#জান্নাহ্
#পর্বঃ৯
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে চললো।পশ্চিমাদেশ কমলা রঙের আভায় রাঙানো।প্রভাকর যেনো এখন জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ড।তার চারপাশে লাল আভা ছড়াতে শুরু করলো।ধীরে ধীরে কমলা রঙের আভা রক্তিম আভায় লীন হয়ে যায়।বেশ কিছুক্ষন গনগনে উনুনের মতো জ্বলতে থাকা সূর্য ধীরে ধীরে কালচে নীলাভ আকাশে প্রলীন হতে থাকে।ঢেকে যেতে থাকে দিনের মায়া রাতের ছায়ায়।
ছাদের দড়িতে নেড়ে দেওয়া কাপড়গুলো রোদে শুকিয়ে কড়কড়ে হয়ে আছে।জান্নাহ্ তার বা’হাতের উপর একটা একটা করে কাপড় নিচ্ছে।কাপড় নেওয়া শেষে ঘুরে তাকাতেই তার সামনে জাবিনকে দেখতে পায়।স্থির জাবিনকে হঠাৎ দেখে চকিত হয় জান্নাহ্।জাবিনকে পাশ কাটিয়ে আসতে গেলেই জান্নাহ্ এর হাত চেপে ধরে জাবিন।জান্নাহ্ শিউরে উঠে।ঝাঁমটা মেরে হাত সরিয়ে তপ্ত গলায় বললো–
“জাবিন!
কতোবার বলেছি না এমন করবে না।একদম স্পর্শ করবে না আমাকে।”
জাবিন থমথমে গলায় বললো–
“কেন শুনছো না তুমি আমার কথা!কেন চলে যাচ্ছো না সারহানকে ছেড়ে?
জান্নাহ্ শাসিয়ে উঠে বললো–
“ছিঃ!বড় মানুষের নাম ধরে বলতে লজ্জা করে না তোমার?সে তোমার মামা হয় জাবিন।”
জাবিন তাচ্ছিল্য গলায় বললো–
“ওই সারহানকে নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না।তুমি চলে যাও এখান থেকে।সারহান তোমার যোগ্য নয়।তুমি এর চেয়েও ভালো ডিজার্ব করো।”
জান্নাহ্ ফোঁস ফোঁস করে।বিয়ের আগে যখন জান্নাহ্দের বাড়িতে যায় জাবিন তখন থেকেই দুইজনের একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়।কিন্তু জাবিন কিছুতেই চায়নি সারহানের সাথে জান্নাহ্ এর বিয়ে হোক।সারহানকে ছোট বেলা থেকেই সহ্য করতে পারে না জাবিন।এই বাড়িতে আসার পরও জান্নাহ্ এর সাথে খুব ভালো সম্পর্ক ছিলো জাবিনের।কিন্তু একদিন এমন কিছু হলো যা জান্নাহ্কে বলার পর থেকে দুই জনের কথা বলা বন্ধ হয়ে যায়।জাবিন মনেপ্রাণে চায় জান্নাহ্ এই বাড়ি ছেড়ে,সারহান থেকে অনেক দূরে চলে যাক।
জাবিনের কথার প্রত্যুত্তরে ক্রোশভরা কন্ঠে জান্নাহ্ বললো–
“এতোদিন সারহানকে আমি কিছুই বলিনি।কিন্তু এইবার বাড়ি আসলে আমি ঠিক বলবো।তুমি তার নামে আমাকে বাজে কথা বলছো।”
“আমি যা বলেছি সব সত্যি জান্নাহ্।চলে যাও তুমি সারহানকে ছেড়ে।”
“একদম চুপ।আরেকটা কথাও বলবে না তুমি।”
সিড়ি বেয়ে দৌড়ে নামে জান্নাহ্।অন্তরা সামনে পড়তেই পায়ের গতি শিথিল করে সে।অন্তরা মুখ বিকৃত করে তীর্যক গলায় বললেন–
“এইভাবে দৌঁড়াইতেছো কেন!ভূতে ধরছে তোমারে?
জান্নাহ ফাঁকা ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বললো–
“না আম্মা মানে,রাত হয়ে যাচ্ছে তাই কাপড়গুলো তাড়াতাড়ি নিয়ে আসলাম।”
“সারাটা দিন করোকি!এই ভর সন্ধ্যাে বেলায় ছাদে যাও!জওয়ান মাইয়াগো এতো রাইতে ছাদে যাওন ঠিক না।যাও,ঘরে যাও।”
“জ্বী,আম্মা।”
জান্নাহ্ দ্রুত পা চালায়।কিন্তু এখন যদি জাবিনকে দেখতে পায় তাহলে অন্তরা আবার কিছু একটা বলবে তাকে।তাই ঘরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে থম মেরে বসে থাকে সে।জাবিন তখন আর নিচে নামলো না।অন্তরা সিড়িধার থেকে রান্না ঘরের দিকে গেলে নরম পায়ে ছাদ থেকে নেমে আসে জাবিন।
,
,
,
মোবাইলের স্ক্রীন জুম করে জান্নাহ্কে দেখছে সারহান।আজকাল বড্ড মনে পড়ে মেয়েটাকে।শরীরের চেয়ে মনটাই তাকে টানে বেশি।হাতের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে জান্নাহ্ এর ঠোঁট,গলা বুক ছুঁয়ে যাচ্ছে সারহান।নির্নিমেখ চাহনি তার।বিপরীত দিকের কাউচে বসে আছে শ্রীজা।সারহানকে এমন গম্ভীর দেখে বললো–
“কিছু ভাবছো?
