#জান্নাহ্
#পর্বঃ২০
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
ঝকঝকে কাঁচ ভেদ করে ঝলমলে মিষ্টি হলুদ রোদ গলিয়ে পড়ছে রেস্তোরাঁর ভেতরে।এসি নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় বাইরের গুমোট তপ্ত আবহাওয়ার আঁচ বোঝা যাচ্ছে না।একটা কমলা রঙের থ্রি পিস পরেছে নিধি।হাস্যোজ্জ্বল মুখটা বেশ চনমনে।হাসলো রাফাত।ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন ছুঁড়ে নিধি–
“ডাক্তার সাহেব হাসলেন যে?
“তেমন কিছু নয়।ইচ্ছে হলো।”
নিধি আলতো হেসে চাপা স্বরে বললো—
“অকারনে হাসলে তাকে পাগল বলা হয়।”
বিগলিত হাসে রাফাত।ঠান্ডা গলায় বললো–
“নো প্রবলেম।ডক্টর দেখিয়ে নিবো।”
ফিকে হাসে নিধি।রাফাত কিছুক্ষন থম মেরে বললো–
“কোন ডিপার্টমেন্টে?
নিধি কোনোরকম সংকোচ ছাড়াই বললো–
“বাংলা।”
স্মিত হাসে রাফাত।রসালো গলায় বললো–
“তাহলে তো সাহিত্যপ্রেমী মনে হয়।”
নিধি ঘোর আপত্তি করে বললো–
“মোটেও না।ভাইয়া বললো অন্য ডিপার্টমেন্টে আমাকে নেবে না তাই বাংলা।”
মুচকি হাসে রাফাত।স্বশব্দে বললো—
“মেয়েদের বুদ্ধি নাকি হাঁটুতে থাকে!
নিধি চটপটে গলায় বললো–
“আমার কোথাও নেই তাই।”
মৃদু ছন্দে হেসে উঠে দুজন।রাফাত নিধির মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য গলা খেঁকরি দিয়ে বললো–
“জান্নাহ্ এর হ্যাজবেন্ড এখানে আসে না?
রাফাতের মুখে জান্নাহ্ এর নামটা শুনে খানিক চমকালো নিধি।তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ম্লান গলায় বললো—
“আসে তো।যখন ইচ্ছে হয়।”
রাফাত আগ্রহী গলায় বললো—
“ঠিক বুঝলাম না।”
নিধি ঝরঝরে গলায় বললো–
“সারহান বরাবরই এমন।মাঝে মাঝে তো কয়েকমাস নিরুদ্দেশ থাকে।ইচ্ছে হলে আসে।দু একদিন থাকে আবার চলে যায়।ঘরের কেউ কিছু বললে তার সাথে কথা বলাতো বন্ধ করেই আর বাড়িতেও আসে না।তাই কেউ তেমন টু করে না।”
রাফাত নিরুদ্বেগ গলায় বললো–
“এখনো এমন?
কপট হাসে নিধি।গম্ভীরভাব ধরে বললো–
“হঠাৎ এইসব জিঙ্গেস করছেন?
রাহাত নড়ে উঠে।একটু ধাতস্থ হয়ে স্বাভাবিক গলায় বললো–
“একচুয়েলী,জান্নাহ্ এর বয়স তো অনেক কম।আর এই বয়সেই বিয়ে..।”
নিধি রাফাতের কথা টেনে নিয়ে বললো–
“খালাম্মা সবসময় চেয়েছেন সারহান যেনো তার আশেপাশে থাকে।ছেলেকে ভীষণরকম ভালোবাসেন তিনি।তাই চেয়েছেন বিয়ে দিলে হয়তো ছেলে ঘরমুখী হবে।তাই কচি মেয়ে দেখে বিয়ে করিয়েছেন।কিন্তু সারহান আগের মতোই।নিজের ইচ্ছের মালিক।আমার সাথেও তেমন কথা হয় না।ভার্সিটি বন্ধ থাকলে যখন আসতাম তখন মাঝে মাঝে দেখা হতো।কিন্তু কথা হতো না।”
রাফাত উৎকর্ণ হয়ে নিধির কথা শুনছে।কোনো পাল্টা প্রশ্ন করলো না।নিধি আবার বললো–
“কিন্তু সারহান আসলেই অদ্ভুত এক মানুষ।”
রাফাতের সরু ভ্রু জোড়া মুহূর্তেই কুঁচকে যায়।চিন্তিত গলায় বললো–
“কেন?
