#জান্নাহ্
#পর্বঃ৬৬
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
নদীর ধার ঘেঁষে জেগে আছে বুনো ঘাস।তাতে সগৌরবে মাথা উচু করে আছে নানা রঙের ঘাসফুল।কারো রঙ লাল তো কারো সাদা।নদীর পাড়ের ফিনফিনে বাতাসে বুনোফুলের মিষ্টি গন্ধ এসে ঠেকছে নাকে।তার সাথেই দুলছে দূর্বা ঘাস।তাতেও আলাদা মোহনীয়তা।ফুলবিহীন সরু,লম্বা পাতার দূর্বা ঘাস কাটা ঘায়ের রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে।তা ছিলো আমাদের আদিকালের চিকিৎসার প্রাথমিক পদ্ধতির পরিচিত অংশ।
সারহানের কাঁধে মাথা হেলান দিয়ে পা দুটো হালকা সোজা করে বসে আছে জান্নাহ্।ফুরফুরে বাতাসে জান্নাহ্ এর বেনুনী করা চুলের সামনের দিকের ছোট ছোট কেশ উড়ছে।বাতাসের বেগ বাড়তেই তাতে ফরফর করে আওয়াজ হয়।তীব্র,মৃদু শীতল বাতাসের ছোঁয়া রন্ধ্রে রন্ধ্রে লাগতেই সারহানের হাত চেপে ধরে জান্নাহ্।সারহান গভীর দৃষ্টিতে তাকায়।তার ঝাঁকড়া চুলগুলো চোখের সামনে এসে পড়তেই চোখ ঢেকে যায়।জান্নাহ্ ফিক করে হেসে ফেলে।সারহানের নাকের ডগা ধরে টান মারে জান্নাহ্।স্মিত হাসে সারহান।নির্বিঘ্ন গলায় বললো—
“আপনার ভালো লাগা এতো আজব কেন?
জান্নাহ্ ভ্রু ক্রুটি করে বললো—
“আজব মানে?
সারহান সরস গলায় বললো—
“এই যে নদী!
জান্নাহ্ স্মিত হাসে।নরম গলায় বললো—
“সব ভালো লাগার কারণ থাকে না।কিছু ভালো লাগা চোখের প্রশান্তি,কিছু ভালো লাগা হৃদয়ের অনুরক্তি।নদী আমার চোখের প্রশান্তি আর..।”
এইটুকু বলেই জান্নাহ্ থামে।গাঢ় চোখে তাকিয়ে আগ্রহী গলায় সারহান বললো—
“আর হৃদয়ের অনুরক্তি?
জান্নাহ্ বদ্ধ ঠোঁটে হেসে বললো—
“আমার পরীর বাবা।”
সারহান বিমোহিত চোখে তাকিয়ে রয়।গ্রীষ্মকালে র খরতাপে নদীর পানি নেমে গেছে পাড় থেকে অনেকটা নিচে।তবুও মাঝিমাল্লারা বসে নেই।জীবনধারনের অন্যতম উপায় মাছ বিক্রি যাদের হাতিয়ার তারা কী বসে থাকতে পারে?
নদীর বুকে তাকিয়ে জান্নাহ্ জিঙ্গাসু গলায় বলে উঠে—
“আপনি আমাকে আটকে কেন রেখেছেন সারহান?
সারহান ভাবলেশহীন প্রত্যুক্তি করলো—
“আপনার এমন কেন মনে হলো?
“তাহলে আপনি বলেন নি কেন তিশাম ভাইয়া আপুকে বিয়ে করেছে।আমি মামার কাছ থেকে জানলাম।”
সারহান নিজেকে যতটা সম্ভব সংযত রেখে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া করলো—
“আপনি যেতে চাইবেন তাই।”
“কেন?গেলে কী সমস্যা?
সারহান নির্লিপ্ত গলায় বললো—
“কোনো সমস্যা নেই।পরী আসুক।আপনি যেখানে যেতে চাইবেন সেখানে নিয়ে যাবো।”
জান্নাহ্ অভিমানি গলায় জোর দিয়ে বললো—
“তাই বলে আমাকে আটকে রাখবেন!
সারহান ফিচেল হেসে নিজের মুখটা জান্নাহ্ এর মুখের কাছে নিয়ে আসে।চাপা সুরে দম্ভ নিয়ে বললো—
“জানেন তো,এভরিথিংক ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়ার।”
জান্নাহ্ এর চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে।খুশি খুশি গলায় জানার আগ্রহ নিয়ে বললো—
“আপনি আমাকে ভালোবাসেন সারহান?
