জান্নাহ্ “পর্বঃ১৮

0
4489

#জান্নাহ্
#পর্বঃ১৮
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

সারা বিছানায় বই খাতা ছড়িয়ে বসে আছে জান্নাহ্।মাথাটা টনটন করছে।কিচ্ছু ঢুকছে না।রসায়নের যৌগমৌল পড়তে পড়তে ত্যানা ত্যানা জীবন।সাবানের যৌগ সংকেত,গ্লিসারিনের যৌগ সংকেত উফ!অসহ্যকর।রসহীন রসায়ন।এর চেয়ে পদার্থ ঢের ভালো।

গরমে উসখুস করছে জান্নাহ্ এর মস্তিষ্ক।ছড়ানো চুল টেনে উঁচু করে পনিটেল করে নেয়।গায়ের ওড়নাটা পাশে রেখে বিছানার উপর ঝুঁকে ইলেকট্রন বিন্যাসে মনোযোগ দেয়।চোখের সামনে যেনো হাইড্রোজেন,নাইট্রোজেন,ক্লোরিন ইত্যাদি হেঁটে হেঁটে চলছে।

“আহ্!

অস্ফুট আওয়াজ করে জান্নাহ্।কিলবিল করছে সবগুলো মাথার নিউরনে।কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছে না।বেজায় রাগ হচ্ছে জান্নাহ্ এর নিজের উপর।কেন যে সাইন্স নিয়ে পড়তে গেলো!অবশ্য সবটা তার বাবার ইচ্ছে পূরণের জন্য।রাফাত অবশ্য বলেছে ডক্টর বরের ডক্টর কনে প্রয়োজন।অন্যথা হলে চলবে না।ভাবতেই জান্নাহ্ এর ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠে অমসৃন হাসি।বিষন্নতায় ছেয়ে যায় তার দু’চোখ।জান্নাহ্ ভাবে সত্যিই কী বন্ধুত্বের চেয়ে বেশি কিছু ছিলো রাফাত আর তার মধ্যে?

“পরীমা,পরীমা,পরীমা।”

তিতির উচ্ছ্বাসিত গলার আওয়াজে সপ্রতিভ হয় জান্নাহ্।ঝুঁকে বসা থেকে উঠে বসে সে।তিতি দৌঁড়ে তটস্থ হয়ে বিছানায় উঠে।তিতির এমন ব্যস্ততায় জান্নাহ্ কিছু ভাবার সময়ই পায় না।তিতির চোখে মুখে খেলে যাচ্ছে অকৃত্তিম উচ্ছলতা।তার ছোট ছোট লম্বা পাঁপড়ি ওয়ালা চোখ দুটো হাসছে।দুই হাতে জান্নাহ্ এর গলা জড়িয়ে ধরে তার গালের সাথে মিশে থাকে।এই এক টুকরো সুখ যেনো জান্নাহ্ এর তপ্ত হৃদয়কে শীতল করার জন্য যথেষ্ট।প্রায় মিনিট খানেক জান্নাহ্ এর শরীরের উষ্ণতায় মিশে থাকে তিতি।তাকে কোলের মধ্যে নিয়ে বুকের সাথে মিশিয়ে নেয় জান্নাহ্।শান্তি পায় সে।তার খালি খালি বুকটা যেনো এক পসলা সুখে ভরে উঠে।তিতির ছোঁয়ায় মাতৃত্বের স্বাদ পায় জান্নাহ্।মাঝে মাঝে তিতির কথায় সত্যিই জান্নাহ্ এর মা হতে ইচ্ছে হয়।একটা নরম মাংসপিন্ডকে নিজের জঠোরে ধারণ করার তীব্র বাসনা জন্মে।তাকে বুকে আগলে রাখতে ইচ্ছে হয়।ইচ্ছে হয় তার আর সারহানের অংশ নিয়ে আসতে ধরায়।
বিয়ের মাধ্যমে দুটি পরিবার,দুটি মানুষ একে অন্যের সত্তায় মেশে।কিন্তু তাদের এই সম্পর্কের ভীত শক্ত হয় যখন তাদের ভালোবাসার অস্তিত্ব তাদের ঘর আলো করে আসে।
তিতির দিকে গভীর আবেশে তাকায় জান্নাহ্।মাঝে মাঝে তার মন খারাপ হয়।কারণ তিতির বাম চোখের পাশের একটা কাটা দাগ।এমনটা জান্নাহ্ এর মায়ের ছিলো।তিতিকে দেখলেই জান্নাহ্ এর মায়ের কথা মনে পড়ে।শীতল নিঃশ্বাস ফেলে জান্নাহ্।হয়তো একেই ভয়ংকর নিয়তি বলে।

তিতির গালে জবরদস্ত একটা চুমু খেয়ে হেসে হেসে জিঙ্গেস করলো–

“আমার তিতিসোনার কী হয়েছে?

