জীবনের অন্যরঙ পর্ব-১৫

0
642

#জীবনের অন্যরঙ [১৫তম পর্ব]
#আজিজুর রহমান

খর স্রোতজলে কাদা-গোলা বলে গ্রীবা নাড়ে তীরে জরদ্‍গব,
গলিত শবের ভাগাড়ের ওরা, ওরা মৃত্যুর করে স্তব।
ওরাই বাহন জরা-মৃত্যুর, দেখিয়া ওদের হিংস্র চোখ –
রে ভোরের পাখি! জীবন-প্রভাতে গাহিবি না নব পুণ্য-শ্লোক?

অনির যা বয়স তাকে ছেলে মানুষ বলা যায়না। বয়স হলেও বাচপনা যায়নি। অর্নিতা ভাত রান্না করবে ভেবেছিল এখন ভাবছে চাপাটি করবে। আম্মি বিয়ের জন্য তাগাদা দিত, সবাই বিয়ে করে সেও করতো।কিন্তু বিয়ের চেয়ে নিজের কেরিয়ারের দিকেই ছিল তার বেশি নজর। অনিকে বিয়ে করে মনে হল একটা খেলার সাথী পাওয়া গেল। খেলখুদ তার খুব পছন্দ।ভেজিটেবল স্যাণ্ড উইচ করে এক ফ্লাক্স চা নিয়ে অনির কাছে গেল। ঘরে ঢুকে দেখল সকালের কাগজ নিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে কি পড়ছে। প্লেটে স্যাণ্ড উইচ এগিয়ে দিয়ে পাশে বসল। অনির মুখে লাজুক হাসি।
ভ্রু কুচকে তাকালো অর্নিতা । অনি কাগজটা এগিয়ে দিয়ে একটা জায়গা দেখিয়ে দিল।
অর্নিতা কাগজ নিয়ে এটা ওটা দেখতে দেখতে এক জায়গায় নজর আটকে যায়। সবুজ পত্রিকার পর্যালোচনা বেরিয়েছে। বিভিন্ন পত্রিকায় কি কি লেখা আছে কোন লেখা উল্লেখযোগ্য ইত্যাদি। সবুজ পত্রিকা সম্পর্কে লিখেছে এক নতুন লেখকের কথা,অনিমান চৌধুরী । অর্নিতা ভাল করে পড়ে।সম্ভাবনাময় লেখক,….পাঠককে দর্পণের সামনে দাড় করিয়ে দিয়েছে….পত্রিকাটিকে নতুন মাত্রা দিয়েছে ইত্যাদি। এতক্ষন এইসব মন দিয়ে পড়ছিল। অর্নিতা ভাবে এইসব পড়ে অনির মনে যেন কোনোভাবে আত্মসন্তুষ্টির মনোভাব না জন্মায়। তা হলে ওর মনের ক্ষিধেটা নষ্ট হয়ে যাবে। অর্নিতা কাগজটা অবজ্ঞাভরে সরিয়ে রাখল। লক্ষ্য করল অনির ভাল লাগেনি।স্যাণ্ডউইচ শেষ করে বলল,চা দাও।
ফ্লাক্স থেকে চা ঢেলে দিয়ে অর্নিতা বলল,কোন পত্রিকা কি লিখলো তার চেয়ে বড় কথা পাঠক কিভাবে নিয়েছে।
–এই সমালোচনা ফালতু?
–আমি তাই বললাম?কেউ সফল হলে কার বেশি আনন্দ হবে?
অনিমান বুঝতে পারে না অর্নির কথা।
অর্নিতা বলল,মায়ের চেয়ে বেশি আপন কেউ নেই।
অনির মন খারাপ হয়,মায়ের কথা মনে পড়ে। তাকে নিয়ে কত চিন্তা ছিল। অর্নিতা বলল, আজ আণ্টি নেই। আজ সবচেয়ে কে খুশী হবে?
অনি হেসে বলল, অর্নি।

