###ছায়াখেলা (৩য় ও শেষ পর্ব)
###লাকি রশীদ
ছোট দুটি বেডরুম ও একটি লিভিং রুম নিয়ে মামার বাসস্থান। জায়গা খুব কম। আমার মনে হয় বড়ভাইয়া এই ভেবেই হয়তো আজকে আসেনি। নয়তো তার এখন আবার এতো কিসের কাজ? ছোট ভাইয়া ও ভাবি অবশ্য চাকরি নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকে। ওদের কোনো বাচ্চাকাচ্চা নেই বলে প্রতি উইকএন্ড ই বাইরে কাটায়। মনে মনে ভয়ে ছিলাম মানুষ বেশি হলে হয়তো আমাকে গাদাগাদি করে বসতে হবে। ফাঁকা ফাঁকা জায়গায় থাকতে থাকতে অভ্যাস নষ্ট হয়ে গেছে। ফারহান দের নিজেদের দোতলা বাসা ছিল। ওর বড়ভাই একতলায় পরিবার নিয়ে থাকতেন। আমার শশুর শাশুরি সহ আমরা মোট ৪জন দোতলায় থাকতাম। আমার রুমটা খুব বড় ছিল যার কারণে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও সমস্যা হতো না।
একবার এক পূর্ণিমার রাতে জানালা লাগাতে গিয়ে চাঁদটাকে চোখে পড়েছে। এখন আবার কে কাজ করে !!আমি কবিতা আউড়াচ্ছি আর মুগ্ধ হয়ে চাঁদমামা দেখছি। বিয়ের পর আমার পাগলামি কর্মকান্ড দেখে দেখে আমার শাশুরি কিছুক্ষন পর পর এসে দেখে যান আমি কি করি। তখন যথারীতি এসে বলছেন, কুহু শাশুরিকে বকিয়ে খারাপ না বানালে আর চলছেই না? রাতে এলোকেশী হয়ে ছাদে বসে থাকলে জ্বীন ভূত ধরে মা। চলে এসো তাড়াতাড়ি। দিনে যেও না হয়। এত্তো আদর করে কথা বলতেন না মেনে কি কোনো উপায় আছে নাকি? বলতে বলতে ই মনে হলো, ভদ্রমহিলা কে মাসখানেক হলো দেখি না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যেতে হবে। মনে মনে অপেক্ষা করে আছেন হয়তো।
মামীর বোন এতো সুন্দর শাড়ি গহনাগাটি পরে আছেন যে, মুখের গড়নে মিল না থাকলে বুঝার উপায় ই ছিল না যে এরা সত্যি ই দুই বোন।অথচ উনি নাকি মামীর বড়বোন। ভদ্রমহিলা এমনিতে বেশ হাসিখুশি স্বভাবের। আমাকে পাশে বসিয়ে অনেক গল্প করলেন কিন্তু ভুলেও স্বামী, সন্তান নিয়ে কোনো কথা জানতে চাইলেন না। মামুজির একটাই মেয়ে কণা,ও আমাকে লিভিং রুমে নিয়ে ওর খালাতো ভাই মোবাশ্বের এর সাথে আলাপ করিয়ে দিল। ভদ্রলোক সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার বল্লেন পরিবার নিয়ে অনেকদিন ধরেই অষ্ট্রেলিয়ায় থাকেন। আমার মনের এলার্ম তখন বিপ বিপ করে বাজতে শুরু করেছে। মামুজিও এসব খেলায় ঢুকে গেল !!! কিন্তু পরক্ষনেই মনে হলো, আমার যে মা ভাই……..ওরা
হয়তো বা বলে এসব করিয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো,চাই না চাই এসবের মুখোমুখি হতে হবে যখন …….
