জান্নাহ্ “পর্বঃ৫৯

0
3320

#জান্নাহ্
#পর্বঃ৫৯
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

পশ্চিমাংশের দিকে ধাবিত হচ্ছে সূর্য।ঝলমলে নীল আকাশ একটু একটু করে ধূসর রঙে রাঙিয়ে যাচ্ছে।গনগনে সূর্য তার তেজস্বী ভাব গুটিয়ে নিয়ে ম্রিয়মান রোদে রাঙাতে ব্যস্ত কিশোরী বিকেলকে।

একটা অনাথ আশ্রমের সামনেই নরম সবুজ ঘাসের উপর কিলকিল করছে কয়েক ডজন ছোট্ট বাচ্চা।
তাদের দিকে অনিমেষ চেয়ে আছে জান্নাহ্।মুখ ভর্তি তিক্ত অনুভূতি নিয়ে বললো—

“আমরা এখানে কেন আসছি সারহান?

সারহান স্মিতহাস্য অধরে বললো–

“কিছু দেখাবো আপনাকে।”

সারহান দুরে দাঁড়ানো মারশিয়াদকে উদ্দেশ্য করে বললো–

“ওই যে দেখতে পাচ্ছেন,তার নাম মারশিয়াদ আরজান।তাকে তার স্ত্রী জান বলে ডাকে।কিন্তু তার মুখের যে আদল সেইটা তার স্ত্রীর রাহান ভাইয়ার।”

গোল গোল চোখ করে তাকায় জান্নাহ্।সন্দিহান গলায় জিঙ্গেস করে—

“আমি বুঝিনি।”

সারহান মারশিয়াদ,প্রহর,আজরাহানের ত্রিকোণ প্রেমের কাহিনী শোনায়।বিস্ময়ে ক্রমাগত জান্নাহ্ এর চোখ জোড়া পূর্ণ প্রকাশিত হয়।সে আবেগপূর্ণ চোখে তাকিয়ে থাকে মারশিয়াদের দিকে।তার অবাক লাগে,যে মানুষটাকে সে সামনে দেখছে সে আসলে সে নয় যাকে সে দেখছে।এভাবেও কেউ ভালোবাসতে পারে!নিজেকে বিসর্জন দিয়ে!
আর রাহান ভাইয়া!সে কী করে পারলো নিজের ভালোবাসাকে সজ্ঞানে অন্য কারো হাতে তুলে দিতে!জান্নাহ্ তো তা পারবে না।সে তার প্রাণের ভাগ কাউকে দিতে পারবে না।
জান্নাহ্ এর কানের কাছে আচমকাই ফিসফিসিয়ে উঠে সারহান।বললো-“আমি কিন্তু এতোটা সুহৃদ নই।আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেলেও আমার রজনীগন্ধাকে আমি অন্য কারো হাতে তুলে দিবো না।”

জান্নাহ্ এর পায়ের কাছে এসে থামে ছয় সাত বছরের একটি ছেলে।ছোট ছোট চোখে মুগ্ধ হয়ে দেখে জান্নাহ্কে।জান্নাহ্ হাঁটু ভেঙে নিচে বসে।বাচ্চাটির গালে হাত দিয়ে আদুরে গলায় বললো–

“কী নাম তোমার?

বাচ্চাটি ফিক করে হেসে আমুদে গলায় বললো–

“আজরাহান।”

জান্নাহ্ বিস্ফোরিত চোখে তাকায়।সারহান এক হাটু ঘাসের উপর ঠেকায়।আরেক পায়ের হাঁটু ভেঙে বসে।আজরাহানের গাল টেনে বলে–

“কেম আছো আজরাহান?

খুশি খুশি গলায় উত্তর করে আজরাহান।

“ভালো।তুমি কেমন আছো আঙ্কেল?

“ভালো।”

জান্নাহ্ উদ্বেগপূর্ণ গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে—

“ও আপনাকে চিনে?

