#জান্নাহ্
#পর্বঃ৪৩
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
খাওয়ার টেবিলে একে অপরের দিকে চাপা রাগ নিয়ে আড়চোখে দেখছে।বাড়ির সবাই খাওয়ায় অভিনিবেশ করেছে।সারহান যতবার লুবনার দিকে তাকিয়েছে ততবারই লুবনা মুখ ভেঙচি দিয়েছে নাহলে অদ্ভুত কোনো মুখভঙ্গি করেছে।সেইসব বেশ মজা নিয়ে উপভোগ করছে জাবিন আর সারহানের পাশে দাঁড়ানো জান্নাহ্।ফচকে হাসিতে ব্যস্ত জাবিন।জান্নাহ্ ইশারা করে হাসতে বাড়ন করে জাবিনকে।আচমকাই লুবনা উবলে উঠে বললো—
“বড় চাচা,তুমি এই টারজানটাকে জঙ্গল থেকে আনলে কেন?
লুবনার অকস্মাৎ এহেন কথায় সবাই হতভম্ব ভাব কাটিয়ে উঠার আগেই সারহান দীপ্ত কন্ঠে বলে উঠে—
“কাকীমা, যত তাড়াতাড়ি পারো এই লবণকে বিয়ে দিয়ে বিদায় করো।নাহলে কিন্তু এ পঁচা ইলিশের জন্য বর খুঁজে পাবে না।”
লুবনা কৃত্রিমতা কাটিয়ে স্বশব্দে বললো–
“হে,এসেছে।আমাকে নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না।তোমার ভাগ্য ভালো যে জান্নাহ্ এর মতো এতো কিউট একটা মেয়ে তোমাকে বিয়ে করেছে।ওর জায়গায় আমি হলে তোমাকে ওই বেল তলার নাক বোঁচা আর দাঁত উঁচু শিয়াল কন্যার সাথে বিয়ে দিতাম।”
সারহান ঠোঁট গুঁজ করে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে মিয়ম্রান কন্ঠে বললো–
“আমার তো হয়েছে বিয়ে।তুই তো সারাজীবন কুমারিই থাকবি।মনে নেই,রুবিনার বিয়ের সময় ওর দেবর তোকে অন্ধকার ঘরে দেখে কী ভয়টা পেয়েছিলো!বেচারা টানা তিনদিন জ্বরে বিছানায় পড়েছিলো।আগে নিজের চেহারা ঠিক কর পঁচা ইলিশ।ছিঃ!
লুবনা থমথমে ভাব নিয়ে কিছুক্ষন বসে থাকলো।তার বড় বোনের বিয়ের দিন লুবনা অদ্ভুতভাবে নিজের হাতে সাজে।রুবিনার দশ বছরের চাচাতো দেবর কারেন্ট চলে যাওয়ার পর যখন এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলো তখন হঠাৎ কারেন্ট আসায় আর লুবনা সামনে পড়ায় বিষম খায়।তা দেখেই ছেলেটা এতো জোরে চিৎকার দেয় ওই এক চিৎকারে পিচ্চি বেহুশ।
সারহানের হাস্যোজ্জ্বল মুখটা শুকনো হৃদয়ে যেনো প্রাণের বন্যা বয়ে যায় অন্তরার।আজ অনেকদিন পর সারহানকে এতোটা প্রাণবন্ত দেখছে সে।সারহানের এই হাসিটাই যেনো এতোদিনে আঁধারে আলো খোঁজার মতো করে খুঁজে চলছিলো অন্তরা।পাশে দাঁড়ানো জান্নাহ্ এর চমৎকার হাসি মুখটা দেখে একটা লম্বা শ্বাস টেনে নেয় নৈঃশব্দে অন্তরা।যদি মা হওয়ার বার্তাতেই সারহানের এতো পরিবর্তন হয় না জানি যখন এই বাচ্চা স্বশরীরে এই দুনিয়াতে তার কান্না জুড়ানো দেহ নিয়ে আবর্তিত হবে তখন কতোটা বদলে যাবে সারহান!অন্তরা এটাই চেয়েছিলেন।তার বুকের মানিক তার কাছে ফিরে আসুক।উপর ওয়ালার সাথে সাথে তিনি জান্নাহ্ এর শুকরিয়া আদায় করেন।
সারহানের কাঁধে হালকা চাপ দেয় জান্নাহ্।যেনো কথা আগে না বাড়ায়।সে আশায় গুঁড়ে বালি দিলো লুবনা।কাটকাট গলায় উচ্চ শব্দে বললো–
“আগে নিজের চেহারা ঠিক করো।আরে তোমার বাচ্চাই তো তোমাকে চিনবে না।হু।নিজের চেহারা দেখেছো!তোমাকে দেখলেই তো মনে হয় তুমি এই বাড়ির ছেলে না।বড় চাচা আর চাচি কারো সাথেই তোমার চেহারার মিল নেই।মিলবে কী করে!কুড়িয়ে পাওয়া ছেলের সাথে মিলে নাকি!
