#জান্নাহ্
#পর্বঃ৫৫
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজেকে সাজাতে ব্যস্ত মৃণালিনী।ঘড়িতে সন্ধ্যা সাত।হলুদ রঙের টপস এর সাথে ব্রাশ জিন্স।টপসের এক হাতা হেলানো নিচের দিকে যেখানে তার ভেতরকার জামার স্ট্রিপ বেরিয়ে আছে।কাঁধ পর্যন্ত থাকা চুলগুলোকে এক সাইডে সিঁথি করে ফেলে রেখেছে।ঠোঁটে গাঢ় খয়েরি লিপস্টিক।কানের মধ্যে ঝুলছে আজকালকার ফ্যাশনেবল রিং।দরজায় দাঁড়িয়ে নিজের মাকে পর্যবেক্ষণ করছে জান্নাহ্।মৃণালিনী মেয়েকে দেখে উচ্ছ্বাসিত হাসলেন।মেয়ের কাছে গিয়ে হাত দুটো ধরে বললেন—
“মাম্মাকে কেমন লাগছে ডল?
জান্নাহ্ গম্ভীর মুখে বললো—
“ভালো।কোথায় যাচ্ছো তুমি?
মৃণালিনী হাসি হাসি মুখে বললেন—
“আজ আমার এক বন্ধুর জন্মদিন।ওটা সেলিব্রেট করতে যাচ্ছি।এবং তুমিও যাচ্ছো আমার সাথে।”
জান্নাহ্ চট করেই বললো–
“নো মাম্মা।আমি তোমার সাথে যাবো না।তুমি জানো এইসব আমার পছন্দ না।”
মৃণালিনী আদর মাখা গলায় বললেন—
“আমার বন্ধু তোমাকে দেখতে চেয়েছে ডল।আমি তাকে কথা দিয়েছি।তোমার নিশ্চয়ই যাওয়া উচিত।”
জান্নাহ্ আপত্তি করে বললো—
“নাহ।আমি যাবো না।”
মৃণালিনী আনম্র গলায় বললেন—
“ডু ইউ লাভ মি?
জান্নাহ্ এর কেনো যেনো কান্না পেলো।মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বললো—
“আই লাভ ইউ মাম্মা।আই লাভ ইউ সো মাচ।”
“আই লাভ ইউ টু ডল।যাও তৈরি হয়ে এসো।”
অগত্যা জান্নাহ্কে যেতে হবে।
সারহানের পেইন্টিং এর সামনে উদাস হয়ে দাঁড়িয়ে আছে জান্নাহ্।একটা স্লিভলেস গাউন পরেছে জান্নাহ্।তার উপর গোল্ডেন কালারের কটি।চোখে গাঢ় কাজল আর ঠোঁটে নুড কালারের লিপস্টিক।বাম হাত ভর্তি চুড়ি।চুড়ি জান্নাহ্ এর ভীষণ প্রিয়।সারহানের দিকে কাতর নয়নে তাকিয়ে আছে।মৃণালিনীর পায়ের শব্দে আড়াল করে সারহানকে।
,
,
,
ধীম ধীম আওয়াজে গান চলছে।ক্লাবের সবাই ব্যস্ত।ক্ষীণ আলো জ্বলছে।তাতে অবশ্য মুখ দেখা যায়।জান্নাহ্ এর গা ঘিনঘিন করে।কেমন উটকো গন্ধ!
তার দিকেই আস্ত নজরে তাকিয়ে আছে পাশে বসা রৌশান।জান্নাহ্ সেদিকে কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া না করে নিজের কোল্ড ড্রিংসের স্ট্রতে সিপ লাগায়।রৌশান মুগ্ধ গলায় বললেন–
“মানতে হয়।তোমার মেয়ে কিন্তু তোমার মতো সুন্দরী।”
মৃণালিনী দাম্ভিকতার সাথে বললেন—
“ভুল বললে।আমার ডল আমার চেয়েও সুন্দরী।শী ইজ লাইক আ এঞ্জেল।”
মৃণালিনী নিজের মেয়ের হাতে চুমু খেলেন।রৌশান ফিচেল হেসে বললো—
“তা অবশ্য তুমি ভুল বলোনি।”
জান্নাহ্ আড়চোখে রৌশানের দিকে তাকায়।লোকটাকে পছন্দ হচ্ছে না জান্নাহ্ এর।সেই কখন থেকে ফ্যাকাশে দৃষ্টিতে তাকে উপর থেকে নিচে দেখছে।মৃণালিনী তার এক বন্ধুকে দেখে বললেন—
“ডল,তুমি বসো আমি আসছি।”
“ওকে মাম্মা।”
মৃণালিনী উঠে যেতেই রৌশানের চোখে দ্যুতি খেলে গেলো।অদ্ভুত দৃষ্টিতে জান্নাহ্ এর গলার দিকটায় তাকিয়ে রইলো।জান্নাহ্ তার খোলা চুলগুলো ঘাড়ের দুই পাশে ছড়িয়ে দেয়।শক্ত গলায় বলে উঠে জান্নাহ্—
“আপনিই মাম্মার সেই কলেজ টাইমের বয়ফ্রেন্ড?
