#জীবনের অন্যরঙ [১৭তম শেষপর্ব]
#আজিজুর রহমান
যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই
কেন মনে রাখ তারে?
ভুলে যাও মোরে ভুলে যাও একেবারে॥
আমি গান গাই আপনার দুখে,
তুমি কেন আসি দাঁড়াও সুমুখে,
আলেয়ার মতো ডাকিয়ো না আর
নিশীথ-অন্ধকারে॥
মাস খানেক পরের কথা। শুভর বিয়ে হয়ে গেছে,হনিমুনে যাবার জন্য কাছাকাছি সিলেট ঠিক হয়েছে। শুভ্রতার বিয়ে হলেও সে ডা.বারেক শাহের কাছে ফিরে এসেছে। ওর স্বামী এফআরসিএস করতে কানাডা গেছে। কিছুদিন পর শুভ্রতাও যাবে তার তোড়জোড় চলছে। মিতার বিয়েও ঠিক বিয়ের পর তাকে ঢাকা যেতে হবে। পাত্র ঢাকা নিবাসী। অর্নিতা সিলেটে-এ এসপির দায়িত্ব নিয়েছে,আম্মীকে নিজের কাছে নিয়ে এসেছে। অর্নির পেটে বাচ্চা আছে জেনে বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে তিনি বেশি ঘাটাঘাটি করেননি।অনিকে নিজের ছেলের মত মেনে নিয়েছেন,কেননা তার নিজের কোনো ছেলে নেই।
এখন পাড়ায় গরম খবর বাশার সর্বত্র গুজ গুজ ফুস ফুস। বিষয়টা চ্যারিটি দপ্তরে এসেছে। রাজুকে সমস্ত ব্যাপার বাশার খুলে বললেও রাজু চিন্তিত। বয়স্কদের কিভাবে বোঝাবে। সুলতা গোজ হয়েছিল,প্রথমে কিছুই বলতে চায়নি। কিন্তু ভাইদের হম্বিতম্বিতে চেপে রাখা সম্ভব হয়নি। মেজ ভাই তিমির নরম প্রকৃতি সমীরের মত গোয়ার নয়। সে তো পারলে বাশার শালাকে খুন করে। বাশার ও সুলতা গুপনে বিয়ে করে নিয়েছে। সুলতা বলল,তোমরা আমাকে মারো, বশুকে কিছু বলবে না।
তিমির বলল, সুলতা মাথা গরম করিস না,এখন মাথা গরম করার সময় না।
–তুমি বলছো কি মেজ ভাই?মাথা গরম করব না?
–দেখ একহাতে তালি বাজে না। তিমির বলল।
–মেজ ভাই আমি ভালবাসি,–।সুলতা বলল।
–চুপ কর। ভালবাসলে এই সব করতে হবে?কিছু করেনা বেকার ছেলে–।
–ও চেষ্টা করছে,কিছু একটা ব্যবস্থা হবেই।
–কি ব্যবস্থা হবে?হতচ্ছাড়ি বংশে কালি দিয়ে দিল।আমার শ্বশুরবাড়ীতে কি করে মুখ দেখাবো–? বড় আপু মমতা খিচিয়ে ওঠে।
সুলতার বড় বোন মমতা। বিয়ের পর চট্রগ্রাম থাকে।খবর পেয়ে ছুটে এসেছে।
–আঃ মমতা উত্তেজিত হলে হবে। চ্যারিটিতে খবর দিয়েছি। দেখা যাক ওরা কি করে?অনেক বিচক্ষন লোক আছেন মানুষ আছেন চ্যারিটিতে। মা কি করছে?তিমির বোনকে থামায়।
–কি করবে,কাঁদছে। মার কথা বলিস না মেজ ভাই।এতকাণ্ডের পর বলছে ওর সঙ্গেই বিয়ে দিতে।
–ছোট আপু তুই আর কথা বলিস না,ভেবেছিস জানিনা কিছুই?সুলতা ফুসে উঠল।
সমীর ঠাষ করে এক চড় বসিয়ে দিল। তিমির বলল,কি হচ্ছে কি এতবড় মেয়ের গায়ে কেউ হাত তোলে?
সুলতা ককিয়ে উঠল,মেরে ফেল আমাকে মেরে ফেলো। মেজ ভাই ঐ গুণ্ডাটাকে বলো আমাকে মেরে ফেলতে।
মমতা আর কথা বলেনা। সাকিল ব্যাঙ্কে চাকরি করে।মমতাকে খুব ভালবাসে,ওর মাই যা দজ্জাল। কদিন আর বাঁচবে বুড়ি, চুপ করে সহ্য করে যায়। তবে নাতি অন্তপ্রাণ।
অর্নিতা বেরিয়ে গেলে একমনে লিখতে থাকে অনিমান। অনিমানের শাশুড়ি চা দিয়ে জামাইয়ের পাশে বসেন। বাংলা বুঝলেও পড়তে পারেন না,বড় আফশোস। অনির গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,চা খাও ছেলে।
অনি একটু মমতার স্পর্শ পেলে আবেগ প্রবণ হয়ে পড়ে। কলম রেখে শাশুড়ি মায়ের হাত চেপে নিজের গালে বুলায়। তারও খুব ভাল লাগে ওর মুখে আম্মী ডাক শুনতে। অর্নির কাছে জেনেছে জামাই একজন লেখক।
–ছেলে আমার, তুমি লেখার পাশাপাশি অন্যকিছু করো। আমি তোমাকে টাকা দিব। আমেনা বেগম বলে উঠলেন।
–আম্মু কিছু মনে করবেন না। যে মাটিতে গাছ হয় সেই মাটির সঙ্গে শিকড়ের একটা নিবিড় সম্বন্ধ তৈরী হয়। সেই মাটি থেকে শিকড়কে বিচ্ছিন্ন করে গাছকে অন্য মাটিতে লাগালে গাছের বৃদ্ধির ব্যাঘাত ঘটে। অনেক সময়–-।
— গাছ মইরা যায়। হইছে হইছে তোমারে আর বুঝায়ে বলতে হবে না। তুমি যে মাটিতে আছো সেখানেই থাকো মাটি বদলের দরকার নাই। যা ভাল বোঝ করবা। গাছ নিয়া আমি টানাটানি করতে চাই না। তুমি আমার ছেলে তাই তোমাকে আরো উপরে দেখতে চাই। লেখকের পাশাপাশি আরো কিছু করতে দেখতে চাই।
–আম্মু, সেটা আমার কাম্য নয়। অর্নি বলে আমি নাকি ভালো লিখি। তাই তার ভালোবাসা আমি উপেক্ষা করতে পারবো না। সে আমাকে ভালোবাসে। তাকে বাহির থেকে যত শক্ত মনে হয় ভিতর দিয়ে তত নরম। সে আমাকে সবসময় আগলিয়ে রাখতে চাই। যেখানে তাকে আগলিয়ে রাখার কথা। তার কথা আমরা দু’জনকে আগলিয়ে রাখছি। অনিমান তার কথা বলল।
অফিস থেকে ফিরে একে একে জড়ো হয়। চ্যারিটির অফিস জমজামাট। সুলতার মেজ ভাই তিমির এবং বাশার এর মামা সুরেন সাহেব এসেছেন। সকলকে অবাক করে উপস্থিত হয়েছেন ডাক্তার সাহেব। সভা শুরু হতেই প্রচণ্ড বাদ-প্রতিবাদ পারস্পরিক দোষারোপ। হাল ধরলেন, অবসর প্রাপ্ত বিচারক আর এন চৌধুরী। দুজনের কেউ ছেলে মানুষ নয় প্রাপ্ত বয়স্ক এবং যা করার নিজ নিজ সম্মতিতে করেছে।তাছাড়া তারা বিবাহ করে নিয়েছে। আইনের চোখে অপরাধ বলতে পারিনা। তিমির বলল,স্যার আপনি ঠিক বলেছেন কিন্তু ছেলেটি বেকার নিজের কোনো সংস্থান নেই বউকে কি খাওয়াবে?আপনারা কি বলেন বোনকে জেনেশুনে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেব?
