#জান্নাহ্
#পর্বঃ৩০
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
অনবরত রিং হওয়ার পরও সারহানের মোবাইল রিসিভ করার সাহস পাচ্ছে না জান্নাহ্।স্ক্রীনে ইহতিশামের নাম দেখে একটু ধাতস্থ হয়ে রিসিভ করে কল।
কাঁপা কাঁপা গলায় বললো—
“হহহ্যালোএ।আসসালামু আলাইকুম।”
ওপাশ থেকে উচ্ছল হেসে ইহতিশাম বললো—
“ওয়ালাইকুমুস সালাম।হ্যাপি অ্যানিভার্সেরি মিসেস জেইদি।”
জান্নাহ্ এর ঠোঁটের কোণে ফুঁটে উঠে এক চিলতে হাসি।মিষ্টি গলায় বললো—
“থ্যাংক ইউ।”
ইহতিশাম সরস গলায় বললো–
“কেমন আছো?
সরি তুমি বললাম।”
জান্নাহ্ হেসে হেসে বললো—
“ছোট বোনকে তুমি বলা যায়।”
ইহতিশাম স্বস্তি নিয়ে বললো–
“দ্যাটস লাইক আ কিউটি।আচ্ছা,তোমার ওই ঘাড় তেড়া বরটা কোথায়?
“সারহান ওয়াশরুমে।”
“ওকে।ওকে বলো আজ রাতে আমি ডিনারে আসছি।”
জান্নাহ্ ভ্রু কুঞ্চি করে।যেই মানুষটাকে সারহান একদমই সহ্য করতে পারে সেই মানুষটাই অকপটে কতো সুন্দর করে তার কাছে আসতে চায়।সারহান তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করেছে কাছের মানুষ না চিন্তে পেরে।যেই মানুষগুলোকে সে বিশ্বাস করে আদৌ তারা তার শুভাকাঙ্ক্ষী কি না সারহান তা জানে না।দীর্ঘশ্বাস ফেলে জান্নাহ্।
কৌতুহলী গলায় বললো–
“কোনো কাজ আছে তিশাম ভাইয়া?
“উঁহু।তোমারদের অ্যানিভার্সেরি উপলক্ষে একটা ট্রিট তো দিতেই পারো।”
মুচকি হেসে নরম গলায় জান্নাহ্ বললো–
“আচ্ছা।”
ইহতিশাম উদ্বেলিত গলায় বললো–
“এই তোমার ওই ঘাড় তেরা বরকে বলো কিন্ত নাহলে আবার ঘরে ঢুকতে দিবে না আমাকে।”
খলখলিয়ে হেসে উঠে জান্নাহ্।ওপাশ থেকে মেকি আক্ষেপের গলায় বললো ইহতিশাম—
“হায়,তোমার এতো সুন্দর হাসিটা স্বচক্ষে দেখা থেকে বঞ্চিত হলাম।”
জান্নাহ্ আবারও হেসে কুটি কুটি হয়।বললো—
“রাতে এলে আরো জোরে জোরে হেসে দেখাবো আপনাকে।”
“ওকে মাই কিউটি।রাখি এখন।”
মোবাইল রাখার ক্ষনকাল বাদ সারহান বের হয় ওয়াশরুম থেকে।জান্নাহ্ এর দিকে সরু দৃষ্টি রেখে বললো—
“কে কল করেছে?
“তিশাম ভাইয়া।”
জান্নাহ্ এর মুখে তিশাম ভাইয়া শুনে সারহানের চাহনি গাঢ় হয়।কিন্তু ভাবনার অবসান ঘটিয়ে ঈষৎ রাগমিশ্রিত গলায় বললো—
“কেন?
“আজ ডিনারে আসতে চায় সে।”
“ওর কী আমার ফ্ল্যাটকে রেস্টুরেন্ট মনে হয়!
জান্নাহ্ ঠোঁট চিপে মৃদু গলায় বললো—
“উনি যখন নিজ থেকে আসতে চাইছে তাহলে আপনি কেন রাগ করছেন?
সারহান কাঠ কাঠ গলায় বললো—
“কারো উপর রাগ নেই আমার।”
ম্লাণ চোখে তাকায় জান্নাহ্।সারহানকে বোঝে না সে।সকাল হতেই সব ঠিক ছিলো।এখন আবার কেমন গম্ভীর হয়ে আছে।সারহান মৃদু উদ্বিগ্ন গলায় বললো—
“আপনি পারবেন?না কি আমি বাইরে থেকে খাবার আনাবো?
