জঠর পর্বঃ৫

0
1928

#জঠর
#পর্বঃ৫
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

ড্রয়িং রুমের কাউচে পা ঝুলিয়ে বসে আছে পিউলী। তার একপায়ে মোজা পরিয়ে দিচ্ছে নায়েল। আরেক পা সমানতালে ঝুলিয়ে যাচ্ছে পিউলী। তার চোখে মুখে উচলে পড়া খুশি। নায়েল চোখে হাসে। মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করে—

” হাসছ কেন পিউ?”

পিউলী গালভরা হাসিতে বলল—

“মামুনি সুন্দর।”

স্মিত হাসল নায়েল। সকাল বেলা যখন অর্হিতা তার অগোছালো জামা, কাপড়ে বাইরে বেরিয়ে আসে তখন পিউলী তার দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল। ঠোঁট চেপে সে কী হাসি!
অর্হিতার চুলগুলো এলোথেলো, গায়ের জামাটা ছিল কুঁচকানো।

হৃতি এসে দাঁড়িয়েছে নায়েলের পেছনে। অনুনয়ের সুরে বলল—

“তুমি ওঠ, আমি পিউলীকে তৈরি করে দিচ্ছি।”

নায়েল অবজ্ঞার সুরে বলল—

“নো থ্যাংকস। আই উইল।”

হৃতি কন্ঠে চাপা রাগের আবির্ভাব ঘটায়। বলল—

“এমন কেন করছ নায়েল? আমার কী কোনো যোগ্যতা নেই পিউলীর মা হওয়ার?”

হৃতির করা প্রশ্নে বাবার দিকে ভুত দেখার মতো চাইল পিউলী। নায়েল শ্রান্ত গলায় বলল—

“হৃতি, এখন এসব কথা বলার সময় না। যাও এখন।”

“কেন? যে মেয়ে পিউলীকে মেনে নিতেই চাইছে না তুমি তাকেই কেন বিয়ে করলে? তুমি ভালো করেই জানো যে আমি…।”

“স্টপ দিস ননসেন্স হৃতি। আমি তোমাকে বোনের থেকে বেশি আর কিছুই ভাবিনি। প্লিজ, যাও এখান থেকে।”

হৃতির চোখের বর্ষণ থামল না। স্ফীত হয়ে ফেঁপে উঠল তা। প্লাবিত হলো তার মুখমন্ডল। প্রস্থান করে বিভীষিকাময় সেই স্থান। নায়েলের বাবা সবটা শুনে নীরব রইলেন। পিউলীর চোখে কৌতূহল। তার কৌতূহল দমাতে হেসে ওঠে নায়েল। ক্ষীণ স্বরে বলল—

“চলো পিউ।”

নওশাদ সাহেব সন্ধানী চোখে চেয়ে বললেন—

“আজও কি পিউলীকে অফিসে নিয়ে যাবে?”

নায়েল সহজ গলায় প্রত্যুক্তি করে—

“জি বাবা।”

“রোজ রোজ ওকে অফিসে নিলে তোমার কাজের ক্ষতি হবে। তাছাড়া আজ দুই মাস হতে চলল পিউলী স্কুলে যাচ্ছে না।”

নায়েলের চোয়াল শক্ত করে বিক্ষিপ্ত গলায় বলল—

“বেঁচে থাকলে আমার মেয়ে অনেক পড়তে পারবে। আপাতত স্কুলে না গেলে ওর বড়ো কোনো ক্ষতি হবে না। কাম পিউ।”

বাবার হাত ধরে গুটিগুটি পায়ে চলতে থাকে পিউলী। তার উচ্ছ্বাস আকাশ ছোঁয়া। সারাদিন বাবার সাথেই কাটে তার। তবে আগে এমনটা ছিল না। কাউচে বসলেন নওশাদ সাহেব। তার বুক চিরে বেরিয়ে এলো তীব্র দীর্ঘশ্বাস। সায়েরা গনগনে চোখে চেয়ে আছেন। নওশাদ সাহেবের কাছে এসে খেঁমটি মেরে বললেন—

“বোনের মেয়েকে নিয়ে এমন পাগলামি না করলে কী নয় নায়েলের? একটা অ্যাকসিডেন্ট-ই হয়েছে। এইটা নিয়ে এত চিন্তা করার কী!”

