জান্নাহ্ “পর্বঃ৪৫

0
3660

#জান্নাহ্
#পর্বঃ৪৫
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

লাল গোলাপের ছাপ ওয়ালা সফেদ রঙের বিছানায় ঘুম জড়ানো চোখে উঠে বসে একটা নয় মাসের বাচ্চা মেয়ে।তার মাথাভর্তি ঘন কালো দুই ইঞ্চি লম্বা চুলগুলো এলোথেলো।চোখের পাঁপড়িগুলো ভ্রমরকালো।ছোট ছোট চোখে ঘুমো ঘুমো ভাব।নিমিঝিমি চোখে সে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করছে তার সামনে বসা অতি আপনজনের মুখটি।নাকে,মুখে অস্বস্তির ভাব পেয়ে দুই হাতে বেপরোয়াভাবে ঘষতে থাকে।তাতে করে বাচ্চাটির মোমের মতো কোমল নাকটা লাল হয়ে যায়।ফুলকো গালদুটো টসটসে।চিকন লাল ঠোঁট দুটি কিঞ্চিৎ ছড়িয়ে ক্লান্ত হাসে বাচ্চাটি।তার হাসিতে মৃদু ছন্দ হয়।ল্যাপটপের স্ক্রিন থেকে চোখ তুলে তাকায় সেই গলুমলু পুতুলের দিকে সারহান।চোখে হাসে সে।একটা ছোট গেঞ্জি আর নরম কাপড়ের তৈরি হাফ প্যান্ট পরা বাচ্চাটি।দুই হাত দিয়ে দুই পায়ের তালু চাপকে ধরে চমৎকার হাসে সে।সারহান আয়েশি ভঙিতে কাউচে হেলান দিয়ে বাচ্চাটির কর্মকান্ড দেখে।মুহূর্তেই নেচে উঠে দুই হাতে তালি বাজায় বাচ্চাটি।সারহান ঝরা হাসে।বাচ্চাটি সারহানের হাসিতে উচ্ছ্বাসিত হয়।তার ঘুম জড়ানো চোখ দুটি উদ্ভাসিত হয় আনন্দে।

সারহান দেখছে তাকে।এক মায়াবীনি কন্যাকে।যে তারই অংশ,তার রক্ত বইছে ওই অবুঝ,জীবন্ত মাংসপিন্ডে।বুক ফুলিয়ে লম্বা শ্বাস নেয় সারহান।এক সমুদ্র সুপ্ত শিহরণ অগোছালোভাবে নাড়িয়ে দিচ্ছে তাকে।

বাচ্চা মেয়েটি তার বাবাকে দেখে।আপ্লুত হয় সে।অবাক হয় সে।কারণ তার বাবা তাকেই মনোযোগ দিয়ে দেখছে।বাচ্চাটি ভাবলো তাকে যেতে হবে।তার বাবার কোলে আঁছড়ে পড়তে হবে।কোলে উঠে মুখ গুঁজে দিতে তার ওই বুক।তার ছোট ছোট চার,পাঁচেক দাঁত বসাতে হবে তার বাবার ওই গালে।তার চোখে মুখে নিজের ধারালো,নরম নখের আঁচড় বসাতে হবে।তাই তাকে ছুটে যেতে হবে ওই বাবা নামক যত্নশীল,প্রেমময়,স্নেহশীল মানবটির কাছে।বাচ্চাটি তাই করলো।শিয়রের বালিশটিকে বালুর বস্তার মতো টেনে নিচে ফেলে দেয়।ভারি কষ্ট হচ্ছে তার।সারহান বিমুগ্ধ চিত্তে নিজের মেয়ের কর্মকান্ড দেখে।বাচ্চাটি আরো একটা বালিশ টেনে ফেলে নিচে।সারহান স্মিত হাসে।মায়ের মতো বুদ্ধিমতী।এইবার অবাক কান্ড করে বাচ্চাটি।বিছানার চাদর খামছে ধরে অতি সন্তর্পনে একটা পা নামিয়ে দেয় ফ্লোরে পড়া সেই বালিশের তাম্বুলের উপর।বাবার দিকে অতি দম্ভের সাথে তাকায়।সারহান অধর কোণে হাসে।বাচ্চাটি তার বাবাকে দেখতে দেখতে অসাবধানতায় আরেক পা বালিশের উপর রাখে।কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তা বালিশের উপর না পড়ে তা চলে যায় বালিশের পাশ কাটিয়ে ফ্লোরে।ব্যালেন্সহীন হতেই নিজের হাতের কন্ট্রোল হারিয়ে ধপাস হয়ে পড়ে যায় টাইলসের ফ্লোরের উপর।নরম,কচি মাথায় শক্ত ফ্লোরের স্পর্শ লাগতেই গলগলিয়ে রক্ত বের হতে থাকে।উদ্ভ্রান্তের মতো শ্বাস আটকে দৌঁড়ে আসে সারহান।বাচ্চাটির রক্তমাখা মাথাটা হাতের তালুতে নিয়েই গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে বলে উঠে—-