তিতি ফিক করে হেসে ভাঙা ভাঙা গলায় বললো–

“তুমি পড়ছো পরীমা?আই এম ছরি।”

জান্নাহ্ তিতির নরম গাল দুটো টিপে বললো–

“আমার মিষ্টি মা।ছরি না সরি।”

তিতি দৃঢ়তার সুরে বললো–

“আচ্ছা।”

জান্নাহ্ জোর হাতে তিতিকে পেছন থেকে জড়িয়ে তার গালের সাথে গাল লাগিয়ে বললো–

“কিছু বলবে আমার তিতি সোনা?

তিতি বারকয়েক মাথা ঝাঁকিয়ে বললো–

“হুম,হুম।”

“বলো।”

ফট করে উঠে দাঁড়ায় তিতি।জান্নাহ্ এর কানের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে কিছু একটা বললো।অনেক মজা নিয়ে হাসলো জান্নাহ্।চোখের পাতা প্রশ্বস্ত করে গালে হাত দিয়ে কপট বিস্ময় নিয়ে বললো–

“ওমা তাই নাকি!

“হুম,হুম।”

তিতি আবারো মাথা ঝাঁকায়।বিগলিত হাসে জান্নাহ্।সরব গলায় বললো—

“আচ্ছা আমার মা।দাঁড়াও।”

লাফিয়ে উঠে তিতি।দুই হাতে তালি মেরে বলতে থাকে—-

“ইয়েএএএ।”

চোখে হাসে জান্নাহ্।ড্রয়ার থেকে একটা ওড়না নিয়ে বিছানায় বসে।নিজের ওড়না আর বাড়তি ওড়নাটা দিয়ে তিতিকে শাড়ির মতো পরিয়ে দেয়।তিতি বউ সাজতে চেয়েছিলো।তাই জান্নাহ্ হালকা লিপস্টিক লাগিয়ে দেয় তিতির ফিকে গোলাপি ঠোঁটে।একগাল হাসে তিতি।খুশি যেনো উপচে পড়ছে তার চোখে মুখে।কোনো মেয়ের জীবনে প্রথম শাড়ি পরা হয়তো এই ওড়নার সাহায্যেই হয়।কিন্তু জান্নাহ্ এর জীবনে এমনটা হয়নি।বিয়ের আগেও সে প্রথম বার তার প্রাণের জন্যই শাড়ি পরেছিলো তাও একদম ঠিকঠাক করে।জান্নাহ্ মিষ্টি গলায় বললো–

“একদম বউ বউ লাগছে আমার মিষ্টি পরীটাকে।”

“ইয়েএএএ।”

তিতির খুশিতেই যেনো জান্নাহ্ এর সারাদিনের ক্লান্তি মুছে গেল।মোবাইলে রিং বেজে উঠে জান্নাহ্ এর।সারহান ভিডিও কল করেছে।তা রিসিভ করেই তিতির কাছে দেয়।তিতি তার আধো আধো গলায় গদগদ হয়ে বললো–

“দেখো মামা,বউ।”

সারহান স্মিত হেসে বললো–

“বাব্বাহ!আমার তিতি সোনা বউ সেজেছে।”

“হু।”

“কেমন আছো তুমি?

তিতি জান্নাহ্ এর দেয়া চুড়িগুলো দেখিয়ে নাড়াতে নাড়াতে প্রত্যুক্তি করে বললো–

“ভালো।”

সারহান ঝরা হেসে প্রশ্ন করে–

“বউ সাজতে ভালো লাগে আমার তিতিসোনার?