রৌশান স্মিত হেসে সম্মতি দিলো।জান্নাহ্ কড়া গলায় শাসিয়ে উঠে—
“কেন ছেড়ে দিচ্ছেন না আমার মাম্মার পিছু?আপনি তো বিয়ে করেছেন।তবুও কেন আমার মাম্মাকে নিজের প্রতি অ্যাট্রাক্ট করছেন?
রৌশান মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।এই টুকু বাচ্চা মেয়ে কী সুন্দর কথা বলে!জান্নাহ্ এর ঠোঁটের নড়াচড়া দেখছে রৌশান।সাবলীল গলায় রৌশান বললো–
“তুমি হয়তো জানো না ডল,আমার ডিবোর্স হয়ে গেছে।”
জান্নাহ্ ক্রোধান্বিত গলায় বলে উঠে—
“একদম আমাকে ডল ডাকবেন না।এই নামে শুধু আমার মাম্মা আর বাবা ডাকবে।”
রৌশান চতুর হেসে জান্নাহ্ এর হাত স্পর্শ করে বললো—
“ওকে,ওকে।জাস্ট ইজি জান্নাহ্।তোমার মা ঠিকই বলেছে।তুমি তার চেয়েও সুন্দরী।জাস্ট আ ফায়ার বিউটি।এই বয়সে এতো সুন্দর তুমি ভাবতো আঠারো ক্রস করলে তুমি তো দুনিয়া কাঁপাবে।তুমি ইচ্ছে করলেই মডেলিং করতে পারো।আমি হেল্প করবো তোমায়।”
জান্নাহ্ ঝাঁড়া মেরে উঠে দাঁড়ায়।গর্জে উঠে বললো—
“ডোন্ট টাচ মি।ইউ রাবিশ!
রৌশান ক্ষীপ্র গলায় বললেন—
“জান্নাহ্!
“চুপ করুন।”
মেয়ের গলার উঁচু আওয়াজে মৃণালিনী দপদপিয়ে আসেন।মায়ের বুকে মাথা গুঁজে দেয় জান্নাহ্।কেঁদে কেঁদে বললো—
“দেখনা মাম্মা,হি টাচ মি ইন ব্যাড ওয়ে।”
মৃণালিনী খলবলিয়ে বললেন—
“হোয়াট?
রৌশান নিজের ডিফেন্সে বললেন—
“মৃণালিনী তোমার মেয়ে মিথ্যে বলছে।আমি তো…।”
তার আগেই এক চড় বসিয়ে দেয় মৃণালিনী রৌশানের গালে।ক্লাবের সবাই নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে আছে।ক্ষীপ্ত কন্ঠে ঝাঁজিয়ে উঠে মৃণালিনী—-
“তোমার সাহস কী করে হলো আমার মেয়েকে ছোঁয়ার!ইউ ফ** ফেলো।”
রৌশান উত্তেজিত হয়ে বললেন—
” ইউ স্লাট,ভাবিস কী নিজেকে তুই!
মৃণালিনী সজোরে আরেক চড় বসিয়ে দেয় রৌশানের গালে।দু দুটো চড় খেয়ে হতভম্ব হয়ে যায় রৌশান।মৃণালিনী অ্যাডিক্টেড হলেও নিজের সম্ভ্রমে কখনো আঘাত হানতে দেয়নি।সেখানে নিজের ফুলের মতো মেয়ের জন্য এক চুলও ছাড় নয়।রৌশান তেড়ে গিয়ে মৃণালিনীকে পাল্টা আঘাত করতে চাইলে কেউ তার হাত ধরে ফেলে।রসালো গলায় বলে উঠে—
“আরে মামা।রিল্যাক্স।নারীর গায়ে হাত দেওয়া কাপুরুষের কাজ।”
রৌশাণ গমগমে গলায় বললেন—
“হোয়াট রাবিশ!তুই কে?