“সারজান!

হুড়মুড়িয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠে সারহান।ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে।কপাল জুড়ে মুক্তোর দানার মতো ঘাম জমেছে।কানের দুই পাশের চিপ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে উষ্ণ জলের প্রস্রবণ।হাপড়ের মতো উঠানামা করছে সারহানের বুক।তার নাকের ডগায় ঘামের পাহাড়।ঢোক গিলতে কষ্ট হচ্ছে তার।অধর ছড়িয়ে মুক্ত শ্বাস নেয় সারহান।

বিছানা ভাঁজ করছিলো জান্নাহ্।সারহানকে চিৎকার করতে দেখে দৌঁড়ে এসে তার সামনে বসে।সারহান দিকভ্রান্তের মতো এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।যেনো কিছু খুঁজছে সে।জান্নাহ্ শুধায়–

“কী হয়েছে সারহান?

সারহান কোনো কথা বললো না।অসহায়ের মতো চেয়ে রইলো।ডিভানে শুয়ে শুয়ে মোবাইল নিয়ে কিছু করছিলো।তন্দ্রাচ্ছন্ন হতেই সেই ভয়ংকর স্বপ্ন এসে হানা দেয়।সারহান ধুপ করে ডিভানের নিচে বসে পড়ে।জান্নাহ্ এর কোমর জড়িয়ে ধরে তার পেটে মুখ গুঁজে দেয়।ভাঙা ভাঙা গলায় বললো—

“আমার পরীর খেয়াল রাখবেন রজনীগন্ধা।আমি সারাজীবন আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবো।”

জান্নাহ্ চকিত হয়।গত কয়েকদিনে এমন অনেকবার হয়েছে।ঘুমের মধ্যেই আঁতকে উঠে সারহান।বাকি রাত জেগে বসে থাকে।জান্নাহ্কে আঁকড়ে ধরে বসে থাকে।জান্নাহ্ যতবার জিঙ্গেস করেছে ততবার বলে খারাপ স্বপ্ন দেখেছে।সে দেখেছে কেউ তার প্রিয় জিনিস তার থেকে কেড়ে নিচ্ছে।

ক্ষীণ শ্বাস পড়ছে সারহানের।জান্নাহ্ এর উদরের সাথে লেপ্ট আছে সে।জান্নাহ্ আলগোছে সারহানের মাথাটা তোলে।কী শান্ত আর নিষ্পাপ মুখ।জান্নাহ্ সারহানের গালে হাত রেখে তার চোখের নিচে জমা ঘাম টুকু মুছে দেয়।ললাটে অধর ছোঁয়ায় জান্নাহ্। নিজের দুই হাতের আঁজলায় নিয়ে নেয় সারহানের মুখটা।কোমল গলায় বললো—

“কী হয়েছে সারহান?এমন করছেন কেন?

সারহান বার কয়েক শুকনো ঢোক গিলে।থমথমে গলায় বললো–

“আমার অতীত আমার বর্তমান ছিনিয়ে নিতে চায় রজনীগন্ধা।আমার পরী!