তখন ট্যাক্টফুলি সামলানোর চেষ্টা করাই ভালো।
ভদ্রলোকের কোলে কিছুক্ষণ পর পর বছর চারেক এর
একটা ছেলে এসে বসছে আবার চলেও যাচ্ছে। আমি এবার বলি, ওর মা আসেননি? সহাস্যে বললেন আজ থেকে বছর খানেক আগে ওর মা ডিভোর্স নিয়ে উনার প্রেমিকের সঙ্গে ঘর বেঁধেছেন। এতো কঠিন কথা কেউ কখনো এতো হাসিমুখে কিভাবে বলতে পারেন সেটাই ভাবছি। আমি আমার কথা বলা শুরু করতেই বললেন,
আমি জানি। আপনি হয়তো জানেন না এরা কিন্তু কিছু একটা তালগোল পাকাতেই আপনাকে ডেকে এনেছে। এবার মৃদু হেসে বলি হুঁ বুঝতে পারছি এবার। ভদ্রলোক একটুখানি কেঁশে বললেন আমি আমার সম্পর্কে কিছু বলি আপনাকে। আমি আসলে মানুষটা শান্তশিষ্ট তবে মাঝে মাঝে অবশ্য রাগ উঠে বলতে পারেন। তবে সবাইকে যার যার প্রাপ্য সম্মান দিতে আমি কখনো পিছপা হইনি ইনশাআল্লাহ হবোও না। আমার মেদহীন শরীর দেখে ধোঁকা খাবেন না আবার। কারণ আমি ভীষন ফুডি। রান্নাবান্না করতে আমি ভীষন ভালবাসি। আমি শুধু চাই যাকে বিয়ে করবো সে যেন আমার ছেলেকে আপন করে নেয়। অবশ্য আমাদের বাপ, ছেলে ও পরিবার কে অপরপক্ষের পছন্দ করার একটা ব্যপার আছে।
আমি এবার পুরোপুরি তৈরি, হাসিমুখে বলি শুনেন মোবাশ্বের আমি কিন্তু মানুষ খুব একটা ভালো না। ভীষণ মুডি, বদরাগী বলতে পারেন। উনি হেসে বললেন,
আমার জীবনে এই প্রথম কেউ নিজেকে নিজে খারাপ বলছে…….. এমন একজন দেখতে পেলাম। এভাবে হবে না, আমি এবার সহজ পথ ধরি, বললাম আমি আসলে এখন বিয়ে করার জন্য প্রস্তুত নই। সারাক্ষণ ভালো মন্দ, ছোট বড় সব জিনিসে যদি মৃত স্বামীকে মনে পড়ে তবে বর্তমান স্বামীকে কি সুখী রাখা যাবে বা নিজে সুখী হওয়া যাবে? প্রতিদিন সকাল থেকে রাতে ঘুমানো পর্যন্ত আমি তাকে ভীষন মিস্ করি। তাই শুধু শুধু আরেকজন লোককে ঠকানো ঠিক হবে না। এবার ভদ্রলোক হেসে বললেন, তিনি আসলেই অনেক ভাগ্যবান। পৃথিবীতে আল্লাহতায়ালা সবাইকে এই সুখ দেন না।
চট্ করে আমার মাথায় তখন আরেকটা ভাবনা এলো, বললাম আপনি তো ভালো একটা মেয়ে খুঁজছেন? আমি একটা খুব ভালো মেয়েকে চিনি। কিন্তু
আপনি যদি কনেপক্ষের আর্থিক সচ্ছলতা চান তবে আর বলছি না। উনি নড়েচড়ে বসে বললেন,ম্যাডাম আমার সবকিছু আছে। হবু শশুর বাড়ির অর্থ দিয়ে আমি কি করবো? তবে আপনাকে আগে জিজ্ঞেস করি
এটাই কি আপনার ফাইনাল ডিশিসন? আমি মাথা নেড়ে বলি হ্যা। এবার বললেন, আপনি যার কথা বলতে চাচ্ছেন তাকে কি ভালো মতন চিনেন? আমি হেসে বলি
তাকে আপনিও চেনেন। আমি কণার কথাই বলছিলাম। আপনি ওর চেয়ে ভালো মেয়ে পৃথিবীতে পাবেন না……. আমি বাজী ধরে বলতে পারি। এবার উনি বললেন কিন্তু বয়সের ফারাক বেশি হয়ে যাবে না? আমি আশ্বস্ত করি, ৮/৯ বছরের ছোট বড় অনেক সুখী দম্পতি পৃথিবীতে বিরাজমান মোবাশ্বের। এটা কোনো সমস্যা না। তাছাড়া কণার মত থাকলেই কথাবার্তা এগুবে। নইলে তো নাই।
