জঠর পর্বঃ১৭

0
1656

#জঠর
#পর্বঃ১৭
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

রাগে মস্তিষ্কের দু’পাশের রগরগ দপদপ করছে নায়েলের। এত বড়ো একটা অঘটন ঘটিয়ে নিরুদ্বেগ ভঙ্গিতে বসে আছে হৃতি। টিমেটিমে চোখে তাকিয়ে মেঝেতে পায়ের আঙুল ঘষে যাচ্ছে। নওশাদ সাহেব গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। সহজ-সরল মেয়েটা এমন একটা চিন্তাতীত কাজ করে ফেলবে তা তিনি ভাবতেই পারেন নি। সায়েরাও নির্লিপ্ত। নায়েল বিক্ষিপ্ত গলায় বলে উঠে—

“বিয়ে কী ছেলে খেলা! বললেই হয়ে গেল? এইটা কী ধরনের বিয়ে?”

হৃতির মুখে রা এলো না। ওড়নার দুইপাশ কোলের মধ্যে নিয়ে শুধু চেপে যাচ্ছে। তার হা,পা কাঁপছে অনবরত। ভয়, শঙ্কায় আর লজ্জার বলয়ে আবিষ্ট হৃতি চোখ তুলেও তাকাচ্ছে না। নায়েল প্রশস্ত গলায় ঘোষণা করল—

“এই বিয়ে আমি মানি না।”

পাশে থাকা সুঠাম দেহের পুরুষটি অধরের কোণ প্রশস্ত করল। হেয়ালি চোখে তাকাল। কালো শার্ট-প্যান্টে তার উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ ধূসর আকাশে একফালি রোদ হয়ে ধরা দিচ্ছে চোখে। বাদামী বর্ণের চোখে ঘন পক্ষ্মচ্ছায়ায় নিবিড় মোহ। প্রশস্ত ললাটে পুরু ভ্রু জোড়া সুদীর্ঘ। ভরাট চোয়াল। পুরুষটি ওঠে দাঁড়াল। তার এক হাত হৃতির হাতে। হৃতিকে নিয়ে দু’কদম সামনে এগোতেই নায়েল প্রতিবাদ করে বলল—

“ওকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছ?”

পুরুষটি তার পুরু অধরে স্নিগ্ধ হাসির ফোয়ারা ঝরালো। তেজবিহীন স্বরে বলল—

“আমার বউ, আমি যেখানে খুশি নিয়ে যাব। যদিও রাজপ্রাসাদ নেই। গাছতলা, ব্রীজতলা কিছু তো একটা উপায় হবেই।”

নায়েল কটমটিয়ে বলল—

“ও কোথাও যাবে না।”

পুরুষটি মিষ্টি করে হাসল। প্যান্টের পকেট থেকে হাত বের করে নাকের ডগায় ঘষা মারল। স্নিগ্ধস্বরে বলল—

” বউকে ছেড়ে তো আমি কোথাও যাচ্ছি না বড়ো ভাই। আসি।”

“দাঁড়ান।”

মেয়েলি মিহি কণ্ঠে থমকে যায় পুরুষটি। অর্হিতা এসেছে। পিউলীকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে এসেছে সে। পিউলীর সামনে এমন ঘটনা ঘটুক তা কেউ চায় না। সেই সকালে বেরেয়েছিল হৃতি। ফিরেছে রাত আটটার পর। একা ফেরেনি। কাজী অফিস থেকে এক আগন্তুককে নিয়ে ফিরেছে। হৃতি তাকে চিনলেও বাড়ির আর কেউ তাকে এ জীবনে দেখেনি। অর্হিতা শান্তকণ্ঠে বলল—

“কোথাও যেতে হবে না আপনাকে। হৃতি, তোমার হাজবেন্ডকে নিয়ে ঘরে যাও।”

হৃতি চোরা চোখে নায়েলের দিকে তাকায়। ক্ষিপ্ত নায়েলের দুই চোখ দিয়ে অগ্নিনালা নির্গত হচ্ছে। হৃতি কুণ্ঠিত হয়। চলে যায় নিজের কক্ষে। বিতৃষ্ণ নওশাদ সাহেব ওঠে চলে গেলেন। সায়েরাও দাঁড়ালেন না। রণলীলা সাঙ্গ হলো। নায়েলের মেজাজ বিগড়ে গিয়েছে। অর্হিতা সান্ত্বনার সুরে বলল—

“প্লিজ, শান্ত হোন। ছোটো মানুষ ভুল করে ফেলেছে। কোথায় যাবে ও আমাদের ছেড়ে? আর ছেলেটারও তো কেউ নেই।”

নায়েল দগ্ধ গলায় বলল—

“এটাই তো। ও এত বড়ো ভুল করল কী করে? ছেলেটার কোনো ব্যাকগ্রাউন্ড নেই, তার ওপর বেকার। এমন ছেলেকে ও বিয়ে করল কী করে? নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটু চিন্তা হলো না ওর?”

