জান্নাহ্ “পর্বঃ১৩

0
4419

#জান্নাহ্
#পর্বঃ১৩
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

“পিয়া বিনা জাগে নারে
নারে জিয়া লাগে নারে
পিয়া বিনা জিয়া লাগে না….

জিয়া বিনা জাগে নারে
নারে জিয়া লাগে নারে
পিয়া বিনা জিয়া লাগে না…

আমি হব রাত আর তুই হবি চাঁদ
জোছনায় ঘর আমাদের
তুই হলে রোদ আমি রংধনু হই…
ছিল সে শহর আমাদের…

ভুলে যেতাম কোলাহল
বুঝে নিতাম সবই বল
ছিল রোজের চলাচল আমাদের…

আমি হব রাত আর তম….।।

গগন জুড়ে রূপালি চাঁদ।নিকষকৃষ্ণ আকাশে তার রাজ।দু এক টা তারার উজ্জ্বল ঝলকানি।মৃদু ঠান্ডা হাওয়া।নিস্তব্ধ চারপাশ।জানালার পাশের খাম্বা আকৃতির কাঁঠাল গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে মিটমিটে চাঁদের আলো।বিছানার উপর দুই হাত মাথার নিচে দিয়ে শুয়ে আছে সারহান।নিথর,নিশ্চল জান্নাহ্।অনুভূতিহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সারহানের দিকে।ক্ষীন শ্বাস নিচ্ছে সে অত্যন্ত সন্তর্পনে।চোখের পাল্লা নৈঃশব্দে উঠানামা করছে।সারহানের গানে তার দিকেই তাকিয়ে আছে।সারহান উঠে বসে।জান্নাহ্ এর গলার কাছে মুখ নিয়ে অধর ছোঁয়াতে থাকে।তার শুষ্ক ঠোঁটের ছোঁয়াতেই জান্নাহ্ এর মস্তিষ্ক এলোমেলো হয়ে যায়।শিউরে উঠে লোমকূপ।দূর্বল হাতে ধাক্কা মারে সারহানকে।বেখেয়ালি সারহান নিজের উপর দৃঢ়তা না রাখার কারণে বিছানায় এলিয়ে পড়ে।

হঠাৎ দমকা বাতাসে পটপট করে উড়ে যাওয়া পর্দার ফাঁক গলিয়ে রূপালি চাঁদের পূর্ণ আলো পড়ে সারহানের মুখে।সারহান স্মিত হাসে।তার সেই হাসিতে ঝনঝনিয়ে উঠে জান্নাহ্ এর অন্তরাত্না।প্রগাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে।সারহান কিছুক্ষন থেমে ফিচেল গলায় বললো–

“আমি ব্যর্থ।বিয়ে হয়েছে আট মাস।আপনি এখনো প্রথম দিনের মতো।ছোঁয়া লাগতেই আঁতকে উঠেন।এতোদিনেও আপনার টিটিলেশন গেলো না।”

জান্নাহ্ কিছু বললো না।উদাস হয়ে বসে রইলো।বিষন্ন চোখ জোড়া ভাবলেশহীন।ব্যস্ত ঘড়ির কাটা অবিরাম চলছে।কিন্তু জান্নাহ্ এর চোখে ঘুম নেই।মেডিসিন খাইয়ে দিয়েছে সারহান তারপরও ঘুমায় নি জান্নাহ্।বাধ্য হয়ে সারহানও জেগে আছে তার সাথে।জান্নাহ্ এর চুলকানি কমে এসেছে।ফোলা ভাবটাও কমেছে।কিন্তু এখনো অসহ্যকর ব্যথা।কিছুক্ষন পরপরই হেচকি তুলে কেঁদে উঠে জান্নাহ্।আবার চুপ হয়ে যায়।সারহান শান্ত,সাবলীল।তার মধ্যে কোনো উদ্দীপনা নেই,নেই কোন আক্ষেপ,ভয়, সংকোচ।

আচমকা জান্নাহ্ কেঁদে উঠে।সারহান ব্যস্ত হয়ে উঠে বসে।জান্নাহ্ এর চোখ মুছে সরল গলায় বললো–

“শিষষ
চুপ।একদম কাঁদবেন না।আমার রজনীগন্ধার চোখের পানি এতো সস্তা নয়।”

জান্নাহ্ এর অক্ষিযুগল মানলো না।ঝমঝমিয়ে ঝরতে লাগলো।আর্দ্র গলায় বললো–

“সারহান,ম্যা….।”

সারহান নিজের অধর চেপে ধরে জান্নাহ্ এর ওষ্ঠাধরে।দীর্ঘসময় নিয়ে চুমু খায় তার ঠোঁটে।মোলায়েম গলায় বললো–

“ভুলে যান সব।আল্লাহ্ পাক যার মৃত্যু যেভাবে লিখেছে সেভাবেই হবে।তা ঠেকানোর ক্ষমতা কারো নেই।”