–লোকে পত্রিকা কেনে বিশেষ কোনো লেখক দেখে নয়। একটা পত্রিকায় অনেকের লেখা থাকে। কিন্তু বই কেনে বিশেষ লেখকের লেখা পড়ার জন্য।
–থাক আর বলতে হবেনা,বুঝতে পেরেছি। অনি বলল।
খিল খিল করে হেসে উঠল অর্নিতা। হাসি থামলে অনি বলল,সকাল থেকে একটা কথা ভাবছি। আচ্ছা আমরা পাড়ায় যাবো এক সঙ্গে না আলাদা আলাদা?
–আলাদা আলাদা কেন?
–এক সঙ্গে গেলে ওরা যদি সন্দেহ করে? তিলকে তাল বানিয়ে ছাড়বে,তুমি তো ওদের চেনো না?
–কি সন্দেহ করবে?আমরা একসঙ্গে যাবো–হাজব্যাণ্ড-ওয়াইফ।
–হাজব্যাণ্ড-ওয়াইফ?অনির চোখ গোল হয়।
–কেন আমাকে ওয়াইফ বলতে লজ্জা করছে? তুমিই আমাকে বলেছিলে, যাকে বিশ্বাস করা যায় তার সামনে অহঙ্কার দীনতা লজ্জা সব কিছু ত্যাগ করা যায়। সেতো আলাদা নয় যেন আত্মজন। নিজের কাছে নিজের লজ্জা কি?

–আমি শিখ তুমি তো মুসলমান। এতে আমাদের সম্পর্ক নিয়ে বা বিয়ে নিয়ে তোমার কোনো সমস্যা নেই।
অনিমান চুপ করে কি যেন ভাবতে থাকে। অর্নিতা বলল,কিছু বলছো নাযে?
–কি বলবো? এইটা মানুষের বাহ্যিক পরিচয়। আমার বিবেচনায় জাত-ধর্ম পোশাকী রূপ। ইচ্ছে করলেই মুসলমান হতে পারি কিন্তু অনায়াসে মানুষ হতে পারবো না—। অর্নিতার চোখে চোখ পড়তে কথা আচমকা থেমে যায়। অর্নিতা কখনোই ভাবতে পারে নি তার অনির এতবড় উদার মন। অর্নিতা মুগ্ধ বিস্ময়ে শুনছিল থেমে যেতে বলল,থামলে কেন?
–ধ্যৎ তুমি আমার অর্নি। অনি আচমকা জড়িয়ে ধরল অর্নিতাকে। ওদের সামনে তোমাকে অর্নি বলতে পারব না।

–তুমি শিক্ষিত এইসব কথা তোমাকে বলা মানায় না।লাজুক গলায় বলল অনিমান।
অনি অনার্সে অধ্যয়ন করছে। অথচ গম্ভীর কথা কেমন সহজ প্রাঞ্জল ভাষায় বলে যাচ্ছিল অবাক লাগে। অর্নিতা জিজ্ঞেস করল, তুমি এখন অনার্সে অধ্যয়ন করছো।
— হুম।
— আর পড়ো নি কেন? ভালো লাগে না?
— পড়তে আমার খুব মজা লাগে।
— মজা লাগে? এরকম কথা অর্নিতা আগে শোনেনি।
— পড়তে পড়তে মনে হয় অন্ধকারের মধ্যে পুট পুট করে আলো জ্বলতে থাকে। যেন মনে হয় উৎসবের বাড়ি।

–যাই রান্না করিগে।
–আর একটা কথা,তুমি ওখানে কি পরে যাবে?
–তুমি বলো।
–পুলিশের পোশাক অনুষ্ঠানের সময় ভাল লাগেনা,তুমি সালোয়ার কামিজ পরবে।
–ঠিক আছে তাই পরবো। আর কিছু?
অনি বোকার মত হাসল। অর্নিতা বলল,আমার অনেক কাজ পড়ে আছে,জানকি নেই।
–আমি হেল্প করবো?
অর্নিতা ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল,তুমি নিজের কাজ করলেই খুশী হবো।

