ছায়া সঙ্গিনী পর্ব-১০

0
568

#ছায়া_সঙ্গিনী
#পর্ব-১০
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)

আমার ভিতরে ঠিক কি হচ্ছে আমি বুঝতে পারছি না। পাশে বসে থাকা ভাবীরা জিজ্ঞাসা করলেন কি হয়েছে? আমি বললাম,
– রাহাত এক্সিডেন্ট হয়েছে।

ভাবীরা আরো জিজ্ঞাসা করলেন,
– এখন কেমন আছে? কোথায় আছে?
– খুবই গুরুতরভাবে আহত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে দূর্গম এলাকায় স*ন্ত্রাস বাহিনী উদ্ধার অভিযানে, অন্যান্য সেনাদের রেসকিউ করতে, নিজের উপর রিস্ক থাকা সত্ত্বেও একচুলও পিছিয়ে আসেনি। ফলে ও সহ আরো তিন জন গুরুতর আহত হয়েছে। প্রাথমিক চিকিৎসার পর,ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট সিএম‌এইচ হসপিটালে নিয়ে আসা হয়েছে।

আমার কথা শেষ হতেই ভাবীরা দৌড়ে গেলেন মাকে খবর দিতে।আমি যেভাবে বাঁশের বেঞ্চিতে বসেছিলাম, সেভাবেই বসে আছি। আমার কোন রকম প্রতিক্রিয়া নেই।এই মুহূর্তে কি করা উচিৎ সেটা বুঝতে পারছি না।
কিছুক্ষণের মধ্যেই মা পাগলের মত কান্নাকাটি করতে করতে বাড়ি আসলেন।এর‌ই মধ্যে মামা তার বড় আর মেজ ছেলেকে খবর দিয়েছেন।বড় ভাই আর মেজ ভাইয়ের বাজারে বড় মুদির দোকান। তাই তারা বলেছেন কর্মচারী কে সব কাজ বুঝিয়ে এক্ষুনি আসছেন। এদিকে মা কান্না করতে করতে বলছেন, তিনি এক্ষুনি ঢাকা তার ছেলের কাছে যাবেন। তাকে যেন এক্ষুনি নিয়ে যাওয়া হয়।ভাবীরা আমার কাছে এসে বললেন,
– তুমি এভাবে থেক না, চুপচাপ থাকলে ক্ষতি হবে। স্বামীর জন্য কষ্ট হচ্ছে তো কাঁদো। কাঁদলে মন হালকা হবে।

কিন্তু আমার তো জীবনেও কান্না আসবে না। ইচ্ছে করে তো কান্না আসবে না। পাথর মানবের কি আবার চোখের পানি কান্না আছে নাকি। আমার অবস্থা দেখে আশেপাশের কিছু মহিলা কানাঘুষা শুরু করে দিয়েছে,কেউ কেউ বলছেন,
– এই ছেড়ির কি স্বামীর লাইগা মায়া মহাব্বত নাই নাকি। আমাগো ব‌উরা অইলে তো এহন মাডিত গ‌ইরায়া কানতো ‌।এই কেমন মাইয়া মানুষ খোদা জানে!
বড় ভাই আর মেজ ভাই বাড়ীতে আসলে মা সহ তারা তৈরি হয়ে নেয় ঢাকা যাওয়ার জন্য।তারা তৈরি হয়ে বের হবে তখন আমার টনক নড়ে যে আমিও যাবো। রাহাতকে দেখা উচিৎ এখন কেমন আছে, কতটুকু আহত হয়েছে। তাই তাদের বলে আমিও তৈরি হয়ে বের হলাম।স্ট্যাশন এসে টিকিট কেটে ডাইরেক্ট ঢাকার বাসে উঠেছি। মা বাসে বসেও খুব কান্না করছেন। অনেক শান্তনা দিয়েও কান্না থামাতে পারছিনা আমি। কান্না করতে করতে বলছেন, এখনো কেন আইয়ে না আর কতক্ষন লাগবো? আমার ছেলেডা না জানি কতো কষ্ট পাইতাছে। মাবুদ গো আমার ছেলেডারে রক্ষা করো ‌।
_______
আমাদের ঢাকায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত হয়ে গেল।সিএম‌এইচ হসপিটালের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি,যে সেনা মায়ের ফোনে কল করে জানিয়েছিল তাকে কল করেছি। আমাদের কে এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তারপর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই লোকটা এসে সালাম দিয়ে বললেন,
– আপনারা রাহাত স্যারের পরিবারের লোক?

