#জান্নাহ্
#পর্বঃ৬৯
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
সকালে হলুদ রঙের মিষ্টি রোদ এসে ছুঁয়ে যায় জান্নাহ্ এর অক্ষিপল্লব।নিভুনিভু চোখে তাকাতেই এক ঝাঁক আলো এসে হানা দেয় জান্নাহ এর অক্ষিকোটরে।ঝট করে চোখ বন্ধ করে জান্নাহ্।জানালার কাছ থেকে সরে আসে সারহান।মিষ্টি হেসে জান্নাহ্ এর পাশে বসে সারহান।তার আঙুল জান্নাহ্ এর গলায় বেপরোয়া ছোঁয়াতেই তেড়ে উঠে জান্নাহ্।বিমোহিত কন্ঠে সারহান বললো—
“রাগ কমে নি রজনীগন্ধা?
জান্নাহ্ অস্পষ্ট কন্ঠে বললো—
“উঁহু।”
“তাহলে শাস্তি দিন।”
“কথা বলবেন না আমার সাথে।”
“তাহলে আমার প্রাণটা কেড়ে নিন।”
“সরুন এখান থেকে।”
ফিচেল হাসে সারহান।জান্নাহ্ এর কামিজের নিচে হাত দিয়ে তার নগ্ন কোমরে আঙুল ছোঁয়াতেই ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে জান্নাহ্।অসহায় গলায় বললো–
“সারহান!এমন করছেন কেন?
ঝলমলে হাসে সারহান।জান্নাহ্ এর গলায় ঠোঁট ছুঁইয়ে বললো—
“সরি,সরি,সরি,সরি,সরি,সরি,সরি…..।”
সারহান যতবার সরি বলছে ততবার ই জোর করেই জান্নাহ্ এর ঠোঁট,গলা,গালে চুমু আঁকতে থাকে।জান্নাহ্ বিরক্ত হয়।অতিষ্ঠ হয়ে বললো—-
“সরুন এখান থেকে।”
“তাহলে বলুন ক্ষমা করেছেন?
“হুম।”
টুপ করেই জান্নাহ্ এর বুকের উপরের সেই ক্ষত যায়গায় চুমু খেয়ে বসে সারহান।অনুযোগের সুরে বললো–
“সরি।”
জান্নাহ্ ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো—
“তখন মনে ছিলো না?
সারহান মর্মাহত গলায় বললো—
“উঁহু।ভালোবাসি নি তো।এখন ভালোবাসি।আকাশের চেয়েও বিশাল,সাগরের চেয়েও গভীর,বরফের চেয়েও শীতল,আগ্নেয়গিরির চেয়ে উতপ্ত।ঠিক তেমন করে ভালোবাসি।ভালোবাসি,ভালোবাসি,ভালোবাসি।”
মৃদু হাসে জান্নাহ।তার বুকে জমাট বাঁধা অভিমাণ সারহানের ভালোবাসার স্বীকারোক্তির উষ্ণতায় গলতে থাকে।
মৃদু গলায় জিঙ্গেস করে সারহান—-
“কী খাবেন?
জান্নাহ্ ঝট করেই বললো–
“আলুর পরোটা।”
সারহান হতভম্ব হয়ে বললো—
“কী!পাগল হয়েছেন?খালি পেটে তেল!
জান্নাহ্ অধরপল্লব এধার ওধার ঘুরিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বললো—
“খাবো,খাবো,খাবো।”
উজ্জ্বল হাসে সারহান।নিরস্ত্র সৈনিকের মতো আত্নসমর্পনিত হয় বললো—
“ওকে।আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন।আমি বানিয়ে দিচ্ছি।”
,
,
,
বিছানায় বসে কোলের উপর একটা বালিশ নিয়ে রেখেছে জান্নাহ্।তার উপর প্লেটের মধ্যে রাখা চার,পাঁচটা গরম গরম আলুর পরোটা।জান্নাহ্ আরামসে খেয়ে যাচ্ছে।তার দিকেই ডিভানে বসে অনিমেখ চেয়ে আছে সারহান।জান্নাহ্ সারহানের দিকে তাকিয়ে কপালের মাঝ বরাবর কুঞ্চি করে।চোখের কোণ ক্ষীণ করে বললো—
“এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?ওদিক তাকান।আমার আর পরীর পেট ব্যাথা করবে।”
স্মিত হাসে সারহান।ব্যস্ত গলায় শুধায়—
“দুপুরে কী খাবেন?
জান্নাহ্ একগাল হেসে উচ্ছ্বাস নিয়ে বললো—
“পিজ্জা।”
সারহানের পুরু ভ্রু জোড়া তড়িৎ বেগে কুকড়ে আসে।আচম্বিত হয়ে বললো—
“কী!
