জান্নাহ্ “পর্বঃ৬২

0
3013

#জান্নাহ্
#পর্বঃ৬২
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

সকালের এক পশলা হলদে নরম রোদ এসে ঝলমলিয়ে দেয় রান্নাঘরের কাঁচের ক্যাবিনেট।সারা রাতের বৃষ্টিতে প্রকৃতি যেনো তার প্রাণ ফিরে পেয়েছে।বাংলোর পেছনের দিকটার নরম মাটি যেনো আরো নরম হয়ে ধরণীকে জানান দিচ্ছে তার কোমলতা।রান্নাঘরের পাশ ঘেঁষে হুংকার দিয়ে উঠা কদম গাছটার পাতায় রোদের আলোয় পড়ায় তা ঝিকমিক করছে।

চুলার উবলানো চায়ের জন্য দেওয়া পানিতে চাপাতা দিয়ে হালকা নেড়ে চুলার আঁচ কমিয়ে দেয় জান্নাহ্।রান্নাঘরের জানালা দিয়ে আসা সতেজ স্নিগ্ধ বাতাসে কেঁপে উঠে সে।সদ্যস্নান করে বেরিয়েছে জান্নাহ্।তার কোমর পর্যন্ত ছড়ানো রেশম চুল দিয়ে পানি পড়ছে।রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে ছোট ছোট পায়ে বেডরুমে আসে জান্নাহ্।সারহান অঘোরে ঘুমোচ্ছে।ঘড়ির কাটায় তখন সকাল আট টা।উপুর হয়ে শুয়ে থাকা সারহান তার মুখ গুঁজে রেখেছে বালিশের মধ্যে।জান্নাহ্ স্থবির হয়ে দাঁড়াতেই লজ্জা ভর করে তার দু’চোখের পাতায়।সারহানের ফর্সা পিঠের বিভিন্ন জায়গায় নখের আঁচড় স্পষ্টত।অপ্রস্তুত হয় জান্নাহ্।ছিঃ!কী বিদঘুটে ব্যাপার!
জান্নাহ লজ্জামিশ্রিত বিব্রত হাসে।আলতো পায়ে সারহানের পাশে এসে বসে।তার পিঠের সেই আঁচড়ে সন্তর্পনে হাত ছোঁয়ায়।
চুলের ভেতর আঙুল নেড়ে সারহানের মাথায় অস্পষ্ট চুমু খায়।জান্নাহ্ এর হাতের শীতল স্পর্শে জাগ্রত হয় সারহান।জান্নাহ্ এর দিকে ফিরেই মোহবিষ্ট হাসে।জান্নাহ্ এর চোখ দুটো আটকে যায় সারহানের গলা আর বুকে।আস্ত দাঁতের কামড়ের দাগ জ্বলজ্বল করছে।সারহান স্মিত হেসে বিমুগ্ধ গলায় বললো—

“এতো সকালে উঠলেন যে?

জান্নাহ্ খেয়ালিপনায় তার হাত ছুঁইয়ে দেয় সারহানের বুকে।অনুযোগের সুর তুলে বললো—

“সরি।”

সারহান ফিচেল হেসে চাপা গলায় দুষ্টুমি নিয়ে বললো–

“আজকাল আপনি এতো ওয়াইল্ড হয়ে যান কেন!

জান্নাহ্ মুহুর্তেই ঠোঁট চিপে রাগ দেখিয়ে বললো—

“আর আপনি!

সারহান টুপ করে জান্নাহ্ এর নিচের ঠোঁটে ছোট কামড় বসিয়ে বললো—-

“আমি তো জন্ম থেকেই ওয়াইল্ড।যান,আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”

জান্নাহ্ দ্রুততার সাথে বললো—

“জলদি আসুন।নাস্তা ঠান্ডা হয়ে যাবে।”

“ওকে,ওকে ডিয়ার বিউটি কুইন।আসছি।”
,
,
,
চায়ের কাপে চুমুক দিতেই জান্নাহ্ বলে উঠে—-

“আজ কোথায় নিয়ে যাবেন?

সারহান আলগোছে চায়ের কাপ টেবিলে রেখে চিবুক তুলে সহজ গলায় বললো—

“কোথায় যাবেন?

