জান্নাহ্ “পর্বঃ৩৭

0
3874

#জান্নাহ্
#পর্বঃ৩৭
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

জাবিন বাড়ন্ত বয়স থেকেই পড়ালেখায় উদাসীন।কেন যেনো তার পড়ালেখায় মন বসে না।সারহানের প্রতি বিদ্বেষ সেই জ্বলন্ত আগুনে খাঁটি ঘিয়ের মতো।সারহান যেমন নিজের মন মতো চলাফেরা করে জাবিনও তেমনটা চায়।কিন্তু পারে না সারহান আর তার মা শুভ্রার জন্য।দুইজনই জাবিনের পড়ালেখায় মাত্রাতিরিক্ত তৎপর।এক চিমটি ছাড় নেই যেনো।তাই তো টেনশন এড়াতে মানবিক শাখা নিয়ে পড়ছে।জাবিনের মুখস্ত বিদ্যা দারুন লেবেলের।

একটা চেয়ারের উপর বসে আরেকটা চেয়ারে পা উঠিয়ে টেবিলে খাতায় কিছু একটা লিখে চলছে।আজকাল পড়ালেখায় বেশ মনোযোগী জাবিন।জান্নাহ্ এর সাথে ভাবটাও বেড়েছে।ঝাঁকড়া চুলগুলো বৈদ্যুতিক ফ্যানের বাতাসে উড়ে চলছে।পড়ার টেবিলটায় বই খাতায় ঠাসা।বিছানার পাশেই টেবিল।উত্তরে দেয়ালের সাথে ছোট্ট আলমিরা।তার পাশেই ক্রিকেট ব্যাট,ক্যারামের বোর্ড রাখা।আর কোনো ভারি আসবাবপত্র নেই বললেই চলে।ভেজানো দরজা কিঞ্চিৎ ফাঁক করে সুরেলী কন্ঠে জান্নাহ্ অনুমতি চাইলো।

“ভেতরে আসতে পারি?

শান্ত দৃষ্টিতে তাকায় জাবিন।চেয়ার থেকে পা টা নামিয়ে সোজা হয়ে বসে।একগাল প্রানবন্ত হেসে বললো–

“ইয়েস মিসেস জেইদি।”

কোমল হাসে জান্নাহ্।দরজাটা তার যতটুক প্রয়োজন ততটুকু ফাঁক করে ভেতরে আসে।জাবিনের সামনে গিয়ে উচ্ছল হেসে বললো–

“পড়ছো?

জাবিন নিঃশব্দে মাথা নাড়ে।পায়ের কাছে থাকা চেয়ার আরেকটু আলগা করে জান্নাহ্কে বসার জন্য ইশারা করে।জান্নাহ্ মিষ্টি হেসে বসে।জাবিন খাতাটা বন্ধ করে পেনস্ট্যান্ডে পেনটা রেখে জান্নাহ্ এর দিকে আস্ত নজর দিয়ে বললো–

“কিছু বলবে?

জান্নাহ্ মৃদুহাস্য অধরে বললো–

“হুম।”

“কী?

জান্নাহ্ অনেকটা মন মরা হয়ে বললো—

“সারহানের উপর রাগ কমেছে?

জাবিন তাচ্ছিল্য হাসলো।সরব গলায় বললো–

“মামার উপর আমার রাগ নেই।তুমি ভালো আছো তো?

জান্নাহ্ এর চোখ চকচক করে উঠে।প্রসন্ন হাসে সে।জাবিন আজ সারহানকে মামা বলেছে।মিচকি হেসে ফিচেল গলায় জান্নাহ্ বললো—

“এইবার আমাকে মামি বলো।”

বিরস হাসে জাবিন।ম্লাণ গলায় বললো—

“যদি তুমি খুশি হও তাতে তাহলে ডাকবো।তাহলে কিন্তু আর আমরা ফ্রেন্ড থাকবো না।আমাদের সম্পর্ক বদলাবে।মামি,ভাগ্নে হবে।তুমি রাজী তো?

টিমেটিমে চোখে তাকায় জান্নাহ্।ক্ষুন্ন খলায় বললো—

“এ কেমন কথা!

জাবিন ফিচেল হেসে বললো–

“এটাই কথা।”

জান্নাহ গুমোট গলায় বললো–

“তাহলে দরকার নেই।”

ফকফক করে হেসে উঠে জাবিন।ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো–

“ইশ!এসেছেন আমার মামি হতে!

জান্নাহ্ চোখ ছোট ছোট করে নাক কুচকে সরব গলায় বললো–

“দুষ্ট ছেলে কোথাকার!

চকিতে জান্নাহ্ এর পায়ের উপর দু হাতের কনুই ভেঙে ঝাঁপিয়ে পড়ে তিতি।উচ্ছলিত গলায় আবেগ নিয়ে চোখ বড় বড় করে বললো—

“পরীমা,বাবু আনবে?

