#জঠর
#পর্বঃ১৬
লেখনীতেঃ তাজরিয়ান খান তানভি
কয়েকদিন ধরেই হৃতির অস্বাভাবিক আচরণ খেয়াল করছে অর্হিতা। মেয়েটা কলেজ থেকে বেশ সময় করে বাড়ি ফিরে। কারো সাথে তেমন একটা কথাও বলে না। চুপচাপ ঘরে বসে থাকে। আগে নায়েলের সাথে ভালো একটি বন্ডিং ছিল। ক্রমশ তা ফিকে হতে লাগল। অর্হিতা ভেবেছে হয়তো তার জন্য হৃতি নিজেকে নায়েলের কাছ থেকে গুটিয়ে নিয়েছে। কিন্তু অর্হিতার ভুল ভাঙল যখন সে হৃতির ব্যবহারের প্রতি অভিনিবেশ করে।
তিমির আচ্ছন্ন নভোলোকে চন্দ্রিকার উদ্ভাসিত চন্দ্রাতপে মুখর মেদিনী। মৃদুশীতল বহ্নিসখে গুঞ্জন উঠেছে শান্ত তিমির পরিবেশে। ছাদের বাউন্ডারি দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে নায়েল। তার বুকের বা’পাশে হৃদপিন্ডের উপর মাথা রেখে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে অর্হিতা।
চাঁদের মিহি আলো চুকচুক করে ছুঁইছে অর্হিতার সুশ্রী আনন। নায়েলের ঘ্রাণেন্দ্রিয় তখন মত্ত অর্হিতার ঘন কেশে। সৌরভের ছড়াছড়ি রেশম কালো অরন্যে। নায়েল প্রাণভরে শ্বাস নেয়। অর্হিতা ধীর গলায় বলল—
“হৃতির সাথে কথা বলেছেন আপনি?”
নায়েলের অস্পষ্ট উত্তর—
“উঁহু।”
“আপনি কালই ওর সাথে কথা বলবেন। আজকাল অদ্ভুত আচরণ করছে। কথা বলছে নি ঠিক মতো, খাচ্ছে না ঠিক মতো। সারাদিন ধুম ধরে ঘরে বসে থাকে। আর কলেজ থেকে ফেরেও দেরি করে।”
নায়েলের শ্রুতিগোচর হলো না কিছুই। সে ব্যস্ত অর্হিতার ঘাড়ে। ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের ঘর্ষণের সাথে উষ্ণ অধরের ছোঁয়া। নায়েলের দিক থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে অসহনীয় গলায় বলে উঠে অর্হিতা—
“নায়েল! কী বলেছি শুনতে পেরেছেন আপনি?”
“হু।”
মেজাজ তিরিক্ষি হলো অর্হিতার। নায়েলের বুকের পাটাতন থেকে পিঠ সরিয়ে সরব কণ্ঠে বলল—
“ধুর! কিছু বলছেন না কেন?”
নায়েল নিরীহ গলায় বলল—
“কী বলব?”
“আপনি কি কিছুই শুনতে পাননি।”
“না তো। শুধু দেখতে পেয়েছি। আপনার ওই চন্দ্রানন! চাঁদের জোছনা ঠিকরে পড়ছে আপনার অঙ্গে। প্রভঞ্জনে উঠেছে ঝড়, উত্তাল করেছে আমার মন।”
অর্হিতা বিষিয়ে উঠা গলায় বলল—
“আপনার এই আবর্জনা মার্কা কবিতাগিরি বন্ধ করবেন? মেজাজ খারাপ হচ্ছে আমার।”
“কুল, কুল মিসেস অর্হিতা। বলুন, আমি শুনছি।”
অর্হিতা সচেতন গলায় ফের বলল—
“হৃতির সাথে কালই কথা বলবেন আপনি।”
নায়েল ফিচেল হাসে। বক্রোক্তি করে বলল—
“যেন আপনি আমার চুল ছিঁড়ে বাতাসে ফুঁ দিয়ে ওড়াতে পারেন। নো চান্স!”