তিতি বেখেয়ালিপনায় উত্তর দেয়–

“হা মামা।আমিও পরীমার মতো বউ হবো।”

একগাল হাসে সারহান,চার বছরের তিতির এই অদ্ভুত অভিলাষের কথা শুনে।তিতি তার হাত দুটো উঁচু করে হাতে পরা জান্নাহ্ এর চুড়িগুলো যথাসাধ্য নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে।হাত উঁচু করতেই তা কনুইয়ের উপরে চলে আসে।কৃত্রিমভাবে পরা শাড়ির আঁচল চিবুক দিয়ে চাপ দিয়ে ধরে রেখেছে।তিতি আবারো গম্ভীর মুখে একরাশ অভিমান নিয়ে বললো—

“পরীমার চুড়ি ভালো না।”

সারহান চোখে হেসে বললো–

“তাই!

“হু।দেখোনা পড়ে যাচ্ছে।”

“তাহলে কী আমার তিতিপাখির জন্য চুড়ি নিয়ে আসবো?

খলখলিয়ে হেসে উঠে তিতি।হাসফাস করে বললো–

“হা মামা।লিপততিকও আনবে।”

জান্নাহ্ মৃদু হেসে বললো–

“তিতি লিপস্টিক।”

তিতি দাঁতের সাথে দাঁত চেপে ধরে ফিক করে হেসে দেয়ে।সারহান স্মিত গলায় বললো–

“সব নিয়ে আসবো তিতি মামুনির জন্য।”

সারহান কল কেটে নাম্বারে ডায়াল করে।তিতি নিজেকে দেখায় ব্যস্ত।বিছানার উপর দুই পা আসন দিয়ে বসে কথা বলছে জান্নাহ্।তার কপাল আর গলায় ঘাম জমে আছে।তা তৃপ্তি নিয়ে দেখছে সারহান।কিন্তু তা সম্পর্কে অবগত নয় জান্নাহ্।ওপাশ থেকে কাটখোট্টা গলায় সারহান বললো—

“তিতিকে এইসব কে শিখিয়েছে!ওই ইউজলেস নিধি?

জান্নাহ্ শান্ত গলায় বললো–

“জানি না।আপনি নিধি আপুকে ইউজলেস বললেন কেন?আম্মা তো তার সাথেই আপনার বিয়ে দিতে চেয়েছিলো।”

“তো!
গাধি একটা।আর ওকে বিয়ে করলে আপনি হাত ছাড়া হয়ে যেতেন তো।”

“ইশ!

দুর্বোধ্য হাসে সারহান।কন্ঠে গম্ভীরতা এনে বললো–

“এতো রাত হয়েছে জেগে আছেন কেন?

“পড়ছিলাম।যে টেস্টগুলো দিতে পারিনি তা এখন তো দিতে হবে।”

সারহান গাঢ় গলায় বললো–

“তাই বলে রাত জেগে থাকবেন!একদম না।ডার্ক সার্কেল পড়ে গেছে আপনার চোখে।”

জান্নাহ্ দুষ্টমির ছলে বললো–

“ইশ!মিথ্যুক।”

“আপনি বড্ড বেরসিক রজনীগন্ধা।”

জান্নাহ্ অভিমানী গলায় বললো–

“তাই বুঝি আমাকে ছেড়ে থাকতেই ভালো লাগে!

সারহান শীতল গলায় বললো–

“কে বললো আপনাকে ছাড়া ভালো আছি?

জান্নাহ্ অনুরক্তির সুরে বললো–

“তা নয়তো কী!

সারহান ফোঁস করে দম ফেললো।নরম গলায় বললো—

“বউ পালা কী এতো সোজা!টাকা ছাড়া তো আজকাল মা,বাবাও কেউ না।সেখানে বউ থাকবে কী করে?

জান্নাহ্ কপট অভিমান করে বললো–

“আমি কী আপনার কাছে কখনো টাকা চেয়েছি?

“আমি তো আপনার কোন ইচ্ছে অপূর্ণ রাখিনি।নিজের সাধ্যের চেয়ে বেশি দিয়েছি সবসময়।”

“আপনার কী আমাকে লোভী মনে হয়?