সারহান গালভর্তি হেসে বললো—

“হুম।যতবার এখানে এসেছি আজরাহান মারশিয়াদের সাথেই ছিলো।”

আজরাহান ঝলমলে হাসে।জান্নাহ্ এর হাত ধরে টানতে টানতে বললো—

“এসো আন্টি,এসো।”

প্রহর মাঠের মধ্যে বসে প্রহরিনীকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছে।প্রহরিনী না খেয়ে অন্য বাচ্চাদের সাথে দৌঁড়ে দৌঁড়ে খেলছে।বিকেল বেলায় বাচ্চাদের হালকা খাবার খেতে দেওয়া হয়েছে।জান্নাহ্ ও বসে আছে তাদের সাথে।তার পাশেই সারহান।বাচ্চাদের জন্য বিভিন্ন খেলনা আর খাবার নিয়ে এসেছে।মারশিয়াদ আশ্রমের কেয়ারটেকারের সাথে কথা বলছে।অসহায় গলায় ডেকে উঠে প্রহর—

“জান!

মারশিয়াদ কেয়ারটেকারের সাথে কথা বলা শেষ করে প্রহরের কাছে এসে দাঁড়ায়।সংকীর্ণ গলায় বললো–

“কিছু বলবেন?

“দেখুন না প্রহরিনী খাচ্ছে না।”

মারশিয়াদ এলোথেলো হয়ে দৌঁড়ানো প্রহরিনীকে খপ করে ধরে বললো—

“দুষ্ট পরী,মাম্মাইকে জ্বালাচ্ছেন কেন?

“বাব্বাই!

মারশিয়াদ প্রহরিনীর গালে টুপটুপ করে কয়েকটা চুমু খেয়ে ওকে নিয়ে আসন পেতে প্রহরের সামনে বসে।হাসি হাসি গলায় বললো—

“আমি ধরে রেখেছি আপনি খাওয়ান।”

প্রহর ভ্রু কুঞ্চি করে বললো—-

“ধুর!

জান্নাহ শ্রান্ত চোখে তাকিয়ে আছে।আনমনেই এক হাত দিয়ে সারহানের পায়ের দিকটায় খাবলা মেরে ধরে।সারহান ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললো–

“ভয় পাচ্ছেন রজনীগন্ধা?ভয় পাবেন না।আপনাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাচ্ছি না।”

থমথমে চোখে তাকায় জান্নাহ্।তার সত্যিই ভয় হয়।মারশিয়াদের আশ্রমের গুটিকতক বাচ্চা আনার ব্যবস্থা করেছে সারহান।তার এনজিওতে আপাতত ওভারলোড।আর সংস্কারের কাজ চলছে।মারশিয়াদের সাথে এমন একটা কেসেই সারহানের পরিচয়।জান্নাহ্ প্রহরের কাছে গিয়ে প্রহরিনীকে আদর করে বললো—

“কেমন আছেন আপনি?

প্রহর নিষ্প্রভ গলায় বললো—

“ভালো।”

জান্নাহ্ চোখে হাসে।এমন কখনো হয়!একজনকে ভালোবেসে অন্যজনের সাথে সংসার করা।
মারশিয়াদের সাথে কথা বলা শেষ করে সারহান।জীবন্ত প্রেমের সমাধি দেখে জান্নাহ্। এক জনের মৃত্যুতে তিন জনই মরে বেঁচে আছে।
,
,
,
রেস্টুরেন্টে বসে খাবারে চামচ দিয়ে বসে আছে জান্নাহ্।উসখুস করছে তার মন।সারহান চিন্তিত গলায় বললো—-

“কী হলো রজনীগন্ধা!খাচ্ছেন না কেন?
ফিরতে হবে আমাদের।”

জান্নাহ্ চোখ-মুখ বিকৃত করে বিতৃষ্ণা গলায় বললো—-

“আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।”

সরল নিঃশ্বাস ফেলে সারহান।গম্ভীর গলায় বললো–

“খেয়ে নিন রজনীগন্ধা।সারাদিন কিছুই খান নি।বাসায় কিন্তু রান্না করা নেই।”