অর্হিতা চোয়াল শক্ত করে। দাঁত কিড়মিড় করে বলল—
“আপনি কী আমার কথা শুনবেন, না আমি চলে যাব?”
নায়েল হুট করে অর্হিতাকে নিজের বুকে টেনে নেয়। টপটপ করে কয়েকটা চুমু খেয়ে বলল—
“আই এম সিরিয়াস নাউ, বলুন।”
অর্হিতা ফোঁস করে দম ফেলে। সোজা হয়ে বসে। মৃদু বাতাসে তার চুলে উড়াভাব এসেছে। নায়েল সেই চুল নিয়ে উঁচু করে ধরে। তারপর একটু একটু করে হাত থেকে ছাড়ে। চুলগুলো কচ্ছপ গতিতে খসে পড়ে বাতাসে দোল খায়। নায়েল সেই চুলের ফাঁক গলিয়ে চাঁদ দেখে। অর্হিতা নাক, মুখ কুঁচকে নায়েলের আচরণ দেখছে। ইচ্ছে করছে এখন নিজের চুলগুলোই টেনে ছিঁড়ে ফেলতে। নায়েলের হাত থেকে চুল সরিয়ে দগদগে চোখে তাকাতেই নায়েল কপট ভয়ের ভঙ্গি ধরে। বুকে থু থু ছিটিয়ে বলল—
“এভাবে তাকান কেন? ভয় লাগে আমার।আচ্ছা বলুন। কী বলছিলেন যেন!”
অর্হিতা রাগ সংবরণ করে। সে বেশ বুঝতে পারছে নায়েল তাকে রাগানোর জন্য এমন করছে। অর্হিতা একটু শান্ত হয়ে বলল—
“আপনি কাল সকালেই হৃতির সাথে কথা বলবেন। হৃতি আপনার সাথে অনেক ফ্রি। আই থিংক ও আপনাকে নিজের সমস্যাটা খুলে বলবে।”
“আপনি শুধু শুধু ভাবছেন। ওর পরীক্ষা সামনে। তাই হয়তো ব্যস্ত।”
“তা নয়। হৃতি ঠিক সময়ে বাসায় ফেরে না। রাতে প্রায়ই না খেয়ে ঘুমিয়ে থাকে। সেদিন দেখলাম মেঝেতে শুইয়ে আছে। মেয়েটার চোখ গুলো কেমন প্রাণহীন! শরীরেও জোর নেই।”
নায়েলের মসৃণ কপাল কুঞ্চিত হয়। গাঢ় শ্বাস ফেলে। চোয়ালে আসে দৃঢ়তা। স্থির গলায় বলল—
” ওকে। আমি দেখছি।”
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে অর্হিতা। মেয়েটার জন্য বড্ড মন পোড়ে তার। নিজেকে কল্পনা করে ওর জায়গায়। তার কেউ নেই, কিন্তু মেয়েটির বাবা থেকেও নেই। অর্হিতার ধ্যান কাটে নায়েলের কণ্ঠে—
“এখন বলুন তার বিনিময়ে আমি কী পাবো?”
অর্হিতা চোখের আয়তণ সংকুচন করে বলল—
“আপনি কী পাবেন মানে? আপনাকে আমি কী দেবো?”
“যা আমার চাই।”
অর্হিতা বিরক্তি নিয়ে উঠে বলল—
“ধুর! বসে থাকুন এখানে। আমার ঘুম পাচ্ছে।”
“আরে, এই, মিসেস অর্হিতা শুনুন।”
খলখল করে হাসে নায়েল। মেয়েটা অদ্ভুত ! দূরে গেলে বাড়ায় জ্বালা, কাছে এলে দিশেহারা!