জান্নাহ্ আপত্তি করে বললো–
“আরে না,না।বাইরের খাবারই যদি খেতে হয় তাহলে ঘরে আসার দরকার কী!আপনি চিন্তা করবেন না।আমি পারবো।”
সারহান ছোট্ট শ্বাস ফেলে নিরুত্তাপ গলায় বললো—
“যান,তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিন।আজ এনজিও তে যাওয়ার কথা আপনার।আবার জলদি ফিরতেও হবে।”
স্বশব্দে হাসে জান্নাহ্।হাত উঠিয়ে এক,দুই,তিন,চার,পাঁচ করে পাঁচ আঙুল সারহানের সামনে ধরে ঝলমলে গলায় বললো—
“চার পাচা বিশ।আপনি বিশ মিনিট ওয়েট করুন।আমি ঝট করে গিয়ে ফট করে রেডি হয়ে যাচ্ছি।”
অধর প্রসারিত করে হাসে সারহান।জান্নাহ্ এর এই বাচ্চামোতেই বার বার প্রেমে পড়তে ইচ্ছে করে।কিন্তু আদৌ কী সে মেয়েটা তার মতো ছেলেকে ডিজার্ব করে?কেন এলো জান্নাহ্ তার জীবনে?জান্নাহ্ আসার আগেই তো তার সব শেষ।এক মরুভূমি বানিয়ে ফেলেছে নিজের জীবনকে।সেই মরুভূমির বুকে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে নেমেছে জান্নাহ্।মরিচিকার পেছনে ছুটছে সে।পাবে কী সে তার দেখা?
সারহানের চিন্তার রেশ কাটে জান্নাহ্ এর যাওয়ার পানে চোখ পড়তেই।ব্যস্ত হয়ে ডেকে উঠে—
“রজনীগন্ধা।”
পেছন ফিরে তাকায় জান্নাহ্।চোখে হেসে সারহান বললো–
“আপনার যে খয়েরি পাড়ের সাদা শাড়িটা আছে আজ ওটাই পড়বেন।”
মৃদু হেসে চোখের সাহায্যে সারহানকে আশ্বস্ত করে জান্নাহ্।
,
,
,
এনজিও এর বাইরে দক্ষিন দিকটায় একটা বিশাল আমগাছ।তার গা ঘেঁষেই একটা একটা নারকেল গাছ।আমগাছটার চার ধারে গোলাকার করে বসার জন্য বেড় দিয়ে রেখেছে।আমগাছের পাতার ফাঁক দিয়ে এলিয়ে আসছে দিবাকরের জ্যোতি।মৃদু বাতাস বইছে।তাতে নড়ছে নারকেলের গাছের সরু পাতা।দুটো পাখি বসে আছে।এক অপরের দিকে প্রগাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে কিছু একটা বলছে যা আমাদের মনুষ্যজাতীর ধারণার বাইরে।
সামনেই একটা কালো রঙের কুকুর।নাক দিয়ে শুঁকে যাচ্ছে বালুতে মেশানো মুরগির নাড়িভুঁড়ি।বিকট গন্ধ তার।কিন্তু কুকুরটি পরম ভক্তিতে তা শুঁকছে।সেই বেড়ের উপর বসে নির্নিমেখ চেয়ে আছে ওই কুকুরের দিকে সারহান।মাঝে মাঝে নিজেকে তার কাছে তেমনই মনে হয়।একদম ছন্নছাড়া।কুকুরকে যেমন তার প্রভু নিজের হেফাজতের জন্য খাইয়ে দাইয়ে নিজের কাছে রাখে।সারহানের জীবনটাও তাই।তাকেও সেই মানুষগুলোর প্রয়োজন।তাই তো এতো আদর যত্ন তার।সারহান অধরের কোণ কিঞ্চিৎ প্রসারিত করে ম্লাণ হাসে।জান্নাহ্ নামের সুবাসিত ফুলটা তার জীবনে না আসলেই পারতো!তাকে ভালো না বাসলেই পারতো!তার বিষাক্ত জীবনের সাথে না জড়ালেই পারতো!