সারহান বেখেয়ালিপনায় অস্ফুটভাবে বললো–
“হুম।”
“জান্নাহ্কে ভাবছো?
রহস্য হাসে সারহান।তার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায় শ্রীজা।সারহানকে বোঝা দুঃসাধ্য।সরল গলায় শ্রীজা বললো–
“এতো মনে পড়লে ওকে নিয়ে আসো এখানে।সবসময় তোমার কাছে থাকবে।”
মোবাইলটা নামিয়ে শ্রীজার দিকে গাঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সারহান।শ্রীজা এনজিও তে একটা ফাংশন করবে বলে তার অ্যারেঞ্জমেন্ট দেখছে।সারহান উঠে গিয়ে শ্রীজার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।সারহানকে কাছে আসতে দেখে উঠে দাঁড়ায় শ্রীজা।এক ঝটকায় শ্রীজার কোমর চেপে ধরে তাকে নিজের বুকে নিয়ে নেয় সারহান।গভীর চুম্বনে লিপ্ত হয় দুজন।একে অপরের মাঝে গভীরভাবে মত্ত হতেই দরজায় করাঘাত করে শায়িখ।দাঁতে দাঁত চেপে ক্ষেপে উঠে দাঁড়ায় সারহান।নিজেকে ঠিক করে নেয় শ্রীজা।দরজা খুলেই প্রদৃপ্ত গলায় সারহান বললো–
“হোয়াট দ্যা হেল?
এখন কেন এসেছো?
সারহানের ধমকে রুদ্ধবাক হয়ে যায় শায়িখ।তার কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে।হাঁপাচ্ছে সে।ভীতসন্ত্রস্ত শায়িখ ভয়াতুর গলায় বললো–
“স্যার একটা জরুরি কথা ছিলো।”
সারহান কাঠখোট্টা গলায় বললো–
“ভেতরে এসো।”
সারহান থমথমে গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে–
“তুমি কী করে জানলে আমি এখানে?
“আপনার ফ্ল্যাটে গিয়েছিলাম স্যার।আর আজ তো বৃহস্পতিবার।তাই ভাবলাম আপনি এখানেই আছেন।”
শ্রীজা উঠে দাঁড়িয়ে বললো–
“তোমরা কথা বলো আমি তৌহিদের সাথে কথা বলে আসছি।”
“হুম।”
শ্রীজার যাওয়ার পানে গভীর দৃষ্টিতে তাকায় শায়িখ।মেয়েটাকে তার ভদ্র আর সুশীল মনে হয়।কিন্তু সারহানের সাথে সুশীল মেয়েদের আনাগোনা কম।বড় কথা সুশীল মেয়েরা সারহানের সান্নিধ্যেই সুশীলতাহীন হয়ে যায়।তবে তার খটকা ছিলো এতোদিন।কিন্তু আজ শ্রীজাকে দেখে শায়িখ নিশ্চিত হলো বদ্ধদ্বারের ভেতর কিছু তো একটা চলছিলো।
শায়িখ ফোঁস করে এক শ্বাস ফেলে।সারহানকে সে বুঝতে পারে না।একদম ই না।সারহানের কঠিন গলায় হুশ ফিরে শায়িখের।উষ্ণ গলায় সারহান বললো-
“বলো কী বলবে।”
শায়িখ ঘনঘন কয়েকটা শ্বাস নিলো।তারপর অতি উৎকন্ঠার সাথে বললো–
“স্যার,তিথি আর সামিরা ম্যামের কেসটা সিবিআই কে হস্তান্তর করেছে।”
বিগলিত হাসলো সারহান।তীর্যক গলায় বললো—
“সে তো পুরোন খবর।নতুন কী সেইটা বলো।”
শায়িখ ভীত গলায় বললো–
“স্যার,এইবার সামিরা ম্যামের বাবা পার্সোনাল ডিটেকটিভের কাছে কেসটা দিয়েছে।”
সারহান তাচ্ছিল্যপূর্ণভাবে বললো–
“তো?
“সেই ডিটেকটিভ আর কেউ নয় বিখ্যাত ডিটেকটিভ ইহতিশাম।”
খলখল করে হেসে উঠে সারহান।রসালো গলায় বললো–
“ইহতিশাম!রিয়েলী!