,
,
,
সকালে জরুরি কাজ থাকায় হৃতির সাথে দেখা হয়নি নায়েলের। বিকেলে বাসায় ফিরে সে অপেক্ষমাণ হৃতির জন্য। হৃতি এলো। কিন্তু সায়াহ্নের শেষ লগ্নে। নায়েল তখনও বসার ঘরে বসে আছে। নায়েলকে দেখে একরকম লুকোচুরি করে নিজের কক্ষে পা বাড়ায় হৃতি। বাসায় এসেই যে নায়েলের সম্মুখিন হবে তা সে ভাবতে পারেনি। প্রায় আধঘণ্টা পরও যখন হৃতি এলো না তখন নায়েল নিজেই তার কক্ষে গেল। বাইরে থেকে নক করতেই থিতিয়ে থাকা হৃতি সরব হলো। নায়েলকে দেখেই অপ্রস্তুত ভঙিতে নিজেকে গোটাতে থাকল। নায়েল চোখের সাহায্যে হৃতিকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করছে। হৃতি অস্বাভাবিক আচরণ করছে। নায়েল কাঠ গলায় বলল—
“এতক্ষণ কোথায় ছিলে?”
ঢোক গিলল হৃতি। মৃদু গলায় বলল—
“কলেজে।”
নায়েল হাত ঘড়িতে তাকায়। বলল—
“সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। বিকেল চারটায় ছুটি। এত সময় কোথায় ছিলে?”
হৃতি থতমত খেয়ে বলল—
“বান্ধবীদের সাথে গেছিলাম। তাই…।”
“মিথ্যে বলছ। কোথায় ছিলে হৃতি? এনি থিংক রং?”
“না, না। আমি ঠিক আছি। তুমি যাও।”
নায়েলের চোখ পড়ে হৃতির হাতে। খপ করে তা ধরে তীক্ষ্ম স্বরে বলল—
“তোমার হাতে কী হয়েছে? পুড়লো কী করে?”
হৃতি নিজের হাতের দিকে তাকায়। জলন্ত সিগারেটের পোড়া দাগ। হৃতির মোমের মতো শরীরে কৃষ্ণ গহ্বর তৈরি করেছে। সিক্ত হয় তার আঁখিজোড়া। নায়েলকে জোর করে কক্ষ থেকে বের করে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল—
“তুমি যাও, যাও এখান থেকে। কিছু হয়নি আমার। যাও এখান থেকে।”
নায়েল ভ্যাবাচাকা খেয়ে যায়। ঠিক পিউলী যেন অভিমান করে কাঁদছে। নায়েল দরজায় চাপড় বসাতে থাকে।
“হৃতি দরজা খোলো। কী হয়েছে তোমার?হৃতি!”
অর্হিতা এসে দাঁড়িয়েছে পাশেই। সন্দিহান গলায় বলল—
“কী হয়েছে?”
নায়েল নাকের ডগা ফুলিয়ে বলল—
“হয়েছে তো কিছু একটা।”
গজগজ করতে থাকে নায়েল। বিছানায় শুয়ে ঝমঝমিয়ে কাঁদছে হৃতি। এত বড়ো ভুল সে কী করে করল? এর মাসুল তাকেই দিতে হবে।
,
,
,
নওশাদ সাহেবের কোলে বসে কার্টুন দেখছে পিউলী। ডিভানের কোণে বসে আছেন সায়েরা। নায়েল কোনো সাড়া না দিয়েই ভেতরে ঢুকে পড়ে। বিব্রত চোখে তাকাল সায়েরা। নায়েল কখনো এমন করে না। তার বাদামী রঙটায় আগুন ধরেছে যেন! গটগট করে বলল—
“হৃতির কী হয়েছে বলোতো? ও কী কারো সাথে রিলেশনে জড়িয়েছে?”
সায়েরা ফাঁকা ঢোক গিললেন। ঊষর গলায় বিস্ময় নিয়ে বললেন—
“এসব কী বলছ তুমি?”
