#জঠর
#পর্বঃ১২
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
ঊষরের বুকে এক প্রশান্তির ছায়া হয়ে পিউলীর জীবনে নেমে আসে অর্হিতা নামের এক জলপ্রপাত। যার প্রতিটি ধাবহান স্রোতে সে তার মাতৃস্নেহের সমস্ত তৃষ্ণা মেটাতে সর্বদা তটস্থ।
প্রভাতের মিষ্টি রোশনাইয়ের ঝলমলে আবরণে আচ্ছাদিত বসুন্ধরা আজ উচ্ছ্বাসিত। কিন্তু খানিক বাদেই তার দখল নিয়ে নিল কুঞ্চিত কৃষ্ণাভ কাদম্বিনীর ভাঁজ। লুকিয়ে গেল প্রভাকর কৃষ্ণাভ কাদম্বিনীর আড়ালে। থেমে থেমে ইলশেগুড়ি বৃষ্টির সাথে অগ্নিসখের টান। শীতলতা বইছে প্রকৃতিতে। নিমগ্ন প্রকৃতিতে খেলছে বৃষ্টি আর অগ্নিসখের দোল।
ছোটো এক টুকরো রুটি পিউলীর মুখে দিতেই উচ্চলিত হয়ে তা দাঁত দিয়ে চিবিয়ে গিলে নিল সে। সাদা মুক্তোর মতো ঝকঝকে দাঁতের মিষ্টি হাসিতে বাতাসে দোল তোলে পিউলী। অর্হিতা সন্দিহান চোখে চেয়ে বলল—
“হাসো কেন?”
পিউলী খিলখিলিয়ে হাসে। অবারিত হাসি। বলল—
“তুমি সুন্দর।”
অর্হিতা কপট বিস্ময় নিয়ে বলল—
“ও মা! তাই না কি?”
“হুম।”
“কতটুকু সুন্দর?”
“অনেকটুকু।”
পিউলী তার দুই হাত ছড়িয়ে দেখায়। অর্হিতা মুচকি হাসে। তৎক্ষণাৎ কক্ষে ঢোকে নায়েল। একদম রেডি হয়েই এসেছে। পিউলীর দিকে তাকিয়ে ব্যগ্র গলায় বলল—
“চলো পিউ, পাপার দেরি হচ্ছে।”
পিউলী উঠে দাঁড়াতেই তার হাত ধরে অর্হিতা। নরম গলায় বলল—
“ওকে নিতে হবে না। আজ থেকে পিউ আমার কাছেই থাকবে।”
পিউলী দন্তপাটি সমান করে হাসে। তার চোখ দুটো মিলিয়ে আসে। উপচে পড়ে খুশি চোখের পল্লবে। নায়েল বিছানার কাছে এগিয়ে আসে। পিউলীকে টেনে নিজের কাছে এনে চোখে, মুখে টপাটপ চুমু খেয়ে বলল—
“খুশি? মামুনি তোমাকে তার কাছে থাকতে বলেছে।”
“হুম।”
“গুড গার্ল। দুষ্টুমি করবে না। মামুনিকে জ্বালাবে না ওকে?”
“হুম।”
“মাই হার্ট। পাপা যাচ্ছি। বাই।”
“বাই।”
নায়েলের বুকের ওপর থেকে যেন পাথর সরে আসলো। দীর্ঘ স্বস্তির সাথে বলল—
“অর্হিতা, পিউর খেয়াল রাখবেন।”
অর্হিতা কপট কটাক্ষ করে বলল—
“হ্যাঁ, হ্যাঁ। মেয়ের বডিগার্ড করেই তো এনেছেন।”
নায়েল ঠোঁট কামড়ে হাসে। ঝুঁকে অর্হিতার কানের কাছে গিয়ে বলল—
“তাহলে মেয়ের বাবার বডিস্প্রে হয় যান। আই ডোন্ট মাইন্ড।”
অর্হিতা দাঁত কিড়মিড় করে তাকায়। অসহ্য গলায় বলল—
“অশ্লীল !”
নায়েল ধুম করেই পিউলীর দিকে তাকায়। অর্হিতা জিব কামড়ে চোখ পিটপিট করে অস্ফুট গলায় বলল—
“সরিইইই। আর বলব না।”
নায়েল মাথা ঝাঁকায়। মিষ্টি হেসে বলল—
“পাপা যাচ্ছি পিউ। বাই।”
“ওকে।”
কলেজে যাওয়ার তাড়া হৃতির। কোনোমতে ছুটে চললেই যেন হলো। দরজার কাছ থেকে দেখতে পেল নায়েল নিচে নামছে। বুকে ধাক্কা লাগে হৃতির। কাতর চোখ দুটো ফিরিয়ে নিয়ে পা বাড়াতেই নায়েলের শক্ত কণ্ঠের আহ্বান।
“দাঁড়াও হৃতি।”
হৃতি থমকায়। ফিরে তাকায় ছলছল লোচনে। আগ্রহীসত্ত্বা অনঢ়। টলটলে গলায় বলল—
“কিছু বলবে?”
নায়েল সামনে এসে অনুদ্বেগ সুরে বলল—
“চলো, আজ আমি তোমাকে কলেজ পৌঁছে দিচ্ছি।”
হৃতির অবাকের মাত্রা অভ্রভেদী। লক্ষ্যভ্রষ্ট তীরের ন্যায় চিন্তিত চোখে চেয়ে বলল—
“কেন?”