পাশে বসা শায়িখ নিজের স্যারকে এতোটা চিন্তামগ্ন কখনো দেখেনি।দুই ভাবিত নয়ন দিয়ে বসে আছে সারহানের পানে।কখন তার স্যার কথা বলবে।কিন্তু সারহান কিছু বললো না।সে ওই কুকুরটিকে দেখছে।পঁচা,দুর্গন্ধযুক্ত নাড়িভুঁড়িগুলো পরম তৃপ্তির সাথে খাচ্ছে।সারহানকে এতোটা বিধ্বস্ত শায়িখ কখনো দেখেনি।হঠাৎ করে সারহানের দুই চোখ চকচক করে উঠে।শায়িখের চোখ এড়ালো না তা।এই মানুষটাকে নেহাত কম নয় অতি মাত্রায় ভালোবাসে বলেই তার ছায়া হয়ে আছে শায়িখ।নারীসঙ্গ ছাড়া আর কোনো খারাপ অভ্যাস সারহানের নেই।বরং ভালোগুন দিয়ে ভরা।অকৃতজ্ঞতা তার রক্তে নেই।কেউ যদি হাঁটু সমান পানিতে তার জন্য নামে তার জন্য গলা পর্যন্ত নামে সে।কেউ যদি রক্ত দিয়ে তাকে সাহায্য করে তাহলে নিজের কিডনি দিয়ে তার ঋণ শোধ করে।
কিন্তু শায়িখ একটা জিনিস খেয়াল করেছে,বিয়ের পর থেকে অনেকটা বদলেছে সারহান।শায়িখ সারহানের বিয়ের কথা শুনে শুধু অবাক নয় চরম অবাক হয়।কারণ নিজের নোংরা স্বভাবের কারণে কখনো বিয়েতে ইন্টারেস্ট ছিলো না সারহানের।বিয়ে নামক বন্ধনে সে কখনো নিজেকে বাঁধতে চায় নি।কিন্তু কেন করলো সে বিয়ে?এর উত্তর জানা নেই শায়িখের।
তবে জান্নাহ্ আসার পর অনেকটা নিজেকে কাজে ব্যস্ত রেখে নারীসঙ্গ এড়ানোর চেষ্টা করলেও লোকে বলে না মিষ্টির উপর মাছি বসবেই।মেয়েগুলোও তেমন।ছাড়তে চায় না।
সারহানের দৃষ্টি কাড়তে গলা খেঁকরি দিয়ে উঠে শায়িখ।নরম গলায় বললো–
“এখন কী করবেন স্যার?
সারহান উদাস ভঙ্গিতে বললো—
“তুমি ভালো করেই জানো টাকার প্রয়োজন নেই আমার।”
“কিন্তু স্যার মন্ত্রীসাহেবের সাথে পাঙা নেওয়া কী ঠিক হবে?
সারহান আলতো দৃষ্টি দিয়ে মোলায়েম গলায় বললো—
“তাকে বলো টাকা আমার লাগবে না।সে যেনো তার পুরো রেকেটের ইনফরমেশন আমাকে দেয়।”
বোকা হাসলো শায়িখ।কপট চঞ্চল গলায় বললো–
“শেয়ালের কাছে কেউ মোরগ বাগা দেয়!
চোখে হাসে সারহান।হাস্যোজ্জ্বল গলায় বললো—
“এইবার দিতে হবে।তাকে বলো,আমি তার কোনো ক্ষতি করবো না।তার কোনো ইনফরমেশনও লিক করবো,না অ্যাসাইমেন্ট জমা দিবো।ওই ফুটেজও আমি তাকে দিয়ে দিবো।সে শুধু আমাকে একটা হেল্প করবে।তার যত ট্র্যাফিকিং এর আড্ডা আছে সব ঠিকানা আমার চাই।”
শায়িখের কপালে মৃদু ভাঁজ তোলে।সারহান কাউকে খুঁজছে।কিন্তু কাকে?আদৌ কী সে বেঁচে আছে?কিন্তু কে সে?গত চারবছর ধরেই তো দেখছে।প্রশ্নও করেছে।কিন্তু তার কোনো সদুত্তর সে পাইনি।শায়িক আনম্র গলায় বললো—
“কিন্তু স্যার মন্ত্রীসাহেব এমনটা কখনই করবে না।আর এখন তো ভাবিজানও আপনার সাথে।যদি কিছু করে বসে!