মুহূর্তেই সারহানের হাসি মুখটা তীব্র রোষে ভরে গেলো।চোয়াল শক্ত হয়ে মসৃণ কপালটায় সমান্তরাল ভাঁজ ফুটে উঠে।দাঁতের সাথে দাঁত নিষ্পেষণ করে ফোঁস করে এক দম ছাড়ে।নিজের ভয়ংকর জাগ্রত ইচ্ছাকে চোখের পাতা বন্ধ করে অবদমন করার চেষ্টা করে সে।সারহানের ঘাড়ের রগ ফুলে উঠে।তার দিকে অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে আছে সবাই।খাওয়ার প্লেটে রাখা হাত মুষ্টি বদ্ধ করে ধীম ধীম শ্বাস ফেলছে সারহান।জান্নাহ্ কিছু বুঝতে না পেরে অসহায় দৃষ্টিতে সবার চোখের দিকে তাকিয়ে সারহানের দিকে তাকায়।শুভ্রা ভীত চোখে তাকিয়ে আছে।ফট করে উঠে যায় সারহান।সামনে থাকা বাটি ভরা মসুরের ডাল,সবজি,মাংস সব এক এক করে লুবনার গায়ের উপর ঢেলে দেয়।আঁতকে উঠে সবাই।ভীতসন্ত্রস্ত লুবনা জোর গলায় চিৎকার করে উঠে।লতা ভড়কে গিয়ে রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে থাকে।সারহানের রাগ সম্পর্কে অবগত সে।কেউ কোনো কথা বললো না।খাবার টেবিলে চারধারের মানব – মানবীরা অত্যন্ত ভীত,শান্ত আর পরাস্থের মতো চেয়ে রইলো।কারো মুখে কোনো শব্দ বের হলো না।যেনো নিস্তব্ধ কোনো ফাঁকা মজলিস।
,
,
,
এক সমুদ্র রাগ আর বিরক্তি নিয়ে ব্যস্ত হাতে বিছানা ঝাড়ছে জান্নাহ্।আজকাল বেঢপ আচরণ করে সারহান।কী দরকার ছিলো মেয়েটার সাথে এমন করার!লুবনার শরীরে আধাঘন্টা বরফ ঢলতে হয়েছে।সে কিছুতেই এই বাড়িতে থাকবে না এই মধ্য রাতেই সে চলে যাবে বলে জেদ ধরেছে।তখন সারহান গিয়ে সামনে দাঁড়াতেই চুপসে যায় লুবনা।একটু আগেই কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়েছে।জমির আর অন্তরা কিছু বলতে গিয়েও যা বললো তা নিতান্ত পান্তা ভাত।নিজের ভাবনার মাঝেই কোমরের দিকটায় কারো হাতের স্পর্শ আর কাঁধে উষ্ণ স্পর্শ অনুভব করে।জান্নাহ্ এর ঘন,কালো রেশমচুলে নাক গলিয় দেয় সারহান।তার গন্ধ নিতে থাকে।বার কয়েক ঠোঁট ছোঁয়ায় ভারি চুলে।জান্নাহ্ সেভাবেই গম্ভীর গলায় বললো—
“লুবনা আপুর সাথে এমন করলেন কেন আপনি?
সারহান কোনো শব্দ করলো না।আলতো হাতে জান্নাহ্ এর ঘাড়ের পাশ থেকে চুল সরিয়ে তার জামার গলাটা হালকা নামিয়ে উষ্ণ চুম্বন করে।জান্নাহ্ বিরক্ত ঝুলায় নাকের ডগায়।সারহান থেকে নিজেকে সরাতে চাইলেই সারহান তাকে ঘুরিয়ে নিজের বুকের মধ্যে নিয়ে নেয়।দুই হাত জান্নাহ্ এর কোমরের দিক রেখে নিজের এক হাতের কব্জি অন্য হাত দিয়ে ধরে বৃত্তাকার বলয়ে আবদ্ধ করে জান্নাহ্কে।জান্নাহ্ মেকি রাগ দেখিয়ে বললো—
“এমন করলেন কেন?