নিধি ছোট্ট দম নিয়ে বললো–
“সারহান কখনো বিয়ে করতে চায়নি।খালাম্মা একবার আমার সাথে বিয়ের কথা বলতেই ছয় মাস বাড়ি আসা বন্ধ করে দেয় সারহান।কিন্তু…।”
রাফাত নিধির দিকে আরেকটু ঝুঁকে উদগ্রীব হয়ে কম্পিত গলায় বললো–
“কিন্তু কী?
“জান্নাহ্কে দেখেই বিয়ের জন্য হ্যাঁ বলে দিলো।মানছি জান্নাহ্ যথেষ্ট সুন্দরী।বাট এতোটাও না।”
রাফাত নাক মুখ কুঁচকে অস্বস্তি নিয়ে বললো–
“আমি আপনার কথা ঠিক বুঝলাম না।”
নিধি তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বললো–
“সারহান অনেক বছর ধরেই শহরে থাকে।সেখানে হাজারো মেয়ের সাথে তার উঠাবসা।এমনকি নিজের ডিপার্টমেন্টেও জান্নাহ্ এর চেয়ে হাজারগুন ভালো মেয়ে থাকা সত্ত্বেও বিয়ের ঘোর বিরোধী সারহান জান্নাহ্কে প্রথম দেখায় কেন রাজী হলো!
রাফাত ভাবলো।তার ভাবাবেশ বুঝতে পারলো নিধি।সরু কপালটা হঠাৎই ভাঁজ হয়ে এলো রাফাতের।ফিক করে হেসে ফেলে রাফাত।ফিচেল গলায় বললো–
“আপনার হিংসে হচ্ছে।আই মিন আপনাকে রিজেক্ট করে অন্যকে বিয়ে করলো।”
নিধি প্রতিবাদ করে বললো–
“একদম না।সারহান আর আমার মাঝে কখনো তেমন কিছু ছিলো না।সারহানকে অপছন্দ করার কোনো কারণ নেই।কিন্তু তার জন্য ফিদা হওয়ার মতো এমন কিছু আমি কখনো অনুভব করি নি।হয়তো তার সাহচার্য আমি তেমনটা পাই নি বলে।কিন্তু সারহানের মতো একজন পুরুষ জান্নাহ্ এর মতো একটা বাচ্চা মেয়ে তার উপর গরীব,এতিম মেয়েকে কেন বিয়ে করলো!বিষয়টা আমাকে ভাবায়।শুধুই জান্নাহ্ এর রূপ?
রাফাতের দমবন্ধ হয়ে আসছে।তবুও সে শুনতে চায়।বুকের ভেতরটায় জান্নাহ্ নামের ঝড়ে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে।নিজের অনুভূতি বস্তা চাপা দিয়ে সরস গলায় বললো–
“এখানে অবাক হওয়ার কী?হয়তো সারহানের পছন্দ হয়েছে তাই।”
নিধি জোর গলায় বললো–
“আমিও তাই ই জানতে চাই।জান্নাহ্ কী আসলেই এতোটাই সুন্দরী যে তার রূপের সামনে সারহানের সমস্ত ব্যক্তিত্ব ধ্বসে গেলো!বিয়ে বিরোধী পুরুষ বিয়ের পর বৌয়ের জন্য পাগল হয়ে গেলো!খালাম্মাও কম না।জান্নাহ্ এর মামার কাছ থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা যৌতুক নিয়েছে।অবশ্য সারহান তা জানে না।ভাইয়া আমাকে বলেছে।”
রাফাত অস্থির হয়ে উঠে।জান্নাহ্ এর মামা!তার মানে এই বিয়ের পেছনে জান্নাহ্ এর মামার হাত আছে।রাফাত অধৈর্য গলায় প্রশ্ন করে–
“কোথায় থাকে জান্নাহ্ এর মামা?
