#জঠর
#পর্বঃ৯
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
“বিদীর্ণ করে মরুছায়া
নেমেছে দেখো জলফোয়ারা
তৃষ্ণার্ত বুকের একক চাওয়া
মিটে যাক সব ক্ষুৎপিপাসা।”
দরজা খুলে ভেতরে প্রবিষ্ট হতে হতে নিজের কণ্ঠের আলোড়নে সতর্ক করে অর্হিতাকে নায়েল। সরোষে তার দিকে চাইল অর্হিতা। ঠোঁটের কোণে বিদ্যুৎ বেগে ছোট্ট করে হাসল নায়েল। তার হাতে খাবারের ট্রে। গুটিগুটি পায়ে বাবার সাথে উপস্থিত পিউলী। মুখে তার ঝলমলে সূর্যের বিকীর্ণ কিরণের হাসি। যেন ক্ষণপলেই বিঁধে যাবে তা যে কারো চিত্তে !
পিউলী দেরি করে না। ব্যস্ত পায়ে বিছানায় উঠে অর্হিতার পাশে বসে। মৃদুমধুর গলায় বলল—
“মামুনি খিদে পেয়েছে তোমার?”
অর্হিতা বাঁকা চোখে তাকাল। কোনো সদুত্তর করল না। নায়েল খাবারের ট্রে টা বেডসাইড টেবিলের উপর রাখে। একটা টুল টেনে নিয়ে অর্হিতার পাশ ঘেঁষে বসে। অর্হিতার হাতে তখন “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের” “শেষের কবিতা” উপন্যাস। সেদিকে চোখে পড়তেই গরগর করে বলে উঠে নায়েল—
” হে অচেনা,
দিন যায়, সন্ধ্যা হয়, সময় রবে না,-
তীব্র আকস্মিক
বাধা বন্ধ ছিন্ন করি দিক,
তোমারে চেনার অগ্নি দীপ্তশিখা উঠুক উজ্জলি,
দিব তাহে জীবন অঞ্জলি।”
—-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
অর্হিতা ফ্যাকাশে দৃষ্টিতে তাকায়। যেন কথাগুলো তাকে উদ্দেশ্যে করেই বলা! সন্ধানী গলায় বলল—
” আপনি “শেষের কবিতা পড়েছেন?”
নায়েল স্মিত হাসল। পেলব গলায় বলল—
“দারুণ উপন্যাস। কয়েকবার পড়েছি। লাবণ্যর প্রেমে যতবার পড়েছি তার চেয়ে মনোমুদ্ধকর ছিল অমিত। পড়ুন।”
অর্হিতা ভাবুক গলায় বলল—
” আর কী পড়েছেন?”
“তা আপাতত মনে পড়ছে না।”
অর্হিতা ছোট্ট শ্বাস ফেলল। পরক্ষণেই মনে পড়ল তাকে ঘরবন্ধি করে রেখে যাওয়ার কথা। খাবারের ট্রেতে নজর বুলিয়ে বলল—
” সারা সকাল ঘরে আটকে রেখে এখন এসেছেন আদিখ্যেতা দেখাতে!”
নায়েল মৃদু গলায় বলল—
“আপনিও জানেন, আমি যা করেছি আপনার ভালোর জন্য করেছি।”
“ভাইয়া কেন এসেছিল সেদিন?”
অর্হিতার প্রশ্নে কড়া হলো নায়েলের চাহনি। ঠান্ডা গলায় বলল—
“ফ্ল্যাট টা পেতে আরও তিনলাখ টাকার প্রয়োজন। সেজন্য এসেছিল।”
“আপনি কেন ওকে টাকা দিয়েছিলেন?”
নায়েল গম্ভীর গলায় বলল—
“আপনি আমাকে বাধ্য করেছেন এমনটা করতে। সব তো ঠিক ছিল! বেঁকে বসলেন কেন আপনি?”
অর্হিতা সচল চোখে চেয়ে রয়। নায়েল যথেষ্ট চেষ্টা করেছে এই বিয়েতে রাজি করাতে অর্হিতাকে। সব জেনে অর্হিতা রাজিও হয়েছিল। কিন্তু যখন জানতে পারে অর্নিশ আশা করে বসে আছে বিবাহিত ছেলের সাথে বোনের বিয়ে দিয়ে টাকা হাতাবে, তখনই বেঁকে বসে অর্হিতা। অর্হিতা তখন চেয়েছে সে এখন বিয়ে করবে না। মাস্টার্স পড়ার পাশাপাশি কোনো জব খুঁজে নেবে যেন ভাইয়ের ওপর আর নির্ভর করতে না হয়। কিন্তু সব গন্ডগোল করে ফেলে নায়েল। অর্নিশকে মোটা অঙ্কের টাকা দেওয়ার নায়েলের প্রতি বিতৃষ্ণা তৈরি হয় অর্হিতার।
অর্হিতা ফুঁসে উঠে বলল—
“তাই বলে আপনি ভাইয়াকে টাকা দেবেন?”
নায়েল ক্লান্ত শ্বাস ফেলল। অর্হিতার আরেকটু কাছে চেপে এসে চাপা স্বরে বলল—
“আমি টাকা না দিলে এখন কোনো অর্ধবুড়োর বিছানায় তন্দ্রা-বিলাস করতেন।”
অর্হিতা চমকিত চোখে তাকিয়ে বলল—
“কী বললেন?”
“পরে বলছি। খেয়ে নিন এখন। পিউ আপনার জন্য না খেয়ে আছে।”
অর্হিতা ক্ষুণ্ণ চোখে তাকিয়ে বলল—
“কেন?”