হাতা-খুন্তিতে অর্নিকে একেবারে গিন্নি-গিন্নী লাগছে।অনিমানের বিষয়টা অবাক লাগে। স্কুল কলেজে পড়ার সময় মেয়েরা কেউ দুষ্টু কেউ চপল কেউ আবার গম্ভীর বিয়ের পর রাতারাতি কেমন বদলে যায়। তখন সেই কৈশোরকে তার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়না।

অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গিয়েছে। পল্টু মাইকে ঘোষণা করছে সকাল সাড়ে-নটায় গান পরিবেশনা শুরু হবে।যারা গাস গাইতে ইচ্ছুক স্টেজে চলে আসুন। বেলা ভাবি হন্তদন্ত হয়ে কাকে খুঁজছে। উশাকে দেখে জিজ্ঞেস করল,রাজু কোথায়?
মুন্নীকে আসতে দেখে বলল,ঐ তো ভাবি আসছে। ভাবি বলতে পারবে ওর খবর। উশার কথায় অভিমানের সুর।
বেলা চৌধূরি এগিয়ে গিয়ে মু্ন্নীকে হাতে ধরা সবুজ পত্রিকাটা দেখালো। মু্ন্নী এক পলক দেখে বলল,আমাদের অনি?
–ও ছাড়া কে হবে?এমন অদ্ভুত নাম কটা আছে?
–তুমি কি যে বলনা,অনিমান খারাপ কি?পড়েছো?
–পড়েছি বলেই বলছি এ অনি ছাড়া কেউ নয়। কিছু কিছু চরিত্র হুবহু আমার চেনা।
–তোমার হলে আমাকে দিও। দেখব কি লিখেছে।
–সে না হয় দেব। আমি ভাবছি ছেলেটার কথা।পাড়ার কথা একেবারে ভুলে গেছে?আর কেউ না জানুক তুমি তো জানো রাজু ওকে কত ভালবাসতো?
মুন্নী বলল,জানো বেলা অনি একদিন আমাকে বলেছিল ভাবি দূর থেকে দেখে কোনো কিছু ভেবে নেওয়া ঠিক নয়। কি জানি কেন আসেনি।
–শোনো মুন্নী অনিকে আমি কম ভালবাসিনা।সেজন্যই রাগ হচ্ছে তোর একবার ইচ্ছে হলনা পাড়ায় কি হচ্ছে?লেখক হয়ে সব ভুলে যেতে হবে?
বাশার চিৎকার করে,ভাবি আসুন গান শুরু হচ্ছে।
–শুরু করে দে। রাজু থাকলে পাঠিয়ে দেতো। বেলা গলা চড়িয়ে বলল।

স্টেজের নিচে দাড়াবার জায়গা নেই। একদিকে মেয়েরা আরেক দিকে ছেলেরা দাঁড়িয়ে গেছে। বারেক শাহকে দেখে কমলেশ সাহেব ডাকলেন,আসুন ডাক্তার । শুভ্রতা মায়ের সঙ্গে মেয়েদের দিকে চলে গেল। মিতা আড়চোখে দেখে ভীড় থেকে বেরিয়ে গেল। ভীড়ে ভাল করে শুনতে পাওয়া যায়না। তবে গানের গলা সুন্দর মনে হচ্ছে।

