#ছায়া_সঙ্গিনী
#পর্ব-০৩
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
আনমনে কাটা স্থানে ডান হাত দিয়ে নাড়াচাড়া করছিলাম, তখন পাশে বসে থাকা ব্যক্তিটি কন্ঠস্বর ছোট করেই বললো,
– ব্যান্ডেজ টা খুলে ফেলার ফন্দি আঁটা বন্ধ করো, এটা নিশ্চই জানো ব্যান্ডেজ খুললে আমি আবার নতুন করে লাগিয়ে দেব।
বুঝলাম রাহাত ছোট করে নিরব ভাষায় আমাকে শাসালো!এই শাসনটা যদি দুই বছর আগে আমাকে করতো, তাহলে আনন্দে পুলকিত হয়ে যেতাম আমি। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার রাগটা আরো বাড়িয়ে তুললো!
চারিপাশে ছিমছাম নিরবতা,ঘড়িতে আনুমানিক বারোটা বেজে কিছু এগিয়ে হয়তো।গ্রামের মানুষজনের কাছে এখন গভীর রাত। কারণ তারা খুব তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পরে। আমি যখন গ্রামে থাকতাম,তখন এগারোটার দিকে আম্মু ঘুম থেকে জেগে আমাকে সজাগ থাকতে দেখলে বলতো,
– এই আয়রা তুই এহনো ঘুমাস নাই? এতো রাইত অইয়া গেছে!সারারাইত মোবাইল টিপোস,এই লাইগাই সকালে ঘুম থেইকা উঠতে চাস না।
আফসোস, এই কথাটা বলার মতোও কোন মানুষ নেই এখন।
আপুদের বাড়ির পাশে একটা বাগান আছে, যেখানে অনেক বড় বড় বিভিন্ন গাছের মধ্যে শত শত বাদুর উল্টো হয়ে ঝুলে থাকে। দিনের বেলা ওখানে গেলে নিজ চোখে দেখতে পাওয়া যায়। সেখান থেকে তাদের হাঁকডাক ভেসে আসছে। মাঝে মাঝে হঠাৎ করে ডাকায় চমকে উঠছি আমি। তখন রাহাত বললো,
– এরকম নাড়াচাড়া করছো কেন? বলেছিলাম তো ব্যান্ডেজ টা না খুলতে! শুনলে না তো আমার কথা। আল্লাহ না করুক, এরকম ছোট ছোট ক্ষত থেকে বড় কোন দুর্ঘটনা ঘটে যেতে কতক্ষন। আমি অনুরোধ করছি পরবর্তীতে এরকম কাজ করো না কখনো।
আমি রাহাতের কথা সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে বললাম,
– আমি নিচে যেতে চাই। জানেন তো,
বেগানা নারী-পুরুষের কোন নির্জন স্থানে একাকী বাস, কিছু ক্ষণের জন্যও লোক-চক্ষুর অন্তরালে, ঘরের ভিতরে, পর্দার আড়ালে একান্তে অবস্থান শরীয়তে হারাম। যেহেতু তা ব্যভিচার না হলেও ব্যভিচারের নিকটবর্তী করে, ব্যভিচারের ভূমিকা অবতারণায় সহায়িকা হয়। আল্লাহর নবী (ﷺ) বলেন, ‘‘কোন পুরুষ যেন কোন নারীর সাথে একান্তে গোপনে অবস্থান না করে। কারণ, শয়তান উভয়ের কুটনী হয়।
(তিরমিযী, মিশকাতুল মাসাবীহ ৩১১৮নং)
রাহাত বললো,
– আমি সত্যি দরজা বন্ধ করার জন্য কাউকে কিছু বলিনি। আচ্ছা আমি দেখছি।
তারপর প্যান্টের পকেট হাতড়ে ফোন বের করে কাউকে কল করলো রাহাত। প্রথমবার রিসিভ হলো না, দ্বিতীয় বার রিসিভ হতেই শুনতে পেলাম কেউ বললো,
– কিরে খবর কি? বুঝাতে পারলি আয়রা কে!