অর্হিতা মৃদু গলায় বলল—

“সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে বাবা- মাকে ভাবতে হয়। না কি তারা নিজেরা চিন্তা করে তাদের কৈশোর নষ্ট করবে। সন্তান ভুল করলে বাবা-মা শুধরে দেবে, বিপদে পড়লে আশ্রয় দেবে। এই জন্যই তো পরিবার। হৃতি অজ্ঞতাবশত হোক আর প্রেমের টানেই হোক ভুল করে ফেলেছে। আমরা তো আছি। ওর পরিবার। আপনি আর এ নিয়ে চিন্তা করে নিজের শরীর খারাপ করবেন না। বাবা, খালামনি তারাও উদ্বিগ্ন এ নিয়ে। আপনি হাল ছাড়লে তাদের কী হবে?”

নায়েল শান্ত হয়। তবুও সে ক্ষুব্ধ।

বিছানার কোণে বসে আছে হৃতি। তার উরুর উপর পা তুলে সটান হয়ে শুয়ে আছে পুরুষটি। হৃতি কাঁদো কাঁদো গলায় বলল—

“তুমি নায়েলের সাথে এভাবে কথা বললে কেন?”

পুরুষটি পা নামায়। ওঠে বসে। হৃতির কাছে এসে শ্বাস ফেলতেই তার নিঃসৃত উষ্ণতায় কেঁপে ওঠে হৃতি। দাঁতের সাথে দাঁত লাগিয়ে বলল—

“তোর আশিকের সাথে কথা বলেছি বলে তোর রাগ হচ্ছে?”

হৃতি তাপিত গলায় বলে উঠে—

“সুহাস! এসব কী বলছ?”

সুহাস একটানে নিজের বুকে নিয়ে নেয়ে হৃতিকে।
,
,
,
ডিভানে শরীরে এলিয়ে বসে আছে নায়েল। তার গম্ভীর, চিন্তিত, নিমগ্ন চিত্ত। স্বামীর এহেন দশায় অর্হিতার মন ক্ষুণ্ণ হয়। নায়েলের পাশে বসে তার বুকে মাথা রাখে অর্হিতা। আদুরে গলায় বলল—

“আপনি কেন এত ভাবছেন?”

অর্হিতার মাথার উপর চিবুক রাখে নায়েল। এক হাতে তাকে বুকের সাথে আলতো করে চেপে ধরে। অবিন্যস্ত চুলে হাত গলিয়ে বলল—

“ভয় হয় আমার। আর কাউকে হারাতে ইচ্ছে হয় না। হৃতি আর নিহিতার মধ্যে কোনো তফাৎ নেই আমার কাছে। ও তো আমার পিউর মতো। পুতুলের মতো কোমল। মেয়েটা কী করে এত বড়ো ভুল করল?”

“আপনি শুধু শুধু ভাবছেন। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

“নিহিতাও এই ভুল করেছে। ইন্টারমিডিয়েট অব্দি দুই ভাইবোন এক ঘরে থাকতাম আমরা। অনার্সে ভর্তি হতেই আমাদের ডিপার্টমেন্ট আলাদা হয়ে গেল, সাথে আমাদের ঘরও। একই কলেজে পড়া সত্ত্বেও আমার নাকের নিচেই মাহিমের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে গেল। আমি টেরও পেলাম না। তারপর বিয়ে, ডিবোর্স, পিউ! সবকিছু এত দ্রুত হলো আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি। হৃতির সাথে যেন এমন কিছু না হয়। আই হোপ!”