জাস্টিস চৌধুরি হেসে বললেন,ভাই আপনি আবেগ প্রবন হয়ে পড়েছেন। আপনার মনের অবস্থা বুঝি।ছেলেটি বেকার গ্রাজুয়েট,এখন কিছু না করলেও না খেয়ে নেই। আজ বেকার কাল কোন কাজ করবে না এটা যুক্তি হিসেবে মেনে নেওয়া যায় না।
তিমিরের মনে হল বিয়েটা মেনে নেওয়াই ভাল।তাছাড়া না মেনে উপায় কি?মোটামুটি সভা যখন শেষ হতে চলেছে গোল পাকালেন সুরেন সাহেব। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ভগ্নীপতি মারা যাবার পর বোনের দায় তার উপর বর্তেছে। ভগ্নীপতির পেনশন ছাড়া সংসারে বোনের কিছু দেবার সামর্থ্য নেই। কিন্তু নিজের বোনকে তো ফেলে দিতে পারেন না কিন্তু আরেকটা মেয়ের দায়িত্ব তিনি নিতে পারবেন না,সাফকথা।
সভায় গুঞ্জন শুরু হল কেউ সুরেন সাহেবের উপর বিরক্ত আবার কেউ বলল,ঠিকই আজকালকার বাজারে উনি আরেকটা সংসার কিভাবে প্রতিপালন করবেন। ওর নিজেরও সংসার আছে। সবাইকে থামিয়ে ড. সাহেব উঠলেন। তিনি একটু ভেবে বললেন, আমি মেয়েটিকে চিনি না কিন্তু বাশার পাড়ার ছেলে ভদ্র নম্র, মানুষের সুখে দুখে পাশে দাড়াতে দেখেছি। আজকাল চাকরি পাওয়া সহজ ব্যাপার নয়।জাস্টিস চৌধুরির সঙ্গে একমত আজ না হোক কাল পাবে। শুনলাম মেয়েটির যা অবস্থা কবে চাকরি পাবে তার জন্য বসে থাকা যায় না।
কে একজন বলল,একমাস। বেলা চৌধুরী ধমক দিল,চ্যাংড়ামী হচ্ছে?
আমি একটা প্রস্তাব দিচ্ছি,আমার কম্পাউন্ডার আছে যদি বাশার রাজি থাকে তাহলে যতদিন চাকরি না হয় কম্পাউন্ডারের সহযোগী হিসেবে কাজ করতে পারে।
রাজু বলল,ডাক্তার সাহেব বাশার রাজী আছে।
ডাক্তার সাহেব কানে একটা কথা যেতে উনি বললেন,আমার যিনি কম্পাউণ্ডার তার দুটি বাচ্চা আছে তিনি যা পান তাতেই সংসার চলে যায়। প্রকাশ্যে বলব না কত পায়।
জাস্টিস চোউধুরী বললেন,ডাক্তার আমার এবং সভার পক্ষ হতে আপনাকে অভিনন্দন। মেয়ে কবে যাচ্ছে?
–ভিসা পেলেই চলে যাবে।
বাইরে বেরিয়েই হিমেশ ধরল,এই বাশার চা খাওয়াতে হবে।
বাশারের মন ছটফট করছে সুলতার জন্য। বেচারি কত কষ্ট পাচ্ছে কে জানে। এখন বাড়ির বাইরে বেরোয় না। সবাই চায়ের দোকানে গেল,রাজু বেলা ভাবির সঙ্গে কি কথা বলছে বলল,তোরা যা আমি আসছি।
সুবীর বলল,ব্যাস গেটপাস হয়ে গেল বাশার এবার সরাসরি বাড়ীতে গিয়ে দেখা কর।
ভোরবেলা উঠে জিমঘরে কিছুক্ষন কসরৎ করা অর্নিতার দৈনিক রুটিন। আম্মি যখন ছিলনা অনিকে খুব খাটিয়েছে। দিনে রাতে যখন ইচ্ছে হয়েছে। আম্মি আসার পর অনি কে দিয়ে কিছু করানো যায় না। সারাদিন নিজের ছেলে বলে কাছে নিয়ে বসে থাকে। অনিকে বিয়ে করে অর্নিতা তৃপ্ত। এক এক সময় মনে হয় সেকি জবরদস্তি বিয়ে করেছে?তার প্রতি কোনো আকর্ষণ আছে বলে মনে হয় না। উপযাচক হয়ে একবারও ইচ্ছে প্রকাশ করেনি। তলপেটে হাত বোলায় এখন কিছুটা বোঝা যাচ্ছে। অর্নিতাও মা হয়ে গেল। অনি বলতো, পাওয়ার মধ্যে আনন্দ আছে তার চেয়ে বেশি আনন্দ দেওয়ার মধ্যে।
ওর গোটা পাঁচেক বই ইতিমধ্যে প্রকাশ পেয়েছে।ঢাকায় থাকলে অনেক সুবিধে হত। বাংলা বইয়ের পাঠক এখানে তুলনায় অনেক কম। ঘেমে নেয়ে বেরিয়ে অনিকে না দেখে কান্তাকে জিজ্ঞেস করে,সাহেব কোথায়?
–সাহেব বড় মেমসাবের সঙ্গে বেরিয়েছে। কান্তা বলল।
অর্নিতা বিরক্ত হয়ে ঘরে গেল। কান্তা স্থানীয় মেয়ে বাংলোয় কাজ করে। আম্মি আসার আগে ভয়ে ভয়ে ছিল। অনিকে মেনে না নিলে কি করবে এই ছিল দুশ্চিন্তা। এখন নতুন সমস্যা,রাতে শোবার আগে ছাড়া অনিকে পায়না। আম্মি সারাক্ষন ছেলেকে নিয়ে পড়ে আছে। নেহাৎ আম্মীর বয়স হয়েছে পায়ে বাতের জন্য খুড়িয়ে হাটে। কান্তা লেম্বুপানি দিয়ে গেল। কিছুক্ষন পর অনির গলা জড়িয়ে ধরে আম্মী এলে।
অর্নিতা জিজ্ঞেস করল,আম্মী কোথায় গেছিলে?
–সকাল বিকাল হাটাহাটি করলে শরীরের জন্য ভালো।
–ওর লেখালিখি করতে হয়–।
অনি বলল,না না তুমি চিন্তা কোর না–।
–তুমি চুপ করো,তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছি?
–অর্নি তুই এভাবে কথা বলছিস কেন? আমেনা মেয়েকে বকলেন।
অর্নিতা ঘর থেকে বেরিয়ে রান্না ঘরে গেল। কান্তা চা বানাচ্ছে। অনিমান রান্না ঘরে গিয়ে বলল, অর্নি আম্মীর কোনো দোষ নেই–।
–এখান থেকে এখন যাও।
অনিমান বুঝতে পারে অর্নির মেজাজ ঠাণ্ডা না হলে কথা বলা যাবে না। বেরিয়ে নিজের ঘরে লিখতে বসল। টেবিলের র্যাকে তার প্রকাশিত “যে কথা বলা হয়নি”-র পাঁচ কপি বই। দ্বিতীয় সংস্করণ বের হচ্ছে। “নবজন্ম” লেখা শেষ কিন্তু অর্নি পড়ে বলেছে এখন ছাপার দরকার নেই। জীবন বড় বিচিত্র, পরের সিড়িতে পা রাখতে আগের সিড়ি থেকে পা তুলে নিতেই হবে,না-হলে একই জায়গায় থাকতে হবে স্থির।
পাহাড়ের পটভুমিতে নতুন উপন্যাস শুরু করেছে। অর্নি চা নিয়ে ঢুকল,টেবিলে রেখে দাঁড়িয়ে থাকে।
–তুমি বেরোবে না? অনি জিজ্ঞেস করল।
একটা চেয়ের টেনে হেসে বলল,বেরোলেই বুড়িটার সঙ্গে আড্ডা শুরু করবে।
–আম্মি আমাকে খুব ভালবাসে। মায়ের স্নেহ কোনো কিছু আলাদা করে বোঝা যায় না।
–তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব,সত্য বলবে?