“স্যার,আপনি হাসছেন?আজ পর্যন্ত একটা কেসও ফল করে নি তার।
আপনার মনে আছে কয়েকবছর আগে উত্তরার নিজ বাড়িতে বিশিষ্ট ব্যবসায়ি আলফাজ খান খুন হয়েছিলো।সেই কেসটাও ইহতিশাম সলভ করেছে।বেচারা আলফাজ নিজের মেয়ের হাতেই খুন হয়েছিলো।”
সারহান মৃদু হাসলো।শায়িখ ভোলা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।এই লোকটাকে সে কিছুতেই বুঝে না।উদ্বেগভরা কন্ঠে শায়িখ আবার বললো–
“স্যার,যদি ইহতিশাম জানতে পারে তারা আপনার গার্লফ্রেন্ড ছিলো।তাহলে তো…।”
সারহান দারাজ গলায় বললো–
“বাঘ দেখোছো?পুরুষ বাঘ নাকি খিদের জ্বালায় নিজের সন্তানকেও খেয়ে ফেলে!
সারহানের কথায় হতভম্ব শায়িখ আহত নয়নে তাকিয়ে থাকে।সে কিছুই বুঝতে পারলো না।শায়িখের ভয় কমানোর জন্য বললো—
“ডোন্ট ওয়ারি শায়িখ। জাস্ট রিলেক্স।”
“বাট স্যার..।”
“সরফরাজ মাহমুদের কোনো খোঁজ পেলে?
“ওপস!ভুলেই গেছি।তিনি আপনাকে দেখা করতে বলেছেন।”
“তাই নাকি!কবে?
“জ্বী কালই।”
“ওকে।”
শায়িখ এখনো আশ্বস্ত হতে পারলো না।তার মস্তিষ্ক জুড়ে খেলছে সারহানের কথা।ক্ষুধার্ত বাঘ নিজের সন্তানদের ভক্ষন করে।এই কথায় কী বুঝাতে চায় সে?
,
,
,
বারে বসে মদ গিলছে রাফাত।আজ সে অনেক খুশি।আজ রাতের বারোটা পর্যন্ত যত কাস্টমার আসবে সবাইকে ট্রিট হিসেবে ফ্রি তে ড্রিংক করার অফার করেছে সে।পুরো খরচ সে দিবে।ইশাক শুধু অবাক পানে চেয়ে আছে রাফাতের দিকে।সেদিন জান্নাহ্ এর সাথে ধাক্কা খাওয়ার পর থেকে রাফাত অদ্ভুত আচরণ শুরু করেছে।ইশাক অনেকবার জিঙ্গেস করার পরও মুখ খুলে কিছু বলে নি।মাতাল অবস্থায়ও ভুলভাল বকে রাফাত।তবুও শেষ চেষ্টা হিসেবে ইশাক প্রশ্ন করে–
“তুই কী তোর রেড চেরির দেখা পেয়েছিস?
রাফাত উদ্ভ্রান্তের মতো হাসলো।তারপর একদমে চুপ হয়ে যায়।চাপা গলায় বললো–
“মাই লাভ কুইন,মাই জানেমান।মাই রেড চেরি।এইবার তোমাকে আমার কাছে আসতেই হবে।”
ইশাক বিরক্ত হয়।কী জিঙ্গেস করেছে আর কী বলছে!ইশাক অস্বস্তিকর গলায় বললো–
“চলতো,একদম ভালো লাগছে না আমার।”
রাফাত ড্রিংসের গ্লাস হাতে নিয়ে হেলেদুলে বললো–
“আমার লাগছে।এই,এই দেখ আমার রেড চেরি।কী সুন্দর ওর ঠোঁট দুটো!কী সুন্দর হাসি!ওর চোখগুলো দেখ,একদম ফোঁটা পদ্মের মতো।আর ওর চুল।একদম রেশম কালো।”
রাফাত তার গ্লাসের দিকে তাকিয়ে আবোলতাবোল বলে যাচ্ছে।ইশাকের অস্বস্তি বাড়তে থাকলো।রাফাত আগে মদ খেতো না।কিন্তু যখন থেকে তার রেড চেরি তাকে ছেড়ে চলে গেছে তখন থেকে রোজ মদ গিলে।হয় বারে না হয় ঘরে।রাফাত আবার বলতে শুরু করে।
“কেন হারিয়ে গেলো ও বলতো!আর কয়েকটা দিন অপেক্ষা করলে কী এমন ক্ষতি হতো।আমি যে আজোও ওকে ঠিক তেমন করেই ভালোবাসি।আমার ভালোবাসার প্রথম ফোঁটা পদ্ম সে।কী করে আমি তাকে ভুলি!
রাফাতের গলা ধরে আসে।ইশাক রাফাতের এইসব শুনতে শুনতে অভ্যস্থ হয়ে গিয়েছে।ড্রাংকড হওয়ার পর সব আবোলতাবোল বললেও এই একটা কথা একদম ঠিক বলে।তার রেড চেরির কথা।”
চলবে,,,