#জান্নাহ্
#পর্বঃ৪২
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
জান্নাহ্ এর দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়ে বসে আছে সারহান।তার অধরে বাঁকা হাসি আর চোখে একরাশ প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে।সোজা হয়ে বসে অত্যন্ত সাবলীল কিন্তু দৃঢ়চিত্তে প্রশ্ন ছুঁড়ে সারহান—
“আপনাকে দেখে কেরানির মেয়ে মনে হয় না।মনে হয় কোনো ডক্টরের মেয়ে।সবকিছুই যেনো ছোটবেলা থেকেই আপনাকে শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছে?
জান্নাহ্ এর মধ্য কোনো ভাবাবেশ হলো না।বারান্দায় থাকা কিছু শুকনো কাপড় এনে তা ভাঁজ করতে করতে সরল গলায় নির্বিঘ্নে বললো—
“প্রাথমিক চিকিৎসা সবার জানা উচিত।তা ডক্টরের মেয়ে হোক আর কেরানির।”
সারহান প্রশ্রয়ের সুরে বললো–
“ওয়েল সেইড।আর আপনার ফোবিয়া?
ভাঁজ করা কাপড়গুলো আলমিরাতে গুঁছিয়ে রেখে স্বশব্দে বললো জান্নাহ্—
“প্রেগন্যান্সিতে ব্লিডিং এর ব্যাপার আছে।তাই আগে থেকেই ট্রিটমেন্ট নিচ্ছি।আপনি ইচ্ছে করলে শুভ্রা আপুকে জিঙ্গেস করতে পারেন।”
সারহানের হাতে একটা প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে দেয় জান্নাহ্।সন্দিগ্ধ দুই চোখ দিয়ে ভ্যাবলার মতো প্রেসক্রিপশন আদ্যোপান্ত দেখছে সারহান।মিচকি হেসে স্বগতোক্তি করে বললো—
“অস্কার তো আপনাকে দেওয়াই উচিত রজনীগন্ধা।ফুল প্রুভ প্ল্যাণ করেই নেমেছেন।আপনার বাবা না জানি আপনাকে কী খাইয়েছে!
পায়ের আঙুলের ব্যাথায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে লুবনা।তা দেখে হেসে কুটিকুটি জাবিন।হেসে হেসে বললো–
“কী হলো লবণ আন্টি!মামা বুঝি তোমার আঙুল ভেঙে দিলো!
লুবনা গর্জে উঠে বললো—
“এক থাপ্পড় মেরে দাঁত ফেলে দিবো।লবণ কিরে?
হা হা করে হেসে উঠে জাবিন।ভাইয়ের সাথে দাঁড়িয়ে ঠোঁটে হাত চেপে হাসে তিতি।পাশেই থমথমে মুখ নিয়ে দাঁড়ানো নিধি।জাবিন একগাল হেসে ফিচেল গলায় বললো–
“মামার সাথে লাগতে গেলে কেন!জানো না,তাকে ইটের টুকরো মারলে পুরো আস্ত ইট ছুঁড়ে মারবে তোমাকে।”
“জাবিন!
শুভ্রার ধমকানোতে ভ্রু ক্রুটি করে জাবিন।উষ্ণ গলায় শুভ্রা আবার বললো—
“এইসব কী ধরনের কথাবার্তা বড়দের সাথে?
জাবিন ভেঙচি কেটে হেয়ালি গলায় বললো—
“আমি কী করলাম!লবণ আন্টিইতো মামার সাথে লাগতে গেছে।”
শুভ্রা দাঁত কিড়মিড় করে বললো—
“আবার!
প্রাণখোলা হাসে জাবিন।হাঁটু ভেঙে বসে তিতিকে বললো—
“চল তিতি,পরীমা আর মামা আমাদের জন্য বাবু আনছে সেই খুশিতে আজ তোকে কুলফি খাওয়াবো।”
তিতি দাঁতের সাথে দাঁত পিষে ধরে অদ্ভুতভাবে হাসে।স্বশব্দে বললো–
“আচ্ছা।”
নিজের ঘরে অন্তরা তার জা এর সাথে খোশখল্পে মশগুল।জরুরি দরকার ছাড়া তেমন একটা মিল নেই তাদের।দরজায় দাঁড়িয়ে অনুমতি প্রার্থনা করে জান্নাহ্।
“ভেতরে আসবো আম্মা?