এটুকু কথা শুনেই বুঝতে পারলাম, সবটা পরিকল্পনা ছিল। রাহাতের ছাদে আসা,কেউ দরজা ভিতর থেকে লক করে দেওয়া সবটা। রাহাত ওপাশের ব্যক্তির কথার উত্তর না দিয়ে বললো,
– দরজা খুলে দে তারাতাড়ি, নিচে আসবো।
তারপর অপর পাশের কথা না শুনেই কল কেটে দেয় রাহাত।
_________
নিচে এসে শাড়িটা পাল্টে নিলাম।
আপু এসে খাবার খেতে বললো,কিন্তু আমি খাবো না বলে শুয়ে পড়লাম।বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করেই যাচ্ছি,মাথায় হাজারো কথা ঘুরপাক খাচ্ছে।ফলস্বরূপ ঘুম নেই চোখে। এটা যেন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে,একটু কিছু মাথায় আসতেই নির্ঘুম কাটাতে হয় রাত গুলো।
হঠাৎ দরজায় কড়াঘাত করলো কেউ! ওঠে বসে জিজ্ঞাসা করলাম,কে?
তখন আপুর কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে দরজা খুলে দিলাম। আপুর কোলে মারওয়া ঘুম ঘুম চোখে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
– আম্মু নাও।
সাথে সাথে ওকে কোলে নিলাম,আপু তখন বললো,
– হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যাওয়াতে ওঠে বসে আছে।আর আম্মু আম্মু বলছে, তখন তোর ভাইয়া বললো,
– এই যে আম্মু তোমার সাথে।
তখন ও কি বলে জানিস?
আমি উৎসুক হয়ে বললাম,
– কি বলে?
– বলে এটা না,আত্তা আম্মু।(আরেকটা আম্মু)
এতো কিছুর মাঝেও আনন্দে মনটা প্রশান্তিতে ভরে গেল।মারওয়ার পুরো মুখশ্রী জুরে অজস্র আদরে ভরিয়ে দিলাম।যার ফলে ছোট্ট হাত দুটো আমার গলা জড়িয়ে সেও আদর গুলো বিনিময় করলো। তারপর ছোট্ট দেহটাকে জরিয়ে কয়েক ঘণ্টার জন্য ঘুমে বিভোর হয়ে গেলাম।
________
সকালের নাস্তা সেরে সাফা আর মারওয়ার সাথে দুষ্টুমি করছি তখন ভাইয়া এসে বললো,
– আয়রা তোমার সাথে কিছু জরুরী কথা আছে,ড্রয়িং রুমে এসো। তারপর লতা কে বললো,সাফা মারওয়ার খেয়াল রাখতে।
ড্রয়িং রুমে যেতেই ভাইয়া তার বরাবর সোফায় ইশারা করলো বসার জন্য। পাশের সোফায় আপু বসে আছে তখন আমিও বসলাম, তারপর জিজ্ঞাসা করার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম ভাইয়ার দিকে। ভাইয়া গলা জেরে বললো,
– ভাইয়ার একটা কথা রাখবে আয়রা?
ভিতরে ভিতরে কেমন খচখচ করছে!ভাইয়া কি এমন বলতে চান যার কারণে এভাবে বলছেন? নিজেকে ধাতস্থ করে বললাম,
– কি ভাইয়া বলুন?
ভাইয়া দুই হাত ভাঁজ করে বললো,
– তোমার সাথে যেটা ঘটে গেছে, আমি দেশে থাকলে কখনোই এরকমটা হতো না। এটা বিশ্বাস করো তুমি?
আমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলাম। তখন ভাইয়া আবার বলতে শুরু করলেন,
– তোমার সাথে যা হয়েছে সত্যিই খুব খারাপ হয়েছে, রাহাতের পরিবারের সদস্যদের উচিৎ হয়নি কাবিনের বিষয়টি বিয়ের আগের দিন উঠানো। উচিৎ ছিল, বিয়ের তারিখ ঠিক করার আগেই মিমাংসা করে নেওয়ার। আচ্ছা যা হওয়ার তা তো হয়েই গিয়েছে। এখন কথা হলো, এখানে একা ছেলে পক্ষের দোষ দেওয়া যায় না। কারণ, ছেলের সামর্থ অনুযায়ী মোহরানা ধার্য করতে হয়। এটাই ইসলামের নিয়ম।
আমাদের কুমিল্লায় কুরবানির গরুর মত এক গাদা দাম হাকাঁনো হয় কনের।পাত্রের বাবা বলে ” বেশি ধরলে সমস্যা কি! এগুলা তো আর এখন ই দেয়া লাগতেছে না।তাছাড়া, মরণ পর্যন্ত সংসার করলে একেবারেই ত ছাড় পেয়ে গেলি”. বেশি দেনমোহর চাইলে আমরাও যৌতুক আর বরযাত্রী বেশি করে চাইবো।
পাত্রীর অভিভাবক বলে” এত অল্প কাবিনে হবে না।আজকাল, রিকশাওয়ালার মেয়ের বিয়েতেও কাবিন ১০ লাখ।তাছাড়া, আমার চাচাতো বোনের খালার ফুফাতো বোনের ননদের মেয়ের বিয়ের কাবিন ছিল ১৫ লাখ।আমরা এর কম নিলে সমাজে মুখ দেখাবো কি করে!