সারহান জান্নাহ্ এর গালে গাল ছুঁইয়ে বললো–
“লবণাক্ত বেশি বাড় বেড়েছে।”
জান্নাহ্ ফোঁস করে দম ফেলে বললো—
“তাই বলে এমন করবেন!মেয়টার পুরো শরীরটা জ্বলে যাচ্ছে।”
সারহান ফচকে হেসে মৃদু গলায় বললো–
“আই ডোন্ট কেয়ার।জ্বলে পুড়ে লবণ গলে যাক।”
“এটা আপনি ঠিক করেন নি সারহান।”
সারহানকে ছাড়িয়ে যেতে চাইলে জান্নাহ্কে আঁকড়ে ধরে সারহান।মোহনীয় গলায় তার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললো—
“যাবেন?
জান্নাহ্ নির্বিকার গলায় সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে বললো—
“কোথায়?
“পদ্মদিঘী।”
জান্নাহ্ এক সমুদ্র আতঙ্ক আর উচ্ছ্বাসের মিশ্র প্রতিক্রিয়া নিয়ে বললো–
“সত্যি!এতো রাতে?
সারহান নরম গলায় বললো–
“হুম।”
“কিন্তু আম্মা?
সারহান জান্নাহ্ এর গলায় চুমু খেয়ে সরব গলায় বললো—
“আমার বউ আমি নিবো তাতে কার কী!
জান্নাহ্ নিষ্প্রভ গলায় হতাশ হয়ে বললো–
“কিন্তু সারহান আম্মা জানলে রাগ করবে।এতো রাতে বাইরে যাওয়া!
“আমার উপর ভরসা নেই?
চোখে হাসে জান্নাহ্।ভরসা!আজীবন সাথে থাকার পণ নিয়ে যার সাথে জীবন বেঁধেছে তার উপর ভরসা থাকবে না!
,
,
,
রাত তখন তিনটা ছুঁই ছুঁই।কালো আকাশে রুপালি চাঁদ জোৎস্না ছড়িয়েছে।বাতাসে ঠান্ডা ঠান্ডা অনুরণন।নিঃশব্দে সারহানের গাড়ি এসে থামে দিঘীর বিশাল গেইটের সামনে।দুইজন নামতেই জান্নাহ্ খেয়াল করে গেইটে বড় একটা তালা ঝুলছে।
গেইটের সাথেই বড় বড় রেইনট্রি,মেহগনি,কাঠালি আরো অনেক বিশাল বিশাল গাছ।এখান থেকেই দিঘীর কালো জল দেখা যাচ্ছে।চাঁদ আজ তার রূপের পসরা সাজিয়েছে দিঘীর ওই নিকষ কালো জলে।গেইটের সামনে আসতেই থমকে যায় দুইজন।মিচকে হাসে সারহান।চাপা গলায় বললো—
“কেরানির মেয়ে,দেয়াল টপকাতে পারেন তো?
সরু কপালটা এক চোটে ভাঁজ করে জান্নাহ্।ভ্রু নাচিয়ে বললো–
“মানে কী?
সারহান মৃদুহাস্য অধরে মিষ্টি করে বললো—
“ভেতরে যেতে হবে না!
“তো?
“গেইট টপকাতে হবে।”
থমথমে রূপ ধারণ করে জান্নাহ্ এর মুখটা।সারহান ফিচেল হেসে ব্যগ্র হয়ে গেইট বেয়ে এপাশে চলে আসে।চোখ দিয়ে টিপ্পনী কেটে বললো–
“আসুন।”
জান্নাহ্ অশ্বথ গাছের মতো স্থির হয়ে রইলো।সারহান গা দুলিয়ে হেসে উঠে।প্যান্টের পকেট থেকে চাবি বের করে জান্নাহ্ এর সামনে ধরে।জান্নাহ্ টিমটিমে চাহনিতে চাবির অর্থোদ্বার করার চেষ্টা করে।কিন্তু পারলো না।সারহান গেইটের দিকে ঝুঁকে মিনমিনে গলায় বললো—
“বিকেলে যখন এসেছিলাম হরিনাথ চাবিওয়ালাকে নিয়ে এসে ছিলাম।চাবিটা বানিয়ে নিলাম।”
জান্নাহ্ ঝাঝালো কন্ঠে বললো—
“তাহলে এমন করলেন কেন?