শুভ চায়ের ভাড় হাতে নিয়ে স্টেজের দিকে আসছে,পিছনে আণ্টির সঙ্গে মেয়ে রোজি। হিমেশ স্টেজে দাঁড়িয়ে শুভকে দেখে বলল,কিরে চা খাচ্ছিস গান গায়বি না?
–আমার দ্বারা এসব হবে না। শুভ বলল।
–কেন গাস দেবে না কেন?শুভ ঘাড় ঘুরিয়ে আণ্টিকে দেখে ভাড় ফেলে দিল। রোজি ফিক করে হেসে ফেলে। আণ্টি বলল,চা খেলে দোষ নেই তুমি হাত মুখ ধুয়ে এসো।
শুভ রোজির দিকে চোখ পাকিয়ে হাত ধুতে চলে গেল।বাশার কোথা থেকে এসে বলল,কিরে শ্বাশুড়ি দাবড়ি দিয়েছে?
–এবার তোকে থাবড়া দেবো।
মিতাকে বেরিয়ে আসতে দেখে সঞ্জনা জিজ্ঞেস করল,কিরে চলে এলি?গান গায়লি না যে?
–পরের বার দেব,এত ভীড়। ফাটুসটাকে দেখেছিস?বাপ মায়ের গুডি গার্ল।
— শুভ্রতার কথা বলছিস?ওই জন্য বেরিয়ে এলি?সঞ্জনা জিজ্ঞেস করে।
–কেন ওর জন্য কেন?অনুষ্ঠান কি ওর একার?এতদিন খেলিয়ে এখন এক ডাক্তারের সঙ্গে নাকি বিয়ে ঠিক হয়েছে।
সুলতাকে আসতে দেখে সঞ্জনা বলল,ওই দেখ খবরি আসছে। দেখ কি নতুন খবর নিয়ে আসছে।
পাড়ার সব খবর সুলতার নখ দর্পনে অবশ্য তার অর্ধেকই ভুল খবর। বন্ধু মহলে সবাই ওকে বলে খবরি,অবশ্য প্রকাশ্যে নয়। সুলতার মুখকে সবাই ভয় পায়। সুলতা এসেই বলল, রাতে হেভি জমবে।
–জমবে মানে?
–হেভি নাচানাচি হবে। বাইরে থেকে একটা ছেলে আসছে হেভি নাচে।
–তোকে কে বলল বাশার?
–সঞ্জনা আমার সঙ্গে লাগতে আসিস না,সুলতা ভালর ভাল মন্দের মন্দ।
–আচ্ছা মিতা তুই বল,আমি খারাপ কিছু বলেছি?
–তুই বাশারের কথা বলিস নি?একদম কথা ঘোরাবি না।
–হ্যা তাতে হয়েছে কি?
–দেখ সঞ্জনা সবাই ঘাসে মুখ দিয়ে চলে না। তুই ওর কথা কেন বললি?আমি কি সুবীরের কথা বলেছি?মিতা তুই বল তনু কেন সুবীরকে ফুটিয়ে দিল বলেছি?
–মোটেই না ঐ তনুকে ফুটিয়ে দিয়েছে।
দূরে বাশারকে দেখে মিতা বলল,এই মনে হয় তোকে ডাকছে।
–ডাকুক,ডাকলেই যেতে হবে নাকি?সুলতা চলে গেল।
সুলতাকে দেখে বাশার গলির দিকে হাঁটতে লাগল।সুলতা একবার পিছন ফিরে ওদের দেখে গলিতে ঢুকে গেল।
মিতা সঞ্জনা চোখাচুখি করে হাসল। বাশার গলিতে ঢুকে কিছুটা গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
সুলতা এসে বলল,কি বলবে তাড়াতাড়ি বলো।
–ওদের সঙ্গে কি নিয়ে কথা হচ্ছিল?
–সুবীরের নতুন লাভারের কথা বলছো?
–কে কার লাভার তোমার তাতে কি?
–এইজন্য ডেকেছো?উষ্ণ গলায় বলল সুলতা।
–কি মুস্কিল তোমার সঙ্গে দেখছি কথা বলাই যাবেনা।
–কথা বোলনা। কে তোমায় মাথার দিব্যি দিয়েছে?
–তুমি আমার সঙ্গে এরকম ব্যবহার করো কেন বলতো?
সুলতা ফিক করে হেসে বলল,একটু বাজিয়ে দেখলাম। কি বলছিলে বলো?
–না কিছুনা।
–সঞ্জনা খুব বাড় বেড়েছে। আমি বলে দিয়েছি তোমাকে নিয়ে বললে আমি ছাড়বো না।
–আঃ কি হচ্ছে কি?আনন্দের মধ্যে কি দরকার ঝামেলা করার?
–ঝামেলা আমি করছি?
বাশার অবস্থা সামাল দিতে বলল,মনে হচ্ছে গানের পর্যায় শেষ হল। এবার শালা গ্যাঞ্জাম হালকা হবে।তুমি গান দিয়েছো?
–ফারস্ট ব্যাচেই দিয়েছি। এ্যাই আমি যাই। সকাল থেকে কিচ্ছু পেটে পড়েনি। কিছুটা গিয়ে পিছন ফিরে বলল,রাতে দেখা হবে?