আর কিছু বললো না সারহান।তার চোখে জল জমে আসে।জান্নাহ্ কিছু বুঝতে পারে না।সারহানকে ভেতর থেকে কিছু খুবলে খাচ্ছে।কিন্তু তা সে কাউকে বলতে পারছে না।নিজে সহ্যও করতে পারছে না।জান্নাহ্ নরম চোখে তাকিয়ে সারহানকে দেখে।এ কয়েকদিনে প্রকুপিত,উন্মত্ত,উগ্র মানুষটা একদম শান্ত,নিশ্চল আর অসহায় হয়ে পড়েছে।জান্নাহ্ নিষ্কম্প গলায় বললো—

“আজ শুক্রবার সারহান।সবসবয় নিজেকে বিশ্বাস করেছেন আজ না হয় আল্লাহ্ পাককে করুন।আপনার সমস্ত কষ্ট,গ্লানি,অভিযোগ ওই ওপর ওয়ালাকে বলুন।দেখবেন তিনি ঠিক বুঝবেন।আপনাকে সঠিক নির্দেশনা দিবেন।”

সারহান তার কপোল থেকে জান্নাহ্ এর হাত নামিয়ে তার অঞ্জলিতে চুমু খায়।নিরুত্তেজ গলায় বললো—

“তিনি সত্যিই আমাকে ক্ষমা করবেন?আমি আমার অতীত ভুলতে চাই রজনীগন্ধা।আমার বর্তমানকে নিয়ে বাঁচতে চাই।”

“আল্লাহ পরম ক্ষমাশীল।তিনি তার সকল বান্দাদের ভালোবাসেন।তার প্রিয় বান্দারা যখন ভুল করে তখন তিনি আশায় থাকেন কখন তার বান্দারা নিজের ভুল বুঝতে পেরে তার কাছে ক্ষমা চাইবেন।তিনি তাদের পরীক্ষা করেন।সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের তিনি পুরষ্কারও দেন।যে মানুষ নিজের ভুল বুঝতে পারে তার চেয়ে বড় অনুশোচনা আর নেই।তাই তো আমাদের সব সময় আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হয়।অতীতে এমন কোনো কাজ করা উচিত নয় যা বর্তমান ধ্বংস করে।উঠুন।আযান দিয়েছে।গোসল করে মসজিদে যান।আল্লাহর দরবার থেকে তিনি আপনাকে খালি হাতে ফেরাবে না।তার সামনে আপনার সব প্রশ্ন রাখবেন।তিনি নিশ্চয়ই আপনাকে তার উত্তর দিবে।”

সারহান ধীরপায়ে উঠে দাঁড়ায়।মৃত্যুকে ভয় না পেলেও আল্লাহভীতি তার খুব কম ছিলো।নিজেকে বিশ্বাস করতো বেশি।কিন্তু আজ!

সারহান ওয়াশরুমে যেতেই ডিভানের কুশন ঠিক করতে গেলে জান্নাহ্ টের পায় কুশনের ডানপাশ ভেজা।হয়তো ঘুমের মধ্যে সারহান কাঁদছিলো।মানুষটা এভাবে কেন ভেঙে পড়ছে!

একটা সাদা ধবধবে পাঞ্জাবী পরে সারহান।মাথায় সাদা রঙের টুপি।আয়নায় নিজেকে দেখে অপ্রস্তুত হয় সে।আড়াল করার চেষ্টা করে।এমনটা করতে ওই ছোট্ট প্রাণটা তাকে বাধ্য করলো।ঘরে ঢুকেই সারহানকে দেখে থমকে যায় জান্নাহ্।স্মিতহাস্য অধরে তাকে ইশারা করে বোঝায় ভালো লাগছে দেখতে।ফর্সা সারহানের গায়ে সাদা পাঞ্জাবীতে তাকে যেন ভিনগ্রহের কোনো প্রাণি মনে হচ্ছে।জান্নাহ্কে অবাক করে দিয়ে ঝাঁপটে ধরে সারহান তাকে।হতবুদ্ধিতা কাটিয়ে ধাতস্থ হতেই জান্নাহ্ টের পায় বেগতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে সারহানের হৃদকম্পন।তা যেনো কালবৈশাখী ঝড়ের মতো সব উড়িয়ে নিয়ে যাবে।মোলায়েম গলায় জান্নাহ্ বললো–