জান্নাহ্ নাক টেনে টেনে ধরা গলায় বললো–

“কিন্তু..।”

সারহান পুরোদস্তুর ঝুঁকে যায় জান্নাহ্ এর দিকে।দু হাতের অঞ্জলিতে তার মুখ নিয়ে কপালে চুমু খেয়ে বললো–

“আর কতো জ্বালাবেন আমাকে?একটুতো শান্তি দিলেন না।”

জান্নাহ্ মলিন চোখ দুটো অবনত করে।জান্নাহ্কে সারহান মেঘনোলিয়ার লাশ দেখতে দেয়নি।কারণ এতে তার অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।কিন্তু যখন থেকে মেঘনোলিয়ার কথা শুনেছে থেমে থেমে একটু পরপর হাউমাউ করে কেঁদে উঠে জান্নাহ্।জান্নাহ্ এর শরীরে হাত বুলায় সারহান।বিরসমুখে বললো–

“কী অবস্থা করেছেন!নিজেকে দেখেছেন?

জান্নাহ্ থেমে থেমে হেচকি তুলছে।পুরো ঘরে অন্ধকার।চাঁদের আলোয় নিজেকে দেখে জান্নাহ্।বিতৃষ্ণা তার ভাবাবেশ।আহত গলায় বললো–

“আঙুল ফুলে কলাগাছ।”

আওয়াজ করে হেসে উঠে সারহান।দুষ্টমিমিশ্রিত গলায় বললো–

“শরীর ফুলে ভেলা।”

জান্নাহ্ সন্দিগ্ধ চোখে তাকায়।সারহান রসালো গলায় বললো–

“আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়।আপনার তো পুরো শরীর ফুলে গেছে।তা দিয়ে ভেলা বানাবো এখন আমি।”

লাজুক হাসে জান্নাহ্।সারহান জান্নাহ্কে শুইয়ে দেয়।শাড়ি বদলে পাতলা একটা কামিজ পরেছে জান্নাহ্।শরীর জুড়ে অস্বস্তি।জান্নাহ্ এর বুকের উপর থেকে ওড়নাটা সরিয়ে দেয় সারহান।তিক্ত গরমে অ্যালার্জি আরো বেশি কষ্টদায়ক।অনবরত ঘুরতে থাকা ফ্যানের বাতাস যেনো বড্ড উত্তপ্ত।কিন্ত জান্নাহ্ এর এখন শীতলতা প্রয়োজন।জান্নাহ্ এর উপর হালকা ঝুঁকে নরম গলায় সারহান বললো–

“ঘুমানোর চেষ্টা করুন।ভালো লাগবে তাহলে।”

জান্নাহ্ বিষন্ন চোখে আহত গলায় বললো–

“ম্যামের সাথে এমন কেন হলো?

সারহান ঈষৎ রাগমিশ্রিত গলায় বললো–

“বললাম না আর না।একদম চুপ।ভুলে যান এইসব।”

সারহান থামলো।ব্যস্ত হয়ে আবার সন্দিহান গলায় বললো–

“ডক্টর ঘুমের ঔষধও দিয়েছে।তাও আপনার ঘুম আসছে না কেন!

জান্নাহ সরল দৃষ্টিতে তাকায়।সারহান বিগলিতে হেসে হিসহিসিয়ে বললো–

“দিলেন তো আমার পুরো সপ্তাহ টা নষ্ট করে।তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে উঠুন।”

সারহান গভীর চুমু খায় জান্নাহ্ এর গলায়।জান্নাহ্ নিরুত্তেজ।জান্নাহ্ এর পাশ থেকে বালিশ নিয়ে কাউচে সটান হয়ে শুইয়ে পড়ে সারহান।দমদমে গলায় বললো–

“ঘুমান রজনীগন্ধা।নাহলে কিন্তু ভালো হবে না।”

বুকের উপর একটি কুশন চেপে ধরে চোখ বুজে সারহান।সারহানের মানসলোকে ভেসে উঠে দুটো হাস্যোজ্জ্বল চোখ।যে বারবার ফিরে দেখছে তাকে।সারহান সেই অবস্থায় মৃদু হাসে।প্রশান্তিতে ছেয়ে যায় তার মন,মস্তিষ্ক।
জান্নাহ্ তাকিয়ে আছে সারহানের দিকে।লোকটাকে কখনো বুঝে উঠতে পারে না জান্নাহ্।মুহূর্তেই বজ্রকঠোর আবার পরক্ষনেই কুসুমকোমল।জান্নাহ চক্ষু মুদন করে।ঘড়ির কাটা তখন চারটার ঘরে।
,
,
,
মেঘনোলিয়াকে গভীরভাবে দেখছে সারহান।নরম তুলতুলে শরীরে এখন অজস্র সূঁচ সুতার টানাপোড়েন।বীভৎস তা।সারহানের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে ফরেনসিক ডক্টর ইরফান।চিন্তিত গলায় বললেন–

“মার্ডারার অত্যন্ত চালাক।”

সারহান সন্দিহান গলায় বললো–

“যেমন?