ভাইয়ারা সম্মতি দিতেই, আমাদের ভিতরে নিয়ে যাওয়া হলো। তবে এখন কেবিনে ঢুকা নিষেধ, রোগীর জ্ঞান ফিরলে ভিতরে যেতে বলেছে ডাক্তার। তাই রাহাতের কেবিনের বাহিরে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিছুক্ষণ বসে থাকার পর এশা এর আযান হলো।আযানের জবাব দিয়ে দো’আ পড়ে, আল্লাহ তা’আলার কাছে দো’আ করলাম রাহাতের জন্য।
আযান শেষ হলে, আল্লাহ তা’আলার কাছে চাও তোমার দো’আ কবুল করা হবে।
(আবু দাউদ শরীফ, হাদীস-৪৪০)

তারপর একজন কে জিজ্ঞাসা করে, মাকে নিয়ে অযু সেরে নামাযের রুমে গেলাম। জোহর নামায থেকে শুরু করে আজকে এক ওয়াক্ত নামায ও পড়া হয়নি। আল্লাহ মাফ করুন আমিন। এখন সব গুলোর কাজা নামায আদায় করে তারপর এশার নামায পড়বো।
মা এশার নামায পড়ে চলে গেলেন তার ছেলের কাছে। আমি সব গুলো নামায পড়ে তার পর গেলাম। গিয়ে দেখি দরজা কাছে দাঁড়িয়ে গ্লাস দিয়ে তাকিয়ে আছেন মা। তখন ভাইয়েরা ব্রেড আর কলা নিয়ে এসেছেন আমাদের জন্য।মা কিছুতেই খাবেন না বলছেন।এক নাগাড়ে চোখের পানি ফেলেই চলেছেন। সবাই মিলে অনেক বুঝিয়ে এক পিস ব্রেড খাওয়াতে সক্ষম হয়েছি।ভাইয়ারা ও খেয়ে নিল। আমাকে বললো খাওয়ার জন্য, কিন্তু আমার খেতে ইচ্ছে করছে না। তবুও তাদের কথা রাখতে কিছুটা মুখে নিলাম।

রাত সাড়ে তিনটার দিকে জ্ঞান ফিরে রাহাতের, আমি নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকি ওর মাথার পেছনের দিকে। মা বললেন,
– এখন কেমন লাগছে বাবা?

তার ছোট করে উত্তর, ভালো।

কপালে আঘাত পেয়েছে,চারটা সেলাই দিতে হয়েছে।চারটা সেলাই লাগলেও ক্ষতটা গভীর ভাবে হয়েছে। এবং বাম পায়ে ও আঘাত পেয়েছে যার কারণে হাঁটুর কিছুটা নিচ থেকে পুরো পা ব্যান্ডেজ করা হয়েছে।
রাতটা এভাবেই কেটে গেল। সকালে নামায পড়ে এসে,সূরা ফাতেহা, তিন কুল, আয়াতুল কুরসি পাঠ করে ওর বুকে ফুঁ দিয়ে দিলাম। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই চোখ খুলে তাকালো রাহাত। আমাকে এখানে দেখে খুব চমকালো।কাল রাতে জ্ঞান ফিরার পর আমি ওর সামনে আসিনি,যখন ঘুমিয়ে ছিল তখন এসেছি।তাই এই মাত্র দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।ওর সাথে চোখাচোখি হতেই আমি মাথা নিচু করে বসে রইলাম।ও কিছুক্ষণ পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
– আয়রা তুমি তো, পায়ের নোখ খারাপ দেখতে পছন্দ করো না!তাই না?

ওর হঠাৎ এ কথা শুনে, নির্বুদ্ধিতার মতো তাকিয়ে রইলাম। তারপর আবার উপরের দিকে তাকিয়ে বললো,
– জানো আমার ভাগ্য খুব খারাপ! এমনিতেই আমার বউ আমাকে পছন্দ করে না। এখন তো আরো আগেই পছন্দ করবে না। কখনোই না।

ওর এরকম কথা বার্তার অর্থ কিছুই বুঝতে পারলাম না আমি। কি হয়েছে যে এখন আরো বেশি অপছন্দ করবো? কি নিয়ে এতো দুশ্চিন্তায় ভোগছে? লক্ষ্য করলাম ওর চোখের কোণে চিকন রেখায় পানি গড়িয়ে পড়ছে। তারপর আবার আমার চোখে চোখ রেখে বললো,
– আমার বাম পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলের নোখ টা থেঁতলে গেছে আয়রা! এখন থেকে তোমাকে পাওয়ার আশা ছেড়ে দিতে হবে!

শেষের কথাটা শুনে আমার ভিতর টা দুমড়ে মুচড়ে উঠলো। না চাইতেই হুরহুর করে কান্না শুরু করে দিলাম।আজ যেন আমার মাঝে নেই কোন দ্বিধা নেই কোন দ্বন্দ্ব।এই মুহূর্তে নিজের কান্না দমন করতে কোন আশ্রয় খুঁজে পাচ্ছি না আমি। খুব করে একটা ভরসার আশ্রয় চাইছি কিন্তু পাচ্ছি না আমি। নিজের দুই হাতে মুখ গুজে কান্না করছি। আমার কান্না গুলো চার দেওয়ালের মাঝেই আবদ্ধ হয়ে আছে। আমার কান্নার মাঝেই নিষ্ঠুর লোকটা আবার বলতে শুরু করলেন,
– হায়রে কি কপাল আমার?আজ তুমি না চাইতেই কান্না করছো। যেখানে আমার ও হাত নেই। হয়তো প্রকৃতির ইচ্ছে তাই কান্না করছো। তবে আমার কি হবে আয়রা? এমন মুহূর্তে তুমি কান্না করলে যখন আমি তোমার অযোগ্য!