–খামোখা মিথ্যে বলতে যাব কেন?
–আমি কি তোমাকে জবরদস্তি বিয়ে করেছি?
অনিমান বিস্মিত চোখ মেলে তাকায়। এতকাল পরে হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন বুঝতে পারেনা।
অর্নিতা বলল,এতকাল বিয়ে হয়েছে তুমি নিজে কোনোদিন নিজের ইচ্ছে প্রকাশ করেছো?
এই ব্যাপার এতক্ষনে বুঝতে পারে অর্নির রাগের কারণ। অনিমান বলল,তোমার কথা শুনিনি তুমি এরকম একটা দিনের কথা বলতে পারবে?
কি কথার কি উত্তর? অর্নিতা বলল,সকালে বেরোবার আগে একটু সময় পাই সন্ধ্যে বেলা বাসায় ফিরে দেখি তুমি নেই। ভাল লাগে একা একা?
–একা কেন,কান্তা থাকে তো।
–ওকে, থাকো তুমি আম্মীকে নিয়ে। অর্নিতা বেরিয়ে গেল।
এখানে পাহাড়ী রাস্তা অর্নিতা নিজে গাড়ী চালায় না। ড্রাইভার বাহাদুর আছে। বডি গার্ড মোহন সব সময়ের সঙ্গী। বেরোবার আগে অর্নিতা প্রতিদিন অনির মাথা ধরে চুমু খায়,আজ খেলোনা। এটা তার নিয়মিত অভ্যাস। অনিমান বুঝতে পারে অর্নির রাগ পড়েনি।
উশা কদিন ধরে বলছে চলো না কোথাও ঘুরে আসি।রাজু বুঝতে পারে শুভ যাচ্ছে শোনার পর থেকেই নতুন বায়না শুরু হয়েছে। ভাই-ভাবিকে রেখে বউ নিয়ে বেড়াতে যাবার কথা ভাবতে পারেনা রাজু। মুন্নী বলল,যাও না ভাই,কোনোদিন তো কোথাও যাওনি।
–তাহলে চলো সবাই মিলে।
–বাড়ী ফাকা রেখে?তোমার সঙ্গে যাবো কেন?গেলে আমি আর তোমার ভাই অন্য কেউ নয়।
ভাবির বলার ভঙ্গী শুনে খিল খিল করে হেসে উঠল উশা। রাজু বলল,কিন্তু শুভ যাচ্ছে এই সময়ে কি–।
–শুভ যাচ্ছে তো কি,সিলেট কি এইটুকু জায়গা?যাও অনির সঙ্গে দেখা হবে,কত ভালবাসতো তোমায়।
অনির কথা শুনে রাজু দুর্বল হয়। সেদিন ভাল করে কথা বলা হয়নি। বলল,দেখি টিকিটের কিছু করা যায় কিনা?
–তোমার বসকে বোলো,উনি তো শুনেছি পর্যটন দপ্তরে আছেন। মুন্নী মনে করিয়ে দিল।
রাজুর মনে হল অফিস থেকে বাড়িতে গেলে বিষয়টা আরো গুরুত্ব পাবে। যেই ভাবা সেই কাজ। রাজু ঠিকানা খুঁজে সাহেবের বাড়িতে হাজির হল। বাড়ীতেই ছিলেন,দেখেই চিনতে পারলেন। সব কথা বলতে উনি বললেন সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। হোটেলে উঠতে হবেনা পর্যটন দপ্তরের বাংলোয় ব্যবস্থা করে দেবেন। জিজ্ঞেস করলেন,আচ্ছা আপনার সেই বন্ধু চিত্রাকে পড়াতো উনি নাকি এখন লেখক?
–অনেকদিন ধরেই লেখে। এবারের সাপ্তাহিক সংখ্যায় ওর একটা উপন্যাস ছাপা হয়েছে।
অনির বিয়ে হয়ে গেছে বলতে গিয়েও বলল না।
শুভ রোজিকে নিয়ে চলে গেছে। বাশারকে আর চায়ের দোকানে দেখা যায়না, ডাক্তার সাহেবের চেম্বারেই বেশি সময় কাটে। লাইনের ধারে ঘর ভাড়া নিয়েছে। সুলতা সেখানেই থাকে,তিমির একদিন গেছিল বাড়ীর আর কেউ যোগাযোগ রাখেনা।
রাজু ফিরতে উশা খবরটা শুনে খুশী,টিকিটের ব্যবস্থা হয়ে গেছে,গোছগাছ শুরু করে দিয়েছে। মাঝে আর একটা রাত। ভাবির জন্য ভাল কিছু একটা কিনে আনবে, নয়নের জন্যও। মুন্নী বলল,শীতের পোশাক নিতে ভুলোনা।
অনিমান হয়তো আম্মিকে নিয়ে বেরিয়েছে। বাসায় ফিরতে ফিরতে অনুমান করে অর্নিতা। বউয়ের থেকে শাশুড়ীর প্রতি দরদ এমন কখনো শোনেনি।
বাংলোর সামনে জিপ থামতে একজন বেয়ারা এসে খবর দিল,ডিএম অফিস হতে জরুরী তলব। জিপ ঘুরিয়ে চক বাজারের দিকে ছুটে চলল। গুরুত্বপুর্ণ কিছু নিশ্চয়ই না হলে ফোনেই বলতো। কি হতে পারে অর্নিতা অনুমান করার চেষ্টা করে। ডিএম ভদ্রলোক খারাপ নয়,সব কিছু নিয়ম মেনে চলেন। বাংলা-হিন্দি মিশিয়ে কথা বলেন। বাংলা ভাল রপ্ত করতে পারেনি নি। নিজ দেশ ছোট বেলা ছেড়ে বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে চাকরি করছেন।
রাস্তার ধারে এক বৃদ্ধা মহিলা মাটিতে থেবড়ে বসে আছেন দেখে অর্নিতা বলল,বাহাদুর গাড়ি থামাও।
দেখে ভিখিরী মনে হচ্ছেনা। জিপ থেকে নেমে বৃদ্ধার কাছে এগিয়ে গিয়ে ঝুকে জিজ্ঞেস করল, আপনি এখানে?
বৃদ্ধা মুখ তুলে হেসে বললেন,দুপুরে হাঁটতে বেড়িয়ে ছিলাম। পায়ে ও হাঁটুকে ব্যাথা উঠলো কিছুটা তাই–।
–কোথায় যাবেন?
–চক বাজারের কাছে।
–আমার সাথে আসুন আপনাকে পৌঁছে দিব। আমিও ঐদিকে যাচ্ছি। অর্নিতা বৃদ্ধাকে পাঁজাকোলা করে জিপে নিজের পাশে বসিয়ে বলল,বাহাদুর চলো।
বাহাদুর এতক্ষন অবাক হয়ে মেম সাহেবের কাণ্ড দেখছিল। চাবি ঘুরিয়ে জিপ স্টার্ট করল।
–মা, আপনি একা থাকেন, আর কেউ নেই আপনার?