অন্তরা পান খাওয়া দুই ঠোঁট ছড়িয়ে বললো—
“আসো বউ।”
কোনোরকম ছন্দ পতন ছাড়াই অন্তরার পাশে গিয়ে বসে জান্নাহ্।লুবনার মা লতা অবাক গলায় বললেল—
“বাহ!পোয়াতি হইয়া তো বউমা আরো সুন্দরী হইছে।কী কও আফা?
অন্তরা মুখে একটা পাট ঠুসে নিয়ে ভজভজ করে বললেন—
“কেন!আমার বউমা এমনেই সুন্দরী।”
অন্তরার সাথে তাল মিলিয়ে লতা হেসে হেসে বললেন—
“কথা তো ঠিক আছে।কিন্তু বিয়ার সময় তো এই চিকন আছিলো।এহন তো গায়ে গতরেও বড় হইছে।আর কী ফর্সা হইছে দেখছো!চুলগুলানও মাশাআল্লাহ্!
অন্তরা দাম্ভিকতার সাথে হাসলেন।যেনো তিনি এভারেস্ট জয় করলেন।উচ্ছ্বাসিত গলায় বললেন–
“তা তুই ঠিক ই কইছোস।বউমা আগের তোন মেলা সুন্দরী হইছে।”
ছোট্ট দম ফেলে জান্নাহ্।এছাড়া কী আর কথা নেই!জান্নাহ্ সংকীর্ণ গলায় বললো–
“আম্মা,ডাকছেন আমাকে?
অন্তরা মাথা নেড়ে বললেন—
“হয় ডাকছি তোমারে।তোমার কাকিমা তোমারে কিছু কইতে চায়।”
জান্নাহ্ প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে লতাকে বললো–
“কিছু বলবেন কাকিমা?
সরস হাসলেন লতা।ফিকে গলায় বললেন—
“তুমি কিছু মনে কইরো না বউ।তোমার চাচা আইতে পারে নাই তার জরুরি কাম আছিলো।তয় তোমার লাইগা কিছু পাডাইছে সে।”
লতা জান্নাহ্ এর দিকে এক জোড়া বালা এগিয়ে দেয়।বেশ পুরু আর ভারি মনে হলো জান্নাহ্ এর কাছে।জান্নাহ্ একটু না অনেক বেশিই চমকালো।সারহান আর জান্নাহ্ এর বিয়ের সময়ও তার কাকা শশুড় আসেনি।তবে গয়না তিনি ঠিকই পাঠিয়েছেন।আর আজও তাই হলো।লতা জান্নাহ্ এর দুই হাতে বালা পড়িয়ে বললেন —
“দেহতো পছন্দ হয় কিনা?
জান্নাহ্ মিষ্টি হেসে আলতো গলায় বললো–
“পছন্দ হবে না কেন?জিনিস ত বড় কথা নয় কাকিমা।এর মধ্যে যে আপনাদের ভালোবাসা আর দোআ আছে তা আমার জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ।এইসব গয়না তো টাকা দিয়ে কত পাওয়া যায়।কিন্তু ভালোবাসা কী টাকার বিনিময়ে পাওয়া যায়!