জান্নাহ্ ঝট করেই চিন্তাহীনভাবে বললো—

“মেঘনা নদী।”

ফস্ করেই হেসে ফেলে সারহান।কিঞ্চিৎ জিঙ্গাসু গলায় বললো—-

“বাড়ির কাছে নদী থাকতে আপনি এতোদূর নদী দেখতে যাবেন!

জান্নাহ্ বিজ্ঞের মতো বললো—

“এইটা কৃত্রিম খাল।নট নদী।”

“বুঝলাম।কিন্তু আপনার পছন্দ এতো আজব কেন?

জান্নাহ্ সংক্ষিপ্ত সুরে বললো—

“জানি না।”

সারহান চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে।হেয়ালি গলায় বললো—-

“আপনার পছন্দ এতো আজব বলেই আপনি আমাকে চুজ করলেন।নাহলে এতো ভালো ভালো অপশন ছেড়ে আদৌ কী আমার কাছে আসতেন!

জান্নাহ্ উসখুস গলায় বললো—-

“এইসব কেন বলছেন?

সারহান অধর কোণে হেসে নির্বিঘ্নচিত্তে বললো—

“আপনার মা থাকলে এমনটা হতো না।সে অবশ্যই আপনাকে ওয়েল বিহেবড,হাই সোসাইটির কারো সাথেই আপনার বিয়ে দিতো।আমারে কপালে তখন আপনি থাকতেন না।আপনার মা নিশ্চয়ই আপনার চেয়ে বারো তেরো বছরের বড় কোনো ছেলের সাথে আপনার বিয়ে দিতো না।বাট আফসোস!শাশুড়ির অকাল প্রয়াণ আমার ভাগ্য খুলে দিলো।”

জান্নাহ্ কটমটে গলায় বললো—

“কী সমস্যা আপনার!আফসোস হচ্ছে আমাকে বিয়ে করে?

সারহান লম্বা শ্বাস ফেলে বললো—

“আপনার অবশ্যই হচ্ছে।রাফাত হাত ছাড়া হয়ে গেলো।”

দারাজ গলায় বলে উঠে জান্নাহ—-

“সারহান!

সারহান স্বাভাবিক গলায় বললো—

“আপনার বেস্ট ফ্রেন্ড কে আমার সহ্য হয় না।”

“রাফাত এমন কিছুই করেনি।”

সারহান গম্ভীর গলায় বললো—-

“আপনার কী মনে হয় ও এমন কিছু করবে তার অপেক্ষায় আমি বসে থাকবো!

জান্নাহ্ শক্ত গলায় বললো—

“আপনি একটু বেশিই ভাবছেন।”

“ওকে,যাচ্ছি আমি।”

জান্নাহ্ তড়িৎ বেগে বললো—

“কোথায় যাচ্ছেন আপনি?আমাকে সাথে নিবেন না?

“নাহ।কাজ আছে আমার।পরে নিয়ে যাবো।”

সারহান আর কথা বাড়ালো না।ব্যস্ত পা দুটো সামনে বাড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো।দরজায় লাগিয়ে গেলো লক।ছোট্ট শ্বাস ফেললো জান্নাহ্।সারহান যতক্ষন বাইরে থাকে তাকে এই ঘরেই বন্দি হয়ে থাকতে হয়।বাড়ির বাইরে সেন্সর লাগানো।যাতে করে দরজার সামনের যে কারো উপস্থিতি সবার আগে সারহান তার ডিভাইসের মাধ্যমে টের পায়।

জান্নাহ্ তার বেডরুমের বহিরাংশের বারান্দার ক্যাচিগেট খুলে বাগানে আসে।নরম ঘাসের উপর পা ফেলে একটু একটু করে এগিয়ে আসে বাংলোর কার্নিশ ঘেঁষে সদর দরজার দিকে।এইখান থেকে সরাসরিভাবে যাওয়া যায় বাংলোর সদর দরজায়।কিন্তু এখন তা সম্ভব নয়।সারহান বাংলোর বাইরের সাথে লাগিয়ে সদর দরজার দেয়ালের সাথে নতুন দেয়াল তুলে দিয়েছে।যাতে করে বাংলোর বাইরে যাওয়ার একটাই পথ।আর তা হলো বাংলোর ভেতর দিয়ে জান্নাহ্দের বেডরুম হয়ে।