জান্নাহ ভ্রু কুঞ্চি করে বিমূঢ় গলায় বললো–

“কীসের বাবু তিতি সোনা!

তিতি গদগদ গলায় হাত নাড়িয়ে বললো–

“ছোট্ট বাবু।”

জান্নাহ্ চেয়ার ছেড়ে ফ্লোরে পা ঠেসে বসে।তিতির দুই ফুলকো গাল অঞ্জলিতে নিয়ে বললো–

“আমার তিতি সোনার বাবু লাগবে?

তিতি ঝুমঝুমিয়ে হেসে উঠে।খিলখিলিয়ে বললো–

“হা,হা।”

জান্নাহ্ তিতির নরম গালে ঠুসে চুমু খেয়ে বললো–

“আচ্ছা।মামাকে বলবো আমার তিতি সোনার জন্য একটা বাবু নিয়ে আসতে।ওকে?

“আচ্ছা।”

ঝলমলে গলায় জাবিন বলে উঠে–

“জান্নাহ্!

জান্নাহ্ হেয়ালি চোখে তাকিয়ে বললো–

“কী?

“তুমি যাবে?

জান্নাহ্ অতি উৎসাহের সাথে বললো-

“কোথায়?

“ওই যে অতিনদের বাড়ি।অতিনের ভাবির ছেলে হয়েছে।চলো না যাই।”

জান্নাহ্ ভাবনাতীত বিস্ময় নিয়ে বললো–

“এখন!আম্মা জানলে খবর আছে।এই সন্ধ্যায় বের হলে তিনটারই ঠ্যাঙ ভেঙে দিবে।”

জাবিন আর তিতি ঘর কাঁপিয়ে হাসে।ছোট দম ফেলে আবেগী গলায় জাবিন বললো–

“তিতি যখন ছোট ছিলো কী মিষ্টি ছিলো!একদম তুলোর বল।কী নরম নরম ছিলো ওর হাত,পা।আর চোখ গুলো একদম চাইনিজদের মতো ছিলো।গাল দুটোতে এতো মাংস ছিলো চোখই খুলতে পারতো না।”

ঝরঝরে হাসে জাবিন।হাসতে হাসতে হঠাৎ ই তার হাসি মিলিয়ে যায়।দুঃখী দুঃখি গলায় বললো–

“ইশ!এখন যদি তিতি ছোট থাকতো কতো ভালো হতো!

জান্নাহ্ দেখতে পায় জাবিনের চোখে মুখে এক অদ্ভুত আকাঙ্ক্ষা লুকোচুরি খেলছে।সলজ্জ হাসে জান্নাহ্।হয়তো এই ছোট্ট আকাঙ্ক্ষা অতি সত্তর পূরণ হতে চলেছে।
,
,
,
শুভ্র বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে জসিম।তার মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো।সমস্ত শরীর নিথর,নিস্তব্ধ,অসাড়।জসিমের শরীরে এমন ধরনের পয়জন ইনজেক্ট করা হয়েছে যাতে তার পুরো শরীর প্রাণহীন হয়ে যায়।একমাত্র তার হার্টবিট চলছে।ডক্টর আরো একটা জরুরী ইনফরমেশন দিয়েছে।আর সেইটা এই কেসে আপাতত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

জসিমের সামনেই একটা প্রজেক্টর লাগানো।তার স্থির দুই দৃষ্টি নিশ্চলভাবে আবদ্ধ সেই প্রজেক্টরে।কৃত্রিম অক্সিজেনই এখন তার বাঁচার একমাত্র উপায়।জসিমের পাশেই হসপিটালে সিনিয়র নিউরোলজিস্ট দাঁড়ানো।তার পাশেই তার জুনিয়র যে বর্তমানে জসিমকে কেয়ার করছে।জসিমের মুখে তাক করা ক্যামেরা যাতে তার মুখের প্রতিটি অভিব্যক্তি স্পষ্ট বোঝা যাবে।যার কানেকশন দেওয়া ইহতিশামের ল্যাপটপে।ক্যাবিনের একপাশে একটা চেয়ারে গম্ভীর হয়ে বসে আছে ইহতিশাম।তার ভয়ংকর সরু চোখ দুটো আবদ্ধ সামনের ল্যাপটপের স্ক্রিনে।দুই হাতের আঙুলগুলো একে অপরের মাঝে গুঁজে তার উপর চিবুক দিয়ে দেখে যাচ্ছে জসিমের দুই চোখ।