উনি বললেন আমার মায়ের মতটাও নেয়া উচিত আমার। বললাম তা তো অবশ্যই। আপনি মায়ের সঙ্গে কথা বলে দেখুন। আমি ভেতরে মামা,মামী ও কণাকে জিজ্ঞেস করে দেখি।
ভেতরে ঢুকে এদের সবাইকে বলতেই সবাই রাজি। শুধু ভাবির মুখটা গম্ভীর। মামুজি বললেন কিন্তু তুই কি আবার ভেবে দেখবি মা? ছেলেটা কিন্তু তোর মতোই খুব ভালো ও শান্তশিষ্ট। আমি হেসে বলি সেজন্যই তো আমি কণাকে উনার সাথে বিয়ে দিতে চাই। তুমি দেখো মামুজি ও ভীষণ ভালো থাকবে আর সুখে থাকবে।
শোনা গেল মামীর বোনের এই বিয়েতে কোনো আপত্তি নেই। মোবাশ্বের সুখী সুখী মুখে দাঁড়ানো কণাকে সুন্দর একটা আংটি পরিয়ে দিলেন। আসার সময় ভাবি শুধু গাড়িতে বললেন, তোমার মতো বোকা মেয়ে আমি আর দেখিনি কুহু। প্রপোজাল টা কি ভালো ছিল। কিছুদিনের মধ্যেই মেয়েসহ কি সুন্দর অষ্ট্রেলিয়ায় চলে যেতে পারতে। মেয়েটারও ভবিষ্যত অনেক ভালো হয়ে যেত। এভাবে কেউ নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারে !!! আমি মৃদু হেসে বলি, তোমরা বুঝবে না ভাবি। আগেও যেমন কোনো দিনও বুঝতে চাওনি। মনে মনে আমি তৈরি হচ্ছি বাসায় গিয়ে ঝড়ের মুখোমুখি হবার জন্য। কিন্তু বাসায় ঢুকে রীতিমতো টর্ণেডোর সামনে পড়ে গেলাম।
মা চেচিয়ে উঠলো তোমাকে ওখানে ঘটকালি করতে পাঠিয়ে ছিলাম? এতো বেশি পন্ডিতি করো কেন? কোন দিক দিয়ে এ সম্বন্ধটা খারাপ ছিল সেটা আমায় বলো? আমি বলি আমি তো পাত্রকে দেখতে যাইনি মা। সেজন্য ই ঘটকালি করে এলাম। চিনি না জানি না কোত্থেকে কে এসে বললেই হলো? এবার মা দেখি বড়ভাইয়ার দিকে তাকিয়েছে। বড়ভাইয়া মাথা নেড়ে কি একটা ইশারা করতেই মা বললো, ঠিক আছে অচেনা কাউকে বিয়ে করতে আপত্তি থাকলে থাক্। তাহলে তুমি শুভকে বিয়ে করো,ও তো আর অচেনা কেউ নয়। সপ্তাহখানেক আগে তোমার ভাইয়ার কাছে ও প্রস্তাব দিয়ে গেছে। কি হলো, কথা এগোই তাহলে? আমি হতভম্ব ভাব কাটিয়ে উঠার আগেই ভাইয়া বলছে,ওর কাগজপত্র আমি চেক করে নিয়েছি। মাস ছয়েকের মধ্যেই ইনশাআল্লাহ সে তোমাদের নিয়ে যেতে পারবে।
দাঁড়ানো থেকে কিভাবে যে বসেছি আমি জানি না। তীক্ষ্ণ কন্ঠে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলি,ও বাবারে !!! সেই
একই মুখ, কিন্তু একেকবার একেক রকম কথা যে বের হয় তোমাদের !!! তুমি না মা ৫ বছর আগে বললে ওদের কোনো বংশ নেই আর আমরা কতো উচ্চবংশীয় !!! তুমি না ভাইয়া ঢড় দিয়ে বলেছিলে ভালো ঘর বাড়ি নেই। ওর সঙ্গে তোমার বিয়ে দিলে আমাদের মান ইজ্জত কিছুই থাকবেনা। তা হঠাৎ ও ভালো বংশ এবং তাজমহল পেলো কি করে? মা এবার চেঁচিয়ে উঠলো, পরিস্থিতি অনেক বদলে গেছে কুহু। সেটা তোমার বুঝতে হবে। আমি হেসে উঠি, আমি আগেই জানতাম তোমরা জোরে এখানে ধরে বেঁধে এনে এরকম ই করবে। তাই,মৌ এর দাদাবাড়ি থেকে আসতে চাইনি। তোমাদের মতো এই যে অবস্থা বুঝে বুঝে চলা………. এসব আমাকে দিয়ে হবে না। তাছাড়া আমি এখন বিয়ে করতে পারবো না। কখনো যদি মনে হয়, এখন করা যায়……….সেই সময় ভেবে দেখবো। এবার স্বভাব সুলভ ভাবে মা চেঁচাচ্ছে,
