#জাস্ট_ফ্রেন্ডস
#৪র্থ_পর্ব
~মিহি
ধীরে ধীরে চোখ খুলতেই ধাক্কাটা খেল রুদ্ধ। আশেপাশের পরিবেশটা বুঝতে বেশ খানিক সময় লাগল। সে তো নিজের বাড়িতে ছিল। এখন গাড়িতে কী করে? তাও গাড়ির বোনেটে! কেউ কি তাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাচ্ছে? জোরে জোরে চিৎকার শুরু করলো রুদ্ধ।
-“দেখ, ষাঁড়টা চিৎকার শুরু করছে।”
-“আহা প্রেমা! ওকে ওখানেই থাকতে দে। পৌঁছানোর আগ অবধি ওকে এখানে আনার কোনো দরকার নাই।”
-“পৌঁছাতে তো অনেক সময় লাগবে।”
-“শর্টকাট আছে কী জন্য? তাছাড়া সামনের হাইওয়ে পার করলে রাস্তা শুনশান। থখন স্পিডে গাড়ি চালানো যাবে।”
-“আচ্ছা, তুই দেখেশুনে গাড়ি চালা। আমি বরং রেহান আর তনয়ার সাথে একটু গল্প করি। ঐ দুইটার তো ঘুমই ভাঙেনি ঠিকমতো।”
-“আচ্ছা কর।”
প্রেমা তনয়া আর রেহানকে ঘুম থেকে তোলার চেষ্টা করছে কিন্তু এই দুইটা রুদ্ধর চেয়েও বড় কুম্ভকর্ণ। শুভ্রর মাথায় আচমকা একটা বিষয় আসে। এই ট্যুরেই যদি রুদ্ধ-প্রেমাকে মিলিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে এর চেয়ে সুন্দর কিছু হতে পারে না। চটজলদি নড়েচড়ে বসে প্রেমাকে ডাকে সে।
-“এই প্রেমা শোন।রুদ্ধ তো অনেকক্ষণ ধরে চুপচাপ! টেনশনে সেন্সলেস হয়ে গেল না তো? ওকে বরং গাড়িতে নিই।”
-“ও আমাকে আগে খুন করবে তারপর আমাদের নিফিউ পাড়া যাওয়ার প্ল্যানটা ভেস্তে দিবে।”
-“আরে! সেরকম কিছুই হবে না। আমি গাড়ি সাইড করে ওকে নিয়ে আসছি। তুই চুপ করে বস এখানে।”
-“আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু ও যদি আমার উপর রাগ দেখায়, আমি তোকে ফাঁসায়ে দিব। বলবো সব তোর প্ল্যান ছিল।”
-“যদি রাগ দেখায়! দেখাবে না। চিল।”
শুভ্র প্রেমাকে সামনের সিটে বসিয়ে রেখে গাড়ির বোনেটের দিকে এগোলো। বোনেট খুলতেই রুদ্ধ কিছু না দেখে, কিছু না বুঝেই ঝাঁপিয়ে পড়লো শুভ্রর উপর। দু-চারটে কিল ঘুঁষি মারার পর শুভ্রর চেঁচানোতে থেমে যায় রুদ্ধ।
-“শালা তুই! তুই আমারে কিডন্যাপ করছিস? তোরে কেডা তাবিজ করছে?”
