__________জীবনের গল্প__________
লেখক: ShoheL Rana
____________পর্ব:-১১___________
♥এগারো♥
বীথি আর মনি পাশাপাশি হেঁটে স্কুলে যাচ্ছে। তাদের সামনে সামনে হাঁটছে রাজ। কিছুটা সংশয় নিয়ে হাঁটছে সে। স্কুল ড্রেসের প্যান্টটা একটু শর্ট হয়ে গেছে তার শরীরে। বেশিদিন হয়নি ড্রেসটা সে সেলাই করেছে। দিনদিন এমন লম্বা হচ্ছে সে, গায়ের সব কাপড়ই ছোট হয়ে যাচ্ছে। বাবার কাছে আবারও ড্রেস চাইবে সেই সাহসটুকুও তার নেই। তবে মাকে বলেছে বাবার কানে যেন কথাটা পৌঁছায়।
হাঁটতে হাঁটতে প্যান্টটা আরেকটু নামিয়ে দিচ্ছিল রাজ। তখন পেছনে মনির উঁচু গলা শোনা গেল। কাউকে যেন গালি দিচ্ছে সে,
-কুত্তা মেয়েদের গায়ে হাত দিতে লজ্জা করে না?’
রাজ পেছনে তাকালো। দেখলো একটা ছেলে সাইকেল থামালো মনির সামনে। মনি তাকে জিজ্ঞেস করলো,
-গায়ে হাত দিলি কেন?’
ছেলেটা কোনো জবাব না দিয়ে শয়তানের মতো হেসে মনির গাল টেনে দিলো। মনি এবার ছেলেটাকে থাপ্পড় মারতে চাইলে ছেলেটা তার হাত ধরে হাতের উপর চুমু খায়। মনি নিজের হাত ছাড়াতে চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না। বীথিও চেষ্টা করে ওর হাত ছাড়াতে।
-এই ছাড়, ছাড় বলছি।’ গজরাতে থাকে বীথি। কিন্তু ছেলেটার গায়ে প্রচুর শক্তি। মনি এবার অসহায়ের মতো তাকায় রাজের দিকে। রাজ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে সব। মনির রাগ আরও বেড়ে গেল রাজকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। সে ভেবেছিল তার বিপদে কখনও চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকবে না রাজ। তার ধারণা মিথ্যে হতে দেখে চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো তার। কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে সে রাজের দিকে, তারপর হেঁচকা টান দিয়ে হাত মুক্ত করলো সে। কোনোদিকে না তাকিয়ে দৌড়ে চলে যেতে লাগলো বাসার দিকে। আর ছেলেটা সাইকেল চালিয়ে চলে গেল রাজকে পাশ কাটিয়ে। রাজ এবার তার ব্যাগ থেকে হান্টারটা বের করলো। হান্টারে একটা ছোট পাথর নিয়ে তাক করলো ছেলেটার দিকে। তারপর হান্টারে টান দিয়ে ছেড়ে দিলো ছেলেটার মাথাকে টার্গেট করে। একটুপর ছেলেটা আর্তনাদ করে উঠে পড়ে গেল সাইকেলসহ। রাজ হেঁটে গেল ওর পাশে। আরেকটা পাথর তুলে হান্টার তাক করলো এবার সরাসরি ওর চোখ লক্ষ করে। ছেলেটা মাথায় হাত চেপে ধরে বললো,
-মেরো না প্লিজ, মেরো না।’
-কোনো মেয়েকে আর ডিস্টার্ব করবি?’ গর্জে উঠলো রাজ।
-না…’ সাইকেল নিয়ে উঠে দাঁড়ালো ছেলেটা। মাথা থেকে রক্ত বের হচ্ছে তার। সাইকেলসহ পড়ায় হাতপায়ের অনেকাংশ কেটে গেছে। সাইকেলটা দুহাতে ধরে সে চলে যেতে লাগলো। রাজ হান্টারটা আবার ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলো। বীথি এসে হাত রাখলো তার কাঁধে। রাজ তাকাতেই মৃদু হেসে দিলো সে। এ যেন বিজয়ের হাসি।
রাতে সবকিছু বীথির কাছে শুনে মনির মনটাও ভালো হয়ে গেছে। সে ভেবেছিল রাজ আর কিছু করবে না তার জন্য, কিন্তু রাজ ছেলেটাকে ছাড়েনি শুনে খুশিতে লাফাতে লাফাতে মনি রাজের সাথে কথা বলতে গেল। রাজ পড়ার টেবিলে বসে মনোযোগ দিয়ে অঙ্ক করছিল তখন। মনি এসে খাটে বসলো। গালে হাত দিয়ে মুগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে তাকালো সে রাজের দিকে। রাজ তাকে দেখেও না দেখার ভান করছে। মনি বললো,
-শুনেছি আজ নাকি কেউ একজন আমার জন্য মারামারি করেছে?’
