জঠর পর্বঃ৬

0
1912

#জঠর
#পর্বঃ৬
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

বুকের খাঁচায় দীর্ঘশ্বাস জমিয়ে ডাইনিং টেবিলে এসে বসে অর্হিতা। খিদেয় পেটের নাড়িভুঁড়ি পেঁচিয়ে যাচ্ছে। যুবা সার্ভেন্ট কলরব এসে অর্হিতাকে খাবার সার্ভ করে। অর্হিতা নাক কুঁচকায়। এত দামী খাবার খাওয়ার অভ্যাস তার নেই। মৃদু গলায় কলরবকে উদ্দেশ্য করে বলল—

“আমাকে এই জুস, টুস দিতে হবে না। দুটো পরোটা আর একটা ডিম ভেজে দিলেই হবে। তারা বুঝি এসব খায় না? ও বড়োলোক তো তাই হয়তো। আমার আবার এসবেই পেটভর্তি হয়। আপনি আমার জন্য এসব-ই নিয়ে আসুন।”

কলরব অপ্রস্তুত চোখে তাকাল। টেবিল ভর্তি খাবার থাকার পরও আবার বায়না! তবে সে তা পালন করতে বাধ্য। কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো সায়েরা। জোরালো গলায় বলে ওঠেন তিনি—

“অর্ডার তো এমনভাবে করছ যেন রেস্টুরেন্টে খেতে এসেছ? ”

অর্হিতা অগাহ্য চোখে তাকাল। স্লিভলেস ব্লাউজের সাথে গাঢ় কমলা রঙের মিহি জর্জেটের শাড়ি পরেছে সায়েরা। অর্হিতা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইল। মহিলা যথেষ্ট সুন্দরী বলা চলে! এই বয়সেও চামড়া কুজ নেই। কেমন টানটান ভাব! চোখগুলোও মাশা আল্লাহ! বয়স অনুসারে শরীরের মেদ বাড়েনি। কিন্তু এখন তার কাছে সায়েরাকে বাংলা ছবির ভিলেন রাণি রিনা খান মনে হচ্ছে।

অর্হিতা সম্মানের সাথে বলল—

“আপনি কি আমাকে কিছু বললেন?”

সায়েরা রোষভরা গলায় বলল—

“তোমাকেই বলছি। অর্ডার তো এমনভাবে করছ যেন এই বাড়ি মালকিন তুমি?”

অর্হিতা ভ্রূকুটি করে। চোখের কোণ ক্ষীণ করে বলল—

“কেন? আপনাদের বাড়ির মালকিন বুঝি দুটো পরোটা আর ডিম ভাজি খায়? আমার মামার অবশ্য এত টাকা পয়সা নেই। তবুও রোজ সকালে মামি দুটো সেদ্ধ ডিম, চারটে পরোটা আর একগ্লাস দুধ খায়। ”

যারপরনাই অপমানবোধ করল সায়েরা। খনখনে গলায় বললেন—

“কী বলতে চাও তুমি?”

“কিছু না। তবে আমি যতটুকু শুনেছি আপনি মি.টাকার কুমিরের সৎ মা! তবে আমার কেন জানি আপনাকে তার বায়োলজিক্যাল মাদার মনে হচ্ছে। স্বভাবে কী মিল! তবে কথায় আছে না-” সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে।”

সায়েরা রাগে গজগজ করছে। তীক্ষ্ম,জ্বলন্ত চোখে চেয়ে শ্বাসভারী করে বললেন—

“বেয়াদব মেয়ে! বড়দের মুখে মুখে তর্ক! এই শিক্ষা দিয়েছে তোমার পরিবার তোমাকে?”

অর্হিতা হেয়ালি হাসল। কটাক্ষপূর্ণ গলায় বলল—

“আমার তো বাবা-মা ই নেই। শিক্ষা পাবো কোথা থেকে? কিন্তু আপনাদের ছেলের তো বাবা, মা সবই আছে। তবুও আদিম মানুষের মতো আচরণ।”

রাগে উৎকন্ঠিত হয়ে অর্হিতার গালে চড় মারতে গেলেই সায়েরার হাত আটকে ধরে নওশাদ সাহেব। ক্ষুব্ধ চোখে চেয়ে শক্ত গলায় বললেন—

“ঘরে যাও সায়েরা। দ্বিতীয়বার যেন এই ভুল না হয়।”