উঁচু দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে চোখ ভরা হতাশা নিয়ে স্থির হয়ে থাকে জান্নাহ্।তার এমন কেন মনে হয় তার জীবনটাও তার বাবা মায়ের মতো হবে!জান্নাহ্ এর মনে পড়ে তার মায়ের কথা।জান্নাহ্ এর মা যখন অন্তঃসত্ত্বা তখন তার বাবাও তার মাকে ঘরবন্দি করে রেখেছিলো।মৃণালিনী ড্রাগ অ্যাডিক্ট ছিলো,ছিলো বেসামাল,বেপরোয়া।তাই নিজ সন্তানের নিরাপত্তার জন্য জাফিন বাধ্য হয়েছে এমনটা করতে।কিন্তু জান্নাহ্ তা নয়।সে তার নিজের চাইতে তার প্রাণকে বেশি ভালোবাসে।ঠিক তেমনভাবে তার সন্তানকেও।সে চায় তার আর তার প্রাণের ভালোবাসার অংশ তাদের কোল জুড়ে আসুক।সে বাঁচতে চায় হাজার বছর তার প্রাণের সাথে এই পৃথিবীতে।কিন্তু জান্নাহ্ এর ভয় হয়।তার মনে হয় তার জীবনটাও তার বাবা মায়ের মতো হবে।এমনটাই তো হয়ে চলছে।তার আর তার প্রাণের সম্পর্কটাও দিনদিন অতীত নাড়িয়ে দিচ্ছে।জান্নাহ্ এর অক্ষিযুগল থৈ থৈ করে উঠে।সে চায় না এমনটা হোক।সে ভুল করেও ভাবতে চায় না তার প্রাণকে আঘাত করার কথা।

ভেজা কর্দমাক্ত ঘাসের উপর নগ্ন পা আওড়াচ্ছে জান্নাহ্। বাতাসে এখনো শীতলতার ভর।তরতর করে তা বইছে।জান্নাহ্ এর ভেজা চুল উড়ে এসে অগোছালো হয়ে পড়ে তার মুখের উপর।ব্যস্ত হাতে তা সরাতেই জান্নাহ্ দেখতে পায় তার বাবা,মা দাঁড়িয়ে আছে।মুহুর্তেই হীম হয়ে আসে জান্নাহ্ এর শরীর।তার ভেজা পা আচমকায় উষ্ণতায় তলিয়ে যায়।জান্নাহ্ ভরা দৃষ্টিতে তার মা,বাবাকে দেখে।তারা অনিমেষ চেয়ে আছে জান্নাহ্ এর দিকে।তাদের অধরে নির্লিপ্ত হাসি।।জান্নাহ্ এর ভয় হয়
।তার শরীর ঝাড়া দিয়ে উঠে।জান্নাহ্ ধীরে ধীরে তার চোখের প্রগাঢ়তা বাড়ায়।সে ভুল দেখছে নাতো!

জান্নাহ্ এর ঘনঘন শ্বাস পড়তে থাকে।জান্নাহ্ এর মনে পড়ে সেই ভয়ংকর রাত।তার রক্তাক্ত মা,বাবা।রক্তে লেপ্টে থাকা নিজের শরীর।কেঁপে উঠে জান্নাহ্।জান্নাহ্ এর মনে হলো তার মা পৈচাশিক সুখে হাসছেন।তিনি যা চাননি তাই ই ঘটেছে।জান্নাহ্ তার মাকে ঘৃণা করতো শুধু তার বাবার সাথে তার মায়ের সুসম্পর্ক ছিলো না বলে।কিন্তু মৃণালিনী ভালোবাসতেন তার মেয়েকে।জান্নাহ্ এর বুক ভেঙে কান্না আসে।তার এই অবস্থা হয়তো তার মায়ের অভিশাপ।স্বশব্দে কেঁদে উঠে জান্নাহ্।তার হাত,পা বিবশ হয়ে আসে।চোখ দিয়ে ছলকে উঠে শান্ত,শীতল জলের প্রস্রবণ।ধপ করে নিচে বসে পড়ে জান্নাহ্।এই পৃথিবীতে কেউ নেই তার।কেউ না।তার ভুল শুধরানোর কেউ ছিলো না।যদি থাকতো তাহলে সে এই ভুল কখনো করতো না।কখনো না।সমানতালে কাঁদতে থাকে জান্নাহ্।ভেজা মাটিতে তার শরীরের নিচের অংশ মেখে যায়।তার চুলের আগা দোল খেলতে থাকে কাঁদাজলে।ঘোলা চোখে অস্পষ্ট দেখতে পায় জান্নাহ্ তার বেস্ট বাবাকে। একটু একটু করে এগিয়ে আসছে তার কাছে।হাঁটু গেড়ে বসে জাফিন।জান্নাহ্ এর চোখেরনীরে ভেজা মুখটা মুছে দিয়ে কোমল গলায় বললেন—