চকিতে নিজের পিঠে বলয় আকৃতির কিছু একটা স্পর্শ পায় জান্নাহ্।পেছন ফিরে তাকাতেই দেখে দুই -তিন বছরের একটা বাচ্চা ছেলে।ভয়ে জড়সড় হয়ে এসে তার বলটা হাতে নেয়।জান্নাহ্ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।বেশ মিষ্টি বাচ্চাটা।জান্নাহ্ পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাতেই বাচ্চাটি অনুযোগের সুরে বললো–

“সলি,আননি।”

না চাইতেও হাসতে বাধ্য হয় জান্নাহ্।বাচ্চাটির টসটসে গাল ধরে বললো–

“কী নাম তোমার?

“আমাদ।”

জান্নাহ্ আহ্লাদী হয়ে আমাদ এর কপালে চুমু খায়।কিন্তু তার বিপরীতে অস্বস্তিকর অঙ্গভঙ্গি করে আমাদ।বললো—

“নো,পাপ্পি।”

জান্নাহ্ ঘাবড়ে যায়।অসহিষ্ণু গলায় প্রশ্ন করে —

“কী হয়েছে?

আমাদ তার কপালে হাত ঘষতে থাকে।পেছন থেকে চিকন কন্ঠ স্বর ভেসে আসে।

“ওর বাবাই ছাড়া কেউ ওকে কপালে চুমু খায় সেটা আমাদ পছন্দ করে না।”

জান্নাহ্ ধীরগতিতে সোজা হয়ে দাঁড়ায়।নরম চোখে তাকায়।দেখে শ্যামবর্ণের একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তার চোখে মুখে উজ্জ্বলতা।স্নিগ্ধ একটা হাসি অধরে।চোখের তারায় যেনো ঝলমলে আকাশের তারা খসে পড়ছে।জান্নাহ্ বিনয়ী গলায় বললো—

“সরি।”

আম্বের নিরুদ্বেগ গলায় বললো—

“ইটস ওকে।বাবাইয়ের পাগলা তো তাই।আমি ওর মা।আম্বের।এই যে দেখছেন ওর হাতের বলটা।ঘুমাতে গেলেও বিছানায় পাশে রেখে ঘুমায়।কারণ এটা তার বাবাই দিয়েছে।”

জান্নাহ্ ফিকে হাসে।ততক্ষনে মাহাদ এসে দাঁড়ায় আম্বের এর পাশে।ঝরঝরে হেসে আমাদকে কোলে তুলে নেয়।মসৃণ গলায় বললো–

“হ্যালো!

মাহাদ হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়ালেও জান্নাহ্ এর ভাবান্তর হলো।আম্বের অপ্রস্তুত হয়।মাহাদের পেটের মধ্যে কনুই দিয়ে ঘুষি মেরে মেকি হাসি দিয়ে মাহাদকে চাপা সুরে বললো—

“মেয়ে মানুষ দেখলেই হ্যান্ডশেক করতে ইচ্ছে করে!

মাহাদ মুখটা আম্বেরের কানের কাছে নিয়ে বললো—

“হ্যান্ডশেক ই করতে চেয়েছি চেস্টশেক নয়।”

আম্বের ত্রস্ত হয়ে বললো—

“চুপ করুন।ঠোঁট কাটা পুরুষ।”

“হায়!আজকাল আপনার মুখে পুরুষ শব্দটা না শুনলে আমি ভুলেই যাই আমি পুরুষ হয়ে জন্মেছি।”

আম্বের জ্বলন্ত চোখে তাকাতেই নিভে যায় মাহাদ।ফিচেল হেসে বললো–

“নাহ।মানে আমাদ আমারই ছেলে তা নিয়ে আমার সন্দেহ নেই।”

আম্বের মৃদু গলায় জান্নাহ্কে বললো—

“আপনি কিছু মনে করবেন না।মাহাদ এমনিতেই ফান করে।”

মাহাদ ব্যগ্র গলায় বললো—-

“সরি মিস।”

মাহাদের কথার পিঠেই বলে উঠে জান্নাহ্—

“মিসেস।মিসেস জান্নাহ্।”