সুলতার বাশার নামটা পছন্দ নয়। এই নামের জন্য ওকে কেউ পাত্তা দেয়নি। সুবীর শুভ কি সুন্দর নাম তা না বাশার। ও বলছিল এই নামে মহান ব্যক্তিত্ব রয়েছে। কিসে আর কিসে চাঁদে আর গুলে।

গানের পরিবেশন শেষ হয়ে আরেক দফা শুরু হতে চলেছে। এবারের ব্যাচে মেয়েরাই বেশি অংশগ্রহণ করবে। রোজির মা মানে আণ্টি আগেরবার দিতে পারেনি,এবার দেবে। শুভ ছেলেদের দিকে দাড়িয়ে, মনে হয় মঞ্চের দিকে নয় ওর বা-দিকে। বারবার ঘুরে বা-দিকে রোজিকে দেখছে। সবাই যেন তার মনের ইচ্ছে পূরণ করে গান গাইতে পারে সেজন্য সবাইকে উৎসাহিত করতে চ্যারিটি গান পরিবেশন সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন।

রান্না শেষ করে অর্নিতা স্নানে গেল। অনির ব্যাপারে আম্মিকে এখনই কিছু বলার দরকার নেই। রইয়ে সইয়ে বলতে হবে। অনির বইটা প্রকাশ হলে একটু নাম হবে তখন হয়তো অতটা আপত্তি করবে না।খাও-পিও জিন্দেগি তার ভাল লাগেনা। যাদের বিধাতা অঢেল টাকা দিয়েছে তাদের দিল দেয়নি।পুলিশগিরি করতে করতে নারীত্ব হারিয়ে ফেলেছিল। কিন্তু অনি তাকে আবার চঞ্চল করে তুলেছে। প্রেমের নতুন স্বাদ জাগিয়েছে মনে। এই সময় জানকি থাকলে ভাল হতো। ও আর ফিরবে মনে হয়না। অনির টাকা জানকিই নিয়েছে। ও যদি না নিত তাহলে নিজের বেতন না নিয়ে যাবে কেন?এতগুলো টাকা অথচ অনি কেমন নির্বিকার। এই জন্য ওকে ভাল লাগে। হাজব্যাণ্ড ওয়াইফ হয়ে যাবে বলতে লজ্জায় একেবারে লাল। বাথরুম হতে বেরিয়ে খেতে ব্যবস্থা করে। সন্ধ্যেবেলা আবার বেরোতে হবে।
খাবার টেবিলে রুটি দেখে অনিমান জিজ্ঞেস করল,এটা কি?
–আলু কুলচা বলি আমরা। বক বক না করে খেয়ে দেখো ভাল না লাগলে খাওয়ার দরকার নেই। অর্নিতা বলল।
সারাদিন খেটে সব বানিয়েছে আর ক্ষেপানো ঠিক হবেনা। অনিমান মুখ বুজে খেতে লাগল। কুলচা না কি খেতে দারুন হয়েছে। এক সময় আদিবাসীদের খাবার খেয়েছে এবার তাকে পাঞ্জাবী খানায় অভ্যস্থ হতে হবে।
–লেখা শুরু করেছো?
–হুউম।
–আমি আছি?
–তোমাকে তো বাদ দিতে পারব না,তবে তুমি এখানে বাঙালী।
–সে কি পুলিশে কাজ করে?
–না। একটা এনজিও মানে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। একটা সমস্যা ছিল,মিটে গেছে।
–সমস্যা?
–সেরকম কিছু না। আসল নাম নাদিয়ে নামের আদ্যক্ষর দিয়ে চরিত্রের নামকরণ করব।
অ-দিয়ে বাংলায় ভাল নাম পাচ্ছিলাম না। তুমি অর্নি বলতে অ-দিয়ে সুন্দর নাম দিয়েছি।
–কি নাম?
অনিমান গভীর দৃষ্টি মেলে অর্নিকে দেখে। অর্নিতা খাবারে মন দেয় জিজ্ঞেস করে,আর একটা রুটি দিই?
–দেও। নাম দিয়েছি অম্মৃত্রা। দুর দুরান্ত হতে অমৃত বয়ে এনে মা যেমন সন্তানকে–।
মা যেমন সন্তানকে কথাটায় অর্নিতা আরক্তিম হয় রুটি এগিয়ে দিয়ে বলল,আর বলতে হবেনা। চুপ করে খাও। শুরু করলে থামতে পারেনা।