তোমার কখন মনে হবে সেই আশায় কি ছেলেটা বসে থাকবে না কি? আমি দৃঢ়স্বরে বলি, আমি তো কাউকে বসে থাকতে বলিনি। বসে না থাকলে চলে যাক্,আমি তার কি জানি? তবে একটা কথা জানি, আমি আর মৌ
আগামীকাল ফারহানের বাসায় চলে যাব ইনশাআল্লাহ।
ভাইয়া এবার বললো ঠিক আছে কেউ আর তোমাকে বিয়ের কথা বলবে না। এখানেই থাকো,কোথাও যেতে
হবে না। যাও ফ্ল্যাটে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে রেষ্ট নাও।
ফ্ল্যাটে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে মৌয়ের পাশে শুয়েছি,কখন চোখ লেগে গেছে জানি না। আধখেচড়া স্বপ্ন দেখে উঠেছি,
দেখি সোফায় বেণু বসে আছে। আমার দিকে তাকিয়ে ছিল, চোখ মেলতেই জড়িয়ে ধরে বললো ভুল হয়ে গেছে রে। মাফ করে দে। ঘর সংসার সব কিছু ফেলে তোর মান ভাঙ্গাতে এসেছি। হেসে বলি ঠিক আছে ঠিক আছে,আর নাটক করতে হবে না। মাফ করে দিলাম। চা
খেতে খেতে বলি,পারলে শুভকে একটা মেসেজ দিস। এভাবে হয় না, আমার মা ভাইয়ের কাছে প্রস্তাব দিলে কোনো লাভ হবে না। বিয়ে কি আমি না ওরা করবে? তারচেয়ে বরং অন্য কাউকে যেন বিয়ে করে ফেলে। ফারহান কে না ভুলতে পারলে আমার কি দোষ বল্। বেণু হাত ধরে বললো,শুভ ভাই আমার বাসায়ও এসেছিল। খুব করে আমাকে ও মিফতাহ কে বলে গেছে তোকে একটু বোঝানোর জন্য। আমি না বলে দিয়েছি। আমার মনে হয়,সবচেয়ে ভালো হবে সামনাসামনি বসে তুই উনার সাথে কথা বললে। তুই যা চাস্ একটু বুঝিয়ে বললেই ল্যাঠা চুকে যায়। আমি ভেবে দেখি ও ঠিক ই বলেছে। বললাম, ঠিক আছে বলবো। বেণু বলছে, আমি উনাকে কাল বিকেল পাঁচটায় কফি এক্সপ্রেসে থাকতে বলবো। সময় মতো তুই চলে যাস্। আসি রে এখন।
সারাটা রাত অদ্ভুত এক মনোকষ্টে কাটলো। একফোঁটা ঘুম আর আসেনি। বিকেলে সম্পুর্ন সাজসজ্জাবিহীন সাদা শাড়ি পরা এক কুহু কফি এক্সপ্রেসে গেল। হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও স্বাভাবিক যেন থাকা যাচ্ছে না। এতো সাদা দেখে শুভ কিছুটা থম মেরে গেছে। আমি এটাই খুব করে চাচ্ছিলাম,কফি খেতে খেতে বলি মানুষ তো আর রোবট না শুভ যে চাইলেই রাতারাতি কাউকে ভুলা যায়। প্রতিটি মুহূর্ত আমি ফারহান কে মিস্ করি। এই অবস্থায় কাউকে বিয়ে করলে ঠকানো ই হবে শুধু। তাই আমার অনুরোধ তুমি অন্য কাউকে বিয়ে করে ফেলো। অনেক যুগ যুগ পর শান্ত স্বর শুনতে পেলাম যেন, ঠিক আছে তোমার যেদিন মনে হবে সেদিন না হয় বলো। আমি হেসে বলি, সেদিন যে আসবে তা তো নিশ্চিত হয়ে বলতে পারছি না। মাথা নিচু করে বললো, আমার কোনো তাড়া নেই কুহু। না হলে ভাববো আমার ভাগ্যে ই