জান্নাহ্ এর পাশে এসে দাঁড়ায় সারহান।উষ্ণ ভাব বিনিময়ে বললো–

“শী ইউ মাই ওয়াইফ।আই এম সারহান।সারহান জেইদি।”

মাহাদ প্রত্যুত্তরের বললো–

“মাহাদ আবইয়াজ।”

“জানি।একসময় কার মেয়েদের ক্রাশ।”

মাহাদ হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বললো—

“এখন দেয়ালের ব্রাশ।”

চোখে হাসে সারহান।মাহাদ আম্বেরকে তাড়া দিয়ে বললো—

“চলুন মিস সুগন্ধি।দেরি হচ্ছে আমাদের”

“হুম।আসি মিসেস জান্নাহ্।বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে।”

জান্নাহ্ নিজেকে হেলিয়ে দেয় সারহানের বুকের একপাশে।চিবুক উঁচু করে অসহায় চোখে তাকায় সারহানের দিকে।
মাহাদ আর আম্বের তাদের যাওয়ার পথ ধরে।মৃদু হেসে ফিচেল গলায় বললো মাহাদ—

“বাহ!দেশ কোথায় এগিয়েছে দেখেছেন।এমন কচি বউ থাকলে জীবনটাই স্বর্গ।”

আম্বের দমদমে গলায় বললো—

“ও আচ্ছা!বুড়ো বয়সে টসটসে,কচকচে বউ পেতে ইচ্ছে হচ্ছে!

“বুড়ো হতে যাবো কেন?

“নাহ,তা কেন।আপনি তো বুড়ো খোকা।এই যে নাক টিপলে তরতর করে দুধ পড়ে।”

“দুধ পড়বে কেন?
অন্যকিছুও পড়তে পারে।”

“ইউ,অসভ্য পুরুষ!চুপ করুন।”

জান্নাহ্ নির্নিমেখ চেয়ে আছে।কাতর গলায় বললো—-

“সবার খুশির ঝুড়িই পরিপূর্ণ।শুধু আমাদের ঝুড়িটাই পূর্ণ হলো না কেন সারহান।”

“ধৈর্য্য ধরুন রজনীগন্ধা।সব হবে।”
,
,
,
এক সপ্তাহ অতিবাহিত হতে সময় লাগলো না।জান্নাহ্ নিজেকে একটু একটু করে স্ট্যাবল করার চেষ্টা করছে।নিজের অবচেতন মনে করা ভুল আজকাল তাকে বড্ড পোড়ায়।নিজের সন্তানকে হারিয়ে জান্নাহ্ উপলব্ধি করেছে যা সে করেছে তা ভুল।
কিন্তু কী করতো সে।অথৈ সাগরে ভেসে থাকার জন্য যে ভেলাটুকু তার সহায় তাকে সে কী করে ডুবতে দেয়!

সারহানের ব্যবহারে আচম্বিত জান্নাহ্।সারাদিন ঘরে বসে সব কাজ নিজের হাতে করে।এমনকি জান্নাহ্ গোসল করলে তার চুল পর্যন্ত মুছে দিতে দ্বিধা করে না।সারহান কেয়ারিং ছিলো।কিন্তু এখন!

ধুম ধরে বসে আছে জান্নাহ্।সারহানের দিকে রাগি চোখে তাকিয়ে আছে।সারহানের কোনো ধ্যান নেই সেইদিকে।ক্রুদ্ধ গলায় বলে উঠে জান্নাহ্—

“কেন নিয়ে গেছেন আমাকে ডক্টরের কাছে?

সারহান বিছানার এই কোনায় বসে ছিলো।সেখান থেকে উঠে অত্যন্ত সাবলীল গলায় বললো—

“আপনার রেগুলার চেকাপের জন্য।”

আলমিরা খুলে একটা সাদা টিশার্ট গলিয়ে নেয় সারহান।জান্নাহ্ উঠে দাঁড়ায়।শক্ত গলায় বললো—

“মিথ্যে বলছেন আপনি।”

সারহান স্বাভাবিক গলায় বললো—

“আমি চুরি করিনি যে মিথ্যে বলবো!

