওয়ার দিকগুলো জানতে চাইছি।”
প্রশ্নটা ঠিক ধরতে না পেরে স্পর্শী ভ্রু কিঞ্চিৎ কুঞ্চিত করে জিজ্ঞেস করে, “মানে?”
“মানে শুধু কি আমার কঠোর ব্যক্তিত্বের জন্যই আমি তোমার অপ্রিয় নাকি কোন চারিত্রিক দোষ তোমার নজরে পড়েছে? কোন সমস্যা আছে আমার মধ্যে?”
নির্বাণের কথায় স্পর্শী বিমূঢ়তা,বিহ্বলতায় মুখের খেই হারিয়ে ফেলে। একপ্রকার বিষম খেয়েও খেল না সে। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো নির্বাণের পানে। এইমাত্র কি বললো নির্বাণ? চারিত্রিক দোষ? সে তো নির্বাণকে ভালো মত চিনেও না পর্যন্ত। আদৌ তার চারিত্রিক দোষ আছে কি-না সে কিভাবে জানবে? ক্ষণেই পরিবেশ বিব্রতকর হয়ে উঠলো স্পর্শীর নিকট। সে দৃষ্টি নত করে হাত কচলাতে শুরু করে। অকস্মাৎ নির্বাণ বলে উঠে,
“নীরবতা কিন্তু সম্মতির লক্ষণ।”
স্পর্শী এইবার আরও বিব্রতবোধ করে। দৃষ্টি নত রেখেই ইতস্তত সুরে বলে, “সেরকম কিছু না। আপনি স্যার হিসাবেই আমার কাছে অপ্রিয়।”
ক্ষণেই নির্বাণের ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠে সরু হাসির রেখা। মৃদুস্বরে বলে সে, “তোমার ভালো লাগায় আমি অপ্রিয় হলেও, আমার ভালো না লাগায় তুমি অপ্রিয়।”
আশেপাশে চলাচলকারী গাড়ির তীক্ষ্ণ শব্দে নির্বাণের কথাটা স্পর্শী ঠিকমত শুনতে পেল না। খেয়ালও করা হলো না নির্বাণের ঠোঁটের কোনে লেগে থাকা হাসিটুকু। স্পর্শী আনমনা হয়েই বলল, “কথাটা ঠিক শুনতে পায়নি।”
নির্বাণ একপলক স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল, কিছু বললো না। স্পর্শী তখনও প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো নির্বাণের পানে। কিছু প্রহর এইভাবেই নীরবে গড়িয়ে যাওয়ার পর নির্বাণ গাড়ি থামায়। অকস্মাৎ গাড়ি থামিয়ে দেওয়ায় স্পর্শী হকচকিয়ে যায়। অস্ফুটস্বরে বলে, “গাড়ি থামালেন কেন?”
নির্বাণ কিছু না বলে নিজের সিটবেলটা খুলে। অতঃপর খানিকটা ঝুঁকে আসে স্পর্শীর দিকে। স্পর্শী তা দেখে ভয়ে মাথা পিছনের দিকে হেলিয়ে দেয়, “কি হয়েছে?”
নির্বাণ স্পর্শীর একদম নিকটস্থে এসে তার সিটবেল খুলে দেয়। মুখটা স্পর্শীর কান বরাবর স্থির রেখেই বলে, “আমরা এসে পড়েছি।”
নির্বাণ এত কাছে আসায় স্পর্শীর প্রায় রুদ্ধশ্বাস অবস্থা। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এসেছে, কথা পর্যন্ত বলতে পারছে না সে। কোনমতে শুধু বলে, “হু?”
নির্বাণ স্পর্শীর কাছ থেকেই সরে এসে হালকা হেসে বলে, “তোমার বাসায় এসে পড়েছি আমরা। নামো!”
স্পর্শী এইবার সম্বিৎ ফিরে পায়, সতর্ক দৃষ্টিতে তাকায় চারপাশে। ওদের কোলানীর সামনেই গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। স্পর্শী এইবার কিছুটা স্বাভাবিক হয়, ঘুরে তাকায় নির্বাণের দিকে। নির্বাণের ঠোঁটের কোনে তখন এক টুকরো হাসি বিদ্যমান। স্পর্শী বেশ কিছু সময় একমনে, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো সেদিকে। নির্বাণের সাথে পরিচয় হওয়ার পর এই প্রথম সে তাকে হাসতে দেখেছে। এ যেন কোন বিরল বস্তুর সন্ধান পাওয়া। ভার্সিটিতে নির্বাণ সর্বদাই গাম্ভীর্য পূর্ণ, তাকে কখনো হেসে-খেলে কথা বলতে দেখা যায় না। বাকি আট-দশটা স্টুডেন্টের মতই স্পর্শীও ধরেই নিয়েছিল নির্বাণ হাসতে জানে না। তবে আজ তা যেন ভুল-প্রমাণিত হলো।
স্পর্শী এইভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে নির্বাণ আবার তার দিকে কিছুটা ঝুঁকলো, “আমাকে দেখার আজীবন সময় পাবে। এখন বাসায় যাও, রাত বাড়ছে।”
কথাটা বলে নির্বাণ সরে আসে। ক্ষণেই স্পর্শীর ভরাট গাল দু’টিতে ছেঁয়ে গেল প্রগাঢ় রক্তিমা। সে দৃষ্টি নত রেখেই মিনমিনে স্বরে বলল, “আসি!”