সবুজ পত্রিকায়-এ অনির লেখা বেরিয়েছে বিষয়টা পরিচিত মহলে ছড়িয়ে পড়ে মুখে মুখে। বেলা চৌধুরি ছাড়া কারো কাছে সবুজ পত্রিকার কপি নেই। মুন্নী ভাবি আগেই চেয়ে রেখেছে। দুপুরবেলা আরেকবার অনির উপন্যাসটা পড়া শুরু করল। শুভ্রতার সঙ্গে শুভার কিছুটা মিলছে মিল পেলেও সাগরের সঙ্গে কাউকে মেলাতে পারে না। অথচ পড়তে পড়তে মনে হয় বিষয়টা ছোওয়া যায় কিন্তু ধরা যায়না। শরীরে কেমন অস্বস্তি হয়।

অর্নিতা শুয়ে পড়েছে পাশে অনি শুয়ে শুয়ে বই পড়ে।দুপুরে ঘুমায় না অনি। একসময় পাশ ফিরে অর্নিতা হাত দিয়ে জড়িয়ে অনিকে। আড়চোখে দেখল অর্নি ঘুমোচ্ছে। অনি বইটা মাথার কাছে সরিয়ে রাখল।একবার ভাবল অর্নিকে ধরে নামিয়ে দেবে আবার মনে হল অর্নির যদি এভাবে শুতে ভাল লাগে তাহলে থাক।মাথায় হাত বোলায় অনি। অর্নি একটু সরে এসে অনির বুকে শুয়ে পরলো। অর্নিতার মুখ অনির গলার কাছে। উষ্ণ নিশ্বাস লাগছে গলায়। অনি হাতে অর্নির মাথায় বুলাতে লাগল।
তন্দ্রা জড়িত গলায় অর্নি বলল,কি করছো?
–তুমি ঘুমোও নি?
–এভাবে কি ঘুমানো যায়?
–তোমার ভাল লাগছে না?
–হু-হু-ম।

অনি বুঝতে পারে অর্নি ঘুমায়নি। অনি ঠোঁটে ঠোঁট রাখল। অর্নিতা ডান হাতে গলা জড়িয়ে বা-হাত দিয়ে মাথার চুলে বোলাতে থাকে। অনি জিজ্ঞেস করল,অর্নি তুমি আমাকে ছেড়ে যাবেনা তো?
হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন? অর্নিতা অবাক হয়। হেসে বলল,আমি তোমাকে এইভাবে জড়িয়ে রাখবো যাতে তুমি হারিয়ে না যাও।

