#জান্নাহ্
#পর্বঃ৫১
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
কোলাহল মুক্ত রেস্তোরাঁয় বসে আছে ইহতিশাম আর সারহান।স্বচ্ছ কাঁচ গলিয়ে দিনের শেষ সূর্যের লালিমা রশ্মির একটা তীক্ষ্ম ফলা এসে হানা দিয়েছে তাদের টেবিলে।একটু পরেই ম্রিয়মান দিনের আলো গোধূলির মায়ায় জড়াবে।রেস্তোরাঁর পাশে থাকা কদম গাছটা নিরাক।তার নিচেই বেড়ির মধ্যে বসে আছে এক জোড়া কাপল।
রেস্তোরাঁর দুই পাশে সারিবদ্ধভাবে রাখা আছে গোলাপ,বেলি আর চাঁপা ফুলের গাছ।বেলীর ফুলের তীব্র গন্ধে যেনো সরব হয়ে আছে সেই জায়গাটা।বসে থাকা সেই কাপলের মেয়েটি উন্মুখ দৃষ্টি দিয়ে অবলোকন করছে আর মুখ ফুলিয়ে নিঃশ্বাসের সাথে নিয়ে নিচ্ছে বেলি ফুলের সেই ঘ্রাণ।
স্থির চাহনি চাপা আক্রোশ একে অপরের প্রতি।বিন্দু বিন্দু করে জমে থাকা রাগ যেনো অথৈ সাগরে রূপ নিয়েছে ইহতিশামের।ইহতিশামের ঘাড়ের রগ টানটান হয়ে আছে।সামনের ব্যক্তিটাকে এতো দিন হৃদয়ে স্থান দিলেও আজ ইচ্ছে করছে সেখান থেকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে পদধূলিত করতে।নিজের ভেতরকার রাগকে নিজের মধ্যেই দমিয়ে নিলো ইহতিশাম।কোনোরকম চিন্তা ছাড়াই নির্ভয়চিত্তে বসে আছে সারহান।একটা তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে সামনের ফাইল থেকে একটা স্কেচ এগিয়ে দেয় ইহতিশাম।চোখের পাতা ঝাঁকিয়ে তা দেখার জন্য বলে সারহানকে।সারহান বেখেয়ালিভাবেই নাক কুঁচকে স্কেচটা হাতে নেয় ।দপদপ করে উঠে তার শিরা উপশিরা।চোখের পাল্লা দুটো প্রশস্ত করে শ্বাসের গতি বাড়িয়ে দেখতে থাকে।ইহতিশাম গভীর দৃষ্টিতে সারহানের প্রতিক্রিয়া দেখে।মুহূর্তেই বিগলিত হাসে সারহান।স্কেচটা হাতে নিয়ে খামখেয়ালি করে বললো—
“তো?
ইহতিশাম চেয়ার থেকে পিঠ আলগা করে ভারি গলায় শুধায়—
“তুই জানিস উনি কে?
মুখটা ফুলিয়ে জীভ নাড়ে সারহান।কোনো ধরনের ভাবাবেশ হলো না তার।শান্ত চোখে এদিক ওদিক তাকিয়ে আবার তাকায় ইহতিশামের দিকে।সরস গলায় বললো—
“আমি কী করতে পারি তোর জন্য?
খলবলিয়ে উঠে ইহতিশাম।রাগে ফেটে যাচ্ছে তার মস্তিষ্ক।গনগনে গলায় বললো—
“বুঝতে পারছিস না কী করবি!জান্নাহ্ এর মামা উনি।”
ফোঁস করে দম ফেললো সারহান।নির্ভীক গলায় বললো—
“তো?