দু’পক্ষের মাঝে এই যে যৌতুক আর দেনমোহর নিয়ে এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা যার কারণে আজ পরিবার গুলো থেকে রহমত উঠে গেছে।পরিবার গুলাতে আজ অশান্তি, দাম্পত্যকলহ, নারী নির্যাতন,ডিভোর্স বেড়েই চলেছে।
অথচ,রাসূল( সাঃ) বলেছেন” যে বিয়েতে খরচ কম,সেই বিয়েতে বরকত বেশি”.
আমাদের সকলের ই উচিত এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে বের হয়ে দ্বীনের অর্ধেক পূরনের নিয়তেই বিয়ে করা।তাই না?
ভাইয়ার সমস্ত কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে বললাম,
– আচ্ছা ভাইয়া, আমি তো নিজে তাকে কল করে বলেছিলাম, মোহরানার টাকা দিতে হবে না আমাকে। সেখানে মোহরানা এক টাকা হোক কিংবা দশ লক্ষ হোক তাতে তো তার কিচ্ছু যায় আসার কথা ছিল না।আসল কথা হলো আমার প্রতি তার বিন্দুমাত্র বিশ্বাস ই ছিল না।
আমাকে সমর্থন করে আপু তখন বললো,
– একদম ঠিক, এরকম নিচু মন মানসিকতার ছেলের সাথে ওর বিয়ে হয়নি এটাই ভালো হয়েছে।
আপুর কথা শুনে ভাইয়া রাগ নিয়ে বললো,
– তোমরা মেয়েরা এটাই পারো, উপর দিক বিবেচনা করো।অথচ এর গভীরতা চিন্তা করলে সেদিন এভাবে বিয়েটা ভেঙ্গে যেত না। তুমি তো উপস্থিত ছিলে সেদিন, আজকের মতোই চিন্তা ভাবনা করেছিলে। অথচ ভালো করে চিন্তা করে দেখলে বিয়েটা সেদিন হয়ে যেত। এখন আমাদের মধ্যে একটাও কথা বলবে না।
তারপর আমাকে আবার ভাইয়া বললো,
– সেদিন ঠিক কি বলেছিলে রাহাত’কে?
আমি একটু ভেবে বললাম,
– তুমি কি আমাকে টাকাটা এক্ষুনি দিয়ে দিচ্ছো? দিচ্ছ না তো, আমিও তো তোমার থেকে টাকাটা চাচ্ছি না বলো। তুমি শুধু মুখে বলে দাও।
আমি তো আব্বুর মুখের উপর বলতে পারতাম না যে, কাবিনের টাকা কম ই হবে।তা ছাড়া আব্বু হয়তো আমার ভালোর জন্যই বলেছিল।আর আব্বুর রাগের ব্যাপারে তো আপনি অবগত আছেন ভাইয়া। জানেন তো আব্বু হঠাৎ করেই রেগে যায়, আবার একদম শান্ত হয়ে যায়।
আমার কথা শুনে ভাইয়া মাথা নাড়িয়ে বললো,
– এখানেই তোমার ভুলটা ছিল আয়রা! তুমি রাহাত কে কথাটা যেভাবে বলেছো, তাতে কিন্তু কেউ বুঝতে পারবে না যে, মোহরানার টাকাটা মাফ করে দিয়েছো! তোমার কথার ধরন এরকম ছিল যে, তুমি আপাতত টাকাটা চাচ্ছো না। কিন্তু এখন না দিয়ে পরে দিলেই হবে! তোমার কথাটা মানে কিন্তু এটাই দাঁড়ায়!আর আমার শ্বশুর মশাইয়ের কথা এখন বাদ দেই।
তাহলে শুন রাহাতের মতো নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে হয়ে কিভাবে সামনে আগাবে বলো?