–সব আছে দু-ছেলে দু-বউ ওদের বাচ্চারা।
–ছেলেরা আপনাকে একা ছেড়ে দিল।
বৃদ্ধা হেসে বললেন,বুড়া মার জন্য তাদের সময় কোথায়? যে নিজের বউ ও বাচ্চাদের নিয়ে ব্যস্ত থাকে। থামো-থামো এখানেই আমাকে নামিয়ে দাও।
বাহাদুর গাড়ী থামাতে বৃদ্ধা মহিলা নিজেই নেমে গেলেন। পিছন ফিরে হেসে বললেন, একটু বিশ্রাম নিলে সব ঠিক হয়ে যায়।
ডিএম অফিস ছুটি হয়ে গেছে। দু-একজন অফিসার যাব-যাব করছেন। অর্নিতা সোজা ডিএমের ঘরে ঢূকে গেল। মোহনজীও সঙ্গে সঙ্গে গেল।
জিপ থেকে নেমে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দু-হাত প্রসারিত করে আড়মোড়া ভাঙ্গে। এই এসপিকে বাহাদুরের বেশ পছন্দ। ড্রাইভারের চাকরি করছে বছর দশেক হয়ে গেল। তার আগে ট্যাক্সি চালাতো। থোড়া খেয়ালি মগর বহুত হিম্মতদার অফিসার। একটা বিড়ী বের করে ধরিয়ে মৌজ করে টান দিল। বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে।গলায় মাফলার জড়িয়ে নিল। অফিস হতে মেমসাবকে বেরিয়ে আসতে দেখে বিড়ি ফেলে দিয়ে ড্রাইভারের আসনে গিয়ে বসল।
গোয়েন্দা দপ্তর হতে খবর এসেছে। কেন ফোনে বলা যায়নি এবার বুঝতে পারে। অর্নিতা জিপে উঠতে বাহাদুর স্টার্ট করল। এসপি বাংলোর দিকে ছুটে চলল গাড়ী।
বৃদ্ধা মহিলা এইখানে বসে ছিলেন অর্নিতার খেয়াল হয়। বউ নিয়ে থাকে ছেলেরা মাকে দেখার সময় কোথায় বৃদ্ধার কথাটা মনে পড়তে আম্মির কথা মনে পড়ল। অনি সব সময় আম্মিকে নিয়ে থাকে আপনা বিবির কথা খেয়াল থাকেনা। চোখের কোল ভিজে যায়। অনি ছেলেটা অন্যরকম।
বাংলোর কাছে জিপ থামতে অর্নিতা বলল,মোহন কাল গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে।
–জ্বি সাব।
অর্নিতা অফিসে না গিয়ে সোজা বাংলোয় চলে গেল। কান্তা দরজা খুলে দিল। ভিতরে ঢুকে জিজ্ঞেস করল,সাহেব ফিরেছে?
–আজ বেরোয়নি। বড় মেমসাহের সঙ্গে কথা বলছে।
অর্নিতা হেসে নিজের ঘরে ঢুকে পোশাক বদলায়। তার মনে কোনো বিরক্তি নেই আজ। আম্মিকে একবার ডাক্তার দেখানো দরকার,হাঁটুর ব্যথাটা কমছেনা কিছুতেই। জামাটা সবে খুলছে আচমকা পিছন হতে তাকে জড়িয়ে ধরে অনি। অর্নিতা মনে মনে হাসে,বলেছিল সন্ধ্যেবেলা ফিরে দেখা পায়না সেজন্য দেখা দিতে এসেছে। অর্নিতা হাত ছাড়াতে চেষ্টা করে বলল,কি হচ্ছে এখুনি কান্তা চা নিয়ে আসবে।
অনিমান জিজ্ঞেস করে,তুমি আমার উপর রাগ করেছো অর্নি?
অর্নিতার মনে পড়ে বেরোবার সময় আদর করেনি সেজন্য বলছে। একটা সেলোয়ার কামিজ পরে অনি জড়িয়ে হেসে বলল,রাগ করবো কেন?
–এখন একবার আদর করবো?
পাগলটাকে নিয়ে ভারী মুষ্কিল হল। অর্নিকে খুশি করতে মরীয়া হয়ে উঠেছে বলল,এখন না রাতে–।
–ঠিক আছে। এই জন্য বলিনা।
কান্তা চা নিয়ে ঢূকলো। চায়ের কাপ নামিয়ে জিজ্ঞেস করে,সাহেব আপনার চা এখানে দেবো?
–হ্যা এখানে দিয়ে যাও।
কান্তা চা আনতে চলে গেল। অর্নিতা লক্ষ্য করে বাবু গোজ হয়ে বসে আছে। অনির কি কোনদিন বয়স হবেনা?এত সুন্দর লেখে মানুষের মনের কথা চরিত্রের মধ্যে দিয়ে এমনভাবে প্রকাশ হয় যেন মনে হয় জীবন্ত। মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করল,এখনই আদর করবে?
–তোমার যখন আপত্তি–থাক।
–আচ্ছা চাটা খেয়ে নিই। তারপর তোমার সাধ মিটিও। তোমাকে সবসময় অন্যরকম লাগে। তাই তো তোমার উপর বেশিক্ষণ রাগ করতে পারি না। অনি, সবাই যদি তোমার মত ভাবতো তাহলে দুনিয়াটা বেহেশত হয়ে যেত। ভালোবাসা ভরা দৃষ্টিতে অনিকে দেখে অর্নি।
অনিমান কিছু না বলে মাথা নীচু করে বসে থাকে কিছুক্ষন,তারপর মুখ তুলে বলে,অর্নি আমার মত বলতে কি বুঝিয়েছো আমি জানিনা। তুমি বেহেশতের কথা বলেছো,ভুলে যাবে না জাহান্নামও আছে। দিন আছে যেমন রাত্রিও আছে। যদি জাহান্নাম না থাকতো তাহলে বেহেশতের কোন কদর থাকতো না। জীবনে দুঃখ আছে বলেই সুখের জন্য হাহাকার। আল্লাহ যাই বলেন সব দিক ভেবে এই বৈচিত্র্যময় দুনিয়া গড়েছেন। আমি সামান্য মানুষ কেউ আমার সঙ্গ পেলে আনন্দ পেলে শান্তি পেলে আমিও শান্তি পাই আমার ভাল লাগে।
মন দিয়ে শুনো অর্নি, তোমাকে যতদুর জানি,তোমার শান্তি অন্যের অশান্তির কারণ হোক তা নিশ্চয়ই কাম্য নয়। স্কুলে পড়েছিলাম, রাতে যদি সূর্যশোকে ঝরে অশ্রূধারা সূর্য নাহি ফেরে ব্যর্থ হয় তারা। একটা কথা আছে এগিয়ে চলো। চলার নাম জীবন। চলতে হবে সামনে লক্ষ্যাভিমুখে। পিছন ফিরে তাকালে গতি ব্যাহত হবে।
অর্নিতা মুগ্ধ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকেন অনির দিকে। তেমনিই আছে কেবল শারীরীক ভাষা বদলে গেছে,মনে হচ্ছে কোন অধ্যাপক ক্লাসে লেকচার করছেন। আগের মতোই অনি নিজের দার্শনিক চিন্তাকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে।
— জানো অর্নি, জন্মের পর থেকেই এই পৃথিবীর আলো বাতাস জল ফুল ফল আমাকে ঋণী করে চলেছে প্রতিনিয়ত। ভিতর থেকে কে যেন আমাকে মনে করিয়ে দেয়,এত নিলে বিনিময়ে কি রেখে যাচ্ছো পরবর্তী প্রজন্মের জন্য? আমি কাজ করার তাগিদ অনুভব করি। আত্মসুখে মগ্ন না থেকে যতটুকু সাধ্য আমার কাজ করে যাই। সেই আমার বেঁচে থাকার সার্থকতা কিম্বা সান্ত্বনাও বলতে পারো। তুমি সাথে আছো আমার জীবনে আর কিছু চাওয়ার নেই। তোমাকে ভালোবেসে আমার সব চাওয়া পূরণ হয়ে গেছে।
অনিমান ফিক করে হেসে উঠে অর্নিতার পাশে এসে বসল। অর্নিতার শরীর চনমন করে উঠল। আজ নিজে থেকে আদর করার ইচ্ছে জানিয়েছে। আরও কি করে দেখা যাক।
কান্তা চা নিয়ে আসতে অনিমান জিজ্ঞেস করল,আম্মি কি করছে?