“তাতো জানি না।কখনো জানা হয়নি।তবে জান্নাহ্ মেয়েটাও অদ্ভুত।এই যে আমার সাথে সারহানের বিয়ের কথা শুনেও কোনো ধরনের ভাবান্তর নেই তার।অনেক মিষ্টি একটা মেয়ে।এই ছোট বয়সেই কতো ম্যাচিউর।কথাবার্তা,চালচলনে কে বলবে ষোড়শী সে!সবাইকে আগলে রাখে।বাড়ির সবাই তাকে পছন্দ করে।শুধু খালাম্মা মাঝে মাঝে চটে যায়।
নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্ম হলেও জান্নাহ্ এর ব্যবহারে দাম্ভিকতার ছোঁয়া,তার ব্যবহার প্রাচুর্যময়।সব মিলিয়ে বলা যায় একটা পুতুল।যাকে কেউ নিজ হাতে সমস্ত গুন দিয়ে তৈরি করেছে।”
তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে রাফাত।ভাবে,তার মানে জান্নাহ্ এর আসল পরিচয় কেউ জানে না!দাম্ভিক তো হবেই।সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছে জান্নাহ্।কোটি টাকার সম্পত্তির একমাত্র সম্রাজ্ঞী সে।আর হ্যাঁ,পারফেক্ট তো সে হওয়ারই ছিলো।জান্নাহ্ এর বাবা ছোটবেলা থেকেই তাকে সেভাবে গড়ে তুলেছে।নিজ হাতে গড়েছেন তিনি তার মেয়েকে।সাথে রাফাতও ছিলো।জান্নাহ্ এর বাবা আদর করে জান্নাহ্কে শ্বেত পাথরের বারবি ডল বলতো।শী ইজ গট গিফ্টেড।বিয়ের দশ বছর পর জান্নাহ্ এ জন্ম হয়।তাই তার বাবাও তাকে রাজকুমারীর মতো করে রেখেছিলো।কিন্তু এমন কী হলো জান্নাহ্ এমন একটা পরিবারে বউ হয়ে এলো!
,
,
,
মলিন মুখে বসে আছে তিল।ম্যাথ ক্লাসে আজ বীজগনিত করিয়েছে।কিন্তু তার মাথায় কিছুই ঢুকেনি।তার ভাবনার রাজ্যের রাজা আজ কয়েকদিন ধরেই তাকে তাচ্ছিল্য করছে।শীতল নিঃশ্বাস ফেললো তিল।তাকে দুর্বল হাতে ধাক্কা মেরে সরব গলায় জান্নাহ্ বললো-
“মুখটা এমন চিরতার মতো করে রেখেছিস কেন?
তিল গলিত বরফের মতো শীতল গলায় বললো—
“আমার জীবন হইলো বৃথা,বলেছে সে মিছা,এখন আমি কইবো আর কী কথা!
কপাল ভাঁজ করে ভেঙচি কাটে জান্নাহ্।সিক্ত গলায় বললো–
“কী হয়েছে বলতো?
তিল দুঃখী দুঃখী ভাব নিয়ে বললো—
“আর বলিস না।ওই আমার হবু রসিকনাগর গেলো আমায় ছাড়িয়া।”
জান্নাহ্ চোখ,মুখ খিঁচে বিতৃষ্ণা গলায় বললো–
“দুত,কী আবোলতাবোল শুরু করলি।ঠিক করে বল কী হয়েছে?
তিল এইবার মুখটা পাংশুটে করে বললো–
“স্যার চাকরি ছেড়ে দিয়েছে।”
জান্নাহ্ সন্দিগ্ধ গলায় বললো–
“কোন স্যার?
তিল জ্বলে উঠে বললো—
“আরে ধের,হ্যায়ার ম্যাথ স্যার।”
জান্নাহ্ এক পলকেই অবাক হয়ে বললো–
“রাফাত চলে গেছে?
তিল ঠোঁট গুঁজ করে চোখ পিটপিট করে তাকায়।কপট গোয়েন্দা সুরে বললো–
“তুই স্যারকে নাম ধরে বললি কেন?
জান্নাহ্ থতমত খেয়ে বললো—
“না,মানে।হঠাৎ বেরিয়ে এলো।”
তিল কোমল গলায় অভিমান করে বলতে লাগলো—
“এইভাবে ধোঁকা দেওয়া কী ঠিক হলো।কালই ফেসিয়াল করিয়েছি।দেখ ভ্রু প্লাগও করিয়েছি।চুলগুলোও টাইটানিকের নায়িকার মতো করে রোজ কাট দিয়েছি।ভাবলাম এবাই ডাল গলবে।কিন্তু তার আগেই পাখি ফুড়ুৎ।”
জান্নাহ্ চুপ করে শুনছে।গম্ভীর সে ভাবনা।এক আকাশ কষ্ট নিয়ে শক্ত গলায় বলে উঠে তিল–
“দেখবি ওই রাফাত না তফাৎ,ওর কোনোদিন বিয়েই হবে না।সারাজীবন কুমার থাকবে।শুধু অন্যের বউয়ের দিকে তাকিয়েই জীবন পার করবে।ও তো জানে না,মন ভাঙা আর মসজিদ ভাঙা সমান।”
মেকি আওয়াজ তুলে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতে থাকে তিল।জান্নাহ্ এর বুক জুড়ে ভারি পাথর চাপা পড়ে।নাহ,এভাবেই আর নয়।তাকে কিছু করতে হবে।ইশাকের সাথে কথা বলতে হবে।ইশাক যেনো যে করেই হোক রাফাতকে এখান থেকে নিয়ে যায়।
চলবে,,,