জান্নাহ্ “পর্বঃ৩

0
6106

#জান্নাহ্
#পর্বঃ৩
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

মাথার ঠিক ওপরে ফ্যান ঘুরছে।সামনে থাকা কাঁচ দিয়ে দেখা যাচ্ছে পথচারীদের।কেউ একা তো কেউ সাথে সঙ্গী করে।সারহানের অক্ষি নিবদ্ধ সেদিকে।একটা ছেলে আর একটা মেয়ে পাশাপাশি বসে আছে ফুটপাতে।শহরাঞ্চলে এমনটা অহরহ হলেও মফস্বলে অনেকটা দৃষ্টিকটু তা।সারহান বাঁকা হাসে।

তার সামনে স্থির হয়ে বসে আছে জাবিন।ভীত দৃষ্টি তার।শ্রান্ত তার দেহ।সারহান তার দিকে তাকিয়ে মৃদু গলায় বললো–

“কেমন আছিস?

ঠান্ডা গলায় প্রত্যুত্তর করে জাবিন–

“ভালো।”

সারহান গলার স্বর একটু তীক্ষ্ম করে বললো–

“পার্কে কী করছিলি তুই?

ফাঁকা ঢোক গিলে জাবিন।কিন্তু কোনো কথা বললো না।চোরা চোখে এদিক অধিক তাকায়।কঠিন গলায় সারহান বললো–

“কোল্ড ড্রিংকস?

জাবিন নিঃশব্দে মাথা হেলায়।সারহান ওয়েটারকে বলে দুটো কোল্ড ড্রিংকস আর দুটো পাস্তার ওর্ডার করে।যতক্ষন ওয়েটার আসলো ততক্ষন জাবিন নিচের দিকে তার দৃষ্টি নত করে রাখলো।জাবিনের বুকের ভেতর খা খা রোদ্দুরে যেনো তৃষ্ণায় ফেটে যাচ্ছে।শরীরের শিরা উপশিরা যেনো রক্ত প্রবাহ থামিয়ে দিচ্ছে।স্বরনালি কাঁপছে মৃদু ছন্দে।কিন্তু আওয়াজ নিঃসরিত হচ্ছে না।

সামনে রাখা কোল্ড ড্রিংকস বেয়ে শীতল জল গড়িয়ে পড়ছে।সারহানদের টেবিলে একটা এক্সট্রা বাটি আছে।সারহান শক্ত গলায় জাবিন কে বললো–

“তোর মোবাইলটা দে।”

জাবিন থতমত খেয়ে যায়।ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলে সামনে তাকায়।আকস্মিক সারহানের উচ্চ আওয়াজে কেঁপে উঠে জাবিন।

“মোবাইলটা দে বলছি।”

নিজের পকেট থেকে কম্পিত হাতে মোবাইল বের করে জাবিন।অনেকটা অস্বস্তি,দ্বিধা,ক্রোধ আর ঘৃণা নিয়ে সারহানের হাতে মোবাইলটা দেয় জাবিন।তা হাতে নিয়ে সরু চোখে তার দিকে তাকায় সারহান।টেবিলের উপর মোবাইলটা রেখে দুটো কোল্ড ড্রিংকস দুই হাতে নিয়ে বাটির মধ্যে ঢালে।টেবিলে রাখা মোবাইলটা সেই বাটির মধ্যে চুবিয়ে দেয়।হতভম্ব হয়ে যায় জাবিন।তার মনে হলো কেউ তার কলিজা কেটে গরম পানিতে ছেড়ে দিয়েছে।দাঁত কিড়মিড় করে এক হিংস্র চোখে তাকায় সারহানের দিকে।কিন্তু মুখে একটা শব্দও করলো না।পাস্তার প্লেট থেকে ফ্রক নিয়ে বাটির মধ্যে ঘুরাতে থাকে।সেদিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে জাবিন।

একটু শান্ত হয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে সারহান।থমথমে গলায় বললো–

“জান্নাহ্কে মামি কেন ডাকিস না তুই?

ফোঁস ফোঁস করছে জাবিন।যেনো জ্বলন্ত উনুন তার মাথায় জ্বালানো হয়েছে।দাঁতে দাঁত চেপে সারহান আবার প্রশ্ন করে–

“জান্নাহ্কে মামি কেন ডাকিস না তুই?