ফুঁসতে থাকে সায়েরা। গনগনে রাগে জলের ধারা বইয়ে নিজ কক্ষের পানে হাঁটা ধরলেন।

নওশাদ সাহেবের ব্রীড়াময় চাহনি। অস্বস্তি ঘিরে ধরল তাকে। প্রথমে নায়েল, এখন আবার সায়েরা! ভাবতে পারছেন না তিনি। লজ্জিত গলায় বললেন—

“তুমি কিছু মনে করো না মা। তোমার যা খেতে ইচ্ছে করবে ওদেরকে বলে দিয়ো। কোনো সংকোচ করো না।”

অর্হিতা মুক্ত শ্বাস ফেলল। সশব্দে বলে উঠে—

“ধন্যবাদ। তবে আদৌ কী আমার সে অধিকার আছে?”

নওশাদ সাহেব বিমূঢ় চোখে চাইলেন। পরক্ষনেই চাহনিতে টেনে আনলেন সরলতা। বললেন—

” আমার ছেলেটা ততটা খারাপ নয়। একটা ভুল করে ফেলেছে। তোমার সাথে ও যা করেছে এর শাস্তি তুমি ওকে দিতে পারো। তাতে আমার আপত্তি নেই। নায়েল নিজেও তোমার কাছে তা স্বীকার করেছে। কিন্তু,,, কিন্তু পিউলীর কোনো দোষ নেই এতে। ও তোমাকে মা মেনে নিয়েছে। একজন বাবা হয়ে আমি কখনো আমার মেয়ের সাথে একটা বিবাহিত ছেলের বিয়ে দেবো না। তোমার মতামতকে আমি পূর্ণ সাপোর্ট করি। কিন্তু জীবন তো সহজ -সরল নয় মা। ঘূর্ণায়মান পৃথিবীর মতো আমাদের এই ক্ষণস্থায়ী জীবনটাও গোলকধাঁধা। তার এপিঠ -ওপিঠ, দুপিঠ-ই আমাদের ভাবনার বাইরে। যা চাই তা ঘটে না। কিন্তু যা চাই না তাই ঘটে যায় অবিলম্বে। ঘটে যাওয়া দারুন ঘটনা বা দূর্ঘটনা দুটোই আমাদের ওপর ন্যাস্ত। আমরা তাকে কোনভাবে গ্রহন করব। কারো কাছে যা সুখকর, আবার কারো কাছে তা দুঃখজনক। এই যে বর্ষা এলেই প্রকৃতি সাজে নতুন সাজে। চারদিকে অথৈ জলে ক্লান্ত, শ্রান্ত ধরণীতে নেমে আসে নব যৌবনা প্রাণের জোয়ার! কিন্তু এই বর্ষাই আবার দিন আনে দিন খায় মানুষের জন্য প্রাণনাশক। আমরা চেয়েও অনেক কিছু বদলাতে পারি না। মানিয়ে নিতে হয়। কিন্তু তা সহ্যের সীমার বাইরে নয়। তোমাকে জোর করার কেউ নেই। তুমি যথেষ্ট বুদ্ধিমতী। তোমার যা ঠিক মনে হবে তাই করবে।”

অর্হিতা মনোযোগ সহকারে সব শুনল। কিন্তু কোনো রা করল না। নওশাদ সাহেব বাড়ির বাইরে চলে গেলেন। অর্হিতার খিদে মরে গেল। চপল পদযুগল বাড়াতে লাগল নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে।
,
,
,
ডিভানের উপর বুক লাগিয়ে শুয়ে আছে পিউলী। দুই হাতের কনুই ভেঙে ডিভানের সাথে ঠেকিয়ে চিবুকের নিচে দিয়ে রেখেছে। গোল গোলে চোখে চেয়ে আছে সামনে রাখা ল্যাপটপের স্ক্রিনে। ছোটো ছোটো দাঁত বের করে খিলখিলিয়ে হেসে যাচ্ছে পিউলী। স্ক্রিনে তখন মটু-পাতলু কার্টুন দৃশ্যমান।