–শুয়ে আছে।
কান্তা চলে যেতে অর্নিতা উঠে দরজা বন্ধ করে দিল।চা শেষ করে অনি অর্নিকে পাজাকোলা করে বিছানায় নিয়ে গেল। নিজে শুয়ে অনিকে বুকের উপর টেনে নিল। অর্নি ওর মাথাটা চেপে ধরে উষ্ণ ভালোবাসা ছুঁয়ে দিল অনির ঠোঁটে। বেশ অনুভব করে অনি তাকে প্রাণপন ভালবাসে। মিথ্যে ওকে বকাঝকা করেছে।
অনি কি ওর পেটে দেখছে অর্নি বুঝতে চেষ্টা করে।জিজ্ঞেস করল,কি দেখছো?
–অর্নি তুমি সুন্দর, তোমার মন সব–।
অর্নিতা ভেবেছিল সব আদর ভালোবাসা আদায় করবে। কিন্তু কি এক খুশীতে তার মন সব ভুলে যায়।উঠে বসে জিজ্ঞেস করল,সব মেয়ের থেকে আমি সুন্দর?
অনি বিরক্ত হয় কি বলতে চাইছে অর্নি বুঝতে অসুবিধে হয়না। অভিমানী গলায় বলে,এইজন্য তোমায় কিছু বলিনা।
খিল খিল হেসে উঠল অর্নি। হাসলে গালে টোল পড়ে বলল,গুসসা হয়ে গেল। জান একটু মজা করতে পারবো না?
–জানি তুমি বিশ্বাস করবে না তাও বলছি,জীবনে এই প্রথম একজনকে আমার ভালো লেগেছে।
অনি তাকে মিথ্যে বলবেনা জানে অর্নি।
অনি মুগ্ধ দৃষ্টিতে অর্নির দিকে তাকিয়ে থাকে।
–কি দেখছো?আগে কখনো দেখোনি। লজ্জা পেয়ে বলল, অর্নি।
–দেখছি বিধাতা কত যত্নে মেয়েদের গড়েছেন।
–পরে দেখবে এখন আমার আদর দাও।
অনিমান ভালোবাসার অসীম অনাবিল অমৃত সাগরে অর্নিকে নিয়ে পাড়ি দিলো। ভালোবাসার নতুন দিগন্তে দু’জনে একসাথে পাড়ি দিলো।
ঘুম ভাঙ্গতে এত দেরী হয়না,অর্নিতা উঠে কিছুক্ষণ বসে থাকে। মুখ ফিরিয়ে দেখল নিঃসাড়ে ঘুমোচ্ছে অনি। এই অনির মাঝে তার সব ভালোবাসা প্রেম ইচ্ছা সবকিছু যেন লুকিয়ে রয়েছে। তার নিশ্বাসের প্রত্যেকটি স্পন্দন যেন অনিকে ঘিরে আছে। অনির ভালোবাসা ছাড়া অর্নি কখনো বেঁচে থাকতে পারবে না। জীবনের প্রত্যেকটি সময়ের অনির হাত তার পাশে থাকলে সব ঝড় ঝাপটা পাড়ি দিতে কুণ্ঠাবোধ করবে না।
গোয়েন্দা দপ্তরের খবর মনে পড়তে বিছানা ছেড়ে নীচে নামল। ফুরফুরে মেজাজে দাতে ব্রাশ করতে করতে একবার আম্মির ঘরে উকি দিল। কান্তা ব্যস্ত রান্না ঘরে। মেমসাব বেরোবার পর তার বিশ্রাম।
কদিন আগে রাজু এসেছে শুভর সঙ্গে দেখা হয়নি।উশার বায়নায় একদিন ছোট ছোট পাহাড় চড়তে গেছিল কিন্তু সূর্যাস্ত দেখা হয়নি। অনেকক্ষন অপেক্ষা করেও শুভর দেখা পায়নি। ওরা অন্য কোথাও চলে যায়নি তো?
উশা বিরক্ত হয়ে বলল,তুমি কি সিলেটে-এ শুভকে দেখতে এসেছো?কত সুন্দর সুন্দর ঝর্ণা এমনকি পার্ক রয়েছর কিছুই দেখা হয়নি।
ওর সঙ্গে কথায় পারেনা রাজু। সব ঘুরে ঘুরে দেখতে চায়। কিন্তু এসপির বাংলোয় যাবার ব্যাপারে খুব উৎসাহ।
সূর্য পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে। স্থানীয় থানায় খবর দিয়েছে। বাহাদুরকে বাদ দিলে মোহন সহ তারা ছ’জন। হঠাৎ নজরে পড়ে চার-পাঁচজনের একটা ছোটো দল পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসছে। তাদের দেখতে পেয়ে উল্টোদিকে হাঁটতে থাকে। কনস্টেবলরা ধেয়ে যায় ওরাও গতি বাড়ায়। অর্নিতার অভিজ্ঞতা আছে ফাঁদে পড়লে এরা রিটালিয়েট করতে পারে।সেইমত সে অন্যদিক দিয়ে ওদের ঘিরে ফেলার চেষ্টা করে। যা ভেবেছিল তাই ওরা গুলি চালাতে শুরু করল। কিন্তু পিছন দিক থেকে গুলি আসবে ভাবতে পারেনি। একজনের গুলি লেগেছে,ধরা পড়ে চারজন।কতজন ছিল জানা যায়নি। কয়েককোটি টাকার চরস কিছু আগ্নেয়াস্ত্র পাওয়া গেল। একজন কনস্টেবলের পায়ে গুলি লেগেছে। ইতিমধ্যে ওসি দলবল সহ হাজির।
কনস্টেবল আর চোরাচালানকারীদের একজনকে হাসপাতালে পাঠাবার ব্যবস্থা করে থানার হাতে দায়িত্ব দিয়ে বাড়ির পথ ধরল অর্নিতা। ওসি সবীর সাহেব অবাক হয়ে অর্নিতাকে দেখে,এ কেমন নারী?দ্রুত জীপে উঠে জীপকে অনুসরন করেন। সবীর পুরানো লোক। এইসব চোরাচালানকারীদের পিছনে প্রভাবশালী লোকজন থাকে অভিজ্ঞতা থেকে জানে।
মোহন বলল,স্যার আকেলা ঐভাবে যাওয়া ঠিক হয়নাই।
অর্নিতা হেসে বলল, একা এসেছি একাই চলে যেতে হবে।
–এটা ঠিক বলেছেন।
পাহাড়ী পথে জীপ ছুটে চলেছে। অনির মুখটা মনে পড়ল। অর্নির জন্য তার বড় চিন্তা। আলো কমে এসেছে।
সন্ধ্যে হবার মুখে অনিমান লেখা থামিয়ে ভাবল আম্মী তো এলনা?রোজ হাঁটতে যায় আজ কি হল?
আম্মীর ঘরে উকি দিয়ে দেখল বিছানায় শুয়ে আছেন। অনি দেখতে পেলো আম্মি শুয়ে আছেন।
এক জায়গায় জীপ থামিয়ে অর্কিড হাউসে ঢূকল অর্নিতা। পছন্দ মত টব সমেত একটা গাছ কিনে পয়সা দিতে গিয়ে গোলমাল। কিছুতেই পয়সা নেবে না,অর্নিতা পয়সা ছাড়া গাছ নেবে না। মোহন বোঝাতে শেষে বাধ্য হয়ে পয়সা নিল। বাংলোর কাছে আসতে অর্নিতার মন খারাপ হয়। মোহন বলল,স্যার সাংবাদিক কথা বলতে চায়।
বিরক্ত হয়ে অর্নিতা বলল, সবীরকে কথা বলতে বলুন।
পিছন পিছন ওসি এসেছিল,খুশী হয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে রোমাঞ্চকর অভিযান সম্পর্কে আলোচনা করতে থাকে।
অর্নিতা ঘরে ঢুকে দেখল যা ভেবেছিল তাই,বাড়ী ফাকা। নিজের ঘরে গিয়ে চেঞ্জ করল।
কান্তাও নেই নাকি?দুবার কান্তা কান্তা বলতেই দরজায় দেখা গেল চা নিয়ে দাঁড়িয়ে কান্তা।
কান্তার হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে অর্নিতা জিজ্ঞেস করল,ওরা কখন বেরিয়েছে?