শক্ত ও দৃঢ় গলায় জাবিন বললো–

“ডাকবো।”

“যা এখান থেকে।আজকের পর তোর মোবাইল ব্যবহার করা বন্ধ।যদি আমি আর কোনোদিন তোকে কোচিং ফাঁকি দিয়ে অন্য কোথাও যেতে দেখেছি তাহলে সারজীবনের জন্য তোর পড়ালেখা বন্ধ।ওঠ এখান থেকে।”

সারহানের ধমকে দ্রুত সেখান থেকে উঠে যায় জাবিন।জাবিন শুভ্রার ছেলে।বয়সে সে জান্নাহ্ থেকে বড়।বিয়ের এতোদিন পরেও জান্নাহ্কে জাবিন কখনো মামি বলে সম্মোধন করেনি।জান্নাহ্ এর সাথে এ ছাড়াও আরো একটা সম্পর্ক আছে তার।যা এই বাড়িতে জান্নাহ্ আসার আগে ছিলো।জান্নাহ্ ছাদে কাপড় মেলতে গেলে জাবিন তখন বাড়ির ভেতরে আসছিলো।জান্নাহ্কে ওই অবস্থায় দেখে নিজেকে সামলাতে পারেনি জাবিন।তাই তার কয়েকটা ছবি তোলে।সারহানের দৃষ্টি জান্নাহ্ এর সর্বত্র।

মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠে সারহানের।একরাশ ক্ষোভ আর বিরক্তি নিয়ে রিসিভ করে।সংক্ষুব্দ গলায় বললো–

“এতোবার কল কেন করছিস?

মেঘনোলিয়া ধীর গলায় বললো–

“আমি তোমার জন্য সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছি সারহান।”

সারহান চোয়াল শক্ত করে ক্ষীপ্ত গলায় বললো–

“এতো জ্বালা কেন তোর শরীরে।সহ্য না হলে পেথিড্রিন নে।আর একবার যদি কল করেছিস তো সারাজীবনের মতো আমার চেহারা ভুলে যাবি।”

লাইন কেটে দেয় সারহান।তার দুই চোখ দিয়ে অগ্নিনালা বের হচ্ছে।
,
,
,
ছেলের গালে ঠাস করে এক চড় বসায় শুভ্রা।জাবিন বিক্ষিপ্ত গলায় বললো–

“তোমার ওই ভাই জান্নাহ্কে একদিন মেরেই ফেলবে।”

শুভ্র ছেলের গালে সজোরে আরেকটা চড় মেরে বললো–

“ভাই কিসের!মামা বল।”

“ওই সারহানকে আমি কোনোদিনও মামা বলবো না।”

ছোটবেলা একবার এক্সামে ফেল করেছিলো বলে জাবিন কে তিনদিন অন্ধকার ঘরে বন্ধি করে রেখেছিলো সারহান।সেই থেকে চাপা ক্ষোভ জন্মেছে সারহানের জন্য জাবিনের মনে।তা আগ্নেয়গিরি লাভার মতো উগরে উঠে যখন জান্নাহ্কে বিয়ে করে এই বাড়িতে আনে সারহান।

শুভ্রা খলবলিয়ে বললো–

“সারহান জানলে কী হবে জানিস!

“কী হবে!মেরে ফেলবে!এমনিতেও ওই সারহান কাউকে বাঁচতে দিবে না।ওর জন্য তোমাদের ভুগতে হবে।আর জান্নাহ্কেও মরতে হবে।”

“চুপ,একদম চুপ।জান্নাহ্ মরুক বা বাঁচুক।তাতে তোর কী?

জাবিন চুপ করে থাকলো।ঘরের দরজায় এক লাথি মেরে বেরিয়ে যায়।শুভ্রা ধপ করে নিচে বসে পড়ে।এই ছেলেকে নিয়ে প্রচন্ড ভয় হয় তার।
,
,
“এইটা কী তিতিসোনা?

“আম।”

“আর এইটা?

“কাঁঠাল।”

“ভেরি গুড আমার সোনাপাখিটা।”

তিতি শুভ্রার চার বছরের মেয়ে।এই বাড়িতে যদি কাউকে সবাই বিনা স্বার্থে ভালোবেসে থাকে তাহলে সে হলো তিতি।জান্নাহ্ যখন এই বাড়িতে আসে তখন তিতিই ছিলো তার সারাদিনের সঙ্গী।গুটিকয়েক কাজ ছাড়া আর কোনো কাজ নেই জান্নাহ্ এর।নিজের পড়ালেখা আর তিতিকে নিয়েই কাটে তার দিন।

“তিতিসোনা,এইটা কী বলোতো?