যেখানে নিজ চোখে আমি ওর জীবনের সাক্ষী।
ছোট বেলায় আমরা বন্ধুরা যখন খেলাধুলায় ব্যাস্ত থাকতাম, সেখানে ও বই পড়ে সময় কাটাতো। তারপর স্কুল জীবনে, কলেজ জীবনে আমরা বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সফরে যেতাম সেখানে ও টিউশনির পিছনে দৌড়াতো!যাতে পরিবারের সদস্যদের মুখে হাসি ফোটাতে পারে, খুব ছোট বেলায় ওর বাবা মারা যাওয়ার ফলে ওর পরিবারের করুন অবস্থা হয়ে উঠে।বড় ভাই একজন বিয়ে করে ঘরজামাই হয়ে চলে যায়। এদিকে সংসার চালানো বিয়ের উপযুক্ত দুই বোনদের বিয়ে দেয়ার দায়িত্ব। সবকিছুই রাহাতের উপর নির্ভর ছিল। তারপর কলেজ শেষ করে আমরা বন্ধুরা যার যার মতো,কেউ ডিগ্রিতে কেউ বা অনার্সে ভর্তি হয়ে গেলাম। সেখানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেনাবাহিনীতে যোগদান করলো রাহাত! সাথে নিজের পড়াশোনা ও চালিয়ে যেতে লাগলো।
এরপর এই ছেলেটা কি করে এতো গুলো টাকার মোহরানা দেওয়ার সামর্থ থাকে তুমি বলো? এখন হয়তোও একজন আর্মি অফিসার! কিন্তু তাও আর্মি অফিসারের বেতন সম্পর্কে নিশ্চই অবগত আছো তাই না?
আমি মাথা নিচু করে বললাম,
– আমি তো তার টাকা পয়সার জন্য বিয়ে করতে উদ্যত হয়নি ভাইয়া, মানুষটাকে ভালো মনে হয়েছে বলেই তো,,
ভাইয়া আমার কথা শেষ না হতেই, বললেন,
– আমি সেটা জানি আয়রা, এতো দিনে তোমাকে আমি খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছি। তুমি খুবই সাধারণ একটা মেয়ে,যার বাবার বিরাট সহায় সম্পত্তি থাকা সত্ত্বেও একচুলও অহংকার নেই। তাই এই বড় ভাইয়াটার কথা রাখো।
ভাইয়া তারপর কি বলেন,তা শুনতে উৎসুক হয়ে তাকালাম। তখন ভাইয়া বললো,
– যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে, এখন সব কিছু নতুন করে শুরু করো। রাহাত কে বিয়ে করো! আমি তোমাকে লিখে দিয়ে বলতে পারি,ওর কারণে বিনা কারণে এতো টুকু ও চোখের পানি ফেলতে হবে না তোমাকে।
ভাইয়ার এহেন কথায় বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে গেলাম আমি! কি বলছেন ভাইয়া, এতো দিনে যাকে ঘৃণার কাতারে শামিল করে এসেছি তাকে হুট করে স্বামী নামক শ্রদ্ধার কাতারে শামিল করবো কীভাবে?
_________
হঠাৎ বৃষ্টির আগমন,
চারিদিকের ভুল ত্রুটি গুলো ধুয়ে মুছে ফেলতেই যেন বৃষ্টির ফোঁটা গুলোর আগমন। কিছুক্ষণ আগেই বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি আমরা! তবে যাই হয়ে যাক না কেন, আমি এতো সহজে সবকিছু ভুলতে পারবো না,,,,
#চলবে,, ইনশা আল্লাহ।
(আসসালামু আলাইকুম।
নোট বার্তা: এখানে যেহেতু উভয় পক্ষের ভুল ত্রুটি রয়েছে তাই আয়রা আর রাহাত কে আলাদা করে দেওয়া আমি উচিৎ বলে মনে করছি না। তাদের আলাদা করে দেওয়া হলে, রাহাতের সাথে অন্যায় করা হবে বলে আমার মনে হয়েছে।
আপনাদের মূল্যবান মতামতের জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ আবারো বলছি। সবাই আমাকে এত্তো এত্তো ভালোবাসা দিচ্ছেন কি বলবো? নিজেকে সত্যি খুব ভাগ্যবান মনে হচ্ছে।”আলহামদুলিল্লাহ”।
আর যাদের বিরুদ্ধে গিয়ে ওদের মিল দিয়েছি তারা কষ্ট করে মানিয়ে নিবেন আশা রাখি।
সবশেষে,
আপনারাই কিন্তু ছেলে পক্ষ এবং মেয়ে পক্ষ। কিন্তু তা-ও আপনাদের নিমন্ত্রণ না দিয়েই বিয়ের কাজ শেষ করে ফেললাম, তার জন্য আমার শাস্তি কি দেওয়া উচিৎ আপনাদের থেকে জানতে চাওয়া আমার মন।)