নিজের চেয়ার থেকে পিউলীর দিকে তাকিয়েই মুচকি হাসে নায়েল। নায়েল আর নিহিতা জমজ ভাইবোন। ভার্সিটিতে পড়াকালীন সেখানকার এক ছাত্রলীগের নেতার সাথে সখ্য গড়ে ওঠে নিহিতার। পরিচয় থেকে পরিণয় ঘটতে বেশি সময় লাগেনি। কিন্তু হঠাৎ করেই একদিন শশুড়বাড়ি থেকে ফিরে আসে নিহিতা। তখন সে সন্তানসম্ভবা। মাস দুয়েক যাওআর পরও যখন ও বাড়ির কেউ খোঁজ নিল না তখন নওশাদ সাহেব শঙ্কিত হলেন। তিনি খবর পাঠালেন। কিন্তু ও বাড়ির মানুষ নিহিতার উপর আরোপ লাগাল। নিহিতার স্বামী মাহিম জানায় নিহিতার অন্য কারো সাথে সম্পর্ক আছে যা সে নিজের চোখে দেখেছে। তার কাছে উপযুক্ত প্রমাণও আছে। সব প্রমাণ- ই নিহিতার বিপরীত। যে ছেলেটাকে নিয়ে নিহিতাকে সন্দেহ করা হয় তাকে অনেক খুঁজেছে নায়েল। কিন্তু পায়নি। কারণ, তাকে শুধু নিহিতাই দেখেছে। কোনো ছবিতেই ছেলেটির চেহারা দৃশ্যমান নয়। নিহিতা বলেছে ছেলেটার সাথে তার এমনিতে জানাশোনা ছিল। এর চেয়ে বেশি কিছু না। অনেক ঝামেলার পর ডিবোর্স হয়ে যায় তাদের। কিন্তু নিহিতা তখন প্রেগন্যান্ট। সে হিসেবে আইনত ভিবোর্স গ্রান্টেড নয়। কিন্তু সন্তানের কথা ও বাড়ির কাউকে জানানো হয়নি। মাস চারেক পর মাহিম আবার বিয়ে করে। পিউলীর জন্মের ছয় মাস পর অ্যাকসিডেন্টে মারা যায় নিহিতা। ভড়কে যায় নায়েল। তার মায়ের মৃত্যুও হয়েছিল। কার অ্যাকসিডেন্টে। নিহিতারও। একবার নায়েলের মনে হয়েছিল হয়তো কাজটা মাহিম করছে। ঝামেলা শেষ করতে। কিন্তু পরক্ষণেই সে ভেবেছে, মাহিম তো জানেই না এই সন্তানের কথা! পিউলীকে বাবার স্নেহেই প্রতিপালন করে নায়েল। তাকে বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকে নওশাদ সাহেব। আপত্তি করল না সে। লুবানার সাথে বিয়ে ঠিক হতেই তাদেরকে সবটা জানানো হয়। শুধু অনুরোধ করে, পিউলীকে যেন কখনো এইটা না বলা হয় যে নায়েল পিউলীর বায়োলজিক্যাল ফাদার নয়। বিয়ে ঠিক হওয়ার কিছুদিন পরেই সেই মর্মান্তিক অ্যাকসিডেন্ট। নায়েল ড্যাম শিউর কেউ ইচ্ছে করে এসব করছে। পিউলী হয়তো তাদের টার্গেট। কিন্তু কেন?

নায়েলের ভাবনা কাটে তার মুঠোফোনের ভাইব্রেশনে। ওপাশ থেকে কী বলল কে জানে! নায়েল উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল। পিউলীর কাছে গিয়ে মৃদু গলায় বলল—

“পিউ, পাপা বাইরে যাচ্ছি। তুমি এখানেই থাকো। আমি শ্যামল আঙ্কলকে বলে যাচ্ছি। কিছু লাগলে তাকে বলো।”

“ওকে পাপা।”

“আর এখান থেকে বের হবে না। পাপা একটু পরেই ফিরে আসছি।”

“ওকে।”
,
,
,
ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের ডাক্তাররা ব্যস্ত। আচমকা লুবানার অবস্থার অবনতি ঘটেছে। তাকে লাইফসাপোর্টে রাখা হয়েছে। ডাক্তার আজমল সেখান থেকে বের হতেই তাড়া দিয়ে জিজ্ঞেস করল নায়েল—

“এখন কী অবস্থা?”

ডাক্তার আজমল জ্যোতিহীন গলায় বলল—

“দেখুন, প্রেশেন্টের অবস্থা খুবই ক্রিটিক্যাল। আমরা আপাতত আপনাকে কোনো আশা দিতে পারছি না। বাকিটা ভাগ্য!”

করুণ শ্বাস ফেললেন তিনি। নায়েল বাইরে থেকে গ্লাস গলিয়ে একবার ভেতরে তাকাল। মেয়েটার অবস্থার জন্য হয়তো সে ই দায়ী!

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here