“ইউ আর মাই ব্রেভ গার্ল,মাই ডল।ডোন্ট লুজ হোপ।আই এম অলওয়েজ উইথ ইউ মাই ডল।ডোন্ট ক্রাই।”

জান্নাহ্ কেঁদে কেঁদে বললো—-

“আই এম সরি,আই এম সরি বাবা।আই ওয়াজ রং।হি ওয়াজ নট লাইক ইউ।বাট আই লাভ হিম।আই লাভ হিম ভেরি মাচ।”

জাফিন মেয়ের কপালে উষ্ণ চুম্বন করলেন।নির্মল গলায় বললেন—

“ভুল থেকেই তো মানুষ শেখে ডল।আমি চাইবো তুমি আর কখনো এই ভুল করবে না।”

জান্নাহ্ ফুঁপিয়ে উঠে বললো—

“মাম্মা,আমাকে ক্ষমা করবে বাবা?আমি যে ভুল করে ফেলেছি।তুমি আমাকে কেন ছেড়ে গেলে বাবা?তুমি থাকলে আমি এতোবড় ভুল কখনো করতাম না।এতোটা অন্ধ হতাম না সারহানের ভালোবাসায়।তুমি থাকলে আমি মানুষ চিনতে ভুল করতাম না।”

জান্নাহ্ উদ্ভ্রান্তের মতো কাঁদতে থাকে।জাফিন সন্তর্পনে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন—

“ভাগ্য তো নির্ধারিত ডল।তাতে আমাদের কারো হাত নেই।আল্লাহ্ এর লিখিত সংবিধান তো কেউ বদলাতে পারে না।তুমিও না,আমিও না।”

“এখন আমি কী করবো বাবা?

“ধৈর্য্য ধরো।ধৈর্যের ফল সুমিষ্ট হয়।”

“আর আমার পাপ?আমি যে পাপ করেছি।তার কী হবে বাবা!আমার সন্তান যে আমার পাপের সাজা পেলো।”

জাফিন আলতো হাতে মেয়ের মাথাটা বুকের সাথে স্পর্শ করালেন পরম মমতায়।জড়িয়ে নিলেন অতলান্তিক মায়ায়।চকিতে জান্নাহ্ অনুভব করলো সেই মমতার হাত ধীরে ধীরে লীন হয়ে যাচ্ছে।জান্নাহ্ অধৈর্য হয়ে মাথা তুলে।জাফিন ক্রমশ প্রলীন হচ্ছে শীতল,শান্ত,স্বচ্ছ বাতাসে।জান্নাহ্ শশব্যস্ত হয়ে তার বাবাকে আটকানোর প্রচেষ্টা চালায়।কিন্তু তা সম্ভব হয়নি।জাফিন মিলিয়ে যায় বাতাসে।অস্পষ্ট,অদৃশ্য,অস্পর্শনীয় সত্তায় পরিণত হয়।দিকভ্রান্তের মতো এদিক ওদিক তাকাতে থাকে জান্নাহ্।ক্ষণে ক্ষণে মৃত্যুসম ভয় আড়ষ্ট করতে থাকে তাকে।জান্নাহ্ এর শরীর ক্রমাগত তার ভার হারাতে থাকে।চোখের পাল্লা দুটো বন্ধ হতে থাকে ক্ষীন গতিতে।নিশ্চেতন হওয়ার আগ পর্যন্ত জান্নাহ্ দেখতে পায় তার মা দু’হাত বাড়িয়ে রেখেছে তার দিকে।ঢুলে পড়ে জান্নাহ্ সেই বৃষ্টি ভেজা নরম ভূমি গর্ভে।
,
,
,
রৌদ্র ঝলমলে দিন।তেজী সূর্য ক্রমশ তার পূর্বের রূপে ফিরে যাচ্ছে।ভেজা রাস্তার স্যাঁতসেঁতে আবরণ শুকিয়ে সেখানে জায়গা করে নিচ্ছে প্রভাকরের তপ্ত লাভা।