রেস্তোরাঁর অনেকেই চেয়ে আছে তাদের দিকে।সারহানকে শান্ত মনে হলেও ঝড় বয়ে এনেছে ইহতিশাম।তার দারাজ গলার আওয়াজে কেঁপে উঠে বদ্ধ রেস্তোরাঁ।
ইহতিশাম জমাট গলায় বললো–
“ওই খুনগুলোর সাথে জান্নাহ্ এর মামা জড়িয়ে আছে।”
সারহান বিক্ষিপ্ত চোখে তাকিয়ে বললো —-
“জানি।”
ইহতিশাম অধর ছড়িয়ে শ্বাস ফেলে সংক্ষুব্ধ গলায় বললো—-
“তাহলে নিশ্চয়ই এইটাও জানিস ওই খুনগুলো জান্নাহ্ ই করেছে।”
সেকেন্ডে ধরা কাঁপিয়ে ক্ষেপে উঠে সারহান।রেস্তোরাঁয় রাখা প্লাস্টিকের টেবিলটা সারহানের হাতের জোরালো ধাক্কায় কোথায় গিয়ে ঠেকেছে তা জানে না।কলকল শুরু হয় রেস্তোরাঁয়।ভীতসন্ত্রস্ত বাকি কাস্টমাররা হকচকিয়ে উঠে।সারহান ইহতিশামের কলার ঝাপটে ধরে প্রশ্বস্ত গলায় বললো—
“এইসবের মধ্যে আমার রজনীগন্ধাকে টানবি না।আমি সব জানি।আর জানি বলেই তোকে এই কেস দিয়েছি।”
ইহতিশামের বুক হাপড়ের উঠানামা করছে।মেঘের মতো গর্জন করে বললো—
“কী বলতে চাস তুই?
সারহান তার মোবাইল বের করে কিছু একটা করে।ইহতিশামের মেসেজ টোন বেজে উঠে।সারহান নির্বিঘ্ন গলায় বললো—
“একটা এম.এম এস. সেন্ট করেছি দেখ।তারপর বল কী করবি।”
ইহতিশাম তড়িৎ বেগে নিজের মোবাইল হাতে নেই।এম.এম.এস.দেখে যেনো তার পায়ে তলার মাটিই সরে গেলে।কোনো উপায়ন্তরের ধার সে ধারলো না। সারহানের চোয়ালে এক সজোরে ঘুসি লাগায়।বেকায়দায় সারহান দাঁড়িয়ে থাকলো না।সেও এক পাল্টা ঘুসি মেরে বসে ইহতিশামের নাক বরাবর।দস্তদস্তি শুরু হয় দুই বন্ধুর মধ্যে।রেস্তোরাঁর সার্ভিস বয়রা ভয়ে কাঁচুমাচু হয়ে যায়।ম্যানেজার কল করে পুলিশকে।ততক্ষনে একে অপরের রক্তে গোসল করে নিয়েছে দুইজন।ইহতিশামে সাদা শার্ট রক্তে মেখে গেছে।সারহানের কপাল আর ঠোঁট কেটে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।তার পোলোশার্টের বুকের মাঝে চাপড় বসায় ইহতিশাম।এক ঝটকায় নিজের মুখের সামনে টেনে ধরে বললো—
“তোর পাপের ঘড়া পূর্ণ হয়েছে সারহান।এইবার তোর প্রায়শ্চিত্তের পালা।হারানোর যন্ত্রণা কী এইবার বুঝবি তুই।”
সারহান উন্মত্ত হাসে নিজের ঠোঁটের রক্ত হাত দিয়ে স্লাইড করে নিয়ে আবার মুখ পুরে দেয়।সাবলীল গলায় বললো–
“আমাকে নিয়ে তোর ভাবতে হবে না।তুই নিজেকে নিয়ে ভাব।জান্নাহ্ আর তার মামা কেউই এই কেসে ইনভল্ব থাকবে না।তুই ওদেরকে এই কেস থেকে মুক্ত করবি।নাহলে মেহনাজের এই ভিডিও শুধু তুই কেন আম জনতা দেখবে।”
ইহতিশাম নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে পাঞ্চ করে সারহানের কানের একটু নিচে।ধপাস করে পেছনের চেয়ারের উপর গিয়ে পড়ে সারহান।উন্মাদের মতো হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়ায় সারহান।দুই রক্ত মাখা হাত দিয়ে নিজের জামা ঝাড়তে থাকে।শান্ত কিন্তু ভারি গলায় বললো–
“কষ্ট হচ্ছে তোর?আমারও হয়েছে।তোর কারণে রোজ এক ঘন্টার রাস্তা পায়ে হেঁটে আমাকে কোচিং করতে যেতে হতো।কলেজের টিচাররা আমাকে পড়াতে চাইতো না।আর যদি কোনো টিচার রাজীও হতো তাহলে কলেজের কোনো না কোনো স্টুডেন্ট আসতোই সেই কোচিংএ।ওই যে আমার দুর্ভাগ্য !তোর মতো বন্ধু পেয়েছি।সারাটা জীবন যাদের মা,বাবা জেনে এসেছি তারাও আমায় ধোঁকা দিলো।যেই বোনকে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করেছি সেই আমার জীবনটা নষ্ট গলির বানিয়ে দিলো।আর তুই!