-“থাম তো! ভঙ করিস না। এখান থেকে উঠে ড্রাইভিং সীটে বস যা। তাহলেই সব জানতে পারবি। আর শোন সুযোগ কিন্তু একবারই আসে। যা বলার বলে ফেলিস। সাতটা দিন সময় আছে। সময়কে কাজে লাগাস।”
রুদ্ধ ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার মতো একটা ভাব নিয়ে ড্রাইভিং সীটে এসে বসতেই প্রেমা খুবই নিষ্পাপ ভঙ্গিতে তাকালো রুদ্ধর দিকে। ব্যস! রুদ্ধর রাগ শেষ! উপরে উপরে একটা রাগী ভাব নিয়েই ড্রাইভিং শুরু করলো।
_____________________________________________________________________________________________
-“গুরুকে বলে দিও, চমৎকার হয়েছে। ওরা নির্জন জায়গা দিয়ে ভ্রমণ করছে। তাছাড়া আমাদের গ্রামের দিকেই যাচ্ছে। যখনি দেখবো রাস্তা বদল করছে, তখনি হামলাটা হবে।”
-“ঠিক আছে। মেয়েটার যেন কোনো ক্ষতি না হয়।”
শ্যামলা লোকটা এখন ইউনিফর্ম পড়ে আছে। ছাইরঙা একটা ইউনিফর্ম। সবটাই সাজানো যাতে ধরা পড়লে কাটিয়ে দেওয়া যায়। ইউনিফর্মের এককোণে নেমপ্লেটে লেখা ওবায়দুর। পকেটে থাকা এনআইডিতেও এই নামটাই দেওয়া। সবটাই নকল। লোকটার আসল নাম রাজন। লোকটা ভালো গতিতে গাড়ি চালাচ্ছে। পিছনের সীটে আরো দুইজন লোক বসে আছে। লোক দুটোকে রাজন ঠিকমতো চেনেনা তবে গুরু পাঠিয়েছেন তার সুবিধার্থে। রাজনের মনটা বিষণ্ন। সবকিছু তার ঝামেলা মনে হচ্ছে কিন্তু করতেই হবে। এই কাজের পেছনে তার স্বার্থ আছে। স্বার্থ ছাড়া তো কেউই কুকর্মে জড়ায় না। রাজন দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সে কি মানসিকভাবে সুস্থ আছে? নাকি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে? নিজের কাজকর্মকে সে আর মানুষের তালিকায় ফেলতে পারে না। দুদিন আগেও সে দুটো মেয়েকে পৌঁছে দিয়েছিল গুরুর কাছে। মেয়ে দুটোর অস্তিত্বের ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট নেই। এক রাতের মধ্যেই দুটো জলজ্যান্ত মেয়ে উধাও। তাদের নাকি অশুভ শক্তির দরবারে প্রেরণ করা হয়েছে। এসব কি মানার যোগ্য কথা? কিন্তু মেনে নিয়েছে রাজন। শেষবারের মতো এই মেয়েটাকে গুরুর কাছে পাঠাতে পারলেই সে চিন্তামুক্ত। তার কাজ সম্পন্ন হবে আর গুরুর কাজ সম্পন্ন হলে রাজনের জীবনেও আর কোনো বিপদ থাকবে না।
-“আচ্ছা ওবায়দুর, তোমার অশুভ শক্তির কি দরকার? তুমি তো গ্রামের ভোলাভালা মানুষ।”
-“ভোলাভালা দেখেই তো সবাই সুযোগ নেয়। নিতে নিতে চুষে ফেলা আমের আঁটির মতো ছুঁড়ে ফেলেছে। আর কত সহ্য করতাম?”
-“বউ-বাচ্চা আছে?”
-“বউ আরেকজনের সাথে পালায় গেছে। একটা মেয়ে আছে।”
-“মেয়ের বাপ হইয়া মেয়ে ধরতে আইছো। মনে ডর লাগে না?”
-“আপনার মা কি জীবিত?”
-“হ, আম্মার চিকিৎসার লাইগাই গুরুর কথায় রাজি হইছি। অশুভ শক্তি পাইলে নাকি কোনো অভাব থাকবো না।”
-“আপনি যার গর্ভে জন্মেছেন, সেও মেয়ে। তাহলে আপনি ক্যামনে আসলেন মেয়ে ধরতে? ভাই রে, দুনিয়ায় কেউ খারাপ না। সবাই বাধ্য, কেউ পরিস্থিতির কাছে তো কেউ নিজের কাছে।”
-“কথা ভালোই কইছো ওবায়দুর মিয়া। গাড়ি জোরে চালাও। মাইয়াডা তো অনেক আগে চলে গেলো।”
রাজন চুপ করে গাড়ি চালানোতে মনোযোগ দিল। ‘ওবায়দুর’ নামটা বারবার শুনতে তার মোটেও ভালো লাগছে না। নিজের নামের জায়গায় অন্য কোন নাম শুনেও বিরক্তি কিংবা রাগ প্রকাশ করতে না পারাটা প্রচণ্ড অসহ্যকর একটা অনুভূতি। গাড়ির গতি আর দিনের দাবদাহ দুটোই বাড়ছে। গরমে রাজনের গলা ঘামছে। কিছু মানুষ সহজেই ঘামে। রাজন তাদের মধ্যে নয়। রাজন সহজে ঘামে না। প্রচণ্ড গরম লাগলে তবেই সে ঘামে। তাপমাত্রা কি তাহলে খুব বেড়েছে?