“আমি বাইরে থেকে সব শুনেছি।”

মৃদু হাসে সারহান।জান্নাহ্ এর সামনে এসে দৃঢ় হয়ে দাঁড়ায়।নরম গলায় বললো—-

“শুনেছেন যখন প্রশ্ন কেন করছেন?

“কেন এমন করছেন সারহান?

সারহান হেয়ালি গলায় বললো—

“কেন করছি জানেন না!

“আমি পারবো না।”

“পারতে হবে রজনীগন্ধা।আমার পরীকে আমার চাই।আপনি এখন সুস্থ।আপনি চাইলেই কনসিভ করতে পারবেন।পুরো খেয়াল রাখবো আপনার।”

জান্নাহ্ ছোট্ট করে বললো—

“আমি পারবো না।”

হিংস্র হায়েনার মতো ক্ষেপে উঠে জান্নাহ্ এর গলা চেপে ধরে সারহান।হাতের চাপ বাড়াতেই শ্বাস আটকে আসে জান্নাহ্ এর।চোখ হয়ে উঠে টলটল।স্থির,নিষ্কম্প চোখে তাকিয়ে আছে সারহান।জান্নাহ্ এর শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে দেখে হাতের বেড় শিথিল করে।কেঁশে উঠে জান্নাহ্।গলা শুকিয়ে ঢোক গিলতে কষ্ট হচ্ছে।সারহান শান্ত হয়ে বেড সাইড টেবিল থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে জান্নাহ্ এর হাতে দেয়।তড়িৎ বেগে তা পান করে জান্নাহ্।মুক্ত নিঃশ্বাস ফেলে সে।
সারহান নির্ভীক ও অতি স্বাভাবিক গলায় বললো—

“নিজের হাতে নিজের প্রাণটা তো আমি নিতে পারবো।কিন্তু আপনাকে কেন আঘাত করতে পারি না বলুন তো!

জান্নাহ্ কাঁপা কাঁপা দৃষ্টিতে সারহানকে দেখে।তার দুই চোখ সারহানের ওই অরুনলোচন চোখে আবদ্ধ।সারহান আবারো ক্ষুন্ন গলায় বললো—

“কেন শুনছেন না আপনি আমার কথা?আমার পরীকে আমার চাই।”

জান্নাহ্ প্রস্ফুরনিত কন্ঠে বললো—

“কেন পাগলামি করছেন সারহান?

সারহান বিক্ষিপ্ত হাসে।বিগলিত গলায় বললো—

“আমি তো পাগলই।এই পাগলকে কেন ভালোবাসলেন আপনি?
মানুষ তার সমস্ত জীবনে ভালোবাসা কুড়োয়।আর আমাকে দেখুন।উপচে পড়া ভালোবাসা আমার পুরো জীবনটা একটা ধ্বংসাবশেষ তৈরি করে দিলো।এই ধ্বংসাবশেষ ভালোবাসার ফুল আপনিই ফুটাতে পারবেন।ফিরিয়ে দিন আমার পরীকে।আমি কথা দিচ্ছি আমি ওর বেস্ট বাবা হয়ে দেখাবো।যেমনটা আপনি আপনার বাবাকে ভাবতেন।আমি সারাজীবন আপনার গোলাম হয়ে থাকবো।শুধু আমার পরীকে আমায় ফিরিয়ে দিন রজনীগন্ধা।আমাকে বাঁচতে দিন রজনীগন্ধা।প্লিজ বাঁচতে দিন।”

জান্নাহ্ তার অশ্রুসিক্ত চোখে তার প্রাণকে দেখে।এই সারহানকে চিন্তে তার কষ্ট হয়।ডিভানে গিয়ে বসে সারহান।দুই হাতে কপাল চাপকে ধরে রাখে।পায়ের আঙুলগুলো উঠানামা করে মেঝের উপর ছন্দের সৃষ্টি করে।ঠোঁট কামড়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে সারহান।আচমকা উঠে দাঁড়ায়।জান্নাহ্ স্থির হয়ে চেয়ে আছে।
জান্নাহ্ এর সামনে গিয়ে বিতৃষ্ণা গলায় বললো—

“কেন করলেন এইসব!কী দরকার ছিলো এইসব করার!কেন খুন করলেন আপনি?