তোর আর আমার হিসেব শেষ।তুই এই কেস থেকে মামা আর জান্নাহ্কে ক্লিয়ার করবি।আর আমি মেহনাজকে।”
ইহতিশাম বজ্র কন্ঠে বললো–
“আরে গাধা,তুই যাকে বাঁচানোর কথা বলছিস মেহনাজ তারই মেয়ে।জান্নাহ্ এর আপন মামাতো বোন মেহনাজ।”
সারহানের বিস্ময় যেনো আকাশ ছুঁলো।গা গুলিয়ে উঠলো তার।যেনো এখনই সব বেরিয়ে আসবে ভেতর থেকে।কাঁপতে থাকে সারহান।মিহি গলায় বললো—
“কী বলছিস তুই?
এটা হতে পারে না।”
চেয়ারের উপর ধপাস করে বসে পড়ে ইহতিশাম।চিৎকার করে পুরো দুনিয়া উল্টে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে তার।নিজের চুলগুলো টেনে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বললো—
“আমি ঠিকই বলছি।মেহনাজ জান্নাহ্ এর ই বোন।কী করে পারলি এইসব করতে তুই!কী করবি এখন তুই!জান্নাহ্ যদি জানতে পারে!
কালবৈশাখী ঝড়ের মতো তেড়ে এসে ইহতিশামের কলার ধরে তাকে ঝাঁকাতে থাকে সারহান।তীব্র রোষ নিয়ে বললো—
“কে বলবে তাকে!তুই?ভুলে যাসনা ওই ভিডিও এখনো আমার কাছে।জান্নাহ্ ছাড়া কারো কোনো মূল্য নেই আমার কাছে।যদি তুই জান্নাহ্কে এইসব বলিস তাহলে আমি..।”
দুই হাতে সারহানের বুকে ধাক্কা মারে ইহতিশাম।প্রদৃপ্ত গলায় বললো—
“কতোদিন লুকিয়ে রাখবি তুই? একদিন না একদিন তো জান্নাহ্ জানবেই যে ওর বোনের জীবনটা যে নষ্ট করেছে সে আর কেউ নয় তারই প্রাণপ্রিয় স্বামী।তখন কী হবে ওই মেয়েটার?
সারহান ভয় আর আবেগ নিয়ে বললো–
“কিচ্ছু হবে না।আমি তার কিছু হতে দিবো না।সব হারিয়ে আমি জান্নাহ্কে পেয়েছি।ওই একজনই আছে যাকে আমি সত্যিই ভালোবাসি।যে আমাকে ভালোবাসে।ছাড়বো না আমি তাকে।পৃথিবীর কোনো কিছুর বিনিময়েও না।আমার রজনীগন্ধা আমাকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারে না।কোথাও না।”
শেষের কথাগুলো বলতে বলতে গলা ধরে আসে সারহানের।তার সমস্ত পৃথিবী যেনো শূন্য হয়ে গেলো এক নিমিষে।সে তার রজনীগন্ধাকে ছাড়া বাঁচবে না।সত্যিই বাঁচবে না।
,
,
,
দরজা খুলতেই ভ্যালভ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মেহনাজ।ইহতিশামের সাদা শার্ট রঙিন হয়ে আছে।তটস্থ হয়ে বললো–
“এই অবস্থা কী করে হলো তোমার?
ইহতিশাম কোনো জবাব দিলো।ব্যস্ত পা দুটো চালিয়ে বেডরুমে গিয়ে বিছানায় বসলো।মেহনাজ দরজা লক করে উদ্বেলিত গলায় বললো—
“বসলে যে!চলো হসপিটালে যাই।”
ইহতিশাম খাপছাড়া সুরে বললো—
“এইটুকুর জন্য হসপিটালে যেতে হলে তোমাকে বিয়ে করেছি কেন?
মেহনাজ কোনো প্রত্যুক্তি করলো না।ওদের বিয়ে হয়েছে আজ দুই দিন।কোনোরকম আড়ম্বর ছাড়াই বিয়েটা করে ইহতিশাম।রাগে ইহতিশামের জ্বলন্ত চোখ দিয়ে যেনো অগ্নিনালা বিচ্ছুুরিত হচ্ছে।হাঁটু গেড়ে তার সামনে বসে মেহনাজ।নরম হাতে ইহতিশামের শার্টটা খুলে প্রশ্ন করে—
“কার সাথে মারামারি করলে?
ইহতিশাম নিরুত্তেজ গলায় বললো—
“সারহানের সাথে।আহ!আস্ত ইয়ার।মেরে ফেলবে নাকি?