–আজ বাইর হয় নাই। বড় মেমসাবের তবিয়ত ভালো নেই।
আম্মীর শরীর খারাপ?জিজ্ঞেস করল,সাহেব একা বেরিয়েছে?
–সাহেব চিকিৎসা করছেন।
–চিকিৎসা ? অর্নিতার কপালে ভাজ জিজ্ঞেস করে, তুমি কি করছিলে?
–আমি দেখছিলাম।
অর্নিতা সোফা ছেড়ে উঠে দাড়ায়। অনি চিকিৎসা করছে?ও গড একী শুনছে?ঘর থেকে বেরিয়ে আম্মীর ঘরে গিয়ে চোখ কপালে ওঠার জোগাড়। অনি পিছন ফিরে বসে, কোলের উপর আম্মীর পা,পাঁচ আঙুলে মালাইচাকি ধরে নাড়ছে। চোখাচুখি হতে মুচকি হাসলেন আমেনা। অর্নিতা নিজের ঘরে ফিরে এল। কান্তাও ঘরে ছিল,অর্নিতা চায়ে চুমুক দেয়।
একটু পরে অনি ঢুকে জিজ্ঞেস করল,অর্নি কখন এলে?
–তোমার ডাক্তারী বিদ্যে জানা আছে জানতাম না তো?
–আম্মীর খুব কষ্ট হচ্ছিল তোমার হলে বুঝতে।
–এটা কি তোমার কাজ?
অনি থতমত খায় পরে বুঝতে পেরে বলল,তুমি দশ পৃষ্ঠা বলেছিলে দাড়াও দেখাচ্ছি।
অনিমান নিজের লেখার ঘরে গিয়ে কাগজপত্র গোছাতে থাকে। অর্নিতা দেখল আম্মী দরজায় এসে দাড়িয়েছে।
–কেমন আছো?
–এখন পায়ে কোনো ব্যাথা হচ্ছে না।
–তোমার বহুৎ লাভ হল?
–মানে?
–ছেলে পেলে ডাক্তারও সাথে পেলে?
আমেনন খিল খিল করে হেসে উঠল। হাসি থামতে বলল,তোর বাবা বলত আমেনা ছেলের জন্য আফশোস কোরোনা। অর্নি তোমার ছেলে সাথে মেয়েও। এখন সত্যিকার অর্থে আমার ছেলে আমি পেয়ে গেছি।
অর্নিতা চোখ তুলে আম্মীর দিকে তাকিয়ে থাকে,চোখে মুখে কি তৃপ্তি। আমেনা বললেন, যাই ঘরের মধ্যে একটূ হাঁটি। আমেনা বেগম চলে গেলেন।
হন্তদন্ত হয়ে অনি ঢুকলো,হাতে একরাশ কাগজ। অর্নিতার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, দেখো নিজের চোখে দেখো।
অর্নিতা কাগজগুলো নিয়ে চোখের সামনে মেলে ধরে।অনিমান বাধ্য ছাত্রের মত পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে। অর্নিতা পড়তে থাকে তিনয় নামে একটি মেয়ে কলেজ যাবার পথে কিছু বকাটে ছেলে বিরক্ত করত। বাড়ীতে দারিদ্র্য বাইরে উপদ্রব সব কিছু উপেক্ষা করে লেখাপড়া চালিয়ে যায়। মনে স্বপ্ন একদিন কোনো প্রশাসনিক পদে পৌঁছে—। অর্নি চোখ তুলে অনিকে দেখে জিজ্ঞেস করল,তিনয় কে?
–কে আবার একটা সাধারণ ঘরের মেয়ে।
অর্নিতা কাগজগুলো ফিরিয়ে দিয়ে বলল,রেখে এখানে এসো।
কান্তা এসে বলল,মেমসাব আপনাকে অফিসে ডাকছে।
–আচ্ছা, তুমি সাহেব আর আমাকে টিফিন দিয়ে যাও।
অর্রিতা কাপড় পাল্টে অফিসে ঢুকলো। সবীর সাহেব স্যালুট করে বলল,আমি আসি স্যার?
–হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে ফোন করে জানাবেন সেণ্ট্রি কেমন আছে?মোহন জী আপনি বিশ্রাম করুন।সকালে দেখা হবে।
অনি ঘরে ঢুকে দেখল টেবিলের উপর একটা গাছে সুন্দর ফুল ফুটেছে। নাক এগিয়ে নিয়ে সুন্দর গন্ধ পেল। অর্নিতা দরজায় এসে দাড়িয়েছে। অনি জিজ্ঞেস করে,কি ফুল সুন্দর গন্ধ?
–একটা নাম বলেছিল মনে নেই। অর্কিড–পরগাছা।ফুল সুন্দর কিন্তু অন্য গাছে ভর করে বেঁচে থাকে।
অনিমানের মুখটা করুণ হয়ে উঠল,চোখদুটো ছলছল করে। অর্নিতা অবাক হয়,কাছে এসে জড়িয়ে ধরে চুমুতে চুমুতে অস্থির করে তোলে। কাঁদছো কেন?
অনিমান হাসল চোখ মুছে বলল,আমিও একটা পরগাছা।
অর্নিতা বুঝতে পেরে জড়িয়ে ধরে বলল,ইউ আর মাই পার্ট–আমার অংশ। তুমি-আমি কি আলাদা?ফুল ফোটাবার জন্য আমি জনম জনম তোমাকে ধরে রাখবো জান।
কান্তা ঢুকতেই অনিকে ছেড়ে দিল। কান্তা দুটো প্লেট নামিয়ে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
শোবার সময় খাটে উঠতে গিয়ে অর্নিতা কোমর চেপে ল্যাংচাতে থাকে। কোমরে আবার কি হল অনিমান ভাবে। এতক্ষন তো ভালই ছিল জিজ্ঞেস করল,তোমার কোমরে কি হয়েছে অর্নি?
–কিছু না।
ধ্বন্দ্বে পড়ে যায় অনি। অর্নিতা উপুড় হয়ে শুয়ে থাকে।অনিমান কোমরে ম্যাসাজ করতে লাগল। বালিশে মুখ গুজে অর্নি মিটমিট করে হাসে। অনি জিজ্ঞেস করে, ভাল লাগছে?
–আরেকটু নীচে করো।
অনিমান বুঝতে পারে আম্মীকে ম্যাসাজ করেছে বলে কৌশল করে তাকে দিয়ে ম্যাসাজ করাচ্ছে। সত্যিই নারীর কত রূপ।
— মুখে বললেই হত,কৌশল করার দরকার ছিল না। আমার চিন্তা হয়না বুঝি? অনি বলল।
অর্নি পালটি খেয়ে হাসে। বলল,আমার শরম করেনা?
অনি নীচু হয়ে পেটে চাপ দিতে আতকে উঠে বলল অর্নি,পেটে চাপ দিও না।
অনি উপলব্ধি করে এক অঙ্গে দুই রূপ–পত্নীসত্তা এবং মাতৃসত্তা। পেটের দিকে তাকিয়ে তেমন কিছু মনে হল না। অনি খাট হেকে নীচে নেমে ম্যাসাজ করতে লাগলো। অর্নি লক্ষ্য করে বিবির প্রতি কত দরদ।
অফিস এসপির বাংলো লাগোয়া,পিছনের দরজা দিয়ে বাংলো যাবার পথ। সকাল বেলা চা টিফিন খেয়ে অর্নিতা পোশাক পরেই অফিসে আসে। খাতা পত্তর দেখে রাউণ্ডে বের হবে।
ফোন করে খবর নিল হাসপাতালে আহত কনস্টেবল কেমন আছে। রাউণ্ডে বেরিয়ে একবার দেখতে যাবে।টেবিলে চাপা দেওয়া স্লিপে চোখ বোলায়,রাজু চৌধুরী। চেয়ার থেকে উঠে বাইরে বেরিয়ে এল। রাজু উঠে দাড়ালো। উশা এই প্রথম অর্নিতাকে পুলিশী পোশাকে দেখল। দারুন লাগছে দেখতে। অর্নিতা জিজ্ঞেস করে,কতক্ষন?এটা অফিস,বাংলোয় যাবে তো।
–বেশিক্ষন না।
–এসো ভিতরে এসো। এই দরজা দিয়ে চলে যাও।অনিকে ডাকবে। আমি আসছি।
রাজু ভিতরে গিয়ে ইতস্তত করে,একজন মহিলা এসে জিজ্ঞেস করল,কিছু বলবেন?