সারহান বিগলিত হাসলো।স্বাভাবিক গলায় বললো–
“আই থিংক সে এই ভুল করবে না।আমি সেই ফুটেজ অলরেডি আমার গোপন আইডিতে অটো পাবলিশ করে রেখেছি।নির্দিষ্ট সময় পর পর তার ডেট চেঞ্জ করতে হয়।যদি আমার কিছু হয় সেই ফুটেজ অটোমেটিকলি ভাইরাল হয়ে যাবে।এতে মন্ত্রীসাহেব মিশে যাবে মাটির সাথে।আমাকে মেরে তার কোনো লাভ হবে না।”
শায়িগ উদ্বেলিত গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে—
“আপনি একা নন স্যার।ভাবিজান..।”
সারহান উঠে দাঁড়ায়।দুই হাত পকেটে গুঁজে দৃঢ় হয়।শক্ত কন্ঠে বললো—
“তাকে নিয়ে তোমার চিন্তুা করতে হবে না।যদি এমন কিছু হয় আমার প্রাণের বিনিময়ে আমি তার প্রাণ চাইবো।আর তুমি ভালো করেই জানো আমার সার্টিফিকেটে আমার বাড়ির ঠিকানা নেই।সব ফেক।মন্ত্রীসাহেব সে পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবে না।
তাই তাকে বলো অতি সত্তর আমার ইন্ডিয়ার যাওয়ার সমস্ত ব্যবস্থা যেনো সে করে।তার সব কিছু আমি তাকে ফিরিয়ে দেবো।বাট,তার ওই গুপ্ত হোটেল আর খুলবে না।”
শায়িখ জানে সারহানকে ভবিতব্য সম্পর্কে কিছু বলে লাভ নেই।সে বর্তমানে বিশ্বাসী।সারহান মৃদু ছন্দে বলে উঠে–
“রাতে বাসায় এসো।জান্নাহ্ আজ নিজের হাতে তোমাদের রান্না করে খাওয়াবে।”
ঢোক গিলে শায়িখ।মুখটা চোরের মতো করে মাথা নিচু করে।সারহান মুচকি হেসে বললো—
“ইহতিশামকে তুমিই বলেছো তাই না!
শায়িখ কথা বললো না।সে অনুযোগের চোখে তাকিয়ে রইলো।
এনজিওর ভেতরে নরম ঘাসের উপর বৃত্তাকার হয়ে বসে আছে ছোট ছোট বাচ্চারা।তাদের মাথার উপর রক্ত বর্নের শিমুল গাছ।ছায়াবিথী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে।জান্নাহ্ এর কোলে দুই বছরের একটি বাচ্চা।বাচ্চাটা বেশ আমোদিত জান্নাহ্ এর কোলে বসে।এই বাচ্চাকে রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছে শ্রীজা।কুড়িয়ে নয় কেউ ফেলে রেখে গিয়েছিলো আস্তাকুড়ে।আচমকাই জান্নাহ্ এর পাশে এসে বসে সারহান।তার মিষ্টি গম্ভীর চেহারাটায় চোখ দুটো অদ্ভুতভাবে খেলছে।বাচ্চাটির হাত ধরে নাড়াতে নাড়াতে আহ্লাদী গলায় জিঙ্গাসা করে জান্নাহ্—
“কী নাম তোমার?
বাচ্চাটি ভাঙা ভাঙা গলায় বললো–
“ছুচি।”
ঝুমঝুম করে হেসে উঠে জান্নাহ্।তার হাসিতে ঝরা হাসে সারহান।বাচ্চাটির হাত ধরে বললো–
“সূচি কন্যা সকালে কী খেয়েছেন?
সূচি তার স্বশব্দে বললো–
“আতু,পলোতা।”
সূচির গালে আলতো চুমু খায় সারহান।জান্নাহ্ প্রগাঢ় দৃষ্টিতে দেখছে।ফিকে গলায় বললো–
“আপনার বাচ্চা ভালো লাগে সারহান?
সারহান হেয়ালি গলায় বললো–
“আপাতত পরের বাচ্চা ভালো লাগে।”
জান্নাহ্ অদ্ভুত মুখভঙ্গি করে খসখসে গলায় বললো–
“কেন,কেন?
সারহান জান্নাহ্ এর ঠোঁটের কাছে মুখ এনে বললো–
“এক বাচ্চাকে সামলাতে কষ্ট হচ্ছে আমার।”
বলেই মৃদু ছন্দে হেসে উঠে সারহান।ভ্রু কুঁচকে অস্বস্তি নিয়ে জান্নাহ্ বললো—
“আই এম নট বাচ্চা।”
সারহান মেকি প্রতিবাদ করে বললো—
“নাতো।ইউ আর মাই ষোড়শী রজনীগন্ধা।”
চলবে,,,