“উঁহু।ফুল কী করে জানেন?সুবাস বিলায়।বিনা স্বার্থে।আপনিও তো আমার ফুল।আমার রজনীগন্ধা।”

জান্নাহ্ এর মনে বসন্তের শীতল হাওয়া বইতে থাকে।রজনীগন্ধা।হ্যাঁ,এই একটা শব্দ তার খুব পছন্দ।সারহানের মুখে রজনীগন্ধা শুনতেই জান্নাহ্ এর সকল বিষন্নতা,অবসাদ এক নিমিষেই উবে যায়।ফাগুনের মাতাল হাওয়ায় সব কিছু ঝরঝরে হয়ে যায়।

মেয়েকে ঘুম পাড়ানোর জন্য খুঁজতে থাকে শুভ্রা।কোথাও না পেয়ে জান্নাহ্ এর কাছে আসে।তিতির এই সাজ দেখে শুভ্রা হাস্যোজ্জ্বল গলায় বললো–

“এতো রাতে সাজতে ইচ্ছে হলো কেন আমার মামুনির?

তিতি চটপটে গলায় বললো–

“বউ।”

“আমার লক্ষীসোনা।”

তিতির চোখ যায় দরজার দিকে।সেরাজ কে দেখে অধৈর্য হয়ে বিছানা থেকে নামতে গেলে পায়ের বেড়িতে ওড়না লেগে নিচে পড়ে যায়।জান্নাহ্ শশব্যস্ত হয়ে তিতিকে উঠায়।নিজের গায়ের ওড়নার কথা বেমালুম ভুলে যায়।আর সেই সুযোগে সেরাজ তার লোলুপ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে জান্নাহ্ এর দিকে।হতভম্ব হয়ে ঘুরে দাঁড়ায় জান্নাহ্।শুভ্রা মেয়ের শরীর থেকে ওড়না খুলে জান্নাহ্কে দেয়।বিরক্তিকর গলায় প্রশ্ন করে সেরাজকে–

“তুমি এখানে কেন?

সেরাজ মিইয়ে গলায় বললো–

“তোমাকে খুঁজছিলাম…।”

শুভ্রা রেগে গিয়ে বললো—

“আমাকে খুঁজলে এখানেই আসতে হবে তোমার!

মেয়ের হাত ধরে টেনে নিতেই জান্নাহ্ বাঁধা দেয়।নরম গলায় বললো–

“তিতি আমার কাছেই আজ থাক আপু।”

শুভ্রা না করতে গেলেও জান্নাহ্ এর কথায় চকচক করে উঠে সেরাজের দুই চোখে।আনন্দে গদগদ হয়ে বললো–

“জান্নাহ্ ঠিক ই বলছে।তিতি আজ ওর কাছেই থাক।”

শুভ্রার মুখ জুড়ে বিরক্তি ছেয়ে যায়।সেরাজ কেন এমন চাইছে তা সে ভালো করেই বুঝতে পারছে।তাই নিজের ইচ্ছে না থাকলেও তিতিকে রেখে যায় জান্নাহ্ এর কাছে।

বই খাতা সব গুছিয়ে তিতিকে নিয়ে শুয়ে পড়ে জান্নাহ্।তিতি তার ছোট ছোট দুই হাতে কী যেনো গুনছে।আনমনেই বলে উঠে–

“পরীমা,কামড় দিলে ব্যথা পাওয়া যায় না?

ভ্রু কুঁচকায় জান্নাহ্।এইটা কেমন প্রশ্ন!জান্নাহ সরল গলায় বললো–

“কেন তিতি সোনা?

তিতি তার দুই হাত জান্নাহ্ এর দুই গালে চেপে ধরে মিষ্টি করে বললো–

“মামা তোমাকে কামড় দেয়?ব্যাথা?

জান্নাহ্ লজ্জিত হয়।বাচ্চাদের মস্তিষ্ক আসলেই ঝকঝকে আয়নার মতো।এরা যা দেখে তা সহজে ভোলে না।জান্নাহ্ এর বুকের কাছে সেই দাগ সেদিন দেখেছিলো।কিন্তু তিতি কী করে বুজলো তা কামড়ের দাগ!
জান্নাহ্ নরম গলায় বললো–

“এইসব বলতে নেই তিতি সোনা।কামড় দিবে কেন!মামা কী পঁচা!পঁচারা কামড় দেয়।”

তিতির দুই চোখ তার নিজের হাতে।চুড়ি গুলো ভীষন জালাচ্ছে।সেদিকে মনোযোগ দিয়েই বললো–

“তাহলে বাবা পঁচা।বাবা মামুনিকে কামড় দেয়।”

জিভ কাটে জান্নাহ।তার আশঙ্কাই ঠিক।তিতি এমন কিছু দেখেছে যা তার ছোটক মস্তিষ্কে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করছে।জান্নাহ্ আলগোছে তিতির হাতে নিজের ঠোঁট বসায়।মিষ্টি গলায় বললো–

“এই যে না ঘুমালে এইভাবে কামড় দেয়।ঘুমাও।”

খিলখিল করে হাসে তিতি।জান্নাহ্ আদুরে গলায় আবার বললো–

“আর কখনো এইসব বলবে না তিতি।এইসব পঁচা কথা।আমার তিতিসোনা কী পঁচা?