“সারহান,দেরি হচ্ছে।বাবা অপেক্ষা করছে আপনার জন্য।”

সারহান শান্ত হয়ে স্থির হয়ে দাঁড়ায়।জান্নাহ্ সারহানের ডান হাতের উল্টো পাশে চুমু খেয়ে নিজের দুই চোখের পাতায় পরম আবেশে ছোঁয়ায়।হৃষ্ট হয় সারহানের মন।অকৃত্রিম শীতলতা তিরতির করে আবদ্ধ করছে সারহানকে।রুম থেকে বের হতেই দেখে জমির আর অন্তরা আগ্রহদীপ্ত চোখে তাকিয়ে আছে।অন্তরার চোখে চঞ্চলতা।খুশির হাওয়া বইছে তার হৃদয়ের দ্বারকোণে।আজ কতো বছর পর সারহানকে এই রুপে দেখছে সে।সারহানের চোখের সামনে তার মমতাময়ী।কিছু একটা ভেবে পা বাড়িয়েও পিছু হটলো সারহান।তার শান্ত,নরম চোখ দুটো মুহূর্তেই ঘৃণার সমুদ্রে উতলে উঠলো।দাঁড়ালো না আর সে।লম্বা লম্বা পা ফেলে বাইরে চলে এলো।
অন্তরা কাঁদলো।কিন্তু সে প্রসন্ন।তার ছেলেটা তার চোখের সামনেই থাকুক।এই ঢের।

তিনতলা মসজিদের সামনে এসে থমকে যায় সারহান।মসজিদের পাশেই বাচ্চাদের সকালবেলা আরবি পড়ানোর জন্য দোচালা ঘর তৈরি করা হয়েছে যার পাশ দেয়ালগুলো ইটের তৈরী।এখনো পলেস্তার করা হয়নি।তার পাশেই একটা বিশাল কাঁঠাল গাছ।উপর থেকে নিচ পর্যন্ত কাঁঠাল ঝুলে আছে।মসজিদের বা’দিকেই কবরস্থান।এখানেই কবর দেওয়া হয়েছে সারহানের দাদুকে।কবরটা বাঁধানো।কিন্তু অনেক দিন সংস্করণ না হওয়ায় ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে।বাঁশের বেড়া দেওয়া সেই কবরের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে সারহান।তার মনে পড়ে ছোটবেলার কথা।একপাশে বাবা আর আরেকপাশে দাদুকে রেখে তাদের দুইজনের দুই আঙুল ধরে একরাশ উদ্দীপনা নিয়ে জুম্মার নামাজ পড়তে আসা সারহান।মুখে তার যুদ্ধ জয়ে যাওয়ার হাসি।ধীরে ধীরে ঘোলা হতে থাকে সারহানের অক্ষিযুগল।এই মানুষটাকে এতোটা ভালোবাসার পরও খুব ঘৃণা করতে ইচ্ছে হয়।

নামাজ শেষে দাদুর কবর জিয়ারত করে জমিরের আগেই বের হয়ে কোথায় যেনো চলে যায় সারহান।জমির মসজিদের আশপাশ বেশ কিছক্ষন খুঁজেও যখন পেলো না সারহানকে তখন হতাশ শ্বাস ফেলে বাড়ির পথ ধরে।

কুঞ্জপুকুরের এসে বসে থাকে সারহান।শান বাঁধানো ঘাট।তার নিমগ্নদৃষ্টি পুকুরের শ্যাওলা পড়া জলে।কয়েকটা মাছ খাবারের খোঁজে উপরিভাগে এসেছে।সারহান বিমুগ্ধচিত্তে তা দেখছে।একটা মিষ্টি হাওয়া এসে লাগে সারহানের গায়ে।তার চোখ নড়ে উঠে।পুকুরের ওই প্রান্তে বাঁশঝাড়।তার শুকনো পাতা পড়ে আছে পুকুরের জলে।তার একটু দুরেই আরেকটা ঘাট তৈরি করা।এর পাশেই রেইনট্রি।মোটা বটগাছ,একটা কদম গাছ।মাঝের কিছু জায়গা ফাঁকা।এখানে হিন্দুদের একটা সমাধি আছে।রোজ ধূপ জ্বালানো হয়।একটা উঁচু বলয়ে তুলসি গাছ লাগানো।রোজ সন্ধ্যায় হিন্দু বাড়ির খুড়োপিসি পিদিম জ্বালিয়ে দেয় তুলসি তলায়।