“তোর বাপ।”
রৌশানের হাতটা পেছনে মুড়ে ধরে ছেলেটি।মৃণালিনীকে উদ্দেশ্য করে বললো—
“আপনি যেতে পারেন ম্যাম।একে আমি দেখছি।”
মৃণালিনী কৃতজ্ঞতার সুরে বললো—
“থ্যাংকস আ লট।”
জান্নাহ্ নিজের মায়ের বুকে মুখ গুঁজে নাক টেনে যাচ্ছে।কিন্তু ছেলেটার কন্ঠস্বর তার পরিচিত মনে হলো।হালকা মাথা বাঁকিয়ে দেখলো সে।ছেলেটার পেছন দিকটা দেখে সে বুঝতে পার এ তারই প্রাণ।সারহান আরো কয়েকধাপ কথা বললো।গলার আওয়াজ আর এক সাইড থেকে দেখে জান্নাহ্ নিশ্চিত হলো এটা সারহানই।নিজেকে লুকায় জান্নাহ্।সে চায় না তার প্রাণ তাকে এইভাবে দেখুক।সারহান থমথমে গলায় মৃণালিনীকে ডেকে বলে–
“আমি পেছন থেকে আপনার মেয়ের কথাগুলো শুনেছি।সে ভুল কিছু বলেনি।আপনার মেয়েকে দেখে মনে হচ্ছে সে এখনো এইসব জায়গার জন্য উপযুক্ত নয়।নেক্সট টাইম তাকে এখানে আনার আগে দু’বার ভাববেন।আর পারলে নিজেও এভয়েট করবেন এইসব জায়গা।এগুলো সবার জন্য নয়।রঙিন পালক লাগালেই তো আর কাক ময়ূর হয়ে যায় না।তাই ময়ূর রূপী কাক চিনতে আমাদের ভুল হয়।যান।”
মৃণালিনী অপ্রস্তুত হলেন সারহানের কথায়।কিন্তু তার গভীরতাও বুঝতে পারলেন।
সারহান কপট হেসে ফিচেল গলায় বললো—
“শালা পার্ভাট, আজ তিনদিন ধরে তোকে টার্গেট করে রেখেছি।আর তুই আছিস নতুন পাখি ধরার ধান্দায়।”
ভ্যাবাচাকা খেয়ে রৌশান বললেন—
“কে তুই?কী চাস?
সারহান জোরালো গলায় ডেকে উঠে—
“শায়িখ,শায়িখ।”
শায়িখ হাঁপাতে হাঁপাতে এসে দম স্থির করে বললো—
“জ্বী স্যার।”
সারহান খটমটিয়ে বললো—
“কোথায় ছিলে তুমি?
শায়িখ মিনমিনে গলায় প্রত্যুক্তি করে—
“ওয়াশরুমে স্যার।”
সারহান নাক ফুলিয়ে বিতৃষ্ণা গলায় বললো—
” আমি বুঝিনা জরুরি কাজের সময় তোমার সবসময় ওয়াশরুমে কেন যেতে হয়।”
শায়িখ অনুযোগের সুরে বললো–
“সরি স্যার।”
“ওই ছেলে দুটো কোথায়?
“এখনই নিয়ে আসছি স্যার।”
একটু পরই দুটো উঠতি বয়সের ছেলেকে নিয়ে ফিরে শায়িখ।ছেলে দুটো ভয় তটস্থ হয়ে থরথর করে কাঁপছে।সারহান তেজি গলায় বললো—
“এই দুটোকে চিনিস?
রৌশান দম্ভ করে বললো —
“নাহ।”
সারহান রৌশানের ব্লেজারে কলার টেনে এক ঘা বসায় তার গালে।তপ্ত গলায় বললো–
“আরেকবার মিথ্যে বললে এখানেই পুঁতে দিবো।”
রৌশান ক্ষীপ্ত চোখে তাকিয়ে আছে।সারহান স্বশব্দে বললো—
“মেয়েদেরকে মডেলিং এর কথা বলে বাইরে পাচার করিস আর যুবক ছেলেদের ড্রাগসের নেশা ধরিয়ে ওদের দিয়েই ড্রাগস সাপ্লাই করাস।”
রৌশান প্রতিবাদ করে বললেন—
” এইসব মিথ্যে।”
“প্রীতির অ্যাকসিডেন্ট এদের দিয়ে করিয়েছিলি তাই না!