ইরফান মেঘনোলিয়ার গলার কাছ থেকে সাদা কাপড়টা সরিয়ে তার গলার ক্ষতটা দেখায়।স্বাভাবিক গলায় বললো–

“খুনি যেই ই হোক সার্জিক্যাল নাইফ ইউজে সে পারদর্শী।ভিক্টিমের গলার মাঝে এমনভাবে তা পুশ করা হয়েছে যাতে করে সে কোন আওয়াজ করতে না পারে।”

সারহান বিস্মিত গলায় বললো-

“তাহলে ডেথ?

ইরফান দৃঢ় গলায় বললো–

“এক্সেস ব্লিডিং।খুনি নাইফ কে ভেতরে ঢুকিয়ে টার্ন করে।এতে করে স্বরনালি ছিড়ে যায়।ভিক্টিম আওয়াজ করার টাইম পায় নি।কিন্তু ব্লিডিং এর কারনেই তার মৃত্যু ঘটে।”

সারহান নিশ্চুপ দৃষ্টিতে কিছুক্ষন ভাবলেশহীন হয়ে তাকিয়ে থাকে।কপালে চিন্তার ভাঁজ।কিন্ত তা প্রকাশ না করে সাবলীল গলায় বললো–

” আর কিছু?

ইরফান চকিতে বললো–

“ও হ্যাঁ।আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস।”

ইরফান একটা চিরকুট দেয়।ছোট্ট করে হাসে সারহান।সেই একই লেখা।সারহান কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না।সহজভাবে বের হয়ে আসে রুম থেকে।ওয়েটিং চেয়ারে বসে আছে জ্যাকি।মেঘনোলিয়ার হ্যাজবেন্ড।বিষন্ন,অবসাদগ্রস্ত।হাত দুটো দুই পায়ের মাঝে দিয়ে স্থির হয়ে বসে আছে।চুলগুলো এলোথেলো।সারহানকে বের হতে দেখেই ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায়।কম্পনরত গলায় বললো—

“মেএএএঘঘ…।”

আর কিছু বলতে পারলো না সে।কান্নায় ভেঙে পড়ে।দুই হাত দিয়ে চোখ চেপে ধরে ঠোঁট উল্টে নিজের কান্না থামানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে।দুই মাস নিরলস পরিশ্রম করে মেঘনোলিয়াকে বিয়ের জন্য রাজি করায় জ্যাকি।কিন্তু বিয়ের ছয় মাস না যেতেই সবকিছু শেষ।মেঘনোলিয়াকে ফিরিয়ে নেওয়ার অনেক চেষ্টা করে জ্যাকি।কিন্তু মেঘনোলিয়া কোনোভাবেই রাজি হয়নি।সারহানের প্রেমে মত্ত হয়ে জ্যাকির পবিত্র ভালোবাসাকে পায়ের তলে পিষে ফেলেছে।আজ তার এই করুণ পরিণতি তারই কর্মেরই ফল।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধীর পায়ে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে আসে সারহান।চোখে মুখে নির্লিপ্ততা।গাড়িতে বসে সারহান।তার দিকেই উন্মুখ হয়ে চেয়ে আছে শায়িখ।আজ সকালেই এসেছে সে।তাকে নিয়েই হসপিটালে আসে সারহান।উৎসুক গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে সারহান—

“স্যার,মেয়েটা কিন্তু ভাগ্যবতী।নাহলে তো আজ..।”

সারহানের শক্ত দৃষ্টিতে কথা গিলে নেয় শায়িখ।সারহান অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় বললো—

“জ্যাকি ছেলেটা ভালো ছিলো।”

শায়িখ ভাবুক নয়নে তাকিয়ে জিঙ্গেস করলো—

“কিন্তু স্যার যা হচ্ছে তা কিন্তু ভয়ংকর।আপনি কিছু বুঝতে পারছেন?

সারহান সস্মিত অধর জোড়া ছড়িয়ে বললো–

“মৃত্যু অমোঘ সত্য শায়িখ।জন্মিলেই মরিতে হয়।হয় আজ না হয় কাল।”

“কিন্তু ম্যাম?

সারহান ক্ষীপ্ত চোখে তাকায়।আত্নবিশ্বাসী সুরে বললো–

“আমি থাকতে তার ছায়াও কেউ মাড়াতে পারবে না।জান্নাহ্ সে।আমার রজনীগন্ধা।”

শায়িখ ঘাবড়ে যায়।তার স্যারের চোখে মুখে অদ্ভুত রহস্য।যার কূল কিনারা সে খুঁজে পাচ্ছে না।কিন্তু সে ভীত।নেক্সট কে?আর কতদিন চলবে এইসব?আদৌ এর শেষ কবে?

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here