“সাথে আইসক্রীম আর ফ্রেন্স ফ্রাইও।ও কোল্ড ড্রিংসও।”
সারহান নাক ফুলিয়ে বললো—
“পাগল হয়েছেন!এইসব কী খাওয়ার কথা বলছেন!আর এতোকিছু!আগামী এক সপ্তাহ কী খাওয়া বন্ধ করে দিবেন নাকি?
জান্নাহ্ মেকি চোখ রাঙিয়ে বললো–
“আমি কী একা খাচ্ছি?বাবুও তো খাচ্ছে।”
তখনই বাইরে দরজার সেন্সর বেজে উঠে।সারহান ব্যগ্র হয়ে তার মোবাইল বের করে।জান্নাহ্ উৎসুক হয়ে বললো—
“কে?
তীর্যক হাসে সারহান।ফিচেল গলায় বললো—
“আমার পরীর মামা এসেছে।আপনার বেস্ট ফ্রেন্ড।দশটা না,পাঁচটা না একটা মাত্র শ্যালক আমার।আপনি বসুন আমি দেখা করে আসছি।”
দরজা খুলেই বিগলিত হাসে সারহান।স্মিত গলায় বললো–
“ভেতরে এসো রাফাত।”
রাফাতের চোখে মুখে জ্বলন্ত কয়লার আভা।কিন্তু তা টের পেলো না সারহান।রাফাতকে বসতে বলে নিজেও বসে।কিন্তু রাফাত বসলো না।সারহান পুনরায় বললো–
“প্লিজ সিট রাফাত।”
দমদমে গলায় বলে উঠে রাফাত—
“জান্নাহ্ কোথায়?
“ঘরেই আছে।”
“ডাকো ওকে।”
রাফাতের গলার অদ্ভুত স্বরে উঠে দাঁড়ায় সারহান।কৌতূহলী গলায় বললো—
“হোয়াটস রঙ রাফাত?
রাফাত দাঁত কিড়মিড় করে বললো—
“জান্নাহ্কে ডাকো অামি ওকে নিতে এসেছি।”
ফট করেই হেসে ফেলে সারহান।তাচ্ছিল্যের সাথে বললো—
“আর ইউ ক্র্যাজি?
রাফাতের সমস্ত রাগ উবলে উঠলো।বজ্রের মতো কন্ঠ কাঁপিয়ে বললো—
“তোমার মতো কোনো পুরুষের সাথে জান্নাহ্কে আমি এক মুহূর্তও থাকতে দিবো নাহ।”
সারহানের অক্ষিপল্লব কেঁপে উঠে।ভীত গলায় বললো—
“কী বলতে চাও তুমি?
“কী বলতে চাই তুমি জানো না।একটা নোংরা কীট তুমি।জঘন্য বিকৃত মস্তিষ্কের পুরুষ।যে নিজের স্ত্রী বোনকেও ছাড়ে না।”
সারহানের দম বন্ধ হয়ে আসছিলো যেনো।চোখের পাতা প্রশ্বস্ত করে তাকাতেই তার শরীরে কম্পন শুরু হয়।তবুও স্বাভাবিক অভিব্যক্তিতে বললো—
“গেট আউট।জাস্ট লিভ।”
পৈচাশিক হাসে রাফাত।দৃঢ় গলায় বললো—
“জান্নাহ্কে না নিয়ে আমি যাচ্ছি না।”
“তুমি ভাবলে কী করে তাকে আমি যেতে দিবো?
“তুমি না চাইলেও ওকে নিয়ে যাবো।জান্নাহ্ আর তার সন্তানের সংস্পর্শে আসতে দিবো না তোমাকে আমি।”
“ভুলে যেওনা ওই সন্তান আমার।”
রাফাত দাঁতখামটি মেরে বললো—
“কিসের সন্তান?তোমার মতো পুরুষ বাবা হওয়ার যোগ্যই না।অবশ্য তোমার থেকে এর বেশি আশা করা যায় না।কারণ ইউ আর আ ব্ল্যাডি বাস্টা*।”
তৎক্ষণাৎ রাফাতের গালে একটা কষে চড় পড়ে।হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে রাফাত।অশ্রুভরা নয়ন যুগলে ঘি জ্বালানো আগুন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জান্নাহ্।রুষ্ট গলায় বললো–
“তোমার সাহস কী করে হলো আমার সারহানকে এইসব বলার?বেরিয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে।”
রাফাতের তপ্ত রাগ যেনো ক্রমশ প্রলীন হতে লাগলো জান্নাহ্ এর মায়াবী মুখটা দেখে।মিইয়ে গলায় বললো–
“জান্নাহ্ তুমি জানো না সারহান…।”
রাফাতকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তার বুকে ধাক্কা মারে জান্নাহ্।ধরা গলায় রাগ নিয়ে বললো—
“কিছু শুনতে চাই না আমি।চলে যাও এখান থেকে। মরে গেছে তোমার রেড চেরি।আর কখনো আসবে না তুমি এখানে।গেট আউট।আই সে গেট আউট।”