” এইটা দেখানোর জন্য,ডোন্ট পাঙ্গা উইথ সারহান জেইদি।আন্ডারস্ট্যান্ড মিসেস জেইদি?
“আপনি একটা পাগল।”
“হ্যাঁ,আমার পরীর পাগলাবাবা।এখন আসুন তো।আচ্ছা দাঁড়ান।আমি খুলে দিচ্ছি।”
সারহান চাবি দিয়ে গেইট খুলে তা অতি সন্তর্পনে ফাঁক করে জান্নাহ্কে ভেতরে নিয়ে আসে।ভেতরে এসে খুশিতে উড়তে ইচ্ছে হয় জান্নাহ্ এর।এর আগেও পদ্মদিঘীতে আসতে চেয়েছিলো জান্নাহ্।কিন্তু আন্ডার আঠারো কাউকে দিঘীতে যাওয়ার অনুমতি নেই।স্কুল ছাত্রছাত্রীদের আরো নয়।কিন্তু কেয়ারটেকার দাদুতো জানে না আঠারোর আগেই জান্নাহ মা হতে চলেছে।এইসব মনে করেই ফিক করে হেসে ফেলে জান্নাহ্
গুটিগুটি পায়ে হেঁটে চলছে সারহানের পাশে জান্নাহ্।সারহানের এক হাত নিজের সাথে চেপে ধরে আছে।জান্নাহ্ আজ ভীষণ খুশি।তার প্রাণ সত্যিই ফিরে এসেছে।যখন থেকে সারহান ফিরে এসেছে এক অন্য সারহানকে আবিষ্কার করেছে জান্নাহ্।এতোটা উচ্ছল,এতোটা প্রাণবন্ত সারহানকে সে কখনো দেখেনি।যখনই বাড়িতে আসতো সারাক্ষন ঘরে ঘাপটি মেরে থাকতো।কারো সাথে কথা বলাতো দুর তাকাতই না।
অন্ধকারে বিড়ালপায়ে হাঁটছে দুইজন।শুকনো পাতার মর্মরধ্বনি যেনো নিস্তব্ধ পরিবেশে ঝঙ্কার তুলছে।ঝিঝিপোকার ডাক যেনো ষোলোকলা পূর্ণ করলো।সাথে কাঠপোকার আওয়াজ।একটু পরপর দমকা হাওয়ায় নড়ে উঠে গাছগাছালি।ঝনঝনিয়ে উঠে জান্নাহ্ এর শরীর।সারহানের হাতটা আরো চেপে ধরতেই ফিকে গলায় হিসহিসিয়ে সারহান বললো—
“চিন্তা করবেন না।আমি থাকতে যমদূতও আপনার ধারে কাছে ঘেঁষতে পারবে না।”
চাঁদের আলোয় আরো লাবণ্যময় লাগছে সারহানের স্মিতহাস্য মুখটা।তার পুরু ঠোঁট জোড়ায় এক অচেনা সুখ।চোখে তার তৃপ্তি।নিজের মাথাটা এলিয়ে দেয় জান্নাহ্ সারহানের গায়ের সাথে।হাঁটতে হাঁটতে দিঘীর পাড়ে এসে দাঁড়ায়।প্রায় পনেরোটা সিড়ি অতিক্রম করে দিঘীর জলে পা ছোঁয়াতে হবে জান্নাহ্ এর।চাঁদের আলোয় যেনো কোনো রূপকথার রাজ্য মনে হচ্ছে পদ্মদিঘীকে।চারপাশের প্রকান্ড গাছের সারি।দিঘীর দুই ধারে পাঁচ ফুটের ব্যবধানে সিমেন্টের বেড় দেওয়া বলয়ে খাম্বাকৃতির নিয়নের বাতি লাগানো।যে পাশে জান্নাহ্ রা দাঁড়িয়ে আছে তার বিপরীত পাশে উঁচু ডিবি যাকে ছোটখাট পাহাড় বলে আখ্যায়িত করে গ্রামবাসী।দিঘীতে ফুটে আছে পদ্ম।চাঁদের আলোয় দিঘীর মাঝের সেই লাল পদ্মে চোখ আটকে যায় জান্নাহ্ এর।
চলবে,,,