“বলল, মামুনি না খেলে সেও খাবে না। খেয়ে নিন আপনি। আর আপনার সব প্রশ্নের উত্তর পাবেন। যতটা খারাপ ভাবছেন ততটা খারাপ নই আমি। নিরুপায়। কাম পিউ।”
নায়েলের প্রতিটি মুখ নিঃসৃত শব্দ শ্রবণ করে অর্হিতা। কোনোরূপ ভাবাবেশ ছাড়া বলল—
“পিউ এখানেই থাক। আপনি যান।”
নায়েল পিউলীর দিকে তাকাতেই বিশ্ব জয়ের হাসি দেখতে পেল সে মেয়ের আদুরে দুই চোখে। চোখে হেসে সম্মতি দিলো নায়েল।
পা গুটিয়ে খাবারের ট্রে টা বিছানার উপর রাখল অর্হিতা। বাটি থেকে প্লেটে খাবার বেড়ে নিয়ে পিউলীর দিকে প্রশ্ন ছুড়ে—
“খাওনি কেন তুমি?”
“খেয়েছি তো। হি হি ।”
অর্হিতা কপালে ভাঁজ তোলে। গিরগিটি মিথ্যে বলল!
“তাহলে তোমার বাবা কেন বলল খাওনি?”
“আমি জুস খেয়েছি। অাইসক্রীমও খেয়েছি।”
অর্হিতা গোল গোলো চোখে বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে বলল—
” এগুলো খাওয়া ভালো না।”
“পাপা বলেছে।”
“তাহলে খেয়েছ কেন?”
পিউলী মাথা নিচু করে। পায়ের আঙুলের ভাঁজে হাতের আঙুল ঢুকিয়ে বলল—
” আমার খিদে পেয়েছে।”
অর্হিতার ভীষণ রাগ হলো। মেয়েটাও বাবার মতো। জেদি!
অর্হিতা নিজের মুখে খাবার দিতে গিয়েও থেমে যায়। পিউলী কেমন কাতর চোখে চেয়ে আছে। নিশ্চয়ই মেয়েটার খিদে পেয়েছে!
“হা করো।”
“হা।”
মাছের মতো গোল করে হা করে পিউলী। অর্হিতা মুচকি হাসে। কী করে রেগে থাকবে এই মেয়েটার সাথে সে?
অর্হিতা চাপা গলায় প্রশ্ন করে—
“পিউ, তোমার মা কোথায়?”
পিউলী বোধহয় অবাস্তব কিছু শুনল। সে ড্যাবড্যাবে চোখে চেয়ে বলল—
“তুমি ই তো আমার মামুনি।”
অর্হিতা লম্বা শ্বাস ফেলল। আজ আর তার রাগ হলো না। নরম গলায় বলল—
“আমি নই। তোমার আগের মামুনি কোথায়?”
“ও নিহি মামুনি! নিহি মামুনি তো আকাশের তারা হয়ে গেছে।”
“কী করে?”
অর্হিতার আজব প্রশ্নের জবাব ছিল পিউলীর কাছে। বলল—
” আল্লাহ নিয়ে গেছে। পাপা বলেছে মামুনিকে আল্লাহ নিয়ে গেছে। আমি তো ছোটো ছিলাম। আমি মামুনিকে বেশি ভালোবাসিনি। আল্লাহ্ বেশি ভালো বেসেছে। আর আল্লাহ যাকে বেশি ভালোবাসে তাকে আকাশের তারা বানিয়ে দেয়। তুমি তারা হবে না তো? আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসবো মামুনি। এত্ত বেশি ভালোবাসবো! তুমি যেয়ো না আমাকে ছেড়ে। তুমি তারা হয়ো না। তাহলে পাপা আবার কাঁদবে। আমিও কাঁদবো। অনেক কাঁদবো। আমিও তারা হয়ে যাব।”
ঠোঁট ভেঙে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতে থাকে পিউলী। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসে অর্হিতার। তটস্থ হয়ে পিউলীকে জড়িয়ে ধরে অপ্রস্তুত গলায় বলল—
“এই মেয়ে চুপ করো। চুপ করো বলছি। আরে আমি কোথাও যাচ্ছি না। ওই উপরওয়ালা আমাকে এত ভালোবাসে না। বাসলে আরো আগেই নিয়ে যেত। রেখে যেত না আমাকে।”
“আমি তোমাকে ভালোবাসবো। পাপাও ভালোবাসবে।”
“আচ্ছা, আচ্ছা। থামো এখন। খেয়ে নাও। খেয়ে দুজন একসাথে বসে কাঁদব।”
পিউলী হাতের উলটা পাশ দিয়ে নাক ঘষতে থাকে।
,
,
,
নীলাভ্রের দিকে একমনে চেয়ে আছে নায়েল। শীতল সমীরণ তার পরনের পাতলা টিশার্ট দুলিয়ে যাচ্ছে। নিজের ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে উদাসচিত্তে ভেবে চলছে, সবটা জানার পর অর্হিতার রিয়েকশন কী হবে? পিউলীকে মেনে নিতে পারবে নিজের সন্তানের মতো করে? নায়েল চায় না পিউলী কখনো জানতে পারে যাকে সে বাবা বলে জানে সে তার জন্মদাতা নয়। নিহিতা শুধু তার বোন ছিল না, তার শরীরের অর্ধাংশ ছিল। মায়ের জঠরে তো পাশাপাশি বেড়ে উঠেছে তারা। তাহলে আজ কেন বিচ্ছিন্ন?
এই কী শুধু জগতের নিয়ম না-কী কারো সংগোপনে করা মায়াজাল?
চলবে,,,