লতা দারুণভাবে হাসলেন।উচ্চ গলায় গদগদ হয়ে বললেন–
“”একখান সোনার টুকরা নিয়া আইছো গো আফা।”
অন্তরা গর্বিত হাসলেন।জান্নাহ্কে এই বাড়ির বউ করে তিনি ভুল করেন নি।এইবার তার ছেলে তার কাছে ফিরে আসলেই হয়।
,
,
,
পাশাপাশি একে অপরের গা ঘেঁষে বসে আছে জান্নাহ্ আর সারহান।মোবাইলে স্ক্রল করে একের পর এক বেবি স্যুট দেখে যাচ্ছে।ছেলে মেয়ে তফাৎ নেই।গভীর মনোযোগ সেই দিকে জান্নাহ্ এর।সারহান পাশেই বসে আছে।জান্নাহ্ এর শরীরের মিষ্টি সৌরভে ঘ্রাণেন্দ্রিয় ঝাঁঝিয়ে উঠে তার।জান্নাহ্ এর কাঁধের দিকটায় নাক ঘষতে থাকে।পরম আবেশে জান্নাহ্ বললো—
“এই ড্রেসটা দেখুন।”
সারহান মত্ত অন্য কাজে।বিরক্তিকর গলায় জান্নাহ্ বলে উঠে–
“দেখুন না!
সারহান কিছু না শোনার মতো চমকে বললো–
“হু।কিছু বললেন?
“হুম।এইটা দেখুন।”
“দেখার দরকার নেই।আপনার যা যা পছন্দ হয় সিলেক্ট করুন।”
সারহানের কথায় কোনো প্রতিক্রিয়া না করে জান্নাহ্ ব্যস্ত হলো দেখায়।হঠাৎ করে অত্যধিক উৎফুল্লতা নিয়ে উঠে দাঁড়ায় সারহান।হকচকিয়ে যায় জান্নাহ্।মুখ ভর্তি প্রাণখোলা হেসে সারহান বললো—
“ভাবুন তো বাবু আসলে কী হবে!ওকে প্রথম আমি কোলে নিবো।উঁহু।আপনি।আরে ধুর! একজন নিলেই হলো।ইশ!কবে যে আসবে!
ঝট করে উঠে সারহানকে জড়িয়ে ধরে জান্নাহ্।অধর ছড়িয়ে খোলা শ্বাস নেয় সারহান।দুই হাতে জান্নাহ্কে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে আবেগী গলায় প্রশ্ন করে—
“কবে আসবে আমাদের পরী?
জান্নাহ্ গভীর আশ্লেষে সারহানের বক্ষস্থলে নাক ঘষে দ্বিরূক্তি করে বললো—
“যদি ছেলে হয়?
সারহান হাতের বেড় শক্ত করে ফিচেল গলায় বললো—
“তাহলে নেক্সট টাইম ট্রাই করবো।”
“ধুর!
একে অপরের সাথে মিশে বেশ কিছু সময় স্থির হয়ে থাকে সারহান জান্নাহ্।জান্নাহ্ আলগোছে তার অধরের স্পর্শ আঁকতে থাকে সারহানের বুকে।বাঁকা হেসে সারহানের বুকের মধ্যে ছোট্ট কামড় বসিয়ে দেয় জান্নাহ্।সারহান আরো চেপে ধরে জান্নাহ্কে।ফিসফিসিয়ে বললো—
“বড্ড সাহস বেড়েছে আপনার!আপনা টাইম ভি আয়েগা।সুদসহ আসল উঠিয়ে নিবো।”
ঘরে ঢুকেই নিজের দুই চোখ হাত দিয়ে ঢেকে ফেলে লুবনা।ব্যস্ত হয়ে বললো—
“আমি কিছু দেখিনি,আমি কিছু দেখিনি।”
সলজ্জ চোখ নিয়ে সারহানের কাছ থেকে সরে দাঁড়ায় জান্নাহ্।সারহান চোয়াল শক্ত করে তীর্যক গলায় বললো—
“ম্যানারলেস লবণ,কারো ঘরে ঢুকতে হলে পারমিশন নিতে হয়।জানিস না?
লুবনা শাহাদাত আর অনামিকা আঙুলের ফাঁক গলিয়ে তাদের দুইজনকে দেখে। চোখের উপর থেকে নিজের দুই হাত সরিয়ে নিজের রেফারেন্সে বললো—
“আমি কী জানি দুইজন যে দরজা খোলা রেখেই জড়াজড়ি শুরু করেছো!