____________________________________________________________________________________________
-“রুদ্ধ, তোর কী হয়েছে বল তো। রাস্তা তো সামনে। তুই একটু পর পর আমার দিকে তাকাচ্ছিস কেন? দু’বছরে আমার চেহারা এতটাও বদলায়নি যে ঘুরে ঘুরে দেখতে হবে। চুপচাপ সামনে তাকা।”
-“তোকে দেখছি না আমি। আমি আশেপাশে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছি রাস্তাটা এত নির্জন কেন। তোরা যে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস আমাকে।”
রুদ্ধর তৎক্ষণাৎ উত্তরে পেছনের সীটের সবাই হেসে ওঠে। রেহান কাশির ভান করে খুকখুক করে কাশে। প্রেমা ভালোই বুঝতে পারছে কিছু একটা চলছে কিন্তু কেউ তাকে বলছে না। অদ্ভুত তো! দু’বছর সে দূরে ছিল তাই বলে ওর বন্ধুরা ওকে এত পর করে দিয়েছে? আর এই রুদ্ধটাই বা এমন আচরণ করছে কেন?
প্রেমার রাগান্বিত দৃষ্টির মানে স্পষ্ট বুঝছে রুদ্ধ। তার মজাই লাগছে প্রেমাকে জ্বালাতে। প্রেমা মেয়েটা এখনো বাচ্চাই আছে, কিছুই বোঝে না। আনমনে জানালার দিকে তাকিয়ে ছিল প্রেমা। রুদ্ধ প্রেমার হাতে হাত রাখে। প্রেমা তখনো খেয়াল করেনি। অনেকটা সময় পর সে রুদ্ধর স্পর্শটা খেয়াল করলো। তখনি চটে গিয়ে বললো,” এই আমি কি বাচ্চা? আমার হাত ধরে রেখেছিস কেন? আমি কি গাড়ি থেকে ঝাপ দিব? আজব তো!” প্রেমার কথায় রুদ্ধর কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে। এই মেয়েকে বোঝাতে তার কত রুটি যে বেলতে হবে! এদিকে প্রেমার কাণ্ড দেখে শুভ্র, রেহান আর তনয়ার হাসি থামছে না। প্রেমা তো রাগে আগুন। সবকিছু তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। আচমকা শুভ্র গান ধরলো,”বলতে গিয়ে মনে হয়, বলতে তবু দেয়না হৃদয়…” ব্যস এটুকু বলেই চুপ। প্রেমা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,” কী রে থামলি কেন? এত সুন্দর গান আর তুই পুরোটা গাইবি না?” শুভ্র মুচকি হেসে বললো,”যাকে বলছি সে বুঝলেই হলো, তোর বোঝা লাগবে না।” রুদ্ধ বিষম খেল। এমনিতেই সে অস্থির হয়ে আছে। তার উপর তার বন্ধুগুলো! একেকটা আস্ত শয়তান। রুদ্ধর মনের মধ্যে এখন গান বাজছে,”অল মাই ফ্রেন্ডস আর টক্সিক!” এতসবের মাঝেও রুদ্ধর মনের এককোণে একটা বিপদের সূক্ষ্ম ঘণ্টা বাজছে। ঠিক কী কারণে এমনটা মনে হচ্ছে তা রুদ্ধ জানে না তবে তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় যে কখনো ভুল বলেনা তার প্রমাণ সে অনেক আগে থেকেই পেয়ে আসছে।
চলবে…