#জান্নাহ্
#পর্বঃ৮
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
চেয়ারে হেলান দিয়ে দুই পা একসাথে করে তা উঠিয়ে রেখেছে টেবিলের উপর সারহান।তার পাশেই সারহানের অফিসিয়াল ল্যাপটপ।পাশে একটা ফ্লাওয়ার ভাস।শায়িক রোজ আধা ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে তাতে তাজা রজনীগন্ধ্যা এনে রাখে।
উত্তরমুখী ঘরের পশ্চিম পাশটায় টেবিলটা রাখা।সারহানের ফ্ল্যাটে দুটো বেড রুম।একটা সে অফিসিয়াল কাজে ব্যবহার করে আরেকটা ঘুমানোর জন্য।সারহান পেশায় একজন আন্ডারকভার ক্রাইম রিপোর্টার।দেশের উঁচ স্থানে অবস্থানকারী অনেক মানুষের সাথে তার গোপন আঁতাত।
দেশের অনেক রাজনৈতিক নেতাদেরও অনেক গোপন তথ্য আছে সারহানের কাছে।ক্ষমতার লোভে মানুষ আজ মানুষকে পিষে তার উপর দালান তৈরি করে।সেই দালানে এসি অন করে শান্তির ঘুম ঘুমায়।সারহানের একটা রিপোর্ট সেই ঘুম হারাম করতে যথেষ্ট।অবশ্য এইসব কাজ করতে গিয়ে তার শত্রুও কম নয়।কিন্তু সবচেয়ে ভয়ংকর শত্রু সে যাকে দেখেও চেনা যায় না।
টেবিলের ও প্রান্তেই প্রভুভক্ত প্রাণীর মতো বসে আছে শায়িখ।তার নরম চোখ দুটো তার স্যার এর দিকে।বেশ কিছুক্ষন চুপ থেকে বলে উঠলো–
“স্যার,আপনার কী ভয় লাগছে না?
সারহান মাথার নিচে হাত দিয়ে আয়েশি ভঙিতে বসে ছিলো।শায়িখের কথায় অক্ষিপল্লব মেলে তাকায়।ক্ষনকাল চেয়ে থেকে বিগলিত হাসলো।সারহানের হাসিতেই চোখ পিট পিট করে শায়িখ।এতো ভয়ংকর মুহূর্তেও লোকটার হাসি কী করে পায়!
সারহান নির্বিঘ্ন গলায় প্রত্যুক্তি করলো–
“ভয় লাগবে কেন?
শায়িক চোখে,মুখে ভয় ফুটিয়ে গলায় স্বর গভীর করে বললো—
“তিথি ম্যাম আর সামিরা ম্যামের জন্য আপনার চিন্তা হচ্ছে না?
সারহান বাঁকা হাসলো।উঠে গিয়ে শায়িখের পেছনে দাঁড়ালো।পাশে থাকা জানালা দিয়ে হুরহুর করে বাতাস ডুকছে আর তাতে সারহানের সিল্কি চুলগুলো উড়ছে।শায়িখ সামনে থাকা মিররে তাকায়।কেমন অদ্ভুত দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে সারহান।শায়িখ ঘাবড়ে যায়।লোকটার এই অদ্ভুত দৃষ্টিতে ভীষন ভয় করে তার।যেনো শরীর হিম হয়ে আসে।সারহানের দৃষ্টি দেখে কখনো বোঝার উপায় থাকে না একটু পরে সে কী করতে চলেছে।যে কোন অপ্রস্তুত বা ভয়ংকর মুহুর্তেও অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে নিজেকে সামলে নেওয়ার কঠিন ব্যক্তিত্বের পুরুষ সারহান।কিন্তু তার ওই চোখ ক্ষেপা নেকড়ের চেয়েও ভয়ংকর,হিংস্র,তীক্ষ্ম আর তান্ডবপূর্ণ।শায়িখ ভেবে পায় না এই যে চোখের নরম চাহনিতেই তার রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায় সেই চোখের চাহনিতে মেয়েরা প্রেমে কী করে পড়ে?