“এমনি। ইচ্ছে হলো।”
হৃতি আপত্তি করে বলল—
“প্রয়োজন নেই। আমি একাই যেতে পারব।”
“আমি তোমাকে আমার সাথে যেতে বলেছি। চলো।”
“বললাম তো না।”
নায়েল শুনল না। খপ করে হৃতির হাত ধরে। হৃতি বদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে রয়। বিস্মিত, বিমূঢ় সে। নায়েল কখনো এমন আচরণ করে না।
,
,
,
গাড়ির জানালা দিয়ে ফুরফুরে বাতাস। তাতে আছে সিক্ত সকালের মিষ্টি ঘ্রাণ। ঝকঝকে পরিষ্কার আকাশে তুলোর মতো মেঘের ছড়াছড়ি। কুসুমকোমল সূর্যের রশ্মি একটু একটু করে তার প্রতিফলন ঘটাচ্ছে হৃতির চোখে, মুখে। নায়েলের শক্ত দৃষ্টি ফ্রন্ট মিররে। কণ্ঠে কাঠিন্যতা রেখে বলল—
“এসব করলে কেন?”
চট করে নায়েলের দিকে নজর ফেলে হৃতি। চকচকে চাহনি রেখে বলল—
“কী করেছি আমি?”
নায়েল গাড়ি থামায়। স্টেয়ারিং থেকে হাত সরিয়ে কাত হয়ে হৃতির দিকে চেয়ে বলল—
“সেদিন তুমিই ছিলে সেখানে তাই না?”
হৃতি ফুঁসলে উঠে বলল—
“আমি ছিলাম বলে আমিই এসব করেছি তুমি ভাবলে কী করে?”
নায়েল তপ্ত শ্বাস ফেলে। নাকের পাটা ফুলিয়ে বিতৃষ্ণা গলায় বলল—
“তাতো তুমি ভালো করে জানো। সিঁড়ির উপর তেল ছিল। আর ঘরে একমাত্র তোমারই আনাগোনা রান্না ঘরে।”
হৃতি রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বলল—
“রান্নাঘরে আমার যাতায়ত বলে আমিই এসব করেছি তুমি ভাবলে কী করে? রান্নাঘরে তো মাঝে মাঝে পিউলীও যায়। তাহলে ওকে কেন সন্দেহ করছ না?”
“জাস্ট শাটআপ ইয়ার। তুমি কী বলছ তা বুঝে বলছ তো?”
হৃতির চোখ বেয়ে ঝমঝমিয়ে শ্রাবণের ধারা নামে। নায়েল এভাবে তাকে বলতে পারে না। অবশ্য বলবেই না কেন? আশ্রিতাদের এর চেয়ে ভালো আচরণ আদৌ কী প্রাপ্য?
,
,
,
কুচকুচে আঁধারে অবগাহনে মত্ত বিভাবরী। তার আঁধার ফুঁড়ে মশাল জ্বালিয়ে স্বগৌরবে উঁকি দিচ্ছে সুধানিধি। ঘন কালো আঁধারে অস্পষ্ট আবছায়ায় বাসায় ফিরেছে নায়েল। জরুরি মিটিং থাকায় আজ একটু দেরি হয়েছে ফিরতে।
বসার ঘরের কৃত্রিম বাতির প্রখর আলো। সিঁড়ি বেয়ে নিজের কক্ষের উদ্দেশ্যে পা চালাতে থাকে নায়েল। ক্লান্ত, শ্রান্ত শরীরের উৎফুল্লতা প্রয়োজন। গায়ের ব্লেজার খুলে তোয়ালে হাতে ওয়াশরুমে ঢুকে নায়েল। লম্বা শাওয়ার নিয়ে বের হয়। সময় প্রহরী তখন জানান দিচ্ছে রাতের মধ্য প্রহরের। চুলের পানি শুকিয়ে একটা পাতলা টিশার্ট গায়ে গলিয়ে নেয় নায়েল। অর্হিতার কক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে ইতস্তত বোধ হয় তার। পিউলীকে আনতে হবে। মেয়েটা মামুনিকে পাওয়ার খুশিতে যেন সব ভুলে গেছে। নক করতেই ভেতর থেকে সাড়া পায় নায়েল। জড়তা ঝেড়ে ফেলে ভেতরে ঢুকে একটু অবাক-ই হয় সে। পিউলী ঘুমোচ্ছে তার পাশে আধো জাগরিত অর্হিতা। তার চোখে, মুখ তন্দ্রালুভাব। নায়েল মৃদুমধুর গলায় বলল—
“সরি, আমার আসতে একটু দেরি হয়ে গেল। আমি পিউকে নিয়ে যাচ্ছি।”
অর্হিতা ঘুমো ঘুমো গলায় বাঁধা প্রদান করে বলল—
“না। আজ থেকে পিউ আমার কাছেই থাকবে।”
“ও আপনাকে ঘুমোতে দেবে না। রাতে জ্বালাবে।”
“এত চিন্তা! সেইটা তো আমাকে ওর মা বানানোর আগে ভাবা উচিত ছিল তাহলে।”
ট্রাউজারে এক হাত গুঁজে অনুতপ্ত চোখে তাকায় নায়েল। জিজ্ঞাসু গলায় বলল—
“পিউ খেয়েছে তো?”
“হ্যাঁ। খাইয়ে দিয়েছি।”
“আপনি খেয়েছেন?”
“আমি কার জন্য না খেয়ে থাকব? তেমন কেউ তো নেই।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলল নায়েল। ঘুরে দাঁড়াতেই অর্হিতার কঠোর গলার প্রশ্ন—-
“আপনি খেয়েছেন?”
“নায়েল ফিরে তাকায়। ন