ভীত চোখে তাকিয়ে ঢোক গিলতে থাকে রৌশান।সারহান ছেলেদুটোর দিকে কড়া চোখে তাকাতেই ছেলে দুটো হন্তদন্ত হয়ে বললো—
“জ্বী স্যার।রৌশান স্যার ই বলেছিলো প্রীতির অ্যাকসিডেন্ট করাতে।প্রীতির কাছে একটা ভিডিও আছে।”
“ইয়া।ওটা এখন আমার কাছে।আর প্রীতিও বেঁচে আছে।
শায়িখ,পুলিশ আসতে আর কতক্ষন?
হকচকিয়ে যায় রৌশান।শায়িখ মৃদু গলায় বললো—
“পুলিশ কমিশনার কে কল করেছি।”
সারহান বিরক্তি নিয়ে বললো—
“ওই নাদাপেটাকে কল করেছো কেন?বউ ছেড়ে আসতেই তো সকাল হয়ে যাবে।”
শায়িখ ঠোঁট চিপে হেসে বললো—
“কমিশনার তার মেয়ের হবু জামাইকে পাঠাচ্ছে।”
সারহান রসালো গলায় বললো—
“ওর জামাই তো কচ্ছপ।”
শায়িখ বিজ্ঞ আচরণ করে বললো—
“স্যার,ছোটোবেলার গল্পটা মনে আছে না।স্লো এন্ড স্টেডি উইন দ্যা রেস।”
সারহান শায়িখের কাঁধে চাপড় মেরে বললো–
“সাবাস!
জান্নাহ্ রা যেই টেবিলটায় ছিলো সেটার উপরে উঠে বসে সারহান।ছেলেদুটো কে বললো রৌশানকে পুলিশ আসার আগ পর্যন্ত ধরে রাখতে।তাহলে ওদেরকে সে ছেড়ে দিবে।ছেলে দুটো তাই করলো।চেপে ধরে রাখলো রৌশানকে।রৌশান টাকা অফার করে সারহানকে।সারহান মশকারি করে বললো—
“টাকার বালিশে ঘুমালে স্লিপিং পিল লাগে আমার।আগে ওটা পেয়ে নেই তারপর।”
মুচকি হাসে শায়িখ।তার স্যার বিয়ের কথা বলছে।দমদমে গলায় ক্লাবের ম্যানেজারকে ডাকে সারহান।
“ম্যানেজার!
ম্যানেজার কাঁচুমাচু হয়ে তার সামনে এসে দাঁড়ায়।তীর্যক গলায় বললো—
“আজকের পর যদি আন্ডার এইটিন কোনো ছেলে বা মেয়েকে ক্লাবে ঢুকতে দিয়েছিস তো তো তু গ্যায়া।”
“সরি স্যার,আর ভুল হবে না।”
“শায়িখ আমার জন্য ঠান্ডা কোল্ড ড্রিংস নিয়ে এসো।এদের সামলাতে গিয়ে আমার গলা শেষ।”
ভৃত্যের মতো শায়িখ বললো—
“জ্বী স্যার।এখনই আনছি।”
“দুই মিনিটে পুরো ক্লাব খালি চাই আমি।”
এতোক্ষন দর্শকের মতো মজা লুটে নেওয়া মাতালরা আস্তে আস্তে ক্লাব থেকে বেরিয়ে যেতে লাগলো।সারহান দুই হাতে টেবিলের উপর ভর দেয়।সে অনুভব করে তার হাতে কিছু একটা লেগেছে।সারহান হাত উঠিয়ে তালুতে দেখে একটা লেন্স লেগে আছে।বিক্ষিপ্ত হাসে সারহান।স্বগতোক্তি করে বললো–
“মনে হয় ওই বাচ্চা মেয়েটার লেন্স!এতো কম বয়সে কেউ লেন্স ইউজ করে!স্ট্রেঞ্জ!
চলবে,,,
(বিঃদ্রঃ
ওই পোস্টে অনেকেই থিউরি লিখলেন!অন্তত তারা এখন বিশ্লেষনমূলক মন্তব্য করবেন।ধন্যবাদ।)