রাফাত ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।তার বদ্ধদৃষ্টিতে ছলকে উঠে নোনতা জল।তা গড়িয়ে পড়তে লাগলো চোখের পল্লব বেয়ে।জান্নাহ্ দাঁত,মুখ খিঁচে তার ভারী শরীরটা সামলে নিয়ে রাফাতকে বের করে বাড়ি থেকে।লক করে দেয় দরজা।ততক্ষনে হুশ ফিরে রাফাতের।জান্নাহ্কে অনেক ডাকলেও তা তার কর্ণকুহর হলো না।দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জান্নাহ্।হাপাচ্ছে সে।সারহান দু’কদম সামনে আসতেই দাপিয়ে উঠে জান্নাহ্।
“ওখানেই দাঁড়ান।একদম আমার কাছে আসবেন না।”
সারহান বিচলিত গলায় বললো—
“রজনীগন্ধা,একবার আমার কথা শুনুন।”
“বলেছিনা এক পাও আগাবেন না।আপনার ওই নোংরা হাতে আমাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করবেন না।মরে যেতে ইচ্ছে করছে আমার।”
ঝমঝমিয়ে কাঁদে জান্নাহ্।সারহানের বুকের ভেতরটা ক্রমশ খালি হতে লাগলো।সব যেনো তপ্ত মরুভূমি।সারহান উদ্বেলিত গলায় বললো—
“প্লিজ রজনীগন্ধা।আমার কথাটা একবার শুনুন।”
“নাহ।কিছু শুনতে চাই না আমি।কেন করলেন আপনি এইসব?এতোটা নিচে কী করে নামলেন আপনি?
“আমি ভুল করেছি রজনীগন্ধা।প্লিজ ফরগিভ মি।”
খসখসে গলায় বললো—
“নো।নেভার।বারবার কেন আপনি ভুল করেন?আর কতো ভুল করেছেন আপনি!আপনার ভুলের সাজা কেন আমার সন্তানকেই পেতে হয়!ভালোই হয়েছে ও মরে গেছে।যার বাবা মায়ের জীবন এতোটা ঘৃণিত তার এই দুনিয়ায় আসার কোনো দরকার নেই।”
সারহান শশব্যস্ত হয়ে জান্নাহ্ এর কাছে এগিয়ে আসলে তেতে উঠে বললো সে—
“আপনার ওই নোংরা হাতে আমাকে ছোঁবেন না।ঘৃণা হচ্ছে আমার।আপনার মতো একটা নোংরা লোকের সন্তান আমার গর্ভে।এরচেয়ে আমার মরে যাওয়াই ভালো।”
স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সারহান।একবিন্দুও নড়লো না।তার দুই চোখের পাতা নিশ্চল,শান্ত।মিহি গলায় বলে উঠে জান্নাহ্—
“এভাবে কেন ছোট করলেন আপনি আমাকে?কী করে যাবো আমি আপুর সামনে?কেন করলেন সারহান?
সারহান ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো।তার প্রাণপাখি যেনো স্পন্দন করতেই ভুলে গেলো।গুমোট মেঘ জমতে লাগলো তার চোখের তারায়।জান্নাহ ভেজা গলায় বললো—
“আল্লাহ্ যা করেন ভালোর জন্যই করেন।ভালো হয়েছে ও মরে গিয়েছে।একেও মেরে ফেলবো আমি।নিজেও মরে যাবো আমি।থাকুন আপনি।যা ইচ্ছে করুন।”
কাঁদতে কাঁদতে বেডরুমে গিয়ে ঢোকে জান্নাহ্।দরজার ধড়াম আওয়াজে হুশ ফিরে সারহানের।বদ্ধ দরজার কাছে গিয়ে চাপড় মারতে থাকে সারহান।ভেতর থেকে কোনো সাড়া পেলো না।অসহিষ্ণু গলায় বললো সারহান—
“প্লিজ রজনীগন্ধা,আমার পাপের সাজা আমার সন্তানকে দিবেন।আপনি তো আমাকে সুযোগ দিয়েছিলেন।তাহলে কেন সেই সুযোগ কেড়ে নিচ্ছেন?আপনাদের কিছু হলে আমি মরে যাবো রজনীগন্ধা।প্লিজ দরজাটা খুলুন।”
অনেকক্ষন যাবত কোনো শব্দ হলো না।সারহান চুপচাপ বসে রইলো দরজার কাছে।আচমকাই কিছু পড়ার আওয়াজে সপ্রতিভ হয় সারহান।ভয়ে উদ্বেলিত সারহান দারাজ গলায় ডেকে উঠে—
“রজনীগন্ধা,রজনীগন্ধা!প্লিজ আমাকে এতোবড় শাস্তি দিবেন না।প্লিজজজজ।”
চলবে,,,