জান্নাহ্ “পর্বঃ৭০

0
2707

#জান্নাহ্
#পর্বঃ৭০
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

রাগে অগ্নিশর্মা সারহানের চোখ দিয়ে ধোঁয়া বইছে।তার উলুথুলু চুলে ঢেকে গেছে চোখ।কানের পাশ দিয়ে নিরবধি গড়িয়ে পড়ছে উষ্ণ জলের স্মিত ধারা।সারহানের দুই হাত কঠোর হয়ে আছে ইহতিশামের শার্টের কলারে।ক্রুব্ধ কন্ঠে বললো—

“কেন এসেছিস আমার জীবনে?তোর জন্য আমার পুরো জীবনটা নষ্ট হয়ে গেছে।”

ইহতিশাম ছোট্ট দম ফেলে সংক্ষিপ্ত সুরে বললো—

“শান্ত হ।আমার কথা শোন।”

সারহান ক্ষেপা গলায় অধরপল্লব ছড়িয়ে বললো—

“কী শুনবো আমি তোর কথা?কেন শুনবো?সব তো ঠিক ছিলো।কেন আমার জীবনটা আবার নরক বানিয়ে দিলি?বল কেন?

ইহতিশাম শীতল নিঃশ্বাস ফেললো।মাথার উপর অনবরত ঘুরতে থাকা ফ্যানের বাতাসও যেনো থমথমে পরিবেশের উত্তপ্ততা ঢলাতে পারলো না।সারহান মিইয়ে কন্ঠে বললো—

“কেন করলি ইহতিশাম।আমি তো তোর কাছে ক্ষমা চেয়েছি।কেন বুঝতে পারছিস না তুই।আমার কেউ নেই ইহতিশাম।তোর তো সব আছে।আর আমি একা।আমার রজনীগন্ধা আর আমার সন্তানই আমার সব।কেন কেড়ে নিতে চাইছিস তুই।”

ইহতিশাম শান্ত গলায় বললো—

“আমি সব ঠিক করে দিবো।আমি জান্নাহ্কে বোঝাবো।তুই একটু শান্ত হ।”

সারহান পরাস্থ হয়ে ইহতিশামকে ছেড়ে দাঁড়ায়।অসহায় মুখ করে বললো–

“কী করে ঠিক করবি তুই।গত দুইদিন ধরে কথা বলছে না আমার রজনীগন্ধা আমার সাথে।কিছু খায়ও না।আমাকে সহ্যই করতে পারছে না।এমনটা না করলেও পারতি তুই।”

ইহতিশাম নির্বিকার গলায় বললো—

“প্লিজ,আমার কথা শোন।”

দাপিয়ে উঠলো শান্ত,স্থির মেহনাজ।ক্ষুব্ধ গলায় বললো–

“তোমার সাথে এমনই হওয়া উচিত।এখন কেন কষ্ট হচ্ছে তোমার?

জ্বলে উঠে সারহানের নিভে যাওয়া আগুন।দগদগে গলায় বললো—

“কী বলতে চাস তুই?

মেহনাজ খসখসে গলায় বলল—

“ভদ্রভাবে কথা বলো।”

সারহান বাঁকা হেসে তীর্যক গলায় বললো—

“তোর সাথে কিসের ভদ্রতা আমার।এইসব কিছুর জন্য তুই দায়ী।”

ইহতিশাম নিজের স্ত্রীর অসম্মান সহ্য করলো না।গমগমে গলায় বললো—

“সারহান,শী ইজ মাই ওয়াইফ।”

সারহান বিক্ষিপ্ত হেসে কন্ঠ শক্ত করলো।বললো—

“এই জন্যই ওর গায়ে এখন পর্যন্ত হাত তুলিনি আমি।নাহলে ও যা করেছে তার জন্য ওকে খুন করতেও আমি দ্বিতীয়বার ভাবতাম না।”

ইহতিশাম শব্দহীন নিঃশ্বাস ফেললো।মেহনাজ খরখরে গলায় বাতাস কাঁপিয়ে বললো–

“ভাবো কী তুমি নিজেকে?লজ্জা করে না তোমার?এতো কিছুর পরও এতবড় মুখে কথা বলছো!কাউকে ধোঁকা দিলে কেমন লাগে এইবার দেখো।”

সারহান মুক্ত হেসে উঠলো।দারাজ গলায় বললো—

“লজ্জা!তোর লজ্জা করেনি আমার সাথে বিছানায় আসতে?তাহলে আমার কেন করবে?তোকে ফোর্স করেছি আমি?নিজ ইচ্ছায় এসেছিস।তোর তো খুশি হওয়া উচিত।এতো কিছুর পরও ইহতিশাম তোকে মেনে নিয়েছে।সব দিয়েছে তোকে।তাহলে আমার সুখ কেন তোর সহ্য হলো না?