রাজ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। সে তার কাজে ব্যস্ত। মনি গাল থেকে হাত নিয়ে বিরক্ত প্রকাশ করলো রাজের আচরণে,
-শুনতে পায় না মনে হয়, কালা কোথাকার।’
এবারও রাজ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। মনি আরও বেশি বিরক্ত হলো। এবার সে রাজের হাত থেকে কলম কেড়ে নিয়ে বললো,
-আমি তোমার সাথে কথা বলছি।’
-বেহায়া মেয়ে, আমার সাথে কথা বলতে লজ্জা করে না?’ বলতে বলতে রাজ মনির হাত থেকে কলমটা নিতে চেষ্টা করলো। মনি তার কলম ধরা হাতটা পেছনে নিয়ে গিয়ে বললো,
-না, লজ্জা করে না।’ বলার সময় মনির ঠোঁটে লজ্জাভাব ফুটে উঠলো। রাজ এবার কলমটা নেওয়ার জন্য মনির উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। তখন মনি খাটের উপর চিৎ হয়ে পড়ে গেল, আর রাজ তার বুকের উপর। আচমকা এ ঘটনায় মনি স্তব্ধ হয়ে গেল। তার নিশ্বাস রাজের মুখে পড়ছে। আর রাজ তার হাত থেকে কলমটা নিতে চেষ্টা করছে। কোনো বাঁধা দেয়ার শক্তি নেই তার। হার্টবিট ক্রমাগত বাড়ছে। খেয়াল করলো সে এতে রাজের কিছুই হচ্ছে না, অথচ তার বুকটা বারবার উঠানামা করছে রাজের স্পর্শ পেয়ে। আর রাজ কলমটা নিয়েই উঠে বসলো তার জায়গায়। মনি আর উঠলো না। বেশ কিছুক্ষণ পড়ে থাকলো ওভাবে, যেন কোনো সুখের রাজ্যে হারিয়ে গেছে সে।
.
.
পরেরদিন রাজের মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখে তার প্রিয় সম্রাট মরে পড়ে আছে। বাসার বিড়ালটা তাকে মেরে ফেলেছে। মেজো মা শখ করে পুষেছে বিড়ালটা। অনেকবার ঐ বিড়াল সম্রাটকে আক্রমণ করে ব্যর্থ হয়েছিল, কিন্তু আজ আর ব্যর্থ হয়নি। একদম গলার উপর কামড় বসিয়েছে। সম্রাটের মৃতদেহটা সামনে নিয়ে অনেকক্ষণ মন খারাপ করে বসেছিল সে। বাড়ির সবারই মন খারাপ এ সম্রাটের পরিণতিতে। কী সুন্দর করে মানুষের মতো কথা বলতো সম্রাট। এখন আর কখনও সম্রাটের কণ্ঠে কোনো কথা শোনা যাবে না। রাজ কাঁদতে লাগলো সম্রাটের জন্য। আয়েশা বেগম ছেলেকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো,
-কাদিস না, আমার লক্ষ্মী বাপ। তোকে আরেকটা ময়না পাখি কিনে দেবো।’
রাজ আরও বেশি কান্না করতে করতে বললো,
-না, আমার সম্রাটকেই লাগবে।’
আয়েশা বেগম এবার বিড়ালের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করলেন,
-বিড়ালটার জন্য বাসায় কিছু রাখা যায় না, চালের উপর মাছ শুকাতে দিলে খেয়ে ফেলে, খাবারে মুখ দেয়। আজ আমার ছেলের প্রিয় পাখিটাকেও মেরে ফেললো।’
-ভাবি, সম্রাটকে যে বিড়ালটাই মেরেছে তা কেমনে বুঝলেন? কোনো ইঁদুরও তো সম্রাটকে কামড় দিতে পারে।’ প্রতিবাদ করে বললো ইয়াসমিন। এবার রাজ রেগে উঠে বললো,
-না, ঐ বিড়ালটাই মেরেছে আমার সম্রাটকে। আজ বিড়ালটাকেও মেরে ফেলবো হান্টার দিয়ে। ‘ বলেই রাগান্বিত হয়ে উঠে দাঁড়ালো রাজ। আর খুঁজতে লাগলো বিড়ালটাকে। ইয়াসমিন বললো,
-রাজ, থাম। বিড়ালটাকে কিছু করিস না। তোকে আমি দাম দিয়ে দেবো সম্রাটের।
-কত টাকা দিবা? ঐ টাকা দিয়ে কি আমি আমার সম্রাটকে ফিরে পাবো? আমি টাকা নেবো না। ঐ বিড়ালটাকেই মেরে ফেলবো আমি।’ রাজের রাগ আরও বেড়ে গেল।
-খুব খারাপ হবে কিন্তু রাজ। বিড়ালটাকে কিছু করবি না, বলে দিলাম।’
ইয়াসমিনের কথা কানে না নিয়ে রাজ বিড়ালটাকে আবার খুঁজতে লাগলো হান্টার নিয়ে। কিন্তু কোথাও খুঁজে না পেয়ে আবার সম্রাটের মৃতদেহের পাশে এসে হাঁটুগেড়ে বসলো। কিছুক্ষণ কেঁদে সে সম্রাটের মৃতদেহটা নিয়ে বাড়ির পেছনে সুন্দর করে কবর দিয়ে আসলো।
.