সারহান তিক্ত গলায় বলে উঠে—
“লবণ কী বাচ্চি!
রজনীগন্ধা এই লবণাক্ত পঁচা ইলিশ যতদিন এখানে থাকবে ততদিন দরজা লক করে রাখবেন।ছিঃ!গন্ধে আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না।”
লুবনা ফুঁসলে উঠে বললো—
“জান্নাহ্,তুমি এই সারহান হনুমানের কথা একদম শুনবে না।জংলী টারজান।”
সারহান তেড়ে গিয়ে লুবনার চুল খাবলা মেরে ধরে।কড়া গলায় বললো—-
“ভাবি বল।”
লুবনা চিৎকার দিয়ে উঠে অস্বীকার করে।সারহান আরো জোরে টেনে ধরে চুল।লুবনা আর্তনাদ করে বললো—-
“আহ!ছাড়ো সারহান ভাইয়া।চুল ছিঁড়ে গেলো আমার।”
জান্নাহ্ হতভম্ব হয়ে যায় সারহানের এমন কান্ডে।লোকটা কীসব আচরণ করে!লুবনার চোখে পানি জমে গেছে।কেঁদে দেয় লুবনা।জান্নাহ্ ঝাড়া মেরে সারহানের হাত সরিয়ে দেয়।কপট রাগি গলায় বললো–
“ছাঁড়ুন।কী করছেন!
সারহানের কোনো মায়া হলো না।ডিভানে গিয়ে হাত পা ছড়িয়ে বসলো।বার কয়েক লুবনার দিকে তাকাতেই দেখে ফুঁপাচ্ছে লুবনা।সারহান কৌতুকপ্রদ হয়ে বললো—
“রজনীগন্ধা,তিতির জন্য আনা চকলেটটা লবণের মুখে দিয়ে দিন।এমনভাবে কাঁদছে যেনো ওর চকলেট কেউ নিয়ে নিয়েছে।ঢং!
জান্নাহ্ কোনো কথার তোয়াক্কা না করে সারহানের কাছে এসে তার ঝাঁকড়া চুলগুলো এক মুঠ নিয়েই একটা টান দেয়।ভড়কে যায় সারহান।নাকের ডগায় বিরক্তি নিয়ে বললো–
“এইটা কী হলো!
জান্নাহ্ ফিচেল হেসে ছোট্ট করে বললো–
“টিট ফর ট্যাট।”
“দিজ ইজ নট রাইট রজনীগন্ধা।”
“কেন!রাইট নয় কেন?এখন দেখুন কেমন লাগে।”
“আমার বিড়াল আমারেই বলে ম্যাও।”
জান্নাহ্ চোখ ছোট ছোট করে নাক কুঁচকে বললো–
“আই এম নট বিড়াল।”
সারহান স্বশব্দে ঘোষনা করে—-
“বিল্লি।”
তাদের দুইজনের কথা কাটাকাটিতে কান্না থামে লুবনার।জান্নাহ্ আড়চোখে সারহানকে ইশারা করে বোঝানোর চেষ্টা করে লুবনার জন্যই এইসব করা।জান্নাহ্ মিষ্টি হেসে লুবনার দিকে তাকিয়ে মৃদু গলায় জিঙ্গেস করে—
“তুমি কী কিছু বলতে এসেছিলে?
লুবনা দুই হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে নাক টানতে টানতে ধরা গলায় বললো—
“চাচা তোমাকে খেতে ডাকছে।”
থামে লুবনা।সারহানের দিকে রোষভরা চোখে তাকিয়ে হিনহিনে গলায় বললো—
“এই হনুমানটাকে নিয়ে আসবে না।এটাকে ঘরে আটকে আসবে।”
“তবে রে লবণাক্ত!
সারহান ডিভান থেকে উঠার আগেই হাওয়াই মিলিয়ে যায় লুবনা।খিলখিল করে হেসে উঠে জান্নাহ্।তার হাসিতে মুচকি হাসে সারহান।
চলবে,,,