মাথাটা কিঞ্চিৎ আলগা করে অর্হিতা। নায়েলের হৃৎকম্পন বাড়ছে। অর্হিতা বিচলিত গলায় বলল—

“শান্ত হোন নায়েল। আপনার হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে।”

নায়েল নিঃশব্দে শ্বাস ফেলে। অর্হিতা দুই হাতে স্বামীকে জড়িয়ে ধরে।
,
,
,
খাবার টেবিলে অনুপস্থিত হৃতি। তার দরজার দিকে বারংবার তাকাচ্ছে নায়েল। হৃতি আসছে না। অর্হিতা নায়েলের উদ্বেলতা বুঝতে পেরে নিজেই এগিয়ে যায় হৃতির কক্ষের দিকে। দরজায় কড়া নেড়ে বলল—

“হৃতি, সবাই বসে আছে। খাবে এসো।”

সমাহিত হৃতির কোমল দেহের উপর থেকে সরে আসে ক্লান্ত সুহাস। তার ঘর্মাক্ত শরীর এলিয়ে দেয় বিছানার অপর পাশে। হৃতি চটপট ওঠে বসে। পড়ে থাকা জামাটা গায়ে পরে নেয় চটজলদি। এলোথেলো চুলগুলো হাত দিয়ে কোনোমতে ঠিক করে দরজা খুলে দাঁড়ায়। হৃতির ছোট্ট মুখটাই শুধু দেখতে পাচ্ছে অর্হিতা। ছোট্ট শ্বাসে বলল—

“খেতে এসো হৃতি।”

“তুমি যাও অামি আসছি।”

“হু। দেরি করো না।”

অর্হিতার টানটান ললাটে ভাঁজ পড়ে। মেয়েটাকে কেমন বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে! প্রায় মিনিট পনেরো পরেও হৃতি এলো না। রাগে টনটন করছে নায়েলের শিড়দাঁড়া। অর্হিতা রয়ে সয়ে বলল—

“হয়তো ওর হাজবেন্ড আসতে চাচ্ছে না। আপনারা খেয়ে নিন। আমি ওদের খাবারটা ঘরেই দিয়ে আসি।”

নায়েল খেঁকিয়ে ওঠে।

“ঘরে কেন খাবার দিয়ে আসবেন?”

“নায়েল, সব বিষয় নিয়ে এত ঝামেলা করলে চলে? আপনি খেয়ে নিন তো।”

নায়েল আর বসল না। খাবার ছেড়ে ওঠে চলে যায়। অর্হিতা নীরাস হয়।

কলরবকে দিয়ে হৃতির কক্ষে খাবার পাঠানো হয়। বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে আছে সুহাস।

“সুহাস উঠো। খেয়ে নাও।”

“তোকে লাইট অফ করতে বলেছি আমি।”

“খেয়ে নাও আগে। সারারাত না খেয়ে থাকবে না কি?”

খিচতি মেরে ওঠে বসে সুহাস। বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা হৃতির হাতের খাবারগুলো ধাক্কা মেরে ফেলে বলল—

“শালি, তোকে খেয়েছি না তাতেই পেট ভরেছে আমার! লাইট বন্ধ কর।”

হৃতি দ্রুত হাতে লাইট অফ করে দেয়। বুক ভেঙে কান্না আসে তার। এই মানুষটাকে চিনতে সে অনেক বড়ো ভুল করে ফেলেছে। সম্পর্কের শুরুতে এত কেয়ার, এত লাভিং আর পারফেক্ট মানুষটা হঠাৎ করেই কেমন অচেনা আগন্তুক হয়ে গেল। হৃতির কোমল মন বিষিয়ে তুলেছে তাদের প্রথম ঘনিষ্ঠতার পরেই। বান্ধবীদের প্ররোচনায় পড়ে সুহাসের সাথে তার বাসায় গিয়েছিল। আর সেদিনই অঘটন ঘটে। হৃতি বুঝতেই পারেনি সুহাস একজন চেইন স্মোকার আর সাথে ড্রাগ অ্যাডিক্টেড। শারীরিক নির্যাতনের সাথে মানসিক নির্যাতন। তাই কাউকে কিছু না বলে সে বিয়ে করে নিল। এতকিছুর পরেও সে সুহাসকে ভালোবাসে। নায়েলের প্রতি তার আবেগ এতটা ছিল না। তবে তার আদর্শ ছিল নায়েল আর সেই সাথে ভালোলাগা। কিন্তু সুহাসকে সে ভালোবেসেছে। তার সবকিছু দিয়েই ভালোবেসেছে। বিনিময়ে পেয়েছে ধোঁকা।

কার্পেট থাকার কারণে নিক্ষিপ্ত খাবারের বাটি, প্লেটের কোনো শব্দ সৃষ্টি হলো না। মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালিয়ে সেই খাবার কুড়াতে থাকে হৃতি। অনবরত তার চোখের কোণ হতে ঝরছে অথৈ জল।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here