শেষের লাইনটা যেনো জান্নাহ্কে একদম নাড়িয়ে দিলো।বদ্ধ শ্বাসে কেঁপে উঠে জান্নাহ্।বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে সে।সারহান অধর ছড়িয়ে শ্বাস নেয়।তীব্র হতাশ হয়ে বললো—

“কেন করলেন আপনি এইসব রজনীগন্ধা?ভয় লাগেনি আপনার?ভাবেন নি এর পরিণতি কী হবে!এই ছোট্ট দুই হাতে এতো নৃশংস কাজ কী করে করলেন?

ড্রেসিং টেবিলে সজোরে ধাক্কা মারায় তা ঝনঝন করে ভেঙে পড়ে।সারহানের হাতেও লেগে যায়।এক নাগাড়ে কেঁদে কেটে বুক ভাসায় জান্নাহ্।
সারহান দাঁতে দাঁত চেপে বললো—

“দোষ তো একার ওদের ছিলো না।দোষী আমিও।তাহলে ওরা একা কেন শাস্তি পাবে!আরে আমি নর্দমা।নিজেকে কেন জড়ালেন আমার সাথে।কেন খোঁজ নিলেন না আমার।যখন জানতে পেরেছেন আমি আপনার যোগ্য নই কেন চলে গেলেন না?

জান্নাহ্ মৃদু গলায় গোঙানি দিয়ে বললো—

“কোথায় যাবো আমি।আপনি ছাড়া তো আমার কেউ নেই।”

সারহান আর্দ্র গলায় বললো—-

“কেন আমাকেই বেছে নিলেন আপনি।মানুষের উপরের অংশ আর ভেতরের অংশে অনেক তফাৎ রজনীগন্ধা।আপনার কেন মনে হলো আমি আপনার বাবার মতো!আমি তা নই।আমি তো জারজ রজনীগন্ধা।”

জান্নাহ্ ঝাঁপিয়ে পড়ে সারহানের বুকে।ভাঙা গলায় বললো–

“নাহ।এইসব বলবেন না।আমি আপনাকে ভালোবাসি সারহান।ক্ষমা করে দিন আমায়।আমি ভুল করেছি।কী করবো বলুন।মা,বাবাকে হারিয়ে আমি যে আপনাকেই সব মেনেছি।আপনার ভাগ আমি কাউকে দিতে পারবো না।কাউকে না।”

সারহান গুমোট গলায় বললো—

“কাউকে এতোটাও ভালোবাসতে নেই যে ভালোবাসা তাকে দূর্বল করে দিবে।ভালোবাসতে হয় পানির মতো।উষ্ণতায় গলবে তো শীতলতায় কঠিন হবে।”

“আমি ইচ্ছে করে করি নি সারহান।ওরা…।”

“তাই বলে এইসব করবেন!আপনার যদি কিছু হয়ে যায়?

“আপনি আমাকে বাঁচাবেন না সারহান?

সারহান নিজের দুই ঠোঁট চেপে ধরে জান্নাহ্কে আবদ্ধ করে তার বক্ষস্থলে।গাঢ় গলায় বললো—

“কিছু হতে দিবো না আমি আপনার।কাউকে পৌঁছাতে দিবো না আপনার কাছে।

“মামা কিছু করে নি সারহান।তাকে বাঁচান।”

“কারো কিছুই হবে না।বসুন আপনি।”

সারহান জান্নাহ্কে বিছানায় বসায়।ভারি গলায় বললো—

“আপনার কেন মনে হলো আমি আপনাকে চিনতে পারি নি!ষোলো সতেরো বছরের সারহান যখন তার মায়ের জন্য দেশ চষে ফেলতে পারে তাহলে আপনাকে কী করে ভুলে যায়!