মেহনাজ অনুযোগের সুরে বললো—-
“সরি,সরি।”
ইইতিশামের কাঁধের দিকটায় কাচ গেথে আছে।সেইটা বের করতেই ব্যথামিশ্রিত আওয়াজ করে সে।মেহনাজ পরম যত্নে তা ড্রেসিং করতে থাকে।ভাগ্যিস ইহতিশামের বাবা,মা বাসায় নেই।থাকলে হৈ হুল্লোড় করে ফেলতো।মেহনাজ স্বাভাবিক গলায় শুধায় —
“মারামারি করলে কেন?
ইহতিশাম ক্ষোভ নিয়ে তাচ্ছিল্য করে বললো—
“ওই শালা একটা গাধা।এতো জেদ!জেদের বসে কখন কী করে কিচ্ছু বুঝতে পারে না।আস্তে ইয়ার।”
ড্রেসিং করতে গিয়ে জ্বালা হয় ইহতিশামের।মুখবিকৃত করে সে।মনোযোগ সহকারে নিজের কাজ করছে মেহনাজ।মিহি গলায় প্রশ্ন করে ইহতিশাম—-
“তোমার বাবাকে বিয়ের কথা বলেছো?
মেহনাজ নমনীয় গলায় প্রত্যুত্তর করে—
“বলেছি।”
“কী বললো?
“খুশি হয়েছেন।বললো,জান্নাহ্ নাকি তোমার কথা বাবাকে বলেছিলো!
ইহতিশাম তাল মিলিয়ে বললো—
“চার বছর আগে যখন জান্নাহ্ এর ছবি তুমি আমাকে দেখিয়েছিলো তখন তো ও অনেক ছোট।সারহানের বাসায় দেখে কেন যেনো মনে হলো ওকে আমি কোথাও দেখেছি।তাই কায়দা করেই কার্ডটা দিয়েছিলাম।”
মেহনাজ মিচকি হেসে রসালো গলায় বললো—
“যদি অন্য কেউ হতো তাকে বিয়ে করে নিতে?
ইহতিশাম স্বাভাবিক চোখে তাকিয়ে কড়া গলায় বললো—
“একজনকে ভালোবেসে আরেকজনকে বিয়ে করি কী করে!
ভালো করে রক্ত মুছে তা পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে দিয় মেহনাজ।অধৈর্য হয়ে উঠে ইহতিশাম।কাভার্ড থেকে একটা অফ হোয়াইট রঙের শার্ট বের করে তা গলিয়ে নেয় গায়ে।ফাইলগুলো হাতে নিয়ে ক্ষীন গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে—
“সারহান কে ক্ষমা করতে পারবে তো?
ভ্রু কুঞ্চি করে মেহনাজ।একটা পিচাশকে কী করে ক্ষমা করা যায়!
ইহতিশাম শান্ত পায়ে মেহনাজের কাছে এসে দাঁড়ায়।তার কপালে গাঢ় চুমু খেয়ে বলে—
“সারহান ভুল করেছে।ওর আজকের এই জীবনের জন্য কোথাও না কোথাও আমিই দায়ী।ও জীবনে অনেক কিছু সয়েছে মেহনাজ।একদম একলা ও।জান্নাহ্কে নিয়ে নতুন করে বাঁচতে চায় ও।তোমার সাথে যা করেছে সেই জন্য আমি ওকে ক্ষমা করবোনা।কিন্তু একজন মানুষ হিসেবে,বন্ধু হিসেবে আমার দায়িত্ব ওকে এই জীবন থেকে বের করে আনা।তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা সেই প্রথম দিনের মতো যার একবিন্দুও কমে নি।আশা করবো তুমি আমার কথা বুঝতে পারছো।”
শশব্যস্ত হয় পা বাড়ায় ইহতিশাম।উদ্বিগ্ন কন্ঠে মেহনাজ বললো—
“কোথায় যাচ্ছো?
“স্যারের কাছে।সারহান আমার কাছে একটা জিনিস চেয়েছে।আজ এতো বছরে আমি আমার ভুলের মাশুল দিতে যাচ্ছি।তা যেনো দিতে পারি।খেয়ে নিও তুমি।ফিরতে লেট হবে আমার।বাই।”
চলবে,,,
(বিঃদ্রঃ
গঠনমূলক করবেন।সুন্দর,ভালো লাগে,দারুন এইসব না করলে ভালো। পঞ্চাশ প্লাস হলেই রাতে আরেক পর্ব।ধন্যবাদ।)