শায়িখের কাঁধে হাত রেখে হালকা ঝুঁকে মিররে সরল দৃষ্টি রেখে অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় সারহান বললো–
“যে নেই তাকে নিয়ে চিন্তা করে যে আছে তাকে অপমান করার কোনো মানে হয় না।”
শায়িখ ফাঁকা ঢোক গিলে।তিথি আর সামিরা সারহানের তথাকথিত গার্লফ্রেন্ড।গত চারমাস আগে তিথি আর ঠিক তার দুই মাস পর সামিরা খুন হয়।নিজেদের বাড়িতেই খুন হয় তারা।বেচারিরা মরেও শান্তি পায় নি।যে বা যারা খুন করেছে শরীরকে কয়েকটুকরো করে ফেলেছে।সারহান একবারই দেখতে গিয়েছিলো।তারপর বেমালুম ভুলে যায় তাদের কথা।সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় দুই জন খুন হওয়ার কিছুদিন আগেই একটা করে চিঠি এসেছিলো সারহানের অফিসে।অবশ্য সারহান তা পায় তার দু’দিন পর।কাজে ব্যস্ত ছিলো সে চট্টগ্রামে।সেখানে কবিতাংশ লেখা ছিলো।ঠিক একই রকম কবিতাংশ তিথি আর সামিরার মুখের ভেতরের কাগজটায় পাওয়া যায়।
এতো কিছুর পর অধৈর্য হয়ে পড়ে শায়িখ।তার দৃঢ় বিশ্বাস এইসব কিছু সারহানের কোন শত্রুই করেছে।কিন্তু তা নিয়ে বিন্দুমাত্র বিচলিত নয় সারহান।বরং সে অন্য নারীতে মত্ত হয়েছে।
শায়িখ বিনা দ্বিধায় বললো–
“স্যার,আপনার কী মনে হয়?কে করতে পারে এই কাজ?
সারহান শান্ত হয়ে বসে।অধরে তার সেই স্মিত হাসি।মুখের অভিব্যক্তি যে কোনো নারী হৃদয়কে ঘায়েল করবে।তার ব্যক্তিত্ব,বাচনভঙ্গিতেই মেয়েরা ঘায়েল হয় বেশি।আর তার সেই হিংস্র চাহনি,ধূর্ত বুদ্ধি,নিশ্চিন্ত চালচলন,বেপরোয়া মন সবকিছুতেই কাঠিন্যভাব।
সারহান নরম গলায় বললো–
“তোমার কী আমাকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছে না আমার গার্লফ্রেন্ডদের নিয়ে?
“নাউজুবিল্লাহ স্যার!এক গার্লফ্রেন্ড রে সামলাইতে পারি না।তার উপর….।”
শায়িখ তার কথা শেষ করলো না।রহস্য হাসে সারহান।শায়িখ গত চারবছর ধরে কাজ করে তার সাথে।অবশ্য সারহান তার কোনো অ্যাসাইমেন্টেই কাউকে অ্যালাউ করে না।যা করে সে নিজেই করে।তবে শায়িখের উপর তার বেশ ভরসা।
সারহান রসালো গলায় বললো–
“ফুলের মধু একদিন শেষ হবেই।সে ঝড়ে পড়বেই।তাই বলে কী ভ্রমর থেমে থাকবে!
শায়িখ অবগত হলো তার স্যার এর কথা।কিন্তু তবুও দ্বিধান্বিত গলায় সে প্রশ্ন করলো–
“স্যার,খুনিটা আপনার গার্লফ্রেন্ডদেরই কেন বেছে নিলো?
সারহান আয়েশি গলায় বললো–
“দ্যাটস আ গুড কোয়েশ্চন!হয়তো তার আমার গার্লফ্রেন্ডদের পছন্দ নয়।”
“কিন্তু কেন স্যার?
সারহান এইবার বিরক্তিকর চোখে তাকায়।তার সেই চাহনিতেই কেঁপে উঠে শায়িখ।মনের প্রশ্ন মনেই অবদমন করে।
,
,
,
টিফিন আওয়ারে দুই বান্ধবী মিলে গল্পে মশগুল।কিন্তু তিল আজ উন্মনা।কথার ফাঁকে তা উপলব্ধি করে জান্নাহ্।ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন ছুঁড়ে জান্নাহ্–
“কী হয়েছে তোর?গালটা একদম চুষা আমের মতো কেন করেছিস?
তিল তাচ্ছিল্য করে বললো–
“সোনার যৌবন যায় বিফলে,নাগর আমার কই?
তার দহনে পুড়ছে দেহ,পুড়ছি আমি সই।”
জান্নাহ্ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থেকে হতভম্ব গলায় বললো–
“এইসব কী বলছিস তুই?
“আর বলিস না,যেদিন থেকে ওকে দেখেছি ঘুম ই আসে না রাতে।”
তিল শান্তভাবে তার হাতটা বেঞ্চের উপর রেখে তাতে চিবুক রেখে উদাসী ভঙিতে সামনে তাকায়।জান্নাহ্ অধৈর্য হয়ে এক ধাক্কা মেরে খেটখেটে গলায় বললো–
“কী আজেবাজে কথা বলছিস!কাকে দেখার কথা বলছিস?
তিল অতি উৎসাহ নিয়ে বললো–
“আরে ওই যে ক্যাম্পেইনের জন্য যে ছেলেরা এসেছে না তাদের মধ্যে একজন।আহা!কী ডেশিং দেখতে!কী গভীর চোখ!কাটা কাটা নাক!আর ঠোঁট দুটো যেনো একদম পাকা জাম।ইশ!