এসির নিচে বসেও স্বস্তি মিলছে না রাফাতের।তার মন,মস্তিষ্ক দুটোই ঘোড়দৌঁড়ের মতো ছুটছে।ক্লান্ত,শ্রান্ত।তার সমান্তলার কপালে চিন্তার ভাঁজ।মুখ জুড়ে এলোমেলো অঙ্গভঙ্গি।চোখে অগ্নিলাভা।ব্যতিব্যস্ত হাতের নাড়াচাড়া।ইহতিশাম পূর্ণ দৃষ্টি ক্ষেপণ করলো।হালকা গলায় উৎসুক হয়ে বললো—

“এনি থিংক রং?

অধর ছড়িয়ে শ্বাস নিলো রাফাত।কপালের ঘামটা মুছে সোজা চেয়ে রইলো ইহতিশামের দিকে।মস্তিষ্কের জাগ্রত চিন্তাগুলো ক্রমশ তরতর করে সারা মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো।নিদারুন যন্ত্রণায় বিষিয়ে উঠলো রাফাত।এই যন্ত্রণার শেষ হওয়া প্রয়োজন।মুখ খুললো রাফাত।স্বশব্দে বললো—

“জান্নাহ্ এর খোঁজ জানো?

ইহতিশাম অবাক হলো না।কিন্তু গাঢ় গলায় বললো—

“তুমি ঠিক আছো তো রাফাত?

রাফাত ঘনঘন কয়েকটা শ্বাস ফেলে বললো—

“হুম।আমি ঠিক আছি।”

রাফাতের অস্থিরতা চোখ এড়ালো না ইহতিশামের।পানিভর্তি গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে নম্র গলায় বললো–

“পানিটা নাও।”

গলায় প্রস্ফুরণ হচ্ছে রাফাতের।পানিটা পান করে একটু ধাতস্থ হয়ে বুক ভরে লম্বা শ্বাস নেয় রাফাত।কিছুক্ষন সময় নিয়ে বললো—-

“আমি কাল রাতেও এসেছিলাম তোমার কাছে।কিন্তু তুমি ক্যাবিনে ছিলে না।তোমার অ্যাসিস্টেন্ট বললো বাসায় চলে গেছো।”

ইহতিশাম মৃদু হাসলো।সরস গলায় বললো—-

“তুমি ঠিক নেই রাফাত।শান্ত হও।”

রাফাত বিচলিত গলায় বললো—

“তুমি প্লিজ আমাকে জান্নাহ্ এর ঠিকানাটা বলো।গত একমাস ধরে ওর সাথে আমি যোগাযোগ করতে পারছি না।ওর নাম্বারও বন্ধ।আমি সারহানের ফ্ল্যাটেও গিয়েছি।কোথাও নেই ওরা।তুমি প্লিজ বলবে কোথায় আছে জান্নাহ্।ও ঠিক আছে তো?