বেশ কিছু সময় যাওয়ার পরও কোনো ফল না পেয়ে বিতৃষ্ণা ইহতিশাম।প্রজেক্টরে একের পর এক হিস্ট্রিশিটারদের ছবি দেখানো হচ্ছে।এসির ভোঁতা ঝিমঝিম শব্দের সাথে তার বিক্ষিপ্ত মস্তিষ্কের নিউরণগুলো যেনো লড়াই শুরু করেছে।চকিতে ইহতিশামে চোখ আটকে যায়।হাতের ইশারায় তার অ্যাসিস্টেন্টকে প্রজক্টর পজ করতে বলে।ইহতিশাম ল্যাপটপের আরেকটু কাছে এগিয়ে এসে দেখে জসিমের সমাহিত চোখের পল্লবে মৃদু কম্পন দেখা দিচ্ছে।তার চোখের মনি কিঞ্চিৎ নড়ছে।স্কেচ করা ছবিটি প্রজেক্টরে প্লে হতেই জসিম যেনো সপ্রতিভ হয়।ওই অসাড় দেহে প্রাণ সঞ্চিবনী বোধহয় এখনই দৌঁড়ে এসে বলতো,”এই,এই সে ব্যক্তি।”

জসিমের অবস্থা খারাপ হতে থাকে।তার শ্বাসের গড়পড়তা বাড়তে থাকে।ইহতিশাম প্রজেক্টর অফ করার অর্ডার দেয়।ছবিটা নিয়েই ক্যাবিন থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে সে।
এই ছবিটা সেই হুডি পড়া লোকটার।ক্যাফেটেরিয়ার অনেক সার্ভিস বয়ই তাকে দেখেছে।তাদের সকলের মিলিত প্রচেষ্টায় এই স্কেচ তৈরি করা হয় যার ফুল প্রুভ চেক করে জসিম।ইহতিশাম নিমগ্নচিত্তে স্কেচ দেখতে থাকে।আচমকা তার টিমের একজন দৌঁড়ে এসে তাকে একটা ফাইল দেয়।গত একমাস ধরে একটা খুনের তদন্ত করছে পুলিশ।কিন্তু কিছুই করতে পারছে না।ইহতিশাম তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে ফাইলটা খুলে দেখে।

নামঃশ্রীজা ব্যানার্জী।
বয়সঃ২৫

বাকিটা আর পড়লো না ইহতিশাম।তোতাপাখির মতো তার টিমের জুনিয়র ফারুক বলতে লাগলো–

“মেয়েটা একটা মাল্টিন্যাশনার কোম্পানিতে জব করতো।একটা এনজিওর সাথেও যুক্ত ছিলো।সেখানেই থাকতো।যেদিন খুন হয় সেদিনও এনজিওর কাজে গাজীপুর যাচ্ছিলো।পথে কিছু একটা হয়।যে বা যারা খুন করেছে পুরো মুখটা ঝলসে দিয়েছে।তাই তো পরিচয় পেতে এতো সময় লাগলো।কিন্তু মৃত্যু হয়েছে সার্জিক্যল নাইফে কাটা শ্বাসনালির এক্সেস ব্লিডিংএ।”

ইহতিশাম চোখের কোন ক্ষীন করে অবাক বিস্ময়ে বললো–

“হোয়াট?আর ইউ সিরিয়াস?

ফারুক নিরুত্তাপ গলায় বললো–

“ইয়েস স্যার।”

“এনজিওর ওনার কে?

ফারুক নির্দ্বিধায় বললো–

“ফাইলে তার নাম আছে স্যার।”

ইহতিশাম অনিচ্ছা সত্ত্বেও আরেকবার চোখ বুলায় ফাইলের ফার্স্ট পেজে।চকচক করে তার ইগল চোখ দুটি। থম মেরে কিছু একটা ভাবতে লাগলো সে।হাতে থাকা স্কেচটা নাক বরাবর ধরে সুক্ষ্ম চাহনিতে দেখছে।রাশভারী গলায় বললো—

“সবগুলো মার্ডারে একটা কমন জিনিস!বলতে পারো সেইটা কী?

ফারুক কৌতূহলী গলায় বললো—

“কী স্যার?

ইহতিশাম নির্বিঘ্ন গলায় বললো–

“সার্জিক্যাল নাইফ।মার্ডারার সার্জিক্যাল নাইফের ব্যবহার অতি সন্তর্পনে করে যাতে প্রতীয়মান হয় সে এই বিষয়ে অভিজ্ঞ।”

উৎসুক চাহনিতে আবদ্ধ করে ফারুক ইহতিশামকে।কিন্তু ইহতিশামের বিচলিত অক্ষিদ্বয় সেই স্কেচে নিবদ্ধ।কেনো যেনো তার মনে হলো স্কেচের মানুষটিকে সে চেনে।কারো সাথে তার চেহারার অনেকটা মিল।ইহতিশামের চোখে ভাসে তার প্রিয়তমার সেই স্নিগ্ধ মুখচ্ছবি।হাসলে অনেকের যেখানে টোল পড়ে তার প্রিয়তমার সেই জায়গায় টোলের পরিবর্তে এক মারাত্মক সুন্দর তিল।
আরো একটা বিষয় মাথা চাড়া দিয়ে উঠে ইহতিশামের।সবগুলো খুনের সাথেই একটাই নাম জড়িয়ে।সে মানুষটা তার খুব কাছের।কিন্তু খুন!

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here