দুপুরের দিকে অনুষ্ঠানে মানুষ কমে গেলেও বিকেল হতে আবার লোক জমতে থাকে। রাত যত বাড়ে আলোকসজ্জা তত স্পষ্ট হয়। এক পাশে চেয়ার নিয়ে রাজু তার দলবল নিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। নানা বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছে। মেয়েরা এবার দায়িত্ব নিলেও পরিশ্রম ওদের কমেনি বরং বেড়েছে। বাজার করা সবই ছেলেরা করেছে। তবে চাঁদা উঠেছে এবার বেশি।পল্টু বলল,কেন বেশি উঠেছে?
–অনি থাকলে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিত। বাশার কথাটা বলতেই সবাই হো-হো করে হেসে ওঠে। রাজু হাসিতে যোগ দেয়না।
হাসি থামলে শুভ বলল,যাই বলিস ও কিন্তু আমাদের থেকে আলাদা।
দূরে উশাকে দেখে বাশার হাক দেয়,ভাবি এদিকে।
–আবার ওর পিছনে কেন?রাজু বলল।
–আচ্ছা মানা করে দিচ্ছি। বাশার বলল।
–এবার কিন্তু গাড়ে লাথি দেব। রাজুর কথা শুনে সবাই বাশারকে দেখে। রাজু সাধারণত এভাবে কথা বলেনা।
উশা আসতেই হিমেশ একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বলল,বসুন ভাবি।
বসতে বসতে উশা বলল,আমি বসলে তোমাদের অসুবিধে হবে নাতো?
ইঙ্গিতটা রাজুর দিকে। রাজু জিজ্ঞেস করল,তুমি একা,নয়ন কোথায়?
–সাজগোজ করছে, ভাবির সঙ্গে আসবে।
–বলুন ভাবি,আমাদের অনুষ্ঠান কেমন লাগছে?শুভ জিজ্ঞেস করল।
–অনুষ্ঠান সবার আমাদের-তোমাদের কি?
–না মানে আগে তো অন্য পাড়ায় অনুষ্ঠান দেখেছেন– তবে এবার আমরা অন্যরকম করে আয়োজন করেছি।
–অানন্দ একই,অঞ্চলের মানুষ পরিবেশানুযায়ী এক-একরকম মাত্রা পায়। উশা বলল।
বাশার পাশ থেকে বলে,আমাদের পাড়ার লোকজন কেমন?
–ভাল তবে–?উশা ইতস্তত করে।
–খারাপ কি?বাশার জিজ্ঞেস করে।
–খারাপ নয়। বাড়ী থেকে বেরোচ্ছি এক অদ্ভুত মানুষের সঙ্গে আলাপ হল।
–রবি সাহেব?
–ভদ্রমহিলা নতুন ফ্লাটে এসেছেন,মিনিট দশেক কথা হল তার মধ্যে খালি প্রশ্ন,কি করি কোথায় থাকি কিভাবে বিয়ে হল–।
–ও হো অনির ভাবি,আল্পনা । সুবীর বলল।
–আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করব এই অনি কে?এ পাড়ায় থাকে না?
বাশার আড়চোখে রাজুকে দেখে। রাজু বলল, তোমার ওর সঙ্গে কথা বলতে যাবার কি দরকার হল?
–বারে আমি কি কথা বলতে গেছি নাকি?ডাকলে কি শুনব না?
–উনি অনির ভাবি। আগে এ পাড়ায় থাকতেন। অনিও থাকতো। ঠিক আছে?রাজু এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে গেল।
–বিয়ের দিন থেকে শুনে আসছি নামটা তাই।মেয়েদের মধ্যেও বেশ জনপ্রিয়,কাল বেলা ভাবির সঙ্গে ভাবি ওকে নিয়ে কথা বলছিল–।
–মেয়েদের মধ্যে জনপ্রিয় হলেও কোনো মেয়ের সঙ্গে প্রেম হয়নি। বাশার বলল।
–খুব দাম্ভিক?উশা জিজ্ঞেস করে।
রাজু বলল,ওর মত বিনয়ী ভদ্র ছেলে হয়না। আলাপ হলে বুঝতে পারতে।
–আসলে কি জানেন ভাবি,মেয়েদের বাইরের সৌন্দর্যের চেয়ে অন্তরে দিকটা বুঝতে চায়। কোন মেয়ে ওর সঙ্গে প্রেম করবে বলুন?
–ইণ্টারেস্টিং। আমার কৌতুহল বাড়িয়ে দিলে।
–এখন আর ওকে পাবেন কোথায়?আগে সারাক্ষণ রাজুর সঙ্গে ঘুরঘুর করতো। এখন বেটা লেখক হয়েছে—।
–এই তোরা আর বিষয় পেলিনা?বাশারকে থামিয়ে দিয়ে রাজু বিরক্তি প্রকাশ করে। তুই ব্যাণ্ডপার্টির সঙ্গে কথা বলেছিস?
–এ্যাডভান্স হয়ে গেছে। বাশার নিজের দায়িত্ব ফেল করেনা।
–চলি ভাই। মনে হচ্ছে আমার যাওয়া উচিত। উশা উঠে পড়ল। বাশার কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,রাজু ভাই অনির উপর খচে আছে।