মেহনাজ উদ্ভাসিত নয়ন যুগলে আঁকড়ে ধরলো সারহানের মুখচ্ছবি।নির্বিকার,নিশ্চল দৃষ্টি।সারহান দাঁতে দাঁত চেপে নাকের ডগা ফুলিয়ে তীব্র আক্রোশে বললো—

“তোদের মতো মেয়েদের সাথে এরচেয়ে ভালো কী হবে!জান্নাহ্ আর তোদের মধ্যে পার্থক্য কী জানিস?তোরা শুধু আমার উপরিটাকে দেখে মোহাচ্ছন্ন হয়েছিস।কিন্তু আমার রজনীগন্ধা আমার ভেতরের সত্তাকে ভালোবেসে।নিজেকে জড়িয়েছে আমার সাথে।বিয়ে করেছে আমাকে।পনেরো বছরের মেয়েও বুঝে বিয়ের আগে অনৈতিক সম্পর্ক ঠিক নয়।আর তোরা?শুধু নিজেদের চাহিদা মিটিয়েছিস।এখন দোষ শুধু আমার?

মেহনাজ ঝাঁমটা মেরে বললো—

“জাস্ট শাট আপ।”

“ইউ শাট আপ।তুই কী ভেবেছিস তোকে আমি ছেড়ে দিবো?যদি আমার স্ত্রী,সন্তানের কিছু হয় তাহলে তুই,তোর ইহতিশাম আর ওই রাফাত কাউকে ছাড়বো না আমি।ওদের ছাড়া তো আমি এমনিতেই শেষ হয়ে যাবো।তার আগে তোদেরকেও শেষ করে যাবো।মনে রাখিস।”

গটগট করে বেরিয়ে যায় সারহান।ইহতিশাম ফুলে ফেঁপে আছে।স্তব্ধ হয়ে আছে সে।মস্তিষ্কের দুই পাশের রগ দপদপ করছে।হাতের শিরাগুলো শিরশির করছে।রাগে থরথর করছে ইহতিশামের শরীর।বদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে আছে মেঝেতে।তার নিস্পলক চোখ দিয়ে টুপ করে গড়িয়ে পড়লো এক ফোঁটা স্বচ্ছ,শীতল জল।
মেহনাজ ধীরপায়ে এসে ইহতিশামের হাত স্পর্শ করতে ঝাটকা মেরে সরে দাঁড়ায় ইহতিশাম।রুদ্ধ গলায় বললো–

“এইবার খুশি তুমি?

মেহনাজ ঠোঁটের ফাঁক গলিয়ে কিছু বলতে গিয়ে থামলো।কিঞ্চিৎ সময় ব্যয় করে নিষ্প্রভ গলায় বললো–

“তুমিও আমাকে দোষ দিচ্ছো?

বিদ্রুপপূর্ণ হাসে ইহতিশাম।ক্ষেপা খলায় বললো–

“কেন,সারহানের একার দোষ হবে কেন?ও দোষী হলে তুমিও দোষী।জোর তো করেনি সারহান তোমাকে।আমাদের তিন বছরের সম্পর্কে আমি তো তোমার কখনো এতো কাছে আসিনি।মাত্র ছয় মাসে সারহান কী করে এলো?
এখন সব সারহানের দোষ?

মেহনাজ চোখের পাতা কাঁপিয়ে বললো—

“এইসব কী বলছো তুমি।তুমি জানো না তখন আমি…।”

“জানতে চাইও না আমি।যতই আমি সব ঠিক করতে চেয়েছি ততই সব বিক্ষিপ্ত হয়ে যাচ্ছে।তুমি আর রাফাত মিলে কী করলে বলো তো?সারহানকে ঘৃণা করলেও জান্নাহ্কে তো ভালবাসতে তোমারা।ওই বাচ্চা মেয়েটার কথা একবারও ভাবলে না।জান্নাহ্ প্রেগন্যান্ট মেহনাজ।একজন নার্স হয়ে এইটুকু উপলব্ধি করার ক্ষমতা তো তুমি অর্জন করেছো।”

মেহনাজ থম মেরে রইলো।তার গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না।ইহতিশাম বিতৃষ্ণা গলায় বললো—

“সারহানকে চেনো না তুমি।রাগের মাথায় কী করে বসে ও নিজেও জানে না।”

মেহনাজ নিভুনিভু চোখে ফ্যাকাশে দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো।ইহতিশাম নাক টেনে আক্ষেপের সুরে বললো—

“আমার নিজেকে কার্টুন মনে হচ্ছে।কেন জানো?
মনে হচ্ছে তোমাকে বিয়ে করে আমি শুধু তোমাকে ক্ষণকালের বিনোদন দিয়েছি।তোমাকে সত্যিকারের ভালো আমি বাসতে পারি নি,করতে পারি নি তোমাকে সুখী।যদি তাই হতো তাহলে আমাকে বুঝতে তুমি।কিন্তু তুমি!
মনে রেখো মেহনাজ ক্রোধ,হিংসা আর মিথ্যে মানুষের সবচেয়ে বড় দুশমন।এর ফল কখনো ভালো হয় না,কখনো না।”

ইহতিশামের রোশভরা কথার ছুরি ছিন্নভিন্ন করল মেহনাজে মন,মস্তিষ্ক।তার চোখ বেয়ে গড়াতে লাগলো স্বচ্ছ শীতল জলের নহর।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here