সারহানের বিক্ষিপ্ত মস্তিষ্ক নড়ে উঠে।তার বুকের ভেতরটা ক্রমশ এক ভয়ংকর ভয়ের আবেশে ভারি হচ্ছে।তার হৃদপিন্ডটা যেনো কেউ খাবলে ধরেছে।যেনো এখনি তা টেনে হিঁচড়ে বের করে নিবে।এমন কেনো হচ্ছে সারহান জানে না।ওই ছোট্ট প্রাণ যা এখনো এই দুনিয়াতেই আসে নি তার জন্য এই মনটা কেন উতলা হয়!কেন এতো ভয় হয় তাকে হারানোর!এরই নাম বুঝি পিতৃত্ব!
সারহান বোঝে না।জীবনের মায়া না করা সারহানের আজ খুব বাঁচতে ইচ্ছে হয়।ওই ছোট্ট প্রাণটাকে এই হাতে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হয়।তার নরম কপোলে চুমু আঁকতে ইচ্ছে হয়।
কিন্তু সারহান ভাবে,তার অনাগত সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে তার এতো চিন্তা সেখানে তার মায়ের কোল থেকে যখন তাকে ছিনিয়ে নিয়েছে তখন তার কেমন লেগেছে!তার কী আদৌ বাঁচতে ইচ্ছে হয়েছে!এ কেমন মায়াজাল!
যার অস্তিত্ব এখনো পৃথিবী দেখেনি তাকে পাওয়ার জন্য সারহানে সত্তা আকুলিবিকুলি করছে সেখানে তার মায়ের বুক খালি করে তাকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে।

তৎক্ষণাৎ সারহানের শান্ত,কোমল মন গর্জে উঠে।তার ভেতরকার মানুষটা হুংকার দিয়ে বললো–

“নাহ,করবে না সে ক্ষমা।ওই মানুষটাকে সে কখনো ক্ষমা করবে না।”

কিন্তু পরক্ষনেই মনে পড়ে অন্তরার সে মায়াভরা মুখ।এতো স্নেহ,এতো ভালোবাসা।সব কী মিথ্যে !মা কী কখনো মিথ্যে হয়!

কিন্তু সেই বিদ্বেষী আবার সারহানকে শ্বাসায়—

“নাহ।তোকে নরম হলে চলবে না।এই কষ্ট তার প্রাপ্য।সন্তান হারানো এক মায়ের আকুতি।তাকে ক্ষমা করা যাবে না।”

সারহান চমকে উঠে।তার কাঁধে আলতো হাত রাখে জমির।সারহানদের বাড়ি যাওয়ার পথেই কুঞ্জপুকুর।ছোটবেলাই কতো ঝাঁপাঝাঁপি করেছে এই পুকুরে।আজ শুধু তা স্মৃতিকথা।
জমির নির্বিঘ্নে বসলেন।কোমল হাসলেন তিনি।সারহান ঘুরে বসলো।বাবার দিকে তাকিয়ে আলতো হাসলো।জমির সারহানের কাঁধে পুরো হাতটা দিলেন।নিজের বুকের একপাশে সারহানের মাথাটা ছোঁয়ালেন।আজ এতোদিন পর ছেলের স্পর্শে বাবার হৃদয় গভীর উচ্ছ্বাসে সরব হলো।সারহান শান্ত হয়ে রইলো।জমির তাকে ছেড়ে বসলেন।আবেগী গলায় বললেন—

“বাবা হতে চলেছিস।নিশ্চয়ই ভয় হচ্ছে?