শীতল নিঃশ্বাস ফেলে সারহান।মেঝেতে আসন পেতে বসে।জান্নাহ্ এর চোখের কার্ণিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল।থমথমে গলায় সারহান বললো—

“আমি কখনো কাউকে ভালোবাসিনি রজনীগন্ধা।ভালোবাসতে ভুলে গিয়েছি আমি।ক্রিমিনাল না হয়েও হয়েছি জেলখাটা আসামী।সেখান থেকে বেরিয়ে সারহান হয়ে গেলে পাথর সারহান।ডুবে গেলাম ক্রাইমের দুনিয়ায়।কী করিনি আমি!নিজেকে শেষ করেছি তিলে তিলে।ভাবিনি কখনো নিজেকে নিয়ে।কারো মায়ায়ও পড়িনি।
সামিরার মৃত্যুতে চমকাই নি আমি।স্যার আর আমি অনেক কাজ করেছি।ভেবেছি হয়তো তার কোনো শত্রু এইসব করেছে।তিথিকে তো আমি নিজেই জেলের ভাত খাওয়াতাম।মেঘনোলিয়ার মৃত্যুর দিনের ওই ভিডিওর মানুষটিকে চিনতে ভুল হয়নি রজনীগন্ধা।সেদিন ক্যাফেটেরিয়াতে আপনার মামাকে দেখে শিওর হলাম আমি।শ্রীজার মরার আগে ওই চিঠি!
শায়িখ ছাড়া কেউ তো জানতো না আমি কোথায় আছি।”

বিগলিত হাসে সারহান।একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে আবার বললো—

“তিথির মৃত্যুর পরই আমার সন্দেহ শুরু হয়।তাইতো ইহতিশামকে কেসটা হ্যান্ডওভার করতে বলেছি স্যারকে।”

জান্নাহ্ ধরা গলায় বললো—

“তিশাম ভাইয়া জানে আমি খুন করেছি?

“হুম।”

“আমার ফাঁসি হবে তাই না সারহান?

ঝরঝর করে কাঁদতে থাকে জান্নাহ্।সারহান নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জান্নাহ্ এর ক্রন্দনরত মুখের দিকে।
দম্ভ করে বললো–

“আপনি ভাবলেন কী করে আপনার কোনো ক্ষতি হতে দিবো আমি!আপনার কাছে কাউকে পৌঁছাতে দিবো না আমি।”

সারহানেকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে জান্নাহ্।তার দেহ ধীরে ধীরে ছেড়ে দিচ্ছে।জান্নাহ্ গলিয়ে পড়ছে সারহানের দেহের সাথে।জান্নাহ্ ছড়ানো চুলগুলো আলতো হাত একপাশ করে সারহান।ফিকে গলায় বললো—

“আপনার বাবা মায়ের ছবি আমি পত্রিকায় দেখেছি।চিন্তে কষ্ট হয়নি আমার।কী করে হলো এইসব?

জান্নাহ্ নির্দ্বিধায় সবটা বলে।আর হু হু করে কেঁদে উঠে।

“কাঁদবেন না রজনীগন্ধা।এতে আপনার কোনো দোষ নেই।অতীত ভুলে যান।আমি যা বলেছি তা নিয়ে ভাবুন।আমরা নতুন করে শুরু করবো।”

জান্নাহ্ সারহানের বুক থেকে মাথা উঠিয়ে ভ্যালভ্যাল চোখে তাকায়।ফ্যাকাশে সুরে বললো—

“আপনি কী করে জানলেন আমি রাফাতের বাসায়?

“মামার কাছ থেকে।”

সারহান আলগোছে জান্নাহ্কে কোলে তুলে নেয়।বিছানায় শুইয়ে ললাটে আলতো চুমু খায়।

“ঘুমান রজনীগন্ধা।ভুলে যান বিষাক্ত অতীত।আমি থাকতে আপনার কোনো ভয় নেই।জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আমি আপনার সাথেই থাকবো।”

“চলবে,,,

(বিঃদ্রঃ
আজ অনেক বড় পর্ব দিছি।মাথায় রাখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here