“ঠিক ই বলছি। ওর হাত দেখেছ? যেন কেউ জ্বলন্ত সিগারেটের ফিল্টার লাগিয়ে দিয়েছে। আই সয়ের, যদি কোনো এড়েগেড়ে ছেলের পাল্লায় ও পড়েছে তাহলে কিন্তু ভালো হবে না। সাবধান করে দিয়ো ওকে।”
পিউলীর কৌতূহল দমাতে নওশাদ সাহেব তাকে টিভিতে ব্যস্ত করলেন। বিভিন্ন কথা বলে ভোলাতে চেষ্টা করছেন। সায়েরা দ্বিধান্বিত ! ভয়ে জবুথবু সায়েরা নিজের প্রশান্তিময়ী জায়গা খুঁজে নিয়ে কাউকে কল করে। ওপাশের ব্যক্তি যেন তার জন্যই অপেক্ষা করছিল। কল রিসিভ করেই বিশ্রি রকম হাসল। সায়েরা খনখনে গলায় বললেন—
” এসব কী শুরু করেছিস তুই? কী করেছিস মেয়েটার সাথে?”
ওপাশের ব্যক্তিটি বাঁকা হাসল। তার ঠোঁটের ভাজে জ্বলন্ত সিগারেট। দুই আঙুলের ভাঁজে নিয়ে মুখ ভর্তি ধোঁয়ার কুন্ডলি বিক্ষিপ্ত করল। প্রকীর্ণ হলো ছোট্ট খুপড়ি কক্ষে। চেয়ারে হেলান দিয়ে আরেক চেয়ারে অদ্ভুত ভঙিতে পা তুলে রেখেছে। রঞ্জিত চোখে দীর্ঘ পল্লব। মেঘবর্ণ মুখে সিগারেট পোড়া ওষ্ঠাধর। কণ্ঠে জীর্ণতা।
“টাকা কোথায় আমার?”
সায়েরা চেঁচিয়ে উঠলেন। বললেন—
“পনেরো দিন আগেই তোকে টাকা দিয়েছি। শেষ করে ফেললি! এত টাকা দিয়ে করিস কী তুই? এই মাসে তুই দুই বার টাকা নিয়েছিস।”
ব্যক্তিটি আঙুলের ভাঁজের সিগারেটটি মুখে পুড়ল। একটা দীর্ঘ টান মেরে মুখ থেকে সরিয়ে নিল। আয়েশি ভঙ্গিতে ধোঁয়া ছেড়ে বলল—
“কী করেছি জানি না। টাকা লাগবে আমার। ব্যবস্থা কোরো। না হলে তোমার ওই নায়েল আনসারীর মান সম্মান নিলামে ওঠাব আমি। জাস্ট এক মিনিট লাগবে আমার। ওই হৃতির অ্যাডাল্ট ভিডিয়ো ভাইরাল করতে। তখন তোমার নায়েল মুখ লুকাতে পারবে না।”
সায়েরা তেঁতে উঠলেন। গরগর করে বললেন—
“আমি তোকে হৃতিকে ভালোবাসতে বলেছি। আর তুই মেয়েটার সাথে এই জঘন্য কাজ করলি!”
বিশ্রি রকম চাপা হাসে ব্যক্তিটি। ভরাট গলায় বলল—
“ভালো বিয়ের পর বাসব। এখন এনজয়! টাকার ব্যবস্থা কোরো আমার আর না হলে ওই বাড়িতে আমার এন্ট্রির। নাহলে ওই হৃতিকে আমি বাজারে উঠিয়ে ছাড়ব।”
“সুহাস!”
ব্যক্তিটি খিঁচতি মেরে হাসে। কল কেটে অ্যাশ ট্রেতে সিগারেটের ফিল্টার ফেলে একটা সিরিঞ্জ নেয়। নিজের হাতে পুশ করে তৃপ্তিকর হাসে। শরীরটা এলিয়ে দেয় পুরোদস্তুর চেয়ারে।
চলবে,,,