নওশাদ সাহেব শান্ত চোখে চেয়ে রইলেন। তার মেয়ে নিহিতার মৃত্যুর পর নিজের ভাগ্নীকে বাবার স্নেহে আগলে রেখেছে নায়েল। সে স্নেহে সামান্য ব্যবচ্ছেদ মানতে নারাজ নায়েল। তার ধারণা কেউ পিউলীকে মারতে চায় যার দরুণ ওই অ্যাকসিডিন্ট সংঘটিত হয়েছে।
,
,
,
হৃতির গালে চপাট করে এক চড় বসিয়ে দিলেন সায়েরা। রাগে ফেটে পড়ে বললেন—

“একটা ছোটো বাচ্চা মেয়েকে বশ করতে পারলি না। আর ওই নায়েলটাকেও না? কী পারিস তুই?”

হৃতি ঝমঝমিয়ে কেঁদে বুক ভাসায়। আর্দ্র গলায় বলল—

“আমার কী দোষ? আমি কী করব? নায়েল কখনো আমার দিকে এগিয়ে আসেনি।”

“আসেনি তো তুই যেতে পারলি না? প্রথমে ওই লুবানা, এখন আবার এই অর্হিতা। লুবানার সাথে বিয়েটা হতে হতে হলো না। আর অর্হিতাকে তো বিয়ে করেই নিয়ে এসেছে। কাউকে জানালো না পর্যন্ত! এই ছেলে বহুত ধুরন্ধর !”

হৃতি একনাগাড়ে কেঁদেই যাচ্ছে। সায়েরা খুব করে চেয়েছেন তার বোনের মেয়েকে নায়েলের সাথে বিয়ে দিয়ে এই বাড়িতে রেখে দিতে। মেয়েটা অনেক সহজ -সরল। তিল থেকে তাল করার জো নেই তার। পড়ালেখা আর রান্নাবান্না ছাড়া কোনো কিছুতেই তার পদার্পন নেই। মেয়েটার এই বোকামির জন্যই সায়েরা চিন্তিত! কোথায় গোচাবে একে?
,
,
,
বারান্দায় দাঁড়িয়ে নায়েলের গাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে অর্হিতা। পিউলীকে গাড়িতে বসিয়েছে ড্রাইভিং সিটের পাশেই। আজ তমাল নেই। বাসায় আরও একটা গাড়ি আছে। মূলত নায়েল নিজের গাড়ি নিজেই ড্রাইভ করে যতক্ষন না সেখানে অন্যকারো প্রয়োজন পড়ে। হতাশ শ্বাস ফেলে অর্হিতা। তার ভাগ্যেই এসব হওয়ার ছিল?

নায়েলকে অপছন্দ করার কিছু নেই। লোকটা যথেষ্ট মার্জিত আর সুশীল। বিয়ের আগে যতবার তার সাথে দেখা হয়েছে নায়েলের ব্যবহার তাকে বারবার তাকে নিয়ে ভাবতে বাধ্য করেছে। কিন্তু অর্হিতা এখন কোনো মতেই বিয়ের জন্য প্রস্তুত ছিল না। তার উপর একটা বাচ্চাকে সামলানো তার কর্ম নয়। সে পড়তে চেয়েছে। নিজেকে গড়তে চেয়েছে। তাই বিয়ের ব্যপারে অনীহা। পিউলী মেয়েটাকে বড্ড মায়া হয় তার। মেয়েটা মামুনি মামুনি বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলে। কিন্তু নায়েলের কাজটা তার মোটেও পছন্দ হয়নি। কেন টাকার বিনিময়ে তাকে কিনে নেওয়া হবে? সে কি কোনো পন্য?
না। তাহলে?

অর্নিশ এতটা লোভী অর্হিতা ভাবতে পারেনি। টাকার জন্য বোনকে বিক্রি করে দেবে? এতটা বোঝা সে?

চোখ ভরে আসে অর্হিতার। ভেবে পায় না কী করবে সে? বিয়ে তো বারবার হয় না। আর যা হয়ে গেছে তা সে চেয়েও অস্বীকার করতে পারবে না। কিন্তু সে পন্য নয়।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here