কথাটা বলেই স্পর্শী হাতের মুঠোয় ব্যাগ চেপে তৎক্ষনাৎ গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। দ্রুত পায়ে হাঁটা দিল সামনের দিকে, ভুলে করেও তাকালো না পিছনের দিকে। ভাব এমন, পিছনে তাকালেই যেন তার সর্বনাশ।
_________________
পুব আকাশে ছেঁয়ে আছে হরিদ্রাভ আলোর ছটা। কুঞ্জ কুঞ্জ মেঘের অন্তরালে খেলা করছে ছোট শালিকের দল। রক্তিমায় আবৃত পলাশ গাছের শেষ প্রান্তে সূর্যের প্রথম আলো পড়তে না পড়তেই আড়ম্বরপূর্ণ হয়ে উঠে পরিবেশ। মন্থর শব্দে বেজে উঠলো শোকগাথা। বেলা হওয়ার সাথে সাথে জাবির প্রাঙ্গণ হয়ে উঠলো কোলাহলে পরিপূর্ণ। সেই সাথে, স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানের সূচনা হলো তখনই। হরেক রঙের শাড়ি ও পাঞ্জাবী পরিহিত নর-নারীর সমারোহ চারদিকে। সকলেই ব্যস্ত কোন না কোন কাজে।
নির্বাণ ভলেন্টিয়ারদের আরেক দফা আদেশ-নির্দেশনা দিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল ব্যাক স্টেজের দিকে। সব ঠিক-ঠাক আছে কি-না পরোক্ষ করতে। নিজ গন্তব্যে এসে নির্বাণ থমকালো, অনিচ্ছাকৃতভাবেই দৃষ্টি গিয়ে আটকালো কাঙ্ক্ষিত নারীর উন্মুক্ত পিঠের দিকে৷ সবসময় সংযত রাখা দৃষ্টি আজ প্রথমবারের মত রূপান্তরিত হলো বেহায়াপনায়। নারীটি উল্টোমুখ করে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে বিভিন্ন আকার ভঙ্গিমা করতে করতে কাউকে কি যেন বুঝাচ্ছে৷ সে কথাতে এতই মশগুল যে, কেউ তাকে খুব গভীরভাবে তা বুঝতেই পারলো না। নারীটির কথা শেষ হতেই সে ঘুরে দাঁড়ালো, নির্বাণ নিষ্পলক দৃষ্টিতে দেখতে থাকলো নারীটাকে। গায়ে আটপৌরে শাড়ি জড়িয়ে, কৃত্রিম রঙে সাজিয়েছে নিজেকে। হাতে এক মুঠ রেশমি চুড়ির ঝংকার তুলে, কাঁধের একপাশে খোঁপা ফেলে কৃত্রিম ফুল গেঁথেছে তা-তে৷ এই অকৃত্রিমতায় যেন আজ নির্বাণ খুঁজে পেল অপার্থিব এক সৌন্দর্যের সন্ধান। মনের মাঝে উঠলো উথালপাথাল ঢেউয়ের জোয়ার। আগেও সে এই বেশে অনেক নারীকেই দেখেছে, কিন্তু কখনও কোন নারীর প্রতি এমন আকর্ষণবোধ করেনি। তবে আজ কেন আকর্ষিত হচ্ছে সে? নারীটির উপর তার অধিকার বলে?
নির্বাণ একধ্যানে তাকিয়ে থাকে স্পর্শীর দিকে। গভীরভাবে পরোক্ষ করতে থাকলো তাকে। হঠাৎ স্পর্শীর কাজলরেখা দৃষ্টিতে নির্বাণের দৃষ্টি মিলিত হতেই, সে দেখতে পেল তার সর্বনাশিনীকে। ক্ষণেই সর্বাঙ্গে খেল গেল তীব্র শিহরণ। মনে পড়ে গেল, চৈত্র মাস নিয়ে লেখা রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত কাব্যিক বাণীটির কথা৷ নির্বাণ দৃষ্টি নত করে বিরবির করলো, “চৈত্র মাস তো নয়, এ যেন সর্বনাশা মাস। পুরুষজাতীর শিষ্টতা বিনাশ করতেই এই মাসের আগমন।”
নির্বাণ একপলক দৃষ্টি তুলে স্পর্শীকে দেখে আনমনে বলে, “সর্বনাশা মাসে পুরুষজাতি কোন নারীর দৃষ্টির মাধুর্যে শহীদ হবে না, সেটা অসম্ভব। একবারেই অসম্ভব!”
#চলবে