“নাশপাতি।”

“ইয়েহ!
আমার তিতি সোনা সব পারে।”

জান্নাহ্ তিতির গালে চুমু খায়।তার বিপরীতে তিতিও জান্নাহ্ এর ঠোঁটে চুমু খায়।উচ্ছলিত গলায় বললো–

“পরীমা,মামা কখন আসবে।”

জান্নাহ্ কে যেদিন প্রথম দেখে তিতি কিছুতেই তার কাছে আসতে চাইছিলো না।তাই সারহান একটা পুরো রাত তাদের সাথে রাখে তিতিকে।চাঁদের আলোয় যখন জান্নাহ্কে তিতি দেখে উচ্ছ্বাসিত হয় সে। সারহানকে জিঙ্গেস করতেই সে তিতি কে শিখিয়ে দেয় জান্নাহ্কে পরীমা বলে ডাকতে।জান্নাহ্ এর বেশ পছন্দ হয় ডাকটা।তিতি যখন তার আধো আধো বোলে জান্নাহ্কে পরীমা বলে ডাকে জান্নাহ্ এর সত্যিই নিজেকে মা মনে হয়।

নরম পায়ে ঘরে ঢুকে সারহান।তাকে দেখেই দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে তিতি।সারহান ভাগ্নির চোখে মুখে অধর ছুঁইয় বললো–

“কেমন আছে আমার তিতি মামুনি?

“ভালো।”

সারহান এক বক্স চকলেট ধরিয়ে দেয় তিতির হাতে।প্রশ্ন করে–

“তিতিপাখির পড়া কী শেষ?

তিতি চটপটে গলায় বললো–

“হুম।”

“তাহলে মামুনির কাছে যাও।”

“আচ্ছা।”

তিতি যেতেই কাউচে হেলান দিয়ে বসে সারহান।কলার টা পিছনের দিকে ছড়িয়ে দেয়।চক্ষু মুদন করে থমথমে গলায় বললো–

“দাঁড়িয়ে আছেন কেন?

“জান্নাহ্ নিঃশব্দে তার পাশে এসে বসে।নরম গলায় সারহান বললো–

“সন্ধ্যায় কিছু খেয়েছেন?

“জ্বী।
কোথায় ছিলেন আপনি?

সারহান চোখ খুলে শক্ত দৃষ্টিতে তাকায়।মুহুর্তেই জান্নাহ্ এর ঝলমলে মুখটা চুপসে যায়।একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে সারহান বললো–

“আপনি এতো পানসে কেনো হয়ে যাচ্ছেন রজনীগন্ধ্যা?

জান্নাহ্ মরিচা পড়া লৌহার মতো চেয়ে থাকে।সারহান আবার বললো–

“এখন আর আগের মতো স্বাদ পাই না।শরীরের যত্ন নেন না আপনি!

জান্নাহ্ বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে।অসহায় তার দৃষ্টি।স্থির তার দেহপিঞ্জর।নিঃশ্বাসের গড়পড়তায় উঠানামা করছে জান্নাহ্ এর বুক।প্রগাঢ় দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আছে সারহান।ধীরগতিতে সারহান তার হাত জান্নাহ্ এর পেছন দিক থেকে ঘুরিয়ে জান্নাহ্ এর উদোরে চেপে ধরে।আরেক হাত দিয়ে জান্নাহ্ এর হাত টেনে তার বুকের উপর শোয়ায়।জান্নাহ্ এর অধরপল্লবে দীর্ঘ সময় মত্ত থাকে সারহান।পেশিবহুল দুই হাত দিয়ে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরেছে জান্নাহ্কে।জান্নাহ্ তার বুকে আর পিঠে ব্যাথা অনুভব করে।কিন্তু সারহানকে বাঁধা দেওয়ার ইচ্ছা বা শক্তি কোনোটাই তার নেই।দীর্ঘ সময় নিয়ে জান্নাহ্ এর অধরামৃত শুঁষে তার গলা, বুকে চুমু খেতে থাকে সারহান।সারহানের স্পর্শেই যেনো কম্পন শুরু হয় জান্নাহ্ এর শরীরে।নিজেকে শান্ত করে সারহান।স্থির দুই চোখে জান্নাহ্কে দেখে।সারহানের ছোঁয়ায় উন্মাদ হয়ে উঠেছিলো জান্নাহ্।কিন্তু সারহান থেমে যেতেই নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে নিজের কাছে তার।সারহান অধর কোণে বাঁকা হাসে।জান্নাহ্ এর অবস্থা এখন জ্বলন্ত উনুন থেকে লাকড়ি সরিয়ে নেওয়ার মতো।দুই চোখ বুজে মৃদু গলায় সারহান বললো–

“আমার জন্য ঠান্ডা পানি নিয়ে আসুন রজনীগন্ধ্যা।আপাতত আপনার দেওয়া উত্তাপ পানি দিয়ে শীতল করি।”

জান্নাহ কোনো কথা বললো না।শাড়িটা ঠিক করে হাঁটা ধরে।জোর গলায় সারহান বললো–

“রজনীগন্ধ্যা,শাড়িটা ঠিক করুন।বাইরে নেড়ি কুকুর বসে আছে।”

চলবে,,.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here