“না।”

“এখন ঘুমাও।”

তিতি দুই হাতে জড়িয়ে ধরে জান্নাহ্কে।তার নাক ঘষতে থাকে জান্নাহ্ এর গলার দিকটায়।জান্নাহ্ এর সুড়সুড়ি লাগে।কোমল গলায় বললো–

“এমন করছো কেন তিতি?

“গন্ধ।”

“কী?

“হুম।মা,মা গন্ধ।”

প্রাণখোলা হাসে জান্নাহ্।তিতিকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে বললো–

“ওরে আমার দুষ্ট।ঘুমাও।”

জান্নাহ্ সিদ্ধান্ত নেয় তিতিকে মাঝে মাঝে নিজের কাছে রাখার চেষ্টা করবে এতে করে শুভ্রা আর সেরাজ হয়তো নিজেদের জন্য একটু সময় বের করে নিতে পারবে।
,
,
,
চোখে রোদচশমা লাগিয়ে গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইহতিশাম।নিজের পাজেরো জীপের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।বিরক্তি নিয়ে হাতের ঘড়িতে বারবার চোখ বুলাচ্ছে।প্রায় এক ঘন্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছে একটা ছোট্ট কলোনিতে।ছোট ছোট আধপাকা দেয়ালের ঘর।একটার সাথে আরেকটা লেগে আছে।হাঁটার রাস্তাও নড়বড়ে।ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ইট,পাথর।একদম নিম্ন শ্রেণীর মানুষের বসবাস এখানে।ময়লা স্তুপ থেকে বিশ্রি গন্ধ এসে নাকে লাগছে ইহতিশামের।তবুও দৃঢ়চিত্তে অপেক্ষমান কারো জন্য।কয়েকটা বাচ্চা ছেলেমেয়ে তাকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে দেখছে।ইহতিশাম হাসে।তাতেই লজ্জায় কুটি কুটি হয় বাচ্চাগুলো।

যে ঘরটার সামনে অধীর আগ্রহ নিয়ে ইহতিশাম দাঁড়িয়ে আছে কয়েক মুহূর্ত পর সেখানে একটা ছেলে প্রবেশ করে।ইহতিশাম গাড়ি লক করে সেদিকে পা বাড়ায়।বাম হাতের তর্জনী দিয়ে কাঠের ভঙ্গুর দরজায় আঘাত করতে একটা ছেলে দরজা খুলে দাঁড়ায়।ইহতিশাম কে দেখেই দরজা লাগাতে গেলেই ইহতিশাম নিজের বলিষ্ঠ হাত দিয়ে ধাক্কা মেরে একরকম জোর করেই ভেতরে ঢুকে পড়ে।ঘুনে ধরা দরজা,বেতের সিলিং থেকে ঝরঝর করে কিছু ঘুন পড়লো ইহতিশামে সাদা শার্টে।চোখ থেকে রোদচশমাটা খুলে পকেটে নেয়।একরাশ বিরক্তি নিয়ে শার্ট ঝাড়তে থাকে।হেয়ালি গলায় বললো—

“ইউজলেস ফেলো।এইটা কী করলি?

ছেলেটি থরথর করে কাঁপছে।চোখের নিচে কালি।সমস্ত মুখ জুড়ে অবসাদ।মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি।চুলগুলো উসকোখুসকো।ইহতিশাম ছেলেটির দিকে একবার ভালো করে তাকিয়ে সম্পূর্ণ ঘর পর্যবেক্ষণ করে।বসার মতো কিছুই পেলো না।ফোঁস করে এক দম ফেলে ইহতিশাম।তীক্ষ্ম গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে —

“একটা চেয়ারও নেই?