নদীর পাড়ে স্নিগ্ধ বাতাসে গা জুড়িয়ে আসে।ছোট্ট একটা দম ফেলে ঘাস বিছানো মাটিতে গা এলিয়ে দেয় সারহান।মাথার নিচে ডান হাত দিয়ে মুক্ত আকাশে তাকায়।নীলাভ ঝলমলে আকাশে উড়ছে শুভ্র মেঘ।সেদিকে আস্ত নজর রেখে সারহান বললো–
“আপনার কী মনে হয়?
জান্নাহ্ একটু সময় নিলো।ঘুরে বসে সারহানের বুকের উপর মাথা রেখে শুয়ে পড়ে।নীলাভ শুভ্র আকাশে উড়ে যাচ্ছে একটা বাজপাখি।জান্নাহ্ সারহানের বা’হাত আলগোছে তার স্ফীত উদরের উপর রাখে। গম্ভীর গলায় বললো—
“তাহলে বললেন না কেন?
“সব কথা ব্যক্ত করার প্রয়োজন পড়ে না।কিছু কথা বুঝে নিতে হয়।”
“যদি সামনের ব্যক্তি না বুঝে?
“তাহলে বুঝতে হবে সে আপনাকে কখনো ভালোবাসে নি।ভালোবাসা একটা সুপ্ত অনুভূতি।তা মুখ নিঃসৃত শব্দে প্রকাশ করার প্রয়োজন পড়ে না।যদি কেউ কাউকে ভালোবাসে তাহলে সামনের ব্যক্তি অবশ্যই তা অনুভব করবে।যদি তা করতে ব্যর্থ হয় তাহলে বুঝতে হবে সামনের ব্যক্তির হৃদয়ে সেই অনুভূতি হয়নি যা আপনার হয়েছে।কারো প্রতি ঘৃণা থাকলে তা প্রকাশের প্রয়োজন হয়,কিন্তু ভালোবাসা প্রকাশের প্রয়োজন হয় না।তা আপনাআপনি প্রকাশ্য।”
মুচকি হাসে জান্নাহ্।মৃদু গলায় বললো—
“একবার আমি আর বাবা রাফাতের নানু বাড়ি গিয়েছিলাম।তখন শীতকাল ছিলো।নদীর মাছ যাওয়ার একটু উষ্ণতা পেতে পানির উপরিভাগে চলে আসে।আমি দেখতে দেখতে কখন যে নৌকার পাটাতনের সাথে জুতোর হিল বেঁধে গেছে খেয়ালই করি নি।পড়তে পড়তে বাচলাম।রাফাত না থাকলে তো ওই মাছগুলো আমাকে খেয়েই নিতো।”
আওয়াজ করে হেসে উঠে সারহান।মাথাটা হালকা বাকিয়ে জান্নাহ্ রাগ দেখিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বললো—
“হাসছেন কেন?
সারহান বেশ কিছুক্ষন হাসে।হাসি থামিয়ে ঠোঁট চিপে বললো–
“মাছ আপনাকে খেয়ে নিতো!হাউ ফানি!
খেমটি মেরে বললো জান্নাহ্—
“হা তো?
“মাছের হজম ক্রিয়ায় সমস্যা হতো আপনাকে খেয়ে ফেললে!
সারহান আবারো বাতাস কাঁপিয়ে হাসে।উঠে বসে জান্নাহ্।ঝামটা মেরে বললো–
“হাসি বন্ধ করুন।”
হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে সারহান।অনেক চেষ্টায় হাসি বন্ধ করে বললো—
“মাছ আপনাকে খেয়ে নিতো!এতো সাহস!আপনার বেস্ট ফ্রেন্ড থাকতে আপনাকে খেয়ে নিতো!হাউ পসিবল রজনীগন্ধা!
জান্নাহ্ নিষ্প্রভ গলায় অভিমানি মনোভাব নিয়ে বললো—
“এই জন্য হাসছেন!
রাফাত ছিলো বলে?
সারহান বেখেয়ালি গলায় বললো–
“তেমন কিছু নয় রজনীগন্ধা।”
জান্নাহ্ অসহায় গলায় বললো—
“আপনি আমাকে বিয়ে করে সুখী নন সারহান?
সারহান হৃদয় ভেজা হাসি হেসে বললো—
“সুখ সাগরে ডুবে যাচ্ছি আমি।উদ্ধার করুন আমায়।”
সলজ্জ হাসে জান্নাহ্।সারহানের হাতের দিকে তাকাতেই চোখের পল্লব নাচিয়ে বললো—
“আপনার হাতের আংটি কোথায়?
সারহান সহজ গলায় বললো—
“ফেলে দিয়েছি।”
আঁতকে উঠে জান্নাহ্ বললো—
“সারহান!ওইটা আমাদের এংগেজমেন্টের আংটি।”
সারহান হেয়ালি গলায় বললো—
“তো!আপনার মামা সোনার বদলে তামা দিয়েছে বোধহয়!