ইহতিশাম দুর্বোধ্য হাসলো।রাফাতের দিকে ঝুঁকে আস্ত নজরে তাকে পর্যবেক্ষণ করে সরব গলায় বললো—–

“জান্নাহ্ ভালো আছে।কারণ সারহান ভালো আছে।”

ফুঁসলে উঠে রাফাতের সুপ্ত রাগ।উচ্চকিত গলায় বললো—

” তুমি কেন বুঝতে পারছো না!জান্নাহ্ সারহানের সাথে সেফ নয়।মেয়েটা এইটুকু বয়সেই কতবড় ভুল করে ফেলেছে।না জানি সামনে আরো কত বড় ভুল করে বসে!সারহান যোগ্য নয় আমার জান্নাহ্ এর।”

লম্বা দম নেয় কথা শেষ করে রাফাত।আশ্চর্যচকিত ইহতিশাম।মুহূর্তেই এতোটা এগ্রেসিভ হয়ে গেলো রাফাত।আমার দুম করে নিভেও গেলো।ইহতিশাম ছোট্ট দম ফেলে অনুরক্তির সুরে বললো—

“সারহান জান্নাহ্কে ভালোবাসে রাফাত।ডোন্ট ওয়ারি।ও ভালো থাকবে।”

পৈচাশিক হাসে রাফাত।চোখে তাচ্ছল্য নিয়ে উপহাস করে বললো—

“ভালোবাসে!যে পুরুষ নিজের স্ত্রী থাকতেও পরকীয়ায় লিপ্ত থাকে সে কখনো কাউকে ভালোবাসতে পারে না।”

ইহতিশাম দীর্ঘশ্বাস ফেললো।নমনীয় গলায় বললো—

“তুমি ভুল ভাবছো রাফাত।সবাইকে দ্বিতীয় সুযোগ দেওয়া উচিত যদি মন থেকে সে অনুতপ্ত হয়।আর সারহানের আলবৎ পাওয়া উচিত।ওর এই জীবনের জন্য ও একা দায়ী নয়।”

“বাট ইহতিশাম…।”

“আমাকে বলতে দাও।আমি মানছি সারহান ভুল করেছে।ভুলের শাস্তিও সে পেয়েছে।এখন সে নতুন করে জান্নাহ্কে নিয়ে বাঁচতে চায়।আমি ওকে সেই সুযোগ দিয়েছি।জান্নাহ্ নিজে সেই সুযোগ দিয়েছে সারহানকে।”

রাফাত উদ্বেলিত গলায় বললো—

“কারণ জান্নাহ্ এখনো অবুঝ।ও বুঝতেই পারছে না কী হচ্ছে ওর সাথে।ছোটবেলা থেকে চিনি ওকে আমি।কাউকে কিছু বলে না।নিরবে সব সহ্য করে নেয়।ওর ভেতরের চাপা কষ্ট বোঝার কেউ নেই।সারহানও নয়।”

তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে ইহতিশাম।তার পুরু ভ্রু জোড়া কুঁচকে আসে।নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরে চোয়াল শক্ত করে।উষ্ণ গলায় বললো—

“আমি মানছি তোমার কথা।কিন্তু সারহান সত্যিই জান্নাহ্কে ভালোবাসে।”

খলবলিয়ে উঠে রাফাত।বললো—

“তাহলে গায়েব কেন হয়ে গেলো ও?কোথায় সে?আমি একবার জান্নাহ্ এর সাথে কথা বলতে চাই।আমার জান্নাহ্কে ধীরে ধীরে শেষ করে দিচ্ছে সারহান।আই ডোন্ট বিলিভ হিম।একটা বাস্ট…।”

ইহতিশাম অসহিষ্ণু গলায় বলে উঠে—

“মাইন্ড ইউর ল্যাংগুয়েজ।তোমার রাগের কারণে তুমি এ ধরনের ধারণা পোষণ করতে পারো না সারহান সম্পর্কে।”

“ওকে।তাহলে বললো কোথায় আছে সে?

ইহতিশাম স্বাভাবিক গলায় বললো–

“আমি জানি না।শায়িখের সাথে কথা বলেও লাভ হয়নি।ও বলেছে ও জানে না।আর আমার মনে হয় ও জানলেও বলবে না।”

রাফাত চোখের পাতা প্রশ্বস্ত করে উদ্বিগ্ন গলায় বললো—

“তাহলে কোথায় পাবো আমি জান্নাহ্কে?

“অপেক্ষা।”

রাফাতের চোখের চাহনি গাঢ় হতে লাগলো।তার কেন মনে হলো ইহতিশাম কিছু লুকোচ্ছে।কী লুকোচ্ছে?

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here