তুমি লেখা নেই। নাও এবার শান্তিতে বসে কফি খাও।
যখন উঠবো তখন বললো, আমাকে সাদার ধাক্কা দিতে চাচ্ছিলে ইটস্ ওকে। কিন্তু প্লিজ মেয়েটাকে দিও না।
দিনের পথে দিন যায়,এর এক সপ্তাহ পর শাড়ির বেশ বড় একটি লট আটকে গেছে। এসব নিয়ে কথা বলতে কাষ্টমস অফিসে গেছি। আগের অফিসার বেশ ভালো ছিলেন। এখনকার জন একটু ছোকছোক স্বভাবের। এসব আমি এখন ট্যাকল দিতে পারি কিন্তু মনের উপর একটা ঝড় বয়ে যায়। মেইন রোডে বাস থেকে নেমে পাড়ায় ঢুকেছি। শুভর বন্ধু ইমতিয়াজ এর গ্ৰোসারী শপ
পেরোনোর সময় আমাদের পাড়ার প্রবাসী রাজ্জাক সাহেব বিগলিত হেসে বললেন, কেমন আছো কুহু? তুমি কি আমার সাথে ইংল্যান্ড যেতে চাও? আমি সাহস দেখে স্তম্ভিত,বললাম জিহ্বার লাগাম টানেন। বড়ভাইয়া
জানলে ওটা লাগাম টানার অবস্থায়ও থাকবে না। এবার ইমতিয়াজ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলি উনার স্ত্রী তো নিশ্চয়ই উনার সাথে এসেছেন। আপনি একটু প্লিজ উনাকে জানাবেন, উনার স্বামী পথে ঘাটে চলার সময় কি কি কর্মকাণ্ড ঘটান। আর দাঁড়াই নি, হনহন করে চলে এসেছি। এরপর সারাটা দিন মাথায় ঘুরেছে, বিধবা মানেই কি বেওয়ারিশ না কি? মানুষ এত খারাপ কেন?
পরদিন খুব ভোরে বেণুর ফোন,শুভ নাকি রাজ্জাক সাহেব কে মারতে মারতে বামহাত ভেঙ্গে দিয়েছে। মারে
আর নাকি বলে জীবনে কোনো দিনও ওর দিকে তাকালে চোখ গেলে দিবো বললাম। তুমি ফাজলামোর আর জায়গা পাওনি। আমার এসব আর ভালো লাগে না। প্রতিদিন সকালে উঠেই মনে হয়,আজ অচিনপুরের উদ্দেশ্যে হাঁটা দেই। যেখানে কেউ আমাকে চেনে না, জানে না। সম্পুর্ন নির্বান্ধব কিন্তু নিরুপদ্রব সে জায়গায়
চুপচাপ বসে থাকবো আমি। রাতে বড়ভাইয়া আমার ফ্ল্যাটে এসে বললেন কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি? মাথা নাড়তেই বললেন,দেখো সমাজে শক্তপোক্ত অবস্থানে থেকে, দুইজন বড়ভাই থেকেও মধ্যবয়সী রাজ্জাক কি বললো !!! মানো আর নাই মানো এরকম ছোট একটি বাচ্চা নিয়ে একটা মেয়ের পথচলা অনেক কঠিন। কোনো জোরজবরদস্তি নাই, শুধু একটু ভাবতে বলছি। অনেক সময় মনের বিরুদ্ধে গিয়েও সিদ্ধান্ত নিতে হয়। একবার আমার জন্য সম্মন্ধটা হতে হতে হয়নি। আসলেই মনে প্রাণে ছেলেটা তোমাকে ভীষণ ভালবাসে, সেটা বুঝতে পেরে খুব আফসোস হচ্ছে।
কিসের শাড়ি বিক্রি, পেইজে আপলোড দিলে না বিক্রি
হবে। এই ৩/৪ দিন আকাশ পাতাল ভেবেও কোনো কূল কিনারা পাই না। পঞ্চমদিনে শুভর মা এসে হাজির।বিনয়ী এই ভদ্রমহিলাকে আমি অনেক পছন্দ করি।পান খেতে খেতে বললেন, আমি ই জোর করে ছেলেকে বিয়ে দিয়েছিলাম। ছেলের মন জুড়ে তুই,অন্য সম্পর্ক টেকা কঠিন সেটা ভুলে গিয়েছিলাম। তাই এই পরিণতি। শোন্ সবাই সেকেন্ড চান্স পায় না রে মা। শুভ বলেছে তোর কথামতো সব হবে। বিয়ের পর কোনো কথা টলবে না।