রাজু বলল,অনি আছে?
পিছন থেকে ততক্ষনে আমেনা বেগম এসে কিছুক্ষন দেখে জিজ্ঞেস করেন, তুমি রাজু না?
রাজু চিনতে পারে বলল,হ্যা আণ্টি আমি।
আমেনা বেগম গলা চড়িয়ে ডাকলেন,ছেলে তোমার দোস্ত এসেছে।
অনি লিখছিল,আম্মীর গলা পেয়ে বেরিয়ে এসে বলল,আরে রাজু ভাই?এসো ভিতরে এসো।
উশা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। দু’জনকে ভিতরে নিয়ে বসালো। জিজ্ঞেস করল,অর্নি জানে তোমরা এসেছো?আম্মী আপনি রাজু ভাইকে চেনেন না?
–আণ্টী তো তোকে ডাকলেন। রাজু বলল।
–কান্তা একটু চা বানাও। কেমন আছেন ভাবি?
–ভাল আছি। আপনি স্থির হয়ে বসুন। উশা বলল।
ইতিমধ্যে অর্নিতা এসে পড়লো। একটা চেয়ারে বসে জিজ্ঞেস করল,কবে এসেছো?
–দিন পাঁচেক হয়ে গেল।
–কদিন আছো তো?ছোটা জিলা তোমাকে সব ঘুরে দেখাবো।
–ছুটি শেষ,কাল সন্ধ্যেবেলার ট্রেনে ফিরব।
–তাহলে আজ এখানে খাবে।
রাজু উশার দিকে তাকায়,উশা বলল,অবশ্যই এসপির আমন্ত্রন বলে কথা।
–তোমরা গল্প করো,এসপি একটা রাউণ্ড দিয়ে আসছে।
–অর্নিত্ তুমি কেমন আছো?
অনির দিকে তাকিয়ে বিষন্ন গলায় বলল,ভাল না,বিয়ে করে খুব অশান্তিতে আছি।
উশা আড়চোখে অনিকে দেখে,এমনভাব করে বসে আছে যেন এসবের সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই। রাজু উশা দুজনেই ধ্বন্দ্বে পড়ে যায়।
অনিকে ডেকে অন্য ঘরে নিয়ে গেল অর্নিতা। মাথা ধরে চুমু খেয়ে বলল,দেখো ওদের যত্নে যেন ত্রূটি না হয়,শেষে পাড়ায় গিয়ে বদনাম করবে। ফিরে এসে বলল,আসি রাজু,আসি ম্যাডাম।
রাজু শুভ শুভ্রতা বাশার সবার কথা একে একে বলে।চ্যারিটির সভা সেখানে ড. সাহেব কি বলছেন–সব কথা। সুরঞ্জনা আন্টির মৃত্যুর কথাও বলতে ভোলে না। অনিমান চুপ করে শুনে যায়। সুরঞ্জনা আণ্টী বেঁচে নেই। নিশ্চয়ই পলি মলিরা এসেছিল। বাশার এখন কম্পাউণ্ডারি করছে বাড়ি ছেড়ে বস্তিতে ভাড়া থাকে শুনে ব্যথিত হয়।
–আচ্ছা রাজু ভাই বাশার তো ঔষূধের নামটাম এখন শিখেছে। একটা ওষূধের দোকান করতে পারেনা?
–ওষুধের দোকান করতে কম করে লাখ খানেক টাকার ধাক্কা।
অনিমান নীরবে কি যেন ভাবে।
–বেড়াতে এসে এইসব কথা বলে দেওরের মন খারাপ করে দিলে। উশা বলল।
অনিমান উশার দিকে তাকিয়ে হাসল। কান্তা চা সঙ্গে স্যাণ্ড উইচ নিয়ে ঢুকে বলল, সাহেব আপনাকে শুধু চা দিলাম।
অনিমান উঠে দাঁড়িয়ে বলল,তোমরা চা খাও,আমি এখুনি আসছি।
অনি চলে যাবার পর উশা বলল,হোটেলে খেয়ে তৃপ্তি হত না। ভালই হল কি বলো?
বউয়ের কথা রাজুর কানে ঢোকেনা। সে অর্নিতার কথা ভাবছে। বিয়ে করে খুব অশান্তিতে আছি তাও আবার বলল অনির সামনে?
অনিমান এক কপি “যে কথা বলা হয়নি” নিয়ে ঢুকল।সোফায় বসে মলাট খুলে লিখল, যার সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগে সেই মুন্নী ভাবিকে–অনিমান। বইটা রাজু ভাইকে দিয়ে বলল,ভাবিকে দিও।
রাজুর হাত থেকে বইটা নিয়ে উশা কি লিখেছে দেখল,হেসে বলল,আর কাউকে দেবেন না?
–সবই যদি বিলি করে দিই তাহলে আমার চলবে কি করে?
–শোন অনি একটু এ্যাডজাস্ট করে চলতে শেখ।গম্ভীরভাবে বলল রাজু।
-মানে?তারপর হেসে বলল,তুমি অর্নির কথা বলছ?ঐ পাগলের কথা আমি ধরি না। ও হল তিস্তা নদীর মত খেয়ালী। তুমি তো জানো কেমন ডাকাবুকো? যতক্ষন বাইরে থাকে খুব দুশ্চিন্তা হয়,বাসায় না ফেরা অবধি শান্তি পাইনা।
–বউকে আপনি অর্নি বলেন?উশা জিজ্ঞেস করল।
–ওর ডাক নাম অর্নি ,ওর মা ওকে এইনামে ডাকে। রাজু ভাই তুমি ঠিকানাটা লিখে দিও। আমি পঞ্চাশ হাজার টাকা পাঠাবো,বাকীটা ম্যানেজ করে বাশার কে একটা দোকান করে দিও।
–সে না হয় ব্যাঙ্ক লোন-টোন করে ম্যানেজ করা যাবে। তুই পঞ্চাশ হাজার দিবি?
–কেন দেবোনা বল?দুরবস্থা কাকে বলে জীবন দিয়ে শিখেছি। অর্নি না থাকলে আমার যে কি অবস্থা হত।
উশার সব তালগোল পাকিয়ে যায়। এদের স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কটা কিছুতেই বুঝতে পারে না।
আত্মীয় স্বজন নয় একজন বন্ধুর জন্য এককথায় এতগুলো টাকা?উপলব্ধি করে অনি আর পাঁচজনের থেকে স্বতন্ত্র। মেয়ে মহলে কেন তাকে নিয়ে এত কৌতুহল?উশা জিজ্ঞেস করে,মিতার বিয়ে ঠিক হয়েছে জানো?
–তাই?কোথায় বিয়ে হচ্ছে?
–ঢাকা থাকে ছেলে।
অনিমান উদাস দৃষ্টি মেলে কি যেন ভাবে। উশা ভাবে মিতার বিয়ে শুনে হয়তো অনির মন খারাপ।
–জানো ভাবি মেয়েদের আমি কেন এত শ্রদ্ধা করি? মিতা ঢাকা চলে যাবে। বাবা-মাকে ছেড়ে নতুন পরিবেশ স্বামী শ্বাশুড়ি ননদ দেওর সব আলাদা আলাদা মেজাজ সবার সঙ্গে ঠিক মানিয়ে নেবে।শিক্ষার উদ্দেশ্য বইতে পড়েছি এ্যাডজাস্টমেণ্ট বাংলায় বলে সঙ্গতি সাধন। মেয়েরা এই শিক্ষা নিয়ে জন্মায়। অথচ সংসারে তারা কোনো দাম পেল না। সব চেয়ে বড়কথা সে জন্য তাদের কোন অভিযোগ বা অভিমান নেই,এটাই তাদের মহত্ব।
অনির চোখের পাতা ভিজে যায়,চোখ মুছে লাজুক হেসে বলল,রাজু ভাই জানে আমার কথায় কথায় চোখে জল এসে যায়।
অর্নিতা ঢুকে বলল,অনেক দেরী হয়ে গেল। কান্তা–।
আমেনা বেগম এসে বললেন,কান্তা স্নানে গেছে।
–রান্না কতদুর?