.
সারাদিন মন খারাপ ছিল রাজের। এখনও মন খারাপ করে বসে আছে সে খালের ধারে। দুপুরে কিছু না খেয়েই সে বের হয়ে এসেছিল ঘর থেকে। এখন বিকেল হয়ে গেছে। তাকে খুঁজতে খুঁজতে মনি, বীথি ওরাও এসে হাজির। তার পাশে বসলো ওরা। বসার পর বীথি বললো,
-তোকে ডাকছে মা। সারাদিন কিছু খাসনি, এখন খেতে ডাকছে।
-তোরা খা সব। আমার খিদে নেই বল গিয়ে…
-জিদ করিস না। চল এখন।’
রাজে উঠলো না। এবার মনি তার হাত ধরে উঠাতে চেষ্টা করলো। রাজ তাকে ধমক দিয়ে বললো,
-যা এখান থেকে।
-কেন যাবো? তুই কি একা ভালোবাসতি সম্রাটকে। আমরা বাসতাম না? এভাবে খাবার না খেয়ে নিজেকে কষ্ট দিচ্ছিস কেন? চল, এখন…’ আবারও রাজের হাত ধরে টানলো মনি। রাজ ওকে ধাক্কা দিলো। একটা ইটের কোণার সাথে লেগে মনির হাতের কনুই কেটে গেল। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হলো ওখান থেকে। বীথি ওকে তুলে বললো,
-দেখি, দেখি… ওমা রক্ত বের হচ্ছে।’ তারপর রাজের দিকে তাকিয়ে রাগ দেখিয়ে বললো,
-তুই থাক, না খেয়েই থাক। চল মনি…’ বলেই হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে চাইলো সে মনিকে। মনি ওকে থামিয়ে অন্য হাত দিয়ে কনুইয়ের রক্ত চেপে ধরে রাজকে বললো,
-তোর জন্য এখানে নিয়ে আসবো খাবার?’
রাজ একবার মনির দিকে তাকিয়ে চোখ ঘুরিয়ে ফেলে। কোনো জবাব দেয় না। মনি মাথা নিচু করে বীথির সাথে চলে গেলো।
.
.
সন্ধ্যার দিকে বড় বউ আর মেজো বউয়ের মধ্যে ঝগড়া লাগে। ঝগড়ার কারণ, বড় বউ মেজ বউয়ের বিড়ালটার দিকে তক্তা ছুড়ে মারে। আর তক্তাটা বিড়ালের পায়ে গিয়ে লাগে। এই নিয়ে ঝগড়া শুরু বাড়ির দুই বউয়ের মধ্যে। পদ্মাবতী ওদের ঝগড়া থামাতে চেষ্টা করেন। কিন্তু থামাতে পারেন না। ঝগড়া আরও বেড়ে যায়। এক পর্যায়ে ঝগড়া তুই তোকারিতে চলে যায়। মেজো বউ গলা উঁচু করে বলে,
-তুই কোন অধিকারে আমার বিড়ালের উপর তক্তা ছুড়ে মারিস?’
এবার বড় বউ আরও গলার আওয়াজ বাড়িয়ে বলে,
-আমার ছেলের প্রিয় সম্রাটকে মেরেছে তোর বিড়াল। ওটাকে না মেরে কি আদর করবো। সম্রাটের শোকে সারাদিন আমার ছেলেটা খেতেও আসেনি।
-তোরা কেউ দেখিসনি যে আমার বিড়াল সম্রাটকে মেরেছে। না দেখে কেউ লাফাবি না।
-তুই বেশি লাফাচ্ছিস। লাফানো থামা। তোর বিড়ালকে আবার হাতের কাছে পেলে দেখবি কী করি।’
-করে দেখিস, তারপর আমিও কী করি দেখবি…
-যা, যা, মুখে বড় বড় কথা বলিস। যা পারিস করিস।’
ঝগড়া আরও বাড়তে থাকে ওদের। আশরাফ সাহেব এসেও কয়েকবার থামাতে চেষ্টা করেন ওদের। কিন্তু পারেন না। শেষে আমান সাহেব এসে নিজের স্ত্রীকে ঘরের ভেতর নিয়ে গেলো। তারপর ওদের ঝগড়া থামলো। কিন্তু আয়েশা বেগমের কান্নার আওয়াজ শোনা গেল ভেতর থেকে। সামান্য কারণে ঝগড়া করায় তার গায়ে হাত তুলেছে আমান। এজন্য সারারাত কাঁদতে থাকে আয়েশা বেগম। রাতে স্বামীর পাশে সুদ্ধ আর শুতে আসলো না সে।
.
.
(চলবে….)