ছেলেটা এখনো কাঁপছে।ইহতিশাম এগিয়ে গিয়ে ছেলেটির কাঁধে হাত রেখে আশ্বস্ত গলায় বললো–

“রিল্যাক্স ডুড,আই এম নট রয়েল বেঙ্গল টাইগার।”

ছেলেটির তার কাঁপা কাঁপা গলায় বললো—

“বিশ্বাআআস করুউউউন স্যার।আমি কিচ্ছুইই করিনি।”

ইহতিশাম বিগলিত হাসলো।ফুরফুরে গলায় বললো–

“আই নো।”

ছেলেটি দুম করে ইহতিশামের পায়ের কাছে পড়ে ঝমঝমিয়ে কাঁদতে লাগলো।ছিটকে সরে আসে ইহতিশাম।হতভম্ব গলায় বললো–

“আরে,আরে কুল ম্যান,কুল।চোখের চাহনিতে মানুষ চিনতে পারি আমি।আই নো,ইউ ডিড নট কিল দ্যাট গার্ল।বি ক্লাম।”

ছেলেটির দু’চোখে শীতল জল ঝরছে।ফোলা দুই চোখ জ্বালা শুরু করে।ইহতিশামকে চেনে সে।তাই ভেবেছে তাকে ধরতে এসেছে।ইহতিশাম নিঃশব্দে নিঃশ্বাস ফেললো।ফিকে গলায় বললো—

“একটু বসতে দেরে ভাই।তোর জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আমার পায়ের ক্যালসিয়াম ক্ষয় হয়ে গেলো।”

ইহতিশামের কথায় ছেলেটি একটু ধাতস্থ হয়ে চৌকির পাশে থাকা এক পায়া ফাটা জলচৌকি এনে দিলো।ইহতিশাম হালকা চাপ দিয়ে বসলো।ছেলেটি ইহতিশামের সামনে অপরাধি মুখ করে থম মেরে বসে রইলো।ইহতিশাম দুই হাতের আঙুল ভাঁজ করে ছোট্ট করে জিঙ্গেস করলো–

“নাম কী?

ছেলেটি চট করে বললো–

“জসিম।”

নাম বলে শ্বাস ফেললো জসিম।জসিমের চোখ দুটো দেখেই ইহতিশাম বুঝলো সারারাত নেশা করে এসেছে।জসিমের দিকে কিছুক্ষন তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করে—

“কোথায় ছিলি রাতে?

জসিম চোরা চোখে তাকায়।গলাটা কাঁপছে তার।চোখ দুটিও প্রস্ফুরিত হচ্ছে।দুই হাতের বেঁড়ে আটকে রেখেছে পা দুটো।তার উপর চিবুক দিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বসে আছে।ইহতিশামের প্রশ্নে মিনমিনে গলায় অনেকটা ভয় নিয়ে বললো-

“কাআআজে।”

ইহতিশাম ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে নিজের মোবাইল হাতে নেয়।তাতে অক্ষি নিবদ্ধ করে বললো–

“কাজ টা কী?

জসিম বড় বড় কয়েকটা ঢোক গিললো।কিন্তু উত্তর দিলো না।ইহতিশাম স্বাভাবিক গলায় বললো—

“মিথ্যে বলিস না।তাহলে কিন্তু…।”

জসিম ঝপ করে এসে ইহতিশামের হাত চেপে ধরে অধৈর্য গলায় বললো–

“আমি খুন করি নি স্যার,আমি খুন করি নি।”

ইহতিশাম বিরক্তি নিয়ে বললো–

“বললাম তো করিস নি খুন তুই।এখন পুরো ঘটনা খুলে বল।একচুল ও মিথ্যে নয়।”

জসিম সরে বসলো।তার সামনে ভেসে উঠতে থাকলো সেই দুর্বিষহ দিনগুলো।স্থির হয় সে।নিষ্কম্প গলায় বলতে শুরু করে—

“সেদিন যখন আমি পিজ্জা ডেলিভারি করতে যাই তখন দরজা খুলে একজন পুরুষ।লোকটির চোখে চশমা,মাথায় ক্যাপ আর গায়ে কালো জ্যাকেট।বাংলোর বাইরে লাইট থাকা সত্ত্বেও তার চেহারা আমি ভালো করে বুঝতে পারি নি।কিন্তু একটা জিনিস খেয়াল করেছি,সে যখন পিজ্জা নিচ্ছিলো আমার কাছ থেকে তখন তার বৃদ্ধা আঙুল কাঁপছিলো।আমি তাকে জিঙ্গেসও করেছিলাম।অর্ডার কোনো আপুর ছিলো।লোকটি বললো সে ভেতরে আছে।আমি ভেতর থেকে একটা আওয়াজও শুনছিলাম।লোকটার দিকে তাকাতেই তিনি হাসলেন।বললেন,ঘরে পার্টি হবে আর আওয়াজটা ব্ল্যান্ডার মেশিনের।কিন্তু আমার কাছে অদ্ভুত লাগলো।”

ইহতিশাম ভ্রু নাচিয়ে বললো–

“কেন?