তুই দিন বললে দিন,রাত বললে রাত। মৌ কে মেয়ের পরিচয়ে বড় করবে। রাজি হয়ে যা মা। মন থেকে বলছি
আমার ছেলের চেয়ে ভালো কোনো সঙ্গী তুই এইজনমে পাবি না। খুব ভালো করে ভেবে দেখিস।
…………………………………………………অনাড়ম্বর এক অনুষ্ঠানে সামান্য কিছু নিকট আত্মীয়দের নিয়ে বিয়ে হয়ে গেল। আগের দিন থেকে আসি কিছুই খেতে পারছি না। গলা দিয়ে খাবার ঢুকে না যেন। রহস্যময়,
অদ্ভুত,অকারণ এক ভয়ে চিন্তায় শরীর মন যেন অবশ অবশ লাগছে। মৌকে বলা হয়েছে তোমার বাবা চিপস
আইসক্রিম নিয়ে এসেছে। ও শুভর কোলে উঠে বসে রয়েছে। যাবার সময় বড়ভাইয়া উনার হাত বাড়িয়ে মৌ
কে কোলে তুলে বললেন,আজ সারারাত মৌ আর আমি কার্টুন দেখব।কালকে আবার বাবার কাছে চলে যাবে।
শুভ বললো,ও আমাদের সাথে গেলে কোনো সমস্যা নেই ভাইয়া। বড়ভাইয়া হেসে বললেন, না আজকের রাত আমরা মামু ভাগ্নী একসাথে থাকবো। অনেকক্ষণ
ওকেআদর করে জীবনের আরেক মোড়ে পা ফেললাম।
পূর্ণিমার রাত, ফিনকি দিয়ে পৃথিবীতে চাঁদের আলো পড়ছে যেন। শুভ এসে বেডকাভার তুলে বলল, অনেক টায়ার্ড নিশ্চয়ই। ঘুমিয়ে পড়ো, কালকে গল্প করবো। আমি খুব বুঝতে পারি এই একটা কথা শুনেই যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ছে। কোন ভয়ে ভীত ছিলাম এখন বুঝতে পারছি। বললাম জানালা খুলে দাও না। খুলে দিলো, মুহূর্তেই বিছানায় আলোর লুটোপুটি। আমি বেশ বুঝতে পারছি, কথা রক্ষা করার জন্য জোর করছে ভেবে হাত ই হয়তো বা ধরবে না। তাই হাত বাড়িয়ে বললাম কতো উত্থান পতনে আমাদের জীবন গড়া তাই না? এতোদিন শুধু ভাবতাম সিনেমা আর নাটকেই এসব মনে হয় সম্ভব। তাকিয়ে দেখি হাতের মুঠোয় শক্ত করে আমার হাত ধরে চোখ বুজে বলছে, কুহু প্লিজ একটা কিছু বলে শোনাও না। ঠিক আগের মতো। রিকুয়েস্ট করছি।
আমি বলি:
না সখা, মনের ব্যথা করো না গোপন।
যবে অশ্রুজল হায় উচ্ছসি উঠিতে চায়
রুধিয়া রেখো না তাহা আমার ই কারণ।
চিনি, সখা চিনি তব ও দারুন হাসি__
ওর চেয়ে কত ভালো অশ্রুজল রাশি।
মাথা খাও__ অভাগীরে কোরো না বঞ্চনা,
ছদ্মবেশে আবরিয়া রেখো না যন্ত্রণা।
মমতার অশ্রুজলে নিভাইব সে অনলে,
ভালো যদি বাস তবে রাখো এ প্রার্থনা ।।
গোল থালার মতো চাঁদের চারপাশের আকাশের দিকে তাকিয়ে আল্লাহ তাআলাকে আপনমনে বলছি, কবিতা আর গান যা ই বলি না কেন আমার একমাত্র আশ্রয়স্থল
আপনি। আমাদের তিনজনকে আপনি হেফাজত করুন মাবুদ, শান্তিতে রাখুন। এই বুকে হয়তোবা আরো দুঃখ কষ্ট সইবার,পোহাবার শক্তি নেই।আমি সম্পুর্ন আপনার
উপর ভরসা রেখে নতুন পথচলা শুরু করলাম। এই পথ টুকু কাঁটামুক্ত করে দিন ও বিশাল সাম্রাজ্যধিপতী।
(সমাপ্ত)