“মামা মোটেও এমন কাজ করেনি।”
সারহান কঠিন গলায় বললো—
“আমি বলিনি সে করেছে।বলেছি বোধহয়।”
জান্নাহ্ দুঃখী দুঃখী চোখে তাকাতেই শার্টের কলার ছড়িয়ে গলার চেইনটা বের করে আনে সারহান।তার হাতের আংটি গলায় ঝুলছে।জান্নাহ্ মিহি গলায় বললো–
“এইটা কেমন কথা!হাতের আংটি গলায় কেন?এমন কেউ করে?
“আমি তো কেউ নই রজনীগন্ধা।আমি সারহান।”
জান্নাহ্ মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় তাকিয়ে থাকে।সারহান জান্নাহ্ এর অধরের দিকে অনিমেষ চেয়ে একটু এগিয়ে আসতেই জান্নাহ্ পেছনের দিকে সরে ভ্রু নাচায়।ঠোঁট গুঁজ করে বললো—-
“অসভ্য লোক!
যেখানে সেখানে এইসব কী?
“ইটস কল্ড রোমান্স।”
“আপনার মাথা!খোলা আকাশের নিচে কীসের রোমান্স!
জান্নাহ্ এর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললো—-
“চোখের মায়ায়,ঠোঁটের ছোঁয়ায়
বেঁধেছি বুকের ক্রন্দন,
মরুর বুকে,তরুর ছায়ায়
জেগেছে প্রাণের স্পন্দন।”
জান্নাহ্ পরম আদরে সারহানের বুকে মাথা রাখে।নদীর পানির উপরে একটা সাদা বক উড়ে যাচ্ছে।সারহান তার অধর ঠেকায় জান্নাহ্ এর শিয়রে।হালকা হাতের বেড়ে বাঁধে তাকে।
সারহানের মোবাইলে ভাইব্রেট হতে থাকে।তা বের করে দেখতেই দেখে একটা আননো নাম্বার।সকালে হসপিটাল থেকে ফেরার পর থেকে একটা নাম্বার থেকে অনবরত ইনকামিং কল হচ্ছে।সারহান চিন্তিত।তার এই নাম্বার কতিপয় বিশেষ মানুষ ছাড়া কাউকে দেয় নি সে।
কল ডিসকানেক্ট করে ব্লক করে সারহান।
কল কাটতেই ক্ষুব্ধ হয় অর্নিশ।একান্ন বার কল করেছে সে।এখন ব্লক।অর্নিশের কপাল জুড়ে অদ্ভুত কিছু ঘটে যাওয়ার শঙ্কার ভাঁজ পড়ে।অর্নিশ চোয়াল শক্ত করে ফিরে তাকায়।তার মা শোয়েতা বেডে শুয়ে আছে।মিনমিনে গলায় বললো—
“কী হলো!
অর্নিশ তটস্থ হয়ে বললো–
“ওর হ্যাজবেন্ড কিছুতেই কল রিসিভ করছে না।”
ফোঁস করে দম ফেললো শোয়েতা।নমনীয় গলায় বললো—
“মেয়েটাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।কতদিন দেখি না।”
অর্নিশ কিছু বললো না।একজন নার্স কেবিনে ঢুকলো।হাতে ট্রে ভর্তি মেডিসিন।আধশোয়া করে উঠে বসায় শোয়েতাকে।ঔষধ খাইয়ে নার্স চলে যায়।শোয়েতা কপাল কুঁকড়ে বললেন–
“ওর হ্যাজবেন্ড কেমন?
অর্নিশ কন্ঠে গাঢ়তা টেনে বললো–
“জান্নাহ্ এর বিয়ে মৃণাল আন্টি দেয় নি মম।আন্টি থাকলে কখনই ওই ছেলের সাথে জান্নাহ্ এর বিয়ে দিতো না।”
শোয়েতা তীব্র হতাশা নিয়ে বললেন—
“হয়তো।তোকে রিফিউসজড তো এইজন্যই করেছিলো।তবে জান্নাহ্ এর ঋণ আমি শোধ করতে পারবো না।ও না থাকলে তোকে তো আমি হারিয়েই ফেলতাম।”
মায়ের কথায় তাল মিলিয়ে অর্নিশ বললো–
“হুম।কৃতার্থ ওর প্রতি আমি।কিন্তু ওর বিয়ে!
আমি মানতে পারছি না মম।জান্নাহ্ কী করে করতে পারে আমার সাথে এমনটা!
শোয়েতা ছেলের উচাটন বুঝতে পারলেন।তবে ভাগ্যের কাছে সব সম্ভব।
চলবে,,,
- (বিঃদ্রঃ
আজকের পর্বটা একটু ছোট।রাতে কিছু পোস্ট করার ইচ্ছে আছে।তবে তা আপনাদের এই পর্বের রেসপন্সের উপর।ধন্যবাদ)