সারহান তার বাবার দিকে তাকালো।কী সুন্দর ওই দুই চোখ।কতো মমতা খেলে যাচ্ছে সেখানে।সারহানের সেই মমতা দেখতে ইচ্ছে হলো।সে তাকিয়ে রইলো।জমির স্মিতহাস্য অধরে আবার প্রশ্ন করলেন—

“কথা বলছিস না যে?

সারহান সরব হলো।বললো—

“হুম।হচ্ছে।কোথাও কিছু হচ্ছে বাবা।বুঝতে পারছি না।বাবা হওয়ার অনুভূতি বুঝি এমনই হয়!

জমির চমৎকার হাসলেন।স্বাভাবিক গলায় বললেন—

“হয়।সব পুরুষের মধ্যেই একটা বাবা থাকে।কিন্তু তা অদৃশ্য।তার পরিস্ফুটতা ঘটে ওই ছোট্ট একটি ডাকে।বাবা!

সারহান সরস হাসলো।বাবা!চমৎকার শব্দ।অদ্ভুত একটা অনুভূতি আছে এতে।ছেলে হয়ে জন্মানো সারহান একদিন কিশোরে রূপ নেয়।তারপর যুবকে।একজন স্বামী।আজ তার পূর্ণতা আসতে চলেছে।সেও বাবা হবে।তার ভেতরকার সুপ্ত একটা মানব যার আছে স্নেহ,আদর আর ভালোবাসা তা সবার সামনে আসতে চলেছে।বটবৃক্ষের মতো কাউকে ছায়া দিবে সে।তার ছোট্ট আঙুল ধরে কেউ বলবে বাবা।কী অদ্ভুত শব্দ!

সারহান সুপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে।আবার ঘুরে বসে সে।পুকুরের ওই পাড়ে তাকায়।একটা পাখি দেখা যাচ্ছে ওই সমাধিতে।সারহান আলতো গলায় প্রশ্ন করে–

“বাবা,একটা প্রশ্ন করি?

জমির সোজা গলায় বললেন—

“কর।”

নির্বিঘ্নে প্রশ্ন করে সারহান—

“তুমি কাকে বেশি ভালোবাসো?আমাকে না আপুকে?

দুর্বোধ্য হাসলো জমির।অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় উদাস ভঙিতে পাল্টা প্রশ্ন করে—

“আমি যদি তোকে বলি তোর দুই চোখের মধ্যে কোন চোখটা আমায় দিবি তাহলে তুই কোনটা দিবি?

ফট করে ঘুরে বসে সারহান।অবিশ্বাস্য গলায় বলে উঠে–

“মানে?

জমির শীতল গলায় বললো—

“সন্তান বাবা মায়ের সেই দুই চোখ,যার একজনের অনুপস্থিতিতে অন্যজন কাঁদতে বাধ্য।তুই যদি আমাদের প্রাণ হোস তাহলে শুভ্রা আমাদের দেহ।প্রাণ ছাড়া যেমন দেহ মূল্যহীন তেমন দেহ ছাড়া প্রাণের অস্তিত্ব বিলীন।”

নীরস হাসলো সারহান।হালকা কন্ঠে শুধায়—

“তাহলে দাদু এমন কেন করলো?

জমির আকাশের দিকে তাকালেন।নির্মেঘ আকাশে যেনো তিনি তার বাবার প্রতিচ্ছবি দেখলেন।প্রসন্ন হাসলেন তিনি।গম্ভীর গলায় বললেন—

“বাবা সেকেলে মানুষ।বংশ রক্ষায় ছেলে সন্তানের গুরুত্ব বুঝতেন।তাই।”

“তাই বলে..।”

জমির হুট করেই বললেন—

“তুই নিশ্চয়ই তোর বোনকে ফেলে দিবি না!

সারহান চুপ করে রইলো।জমির আলতো করে সারহানের হাত ধরলেন।বললেন—

“চল, আজ তোকে মহানবী( সাঃ) এর সেই মা পাখিটি আর তার ছানার গল্প শোনাবো।তারপর একসাথে খাবো।অনেকদিন একসাথে খাওয়া হয় না।কী জানি তোর ছেলে এলে আর সে সুযোগ নাও পেতে পারি!

সারহান মৃদু লজ্জায় হাসলো।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here