রাত হয়েছে,চা টিফিন খেয়ে বেরোবার জন্য প্রস্তুত। অনিমান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে, অর্নিকে আজ নতুন করে দেখছে,অর্নি তার বউ। অর্নিতা সালোয়ার কামিজ পরেছে। অনিমান লক্ষ্য করে অর্নি কোমরে রিভলবার গুজছে।
–আমরা কোথায় যাচ্ছি?অনি জিজ্ঞেস করল।
–গেলেই দেখতে পাবে।
ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতে অনি হেসে বলল,যেভাবে সাজগোজ করছো মনে হচ্ছে যুদ্ধ করতে যাচ্ছি।
–বাজে না বকে জীপে গিয়ে বোসো।

আজ অনেকদিন পর বাইরে বের হচ্ছে। অনিমানের মন খুশী-খুশী। বাংলোর বাইরে জীপ দাঁড়িয়ে আছে। অনিমান ধীর পায়ে এগোতে থাকে। এখানে আর কদিন,ওকে বদলি করে দিয়েছে। আচমকা দুটো লোক কোথা থেকে এসে দু-হাত ধরে টেনে তাকে একটা গাড়ীতে তোলার চেষ্টা করে। একী এরা কারা? অনিমান বলল,এই-এই তোমরা কারা?একী হচ্ছে–?চীৎকার করে উঠল, অর্নি–অর্নি-নি-ই-ই–।
–এই হালা তোর অর্নির–। কথা শেষ না করে লোকদুটো হাত ছেড়ে দিয়ে দ্রুত গাড়ীতে উঠে পালিয়ে গেল। পিছন ফিরে দেখল অর্নি দাঁড়িয়ে হাতে রিভলবার। চীৎকার শুনে সম্ভবত ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। অনিমান বুঝতে পারে ওকে ফেলে কেন ওরা পালিয়ে গেল?এইরূপে অর্নিকে আগে দেখেনি। অনিমান হতবাক দৃষ্টিতে অর্নিকে বলল,তুমি এখনো তৈরী হওনি?
–তুমি জিপে বোসো আমি এক্ষুনি আসছি।
জিপে বসে বারবার পিছন দিকে দৃষ্টি চলে যায়। অর্নি না থাকলে আজ কি যে হতো ভেবে শিউরে ওঠে।লোকগুলো ওকে কোথায় নিয়ে যেতে চাইছিল?এখনো বুকের মধ্যে ঢিপ ঢিপ করছে। পর মুহূর্তে
লোকগুলোর উপর মায়া হয়,এক্টু হলে ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যেতো। অর্নিকে তো চেনে না। উফস এত দেরী করছে কেন?মেয়েদের এই এক দোষ কোথাও বেরোতে হলে গোছগাছ করতে করতে দিন কাবার।নাকে সুন্দর পারফিউমের গন্ধ যেতে তাকিয়ে দেখল অর্নি। পুলিশ বলে মনেই হচ্ছে না। জিপে উঠে বলল,কাছে এগিয়ে এসো,অত দূরে কেন বসেছো?
–আজই পাটভাঙ্গা জামাটা পরেছি দেখেছো কুচকে-মুচকে কি করেছে?অনিমান অনুযোগ করে।
.
.
.
চলবে…!

[গল্পটি কেমন হয়েছে কমেন্ট বক্সে আপনার মতামত জানান।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here