এই নিষ্ঠুর লোকটার কথা আর সহিতে পারলাম না আমি। হাউমাউ করে নিষ্ঠুর লোকটার প্রশস্ত বুকেই ঝাঁপিয়ে পরলাম। খামচে ধরলাম তার পিছনে থাকা বালিশে। একজন নার্স এসে বললেন,
– ম্যাম এরকম করবেন না পেশেন্টের অবস্থা ভালো না।

তারপর আরো কিছু বলতে যাবে, তখন রাহাত হাত দিয়ে ইশারা করতেই চলে যায় নার্স। আমি আগের ন্যায় কেঁদেই চলেছি। রাহাত তখন বললো,
– আয়রা কেঁদো না প্লিজ। আমি কখনোই তোমার কান্না চাইনি।যার কারণে এখনো অবধি আমাদের বিচ্ছেদ রয়ে গেছে।

কিন্তু না আমি আজকে কাঁদবো খুব করে কাঁদবো। আমি কান্নার মাঝেই বললাম,
– আমি কাঁদতে চাই রাহাত, আমি কাঁদতে চাই। আমাকে বাধা দিও না প্লিজ। আমি পাথর মানব হয়ে থাকতে চাই না।আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতো বাঁচতে চাই আমি। আমাকে এভাবেই সারা জীবন তোমার আশ্রয়ে রেখে দাও। আমি এভাবে সারা জীবন কাটিয়ে দিতে চাই। এবার যদি তুমি আমাকে ফিরিয়ে দাও তাহলে আমি আর বাঁচবো না রাহাত, ধুঁকে ধুঁকে শেষ হয়ে যাবো।

দুই হাত দিয়ে ধীরে ধীরে আমার মাথাটা তুলে সোজা করে রাহাত। তারপর বললো,
– এমন কথা মুখেও আনবে না,আনলেই সু*ট করবো! আমি কে জানো তো? আমার কিন্তু রি*ভলবার আছে হু।

আমাকে হাসানোর জন্য তার এই কথা। কিন্তু আজকে তো আমি হাসবো না! এতো কষ্টের মাঝে কেউ হাসে নাকি?অন্য কেউ হাসলেও আমি হাসবো না। আবার তার সাথে মাথা ঠেকিয়ে কান্না শুরু করলাম। এদিকে নার্স খাবার নিয়ে এসে দরজায় কড়াঘাত শুরু করেছে। রাহাতের ভয়ে ভিতরে ঢুকতে সাহস পাচ্ছে না। রাহাত তখন বললো,
– আমার মনে হয় না খেয়েই জীবন পার করতে হবে। কি করবো ব‌উ যদি এভাবে কান্না শুরু করে তাহলে কি আর গলা দিয়ে খাবার নামবে? থাক না খেয়েই জীবন পার করবো আমি।

এবার রাহাত কে ছেড়ে চোখ মুছে, নার্সের থেকে খাবার নিয়ে এসে রাহাতের মুখের কাছে চামচ ধরলাম।সে না খেয়ে বললো,
– উহু খাবো না আমি।

– কেন?

– কাছে এসো।

– পারতাম না।

– স্বামীর অবাধ্য হবে?

আর কিছু না বলে, কাছে এগিয়ে গেলাম। আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে, চোখের পাতায় তার ঠোঁট ছুঁয়ে দিল।পরম আবেশে স্তব্ধ হয়ে র‌ইলাম আমি।
তারপর বললো,
– তুমি আর মা তো কিছু খাওনি এখনো। মায়ের সাথে দেখা হয়েছে তোমার?

– আমরা খেয়ে নিব আপনি আগে খেয়ে নিন, আপনাকে মেডিসিন নিতে হবে।তাই আপনার খাওয়া বেশি জরুরি।

রাহাত স্যুপ খেতে খেতে বললো,
– মায়ের সাথে দেখা হয়নি তাই না?

– আমি মাকে সঙ্গে করে নিয়ে তবেই এসেছি। এবার খাবার শেষ করো।

আমার কথা শেষ হতেই রাহাত বিষম খেয়ে, কাশতে শুরু করে,,,,,,

#চলবে,,, ইনশা আল্লাহ।

(আসসালামু আলাইকুম।
তাড়াতাড়ি লেখার কারণে অনেক ভুল হয়ে যায়, বুঝতে পারি আমি। কিন্তু রোজার মাস কতো কাজ থাকে তার উপর বেশি ফোন নিয়ে বসে থাকার জন্য আম্মু অনেক বকাঝকা করে।বড় করেও লিখতে পারি না, তবে ১০০০+ শব্দ থাকে। তারপর রি-চেইক করা হয় না। তাই ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন।আর জানাবেন কেমন লাগলো।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here