জান্নাহ্ হতবাক হয়।ঠোঁট গুঁজ করে অবাক দৃষ্টিতে তাকায়।ঠাট্টামিশ্রিত গলায় বললো—
“এখন তোর রণবীর সিং এর কী হবে!তুই যে রনবীর কাপুরের প্রেমে পড়লি!
“আরে দুর।ইশ!তুই যদি দেখতি!ছেলেটা কী সুন্দর কথা বলে!
জান্নাহ্ কিছুক্ষন বোকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।গত এক সপ্তাহ ধরে ওদের স্কুলে কিছু ছেলে মেয়ে এসেছে।তারা কিছু স্বেচ্ছাকর্মী নিতে চায়।তারা দেশের বিভিন্ন স্কুল,কলেজ থেকে কিছু ছাত্র-ছাত্রী সংগ্রহ করবে।দরিদ্র,অসহায় শিশুদের জন্য কমপক্ষে ক্লাস টু পর্যন্ত বিনা খরচে পড়ার সুবিধার পাশাপাশি আর্থিক সুবিধার ব্যবস্থা করবে।
জান্নাহ্ কপট ভীত গলায় বললো–
“এই এখন যদি এইসব ভাবিস তাহলে তোর মডেলিং এর কী হবে?তুই না দীপিকা পাডুকোন।”
তিল মেকি আফসোসের গলায় বললো–
“হায়!আমার দীপিকা!এখন আমি কী করি!
হঠাৎ করে তিল জান্নাহ্ এর হাত ধরে তাকে করিডোরে নিয়ে আসে।সেখান থেকে মাঠের মাঝখানে অবস্থানরত সেই ছেলেমেয়েদের দেখা যাচ্ছে।তিল গদগদ হয়ে বললো–
“দেখতো ছেলেটাকে কেমন লাগে?
তিলের দিকে তাকিয়ে হতাশ শ্বাস ফেলে জান্নাহ্।তারপর বাধ্য হয়েই বান্ধবীর মন রক্ষার্থে সামনে তাকায়।ঝনাৎ করে উঠে জান্নাহ্ এর দেহপিঞ্জর।কাঁপা কাঁপা গলায় প্রশ্ন করলো–
“ওওওই ব্ল্যাক কালারের পোলোশার্ট পরা ছেলেটা?
তিল আমুদে গলায় বললো–
“তুই কী করে বুজলি?
“কিইইছু না।”
ত্রস্ত পায়ে ক্লাসে আসে জান্নাহ্।ব্যাগের উপর থাকা বই,খাতা গুছিয়ে নিয়ে তা ব্যাগে ডুকায়।কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে যেতে চাইলে তিল অবাক গলায় প্রশ্ন করলো–
“কোথায় যাচ্ছিস তুই?এখনো তো দুটো ক্লাস বাকি।”
জান্নাহ্ ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে বললো–
“আমার ভালো লাগছে।অস্বস্তি লাগছে।”
“এইতো ভালো ছিলি।”
জান্নাহ্ ঈষৎ চটে গিয়ে বললো–
“এখন লাগছে না।যেতে দে।”
“মেঘনোলিয়া ম্যামের ক্লাস আছে।”
“জানি।যা হবার হবে।”
“দারোয়ান যেতে দিবে না।”
“রতন স্যারকে বলেই যাবো।”
তটস্থ হয়ে ক্লাস থেকে বের হয় জান্নাহ্।থরথর করে কাঁপছে তার শরীর।ভয়ে গলা শুকিয়ে গেছে।অতি উত্তেজনায় শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে।সিড়ির কাছে যেতেই ধাক্কা খায় রাফাতের সাথে।শ্বাস আটকে নেকাবের মধ্য থেকেই প্রশ্বস্ত দুই চোখ দিয়ে তাকিয়ে থাকে রাফাতের দিকে।ধাক্কা লাগায় অপ্রস্তুত হয় রাফাত।অনুযোগের গলায় বললো–
“আই এম সরি।”
জান্নাহ্ কোনো কথা বললো না।রাফাতকে পাশ কাটিয়ে দ্রুতপায়ে নিচে নেমে যায়।রাফাত নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে জান্নাহ্ এর যাওয়ার পানে।আচমকা বাঁকা হাসে রাফাত।ইশাক উৎসুক গলায় জিঙ্গেস করে–
“হাসছিস যে?
এইবার পুরো অধর ছড়িয়ে হাসে রাফাত।রসালো গলায় বললো–
“চল,তোকে আজ বিরিয়ানি খাওয়াবো।”
“বিরিয়ানি!
“ইয়েস।মানুষের মাংসের বিরিয়ানি।”
চলবে,,,