–হয়ে গেছে,আমিই করেছি। আমেনা বেগম বললেন।
ওরা স্নান করেই বেরিয়েছিল। অনি স্নানে গেল। কান্তা টেবিল গোচ্ছাছে। রাজু উশা টেবিলে বসে আমেনা বেগমের সঙ্গে কথা বলছে। স্বামীর কথা বলতে বলতে আমেনা বেগমের চোখে জল এসে গেল। অনি বাথরুম থেকে বের হল। রাজু জিজ্ঞেস করে,আণ্টি আপনার জামাই কেমন হল?
আমেনা বেগম উঠে অনিকে বুকে চেপে ধরে বলল,আমার ছেলে মানি আছে মানি।
অর্নিতা বিরক্ত হয়। আদর করে নাম দিয়েছে মানি।মানি আগে কি করতো জানে না তো। অনিমান চেয়ার টেনে বসে বলল,আম্মী ভুখ লেগেছে।
অর্নিতা ঘরে গিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করে। অর্নির আচরণ অনির নজর এড়ায় নি। আম্মীকে নিয়ে অর্নির মনোভাব রোগে না দাঁড়িয়ে যায়।
–মানিকে মতলব কি জানো? শিউজী আছে। আমেনা বেগম আপন উচ্ছ্বাসে বললেন।
কান্তা চারটে প্লেট দিয়ে গেল। অনি এসে অর্নির পাশে বসল। তরকারি মিশ্রিত ভাত দেখে উশা জিজ্ঞেস করে,এটা কি?
অনিমান বলল,আলু গোবি পোলাও। আম্মী বানিয়েছে খেয়ে দেখুন।
খেতে খেতে আরেকবার বাশারের কথা বলল,রাজু। অর্নিতা বিস্ময় প্রকাশ করে। বাশার এই আচরণ প্রত্যাশিত নয়। অনি বলল,অবস্থা পরিবেশ মানুষকে চালিত করে। অর্নিতা আড়চোখে দেখল অনিকে। রাজু বলল,দোকান করার জন্য অনি টাকা দেবে। অর্নিতা বলল,ও টাকা কোথায় পাবে?
রাজু অনির দিকে তাকালো। অনি মাথা নীচু করে খেয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি পদ খুব তৃপ্তি করে খেলো ওরা।কথা হল কাল সন্ধ্যেবেলা অর্নিতা স্টেশনে পৌঁছে দেবে। রাজু মৃদু আপত্তি করল।
পরের দিন সন্ধ্যেবেলা জিপে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে পৌঁছে দিল। মালপত্তর তুলে রাজু প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। নিজের জায়গায় বসে উশা জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে উদাস চোখে বাইরে তাকিয়ে,ইশারা করে ডাকতে অনিমান এগিয়ে গেল। অর্নিতা ব্যাপারটা আড়চোখে দেখে।
–তোমাদের প্রেমের বিয়ে? উশা জিজ্ঞেস করল।
অনিমান লাজুক হাসে। উশা বলল,কি হল হাসছো?
–আসলে প্রেম সম্পর্কে আমার ধারণা খুব পরিষ্কার নয়।
–তোমার মিসেস বলেছিল কৈশোরের প্রেম হয়েছিল বিয়ে করে নিলাম।
–ব্যাপারটা আমি যেভাবে দেখি আপনার ভাল লাগবে না।
–না লাগুক তুমি বলো।
–ধরুন জুতোর দোকানে জুতো কিনতে গেলেন।অনেকে আসছে জুতো দেখছে পায়ে গলিয়ে মাপসই হচ্ছে কিনা। একজোড়া জুতো আপনার পছন্দ হল দামও আপনার আয়ত্তে। পরে দেখলেন ভাল লাগছে।আপনি কিনে ফেললেন। জুতো জোড়া এখন আপনার অন্য কাউকে পায়ে গলাতে দেবেন না।নিয়মিত পয়সা দিয়ে পালিশ করাচ্ছেন যত্ন করছেন।একটু ময়লা লাগলেই মুছে ফেলছেন। যখন দোকানের শোকেসে ছিল তখন একরকম যখন আপনার অধিকারে এল তখন আরেকরকম। বিয়ের আগে রাজু ভাইকে চিনতেনও না বিয়ের পর রাজু ভাইকে নিয়ে চিন্তার শেষ নেই।
উশা খিল-খিল হেসে উঠল। প্রেম আর জুতো–তুমি বেশ বলো।
–তা নয় আমি বলতে চাইছি স্বামীত্বের কথা। অর্থাৎ অধিকার বোধ।
ট্রেনের হুইশল বাজতে রাজু ট্রেনে উঠে পড়ল। অর্নিতা পকেট থেকে একটা খাম বের করে রাজুর হাতে দিল। ট্রেন ছেড়ে দিল। প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ে। ট্রেন দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে গেল। অর্নিতা জিজ্ঞেস করল,অত কি কথা বলছিলে?
–কি করব ডাকলো–। অনিমান বলল।
–তোমাকে মেয়েরা এত ডাকে কেন?
–মেয়েলি সীমা থেকে তুমিও বের হতে পারো নি অর্নি।
একটু আগের অনির কথাগুলো নিয়ে মনে মনে নাড়াচাড়া করতে থাকে উশা । রাজু ট্রেনে উঠতে আড়চোখে দেখে ভাবলো,লোকটাকে সে ভালোবাসে না?জিজ্ঞেস করল,তোমার হাতে কি?
জায়গায় বসে রাজু খামটা খুলল,পঞ্চাশ হাজারের চেক তার নামে। কি একটা পড়ে যেতে উশা কুড়িয়ে রাজুর হাতে দিল। ছোট্ট একটা কাগজের চিরকুট। চিরকুট খুলে চোখের সামনে মেলে ধরল।” রাজু ,অনি যখন ছিল না ভাল ছিলাম কোনো চিন্তা ছিলনা। বিয়ের পর চিন্তা পয়দা হল,সব সময় ভয় হয় হারিয়ে ফেলবো নাতো ? আমার জীবনের নিশ্বাস ওর সাথে জড়িয়ে আছে। অনির ভালোবাসাই আমার বেঁচে থাকার শেষ সম্ভল। ভালো থেকো তোমরা তাই দোয়া করি। পাড়ার দিকে গেলে দেখা হবে। অর্নিতা চৌধুরী ।”
রাজুর অনেক পুরোনো কথা মনে পড়ে গেল। অনিমান বলতো,”শিক্ষা মানুষের ক্ষুধা বাড়িয়ে দেয়। যত জানা যায় মনে হয় তত মনে হয় কিছুই জানা হল না। জ্ঞানের অন্দরে যে উকি দিয়েছে সেই বুঝতে পারে তার জানা কত নগন্য।” কিন্তু আজ তাদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক আমাকে তেমনটা ভাবিয়ে তুলেছে। কিছুই জানা হলো না। তবে অনেক কিছুই তাদের হতে পেলাম।
————–🥰সমাপ্ত🌹—————-
[(বিঃদ্রঃ) সম্পূর্ণ গল্পটি কেমন হয়েছে সবার গঠনমূলক মতামত আশা করছি। যদি এরকম আরো গল্প চান তাহলে কমেন্ট করে জানান। এই গল্পটি ভালো লাগলে বেশি বেশি শেয়ার করুন।]