জসিম ভীত গলায় বললো–

“আমি ব্ল্যান্ডারের আওয়াজ চিনি।”

শীতল শ্বাস ফেললো ইহতিশাম।সরু গলায় বললো–

“তারপর?

জসিম ঝরঝর করে কাঁদতে লাগলো।ইহতিশাম শক্ত চোখে তাকাতেই কান্না গিলে বললো–

“সেদিন সেই অর্ডার পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিলো সাগরের।ওর মা অসুস্থ হওয়ায় ও ছুটি নিয়ে চলে যায়।তাই আমাকেই অর্ডার ডেলিভারি করতে যেতে হয়।কিন্তু পরদিন সকালে যখন পত্রিকায় খবর বের হয় আর পুলিশ জানতে পারে আমি পিজ্জা ডেলিভারি করেছি।আর তখন আমাকেই সন্দেহ করে।বিশ্বাস করুন স্যার আমি কিছুই জানি না।”

আর কিছু বলতে পারলো না জসিম।অঝোরে কাঁদতে লাগলো।খুনি সন্দেহ করে জসিমকে তিন দিনের রিমান্ডে বেধড়ক মারে।কিন্তু পরে কোনো প্রমান না পাওয়ায় তাকে ছেড়ে দেয়।পুলিশের খাতায় এন্ট্রি পাওয়ায় তার পার্ট টাইম জবটাও হাতছাড়া হয়।পড়ালেখাও বন্ধ হয়ে যায়।কোথাও কোনো কাজও পায় না।

ইহতিশাম দীর্ঘশ্বাস ফেললো।কথায় আছে,শ’খানের অপরাধি মুক্তি পেয়ে যাক কিন্তু একজন নিরঅপরাধি সাজা না পাক।ইহতিশাম উঠে দাঁড়ায়।নিরুদ্বেগ গলায় বললো–

“তোমার সাথে যা হয়েছে তার জন্য আমি দুঃখিত।”

জসিম হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে বললো–

“স্যার একটা কথা বলবো?

“হুম।”

জসিম সাহস নিয়ে চাপা কন্ঠে বললো—

“সেদিন আমি একটা মেয়েকেও সেখানে দেখেছিলাম।গায়ে টপস আর কালো জিন্স পরা।আমি ভেবেছি সেই হয়তো সামিরা ম্যাম।কিন্তু পত্রিকায় যখন তার ছবি দেখলাম তখন বুঝেছি সে অন্য কেউ ছিলো।লোকটি বলেছিলো ঘরে পার্টি।হয়তো তার কোন বান্ধবী হতে পারে।”

ইহতিশাম সন্দিগ্ধ গলায় বললো–

“পুলিশকে কেন এই কথা বলোনি?

“স্যার,এই কথা বললে আমাকে আরো ফাঁসিয়ে দিতো।আমি তো মেয়েটাকে একটুখানিই দেখেছি।দেখলে হয়তো মনে পড়বে।কিন্তু ওই মেয়ে যদি জানতে পারে এই কথা তাকে ধরার আগেই তাহলে তো…।”

ইহতিশাম মাথা ঝাঁকালো।গম্ভীর গলায় বললো–

“রাইট,ইউ আর ইন্টিলিজেন্ট।”

ইহতিশাম একটা কার্ড দেয় জসিমকে।আর একটা ঠিকানা।এখানে গিয়ে ইহতিশামের কথা বললে তার কাজের ব্যবস্থা হয়ে যাবে।আর লেখাপড়া আবার শুরু করতে বলে।ইহতিশাম চলে যেতেই হতাশ শ্বাস ফেলে জসিম।যদি আর কয়েকটা দিন আগে এই মানুষটা তার জীবনে আসতো তাহলে তার বাবা আজ বেঁচে থাকতো।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here